ঘুনপোকা,পর্ব_১

0
1115

ঘুনপোকা,পর্ব_১
মিম

টেবিলের উপর থাকা ফাইলগুলো সাইন করে সামনে এগিয়ে দিলো সৈকত৷ ফাইল হাতে নিয়ে ইমরান জিজ্ঞেস করলো,
– বাসায় যাবেন না ভাইয়া? আসুন একসাথে বের হই।
– নাহ্, তুমি যাও৷ আমি আরো পরে যাবো।
– সাড়ে নয়টা বাজে৷ কাজ তো নেই হাতে। শুধু শুধু বসে থেকে কি করবেন?
– বাসায় গিয়েও তো তেমন কাজটাজ নেই৷ থাকি কিছুক্ষন….
– ভাবী রাগ করবে না?
মুচকি হাসলো সৈকত৷ ইমরানের প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বললো না সে। সৈকতের হাসিটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে ইমরান। মানুষটার স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুললেই লোকটা তেমন কিছু বলতে চায় না কেনো বুঝে পায় না সে। কখনো ইচ্ছে হলে একটু আধটু উত্তর দেয় নয়তো এভাবে মুচকি হাসি হেসে কথার প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। হাসির মাঝে একরাশ বিষন্নতা লুকিয়ে থাকে। এত বিষন্ন কেন এই হাসিটা? এই অফিসে জয়েন করেছে ছয়মাস হলো। শুরু থেকেই সৈকতের সাথে তার বেশ সখ্যতা। আজ পর্যন্ত একবারও লোকটাকে স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলতে শোনা যায়নি। স্ত্রীর সাথে কি লোকটার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে নাকি স্ত্রী মারা গেছে? মাঝে মধ্যে খুব কৌতুহল জাগে ইমরানের। ইচ্ছে হয় একটু জোর খাটিয়ে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে। অজানা কারণবশত কথাগুলো আর জিজ্ঞেস করা হয় না৷ ইমরানের পকেটে ভাইব্রেট হতে থাকা মোবাইলটা সৈকত সম্পর্কিত ভাবনায় ছেঁদ ঘটালো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রিনে তাকাতেই বিরক্ততে চেহারা কুঁচকে এলো তার। ইমরানের কুঁচকে যাওয়া চেহারার ভাঁজগুলো দেখছে সৈকত। মানুষটা খুব বেশিই বিরক্ত হচ্ছে৷ ইমরান কলটা কেটে তাকে কি যেনো বলতে যাচ্ছিলো ঠিক সে মুহূর্তে আবারও কল এলো৷ চেহারায় নতুন করে আরো কয়েকটা ভাঁজ যুক্ত হলো৷ কলটা আবারও কেঁটে সুইচ অফ করে দিলো ইমরান। চেহারা স্বাভাবিক করে সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি একা বসে থাকবেন অফিসে?
– হুম। প্রায়ই তো থাকি।
– ওহ্। তাহলে আমি চলে যাই?
– একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?
– জ্বি, অবশ্যই।
– যার কল পেয়ে চেহারা কুঁচকে গিয়েছে সে তোমার গার্লফ্রেন্ড না?
– হুম।
– দুদিন যাবৎ ঝগড়া চলছে তাই না?

বেশ চমকে যাওয়ার ভঙ্গিতে ইমরান জানতে চাইলো,
– আপনি কিভাবে জানেন?
– তুমি দিনের বেশিরভাগ সময় আমার সাথেই কাটাও। আমার সামনেই কল রিসিভ করে মাঝে মধ্যে কথাও বলো। কথার ধরন শুনলেই বুঝি কার সাথে কথা বলছো আর কি নিয়ে কথা বলছো।
মাথা নিচু করে বসে আছে ইমরান। কিছু মুহূর্ত চুপ থাকার পর সে বললো,
– আসলে ভাইয়া ওর আচরণ খুব অদ্ভুত। রিলেশনের শুরুর দিকে বুঝিনি। মাস দুয়েক যাওয়ার পর থেকে ও ধীরে ধীরে আমার সাথে ফ্রি হতে শুরু করলো। তখন থেকে একটু আধটু খেয়াল করতাম। মাস ছয়েক যাওয়ার পর ও যখন পুরোপুরি আমার সাথে মনখুলে মিশতে শুরু করলো তখন বুঝলাম এই মেয়ে আমার জন্য না৷ সম্পর্কটা বোঝা মনে হতে লাগলো। ওকে জানালাম ব্রেকআপ করবো৷ ও করবে না৷ যতবার ব্রেকআপ করতে চেয়েছি ততবারই কান্নাকাটি করে নাজেহাল অবস্থা! আমার বাসার সামনে চলে আসে, অফিসের সামনে চলে আসে৷ আমার বন্ধুদের কল করে বিরক্ত করতে থাকে৷ বাধ্য হয়ে এই বোঝা আমি একটাবছর ধরে টেনে যাচ্ছি। আজ পর্যন্ত কত রুড বিহেভ করলাম ওর সাথে অথচ কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না৷ আমি টায়ার্ড। আমি ওর কাছ থেকে মুক্তি চাই।
– সমস্যা হচ্ছে কি নিয়ে?
– আমার সবকিছুতেই খবরদারি করতে চায়।
– যেমন?
– খেয়েছি কিনা? কখন খেয়েছি? কেন দেরী করে খেলাম? শুধু মাংস দিয়েই কেন ভাত খাই? সব্জি, ছোটমাছ কেন খাই না? সিরিয়াসলি ভাইয়া? সবজি, ছোটমাছ এগুলো কি কথা বলার কোনো টপিক? আরো আছে। রাতে দেরী করে কেন ঘুমাচ্ছি? আমি একটু কাঁশি দিলেও সমস্যা। এটা নিয়েও শুরু হয় ঘ্যানঘ্যান। কেন আমি ডক্টর দেখাচ্ছি না। আধাঘন্টা পরপর কল করতে থাকে কি করছি সেই খবর নেয়ার জন্য। খুবজোর এক মিনিট কথা বলে কলটা কেটে দেয়। বারবার ফোন করে এই এক খবর নেয়ার মানে কি?
– ও তোমার যত্ন নেয়। তোমার খুশি হওয়া উচিত। তুমি এটাকে খবরদারী বলছো কেন?
– প্রয়োজনের চেয়ে বেশি যত্ন করা হলে সেটাতে আর ভালোলাগার ব্যাপার থাকেনা। তখন মাথাব্যথা শুরু হয়৷ এছাড়াও আরো কিছু সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা?
– একটু ছ্যাচড়া স্বভাবের।
– এভাবে বলছো কেন?
– মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট তো থাকা উচিত তাই না? ওর এসব নেই। যে যা খুশি বলে চলে যায় কখনোই পাত্তা দেয় না। ও প্রচুর কথা বলে। একবার বলতে শুরু করলে আর থামে না৷ ওকে নিয়ে বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে এক বন্ধুর বউয়ের সাথে বকবক করেই যাচ্ছে। শেষমেশ ও আর সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেলেছে, তুমি এত কথা কিভাবে বলো!

লজ্জায় আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম৷ অথচ আমার প্রেমিকা দাঁতগুলো বের করে নির্লজ্জের মত হেসে বলছিলো আমি এমনই। এই বলে আবারও কথা জুড়ে দিলো। আমি বন্ধুর ওয়াইফের মুখটা বারবার দেখছিলাম। ও খুব বিরক্তভরা চেহারা নিয়ে চুপচাপ শুনে গিয়েছে আমার প্রেমিকার কথাগুলো। আমি ওকে কয়েকবার ডেকেছিও। ও সেখান থেকে উঠে আসবে না।
– কি কথা বলছিলো ও?
– এইতো আমাদের বিয়ে নিয়ে৷ বিয়েতে কি করবো না করবো সেসব। তারপর ওর ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে বললো। ও যাকে পায় তার সাথে এই দুটো বিষয় নিয়ে গল্প করতেই থাকে।
– হয়তো ওর প্রিয় বিষয় এই দুটো, তাই বলতেই থাকে।
– হুম। খুব প্রিয়।
– কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানতে চায় না তো তাই না?
– উহুম। সে অভ্যাস নেই।
– সবাই সমান হয় না ইমরান। একেকজনের অভ্যাস একেকরকম। তুমি আমি আমরা সবাই যদি একই স্বভাবের হতাম তাহলে হয়তো এই পৃথিবীটা আরো আগেই ধ্বংস হয়ে যেত আর নয়তো অসম্ভব সুন্দর হতো।
– হ্যাঁ, সমান হয় না। কিন্তু এতটাও বেমানান তো মেনে নেয়া যায় না।
– আজ যদি বাসায় না যাও তাহলে কি সমস্যা হবে?
– নাহ্। কিন্তু বাসায় যাবো না কেন?
– আমার সাথে অফিসে বসে থাকো।
– কোনো প্রয়োজন ভাইয়া?
– হ্যাঁ প্রয়োজন। তোমাকে আজকে গল্প শোনাবো।
– কিসের গল্প?
– আমার রুপুর গল্প।
– রুপু কে?
– যাকে নিয়ে তোমার খুব কৌতুহল।
– আপনার ওয়াইফ?
– হ্যাঁ, আমার ওয়াইফ।
– আমার খুব কৌতুহল সেটা আপনাকে কে বলল?
– বলতে হবে কেন? আমিই বুঝি।
আগে বলো ডিনারে কি খাবে? খাবার অর্ডার করে দেই। তারপর বলছি।

খাবার অর্ডার করে ইমরানের মুখোমুখি এসে বসলো সৈকত। বললো

-আমার ওয়াইফের ডাকনাম রুপন্তি। সবাই আদর করে রুপু ডাকে। আমিও ডাকি। রুপু আমার সেকেন্ড ওয়াইফ।
খানিকটা চমকে উঠলো ইমরান। সামান্য ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার এর আগেও বিয়ে হয়েছিলো?
– হ্যাঁ। ডিভোর্স হয়েছিলো নবনীর সাথে৷ নবনী আমার ফার্স্ট ওয়াইফ। প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম আমরা। ওর সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুবই ভালো ছিলো। কিছু না বলতেই একজন আরেকজনের মুখ দেখে বলে দিতে পারতাম আমরা কি চাচ্ছি। একবছরের প্রেম ছিলো। আর আড়াই বছরের সংসার। এই লম্বা সময়ে ওর সাথে আমার কখনোই ঝগড়া হয়নি। স্মুদলি এগোচ্ছিলো আমাদের রিলেশন। আমরা দুজনই একই স্বভাবের ছিলাম। ডিসিপ্লিনড লাইফ মেইনটেইন করতাম। কথা কম বলা পছন্দ করতাম। আমাদের ফুড হ্যাবিট, ফেভারিট কালার, ঘুরাঘুরির নেশা, পছন্দ অপছন্দ সবকিছুই ম্যাচ হতো। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা কেউই সংসার করার মত মানুষ ছিলাম। নবনী একদমই সাংসারিক মেয়ে না৷ আমিও না। কর্পোরেট সেক্টরে একটা বড় পজিশন পাওয়া ছিলো ওর এইম ইন লাইফ। আমারও একই। রাতদিন কাজে লেগে থাকতাম। ওর সাথে আমার পার্টনারশিপটা অসম্ভব জমতো৷ কেও কাউকে কোনো ব্যাপারে বাঁধা দিতাম না। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ঘুরাফেরা করতাম। যেমন ধরো নবনী অসুস্থ। হঠাৎ বন্ধুরা ফোন দিয়ে বললো চল বাহিরে যাই। আমি চলে যেতাম। এই নিয়ে নবনী কখনোই অভিযোগ করতো না৷ কিংবা আমার কখনো বাসায় ফিরতে দেরী হচ্ছে তখন নবনী নিজের মত খেয়ে নিতো৷ এ নিয়ে আমার কখনো অভিযোগ ছিলো না৷ কিংবা আমার সংসারের দায়িত্বের ব্যাপারটাই বলি, ওর ওসবের প্রতি অতটা ইন্টারেস্ট ছিলো না৷ সাংসারিক দায়িত্বগুলো থেকে ও গা বাঁচিয়েই থাকতো। আমি এসব নিয়ে কখনোই ওকে কিছু বলতাম না। ওর সাথে বিয়ের পরও আমার মা ই সব দেখতো। ও আর আমি এক কথায় বলতে গেলে ঐ বাসার মেহমান ছিলাম। সকালে মা টেবিলে নাস্তা দিতো৷ আমরা দুজনে খেয়ে বের হয়ে যেতাম। রাত আটটা নয়টায় বাসায় ফিরতাম। ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসে যেতাম। মা গরম খাবার বেড়ে দিতো। আমরা খেতাম৷ মাঝেমধ্যে ওদের সাথে বসে টিভি দেখতাম, গল্প করতাম। আবার কখনো নবনী আর আমি নিজেদের ঘরে বসে কথা বলতাম, মুভি দেখতাম অথবা অফিসের কাজগুলো সেড়ে নিতাম।
-আপনার মা বাবা কখনো অভিযোগ করতো না?
– নাহ্। কি অভিযোগ করবে? আমিই তো নবনীকে কিছু বলতাম না৷ বাবা মা ভালো করেই জানতো আমাকে এসব বলে কোনো লাভ হবে না৷ তবে মনে মনে উনারা বেশ বিরক্ত ছিলো আমাদের দুজনের প্রতিই৷ আমি উনাদের চেহারার ধরন দেখেই বুঝতাম। বুঝেও না বুঝার ভান করতাম।
– কেন?
– আমার কাছে মনে হতো নবনী সংসারের দায়িত্ব পালন করতে চায় না, অহেতুক ওর কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার দরকারটা কি?
– কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি ভাইয়া?
– অবশ্যই।
– আপনার মায়ের কিন্তু এই বয়সে দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার কথা ছিলো না। উনার কাঁধেও কিন্তু দায়িত্ব চাপিয়েই দেয়া হয়েছে।
– হ্যাঁ, তা তো দিয়েছিই। এক প্রকার অবিচার করেছি মায়ের সাথে আমি। শুধু মায়ের সাথে না, বাবা আর ছোটবোনের সাথেও। আমার ছোটবোন সাবিহা। ওর সাথে নবনীর নামমাত্র সম্পর্ক ছিলো৷ আমি ওর একটাই ভাই৷ যেহেতু আর কোনো বড় ভাইবোন নেই সে হিসেবে আদর আহ্লাদ কিন্তু আমার আর নবনীর কাছেই সে পাওনা। অথচ তেমন কিছুই আমি ওর জন্য করতাম না৷ কিংবা নবনীও না৷ বার্থডে, দুই ঈদ আর পহেলা বৈশাখে ড্রেস কিনে দেয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব নবনী আর আমি পালন করেছি বলে মনে পড়ে না। আমরা দুজনই নিজের মত সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। সাবিহা তিন চারদিন এসেছিলো আমাদের সাথে বসে একটু গল্প করতে। আমি ততটা পাত্তা দেইনি। আর নবনী তো ভীষণ বিরক্ত হতো৷ সাবিহা বুঝতে পেরেছিলো নবনীর বিরক্ত হওয়া কিংবা আমার ওকে এড়িয়ে যাওয়া। এরপর আর কখনো আসেনি কথা বলতে।
– আপনারা দুজনই একইরকম। তাহলে ডিভোর্স কেন হলো?
– বলছি। আমাদের দুজনের মাঝে আরো দুটো ব্যাপারে খুব মিল ছিলো।
– কি কি?
– আমাদের দুজনের খুব বেশি ইগো প্রবলেম ছিলো আর আমরা কেউই কখনো ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে পারতাম না। নবনী কিংবা আমি আমরা কেউই খুব সহজে ভালোবাসি কথাটা বলতাম না। কিংবা আরো কতভাবেই তো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা যায়। সেসবের মধ্যেও আমরা ছিলাম না৷ এগুলো আমাদের দুজনের কাছেই নেহাৎ বিরক্তিকর বিষয় ছাড়া আর কখনোই কিছু মনে হয়নি। তারপর একদিন হঠাৎ নবনী কল করে বললো ওর প্রমোশন হয়েছে। সেলারী বেড়েছে আরো বারো হাজার টাকা। নবনী এখন আমার চেয়ে ভালো পোস্টে জব করছে। আমার চেয়ে বেশি স্যালারী। আমার খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছিলাম না৷ অথচ এই আমিই মনে প্রাণে চাইতাম নবনীর স্বপ্ন পূরণ হোক। ওর প্রমোশনের ব্যাপারটা কেন যেনো আমার মানতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমার ওয়াইফ আমার চেয়ে ভালো পজিশনে আছে এটা মনে পড়তেই আমি অজানা এক অশান্তিতে ডুবে যেতাম। ওকে আমি কম্পিটিটর ভাবতে লাগলাম। ওর সাথে আমার সময় কাটাতে ভালো লাগতো না। ওর সাথে কথা বলতে গেলেই আমার মনে হতো আমার ওয়াইফ আমার চেয়ে বেটার পজিশন হোল্ডার। নিজেকে ছোট মনে হতো। মনে হতো ওর সাথে আমাকে মানাচ্ছে না। মনে হতো ও আমাকে আগের মত পাত্তা দিচ্ছে না। মনে হতো আগের সেই আন্তরিকতা আমি পাচ্ছি না৷ আমাদের দূরত্ব একটু একটু বাড়তে থাকলো।
– সত্যিই কি উনি আপনাকে পাত্তা দিচ্ছিলো না?
– উহুম। ব্যাপারটা এমন না। ও স্বাভাবিকই ছিলো। বরং অস্বাভাবিক আমি হয়ে গিয়েছিলাম। ও আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না সেটা ছিলো আমার ভুল ধারণা। এভাবে ওর সাথে ছয় সাতমাস কাটানোর পর শুরু হলো নবনীর অভিযোগ। প্রথম! সেবারই প্রথম নবনী আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলো। নবনী ওর প্রতি আমার মনোযোগ চাচ্ছিলো। ভালোবাসা চাচ্ছিলো৷ যত্ন চাচ্ছিলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন রাতে সেই নবনী অভিযোগ করছিলো যার কাছে যত্ন, ভালোবাসা এই ব্যাপারগুলো ন্যাকামি মনে হতো। আমি অবাক হচ্ছিলাম নবনীর আচরণে। একটানা দশ মিনিট ধরে মুখস্থ পড়ার মত অভিযোগগুলো ও বলে ফেললো । তারপর ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে লাগেজটা নিয়ে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। সেই যে নবনী চলে গেলো আর ফিরে আসেনি। এরপরই আমাদের ডিভোর্স।
– আসলো না কেন?
– কারণ আমি ওকে আনতে যাইনি।
– কেন?
– ঐযে বললাম ইগো প্রবলেম। যে চলে গেছে তাকে কেন ফিরিয়ে আনবো? কাওকে রিকুয়েষ্ট করবো কিংবা সরি বলবো ওসবের মধ্যে আমি নেই৷ নবনীকে সেধে সেধে সরি বলে বাসায় ফিরিয়ে আনা মানে নিজে মাথা নত করা৷ কোনোভাবেই মাথানত করতে রাজি না আমি। নবনীও আমি সরি না বললে বাসায় ফিরবে না৷ আমার মা বাবা বহুবার ওর বাসায় গিয়ে ওকে বুঝিয়েছে৷ আমাকেও বুঝিয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই মাথা নত করতে রাজি না৷ মাসখানেক পর জানতে পারলাম নবনীর কারো সাথে প্রেম চলছে। খবরটা জানার পর আমি ওকে কোনোকিছু জানাইনি। কিছুই জানি না ভান ধরে বসে ছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম ও নিজ থেকে আমাকে এসে বলুক।
– আপনার ওয়াইফের কারো সাথে এক্সট্রা ম্যারিটিয়াল এ্যাফেয়ার চলছে এটা জেনেও চুপ করে রইলেন! রাগ কিংবা কষ্ট হয়নি আপনার?
– একদম না। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম পুরো ব্যাপারটা।
– কিভাবে সম্ভব!
– আমার কাছে তখন মনে হয়েছিলো নবনীকে আমি বিয়ে করেছি। ওকে দাসী তো আর বানাইনি। ওকে বেঁধে রাখার অধিকার আমার নেই। হয়তো আমি ওকে ভালো রাখতে পারছিলাম না তাই ও অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রতিটা মানুষের ভালো থাকার অধিকার আছে। নবনীরও আছে। ও যদি অন্য কারো সাথে নিজেকে জড়িয়ে সুখে থাকে তো থাকুক না! সমস্যা কোথায়!

অবাক চোখে নিশ্চুপ সৈকতের দিকে তাকিয়ে রইলো ইমরান। বোকা বোকা চেহারার ইমরানকে দেখে সৈকত হেসে উঠলো। বললো,
– আমি এই যুগের শিক্ষিত ছেলে। আদিকালের চিন্তা ধারা নিয়ে ঘুরাফেরা করার মানুষ আমি না।
– তাই বলে ওয়াইফের পরকীয়া!
– হ্যাঁ। ঐ যে বললাম না? আমি এই যুগের ছেলে।
– তারপর?
– আরো একমাস গেলো। ও একদিন কল করলো। দীর্ঘ ২৫ মিনিটের আলাপ হলো সেদিন৷ ওর বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে জানালো। সেইসাথে জানালো ডিভোর্সের কথা৷ আর সাথে কিছু অভিযোগ করলো। এই যেমন ধরো, আমাদের মাঝে ভালোবাসা নেই। যত্ন নেই। এভাবে বিবাহিত জীবন কাটানো যায় না৷ আমার সাথে থাকলে একটা সুন্দর বিবাহিত জীবন সে পাবে না। আমি প্রতিউত্তরে কিছুই বলিনি। শুধু শুনে গিয়েছি। ওর অভিযোগগুলো আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমি সংসার করার উপযুক্ত না, আমার সাথে কেও টিকতে পারবে না এসব অভিযোগ আমি মেনে নিতে পারিনি। পুরো এক সপ্তাহ আমার ঘুম হয়নি ওর অভিযোগগুলো শুনে। আমি আবার বিয়ে করবো এবং সংসার করে ওকে দেখিয়ে দিবো এমন একটা জেদ চেপে গেলো।
– উনিও তো আপনার মতই ছিলো৷ তাহলে অভিযোগ কেনো করলো? দোষ যদি আপনার থাকে তো উনারও আছে।
– উহুম। ওর প্রমোশন হওয়ার পর থেকে দেখতাম ওর মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ও আমার কাছ থেকে একটু যত্ন খুঁজতো, একটু ভালোবাসার
চাইতো। মানে হাজবেন্ড ওয়াইফের ইমোশনাল রিলেশনশিপ যেমন হয় ওরকম আরকি। আমিই পাত্তা দিতাম না৷
– হঠাৎ পরিবর্তন কেন?
– ও এতদিন ওর স্বপ্নের পিছনে ছুটেছে। আশপাশে তাকানোর সময় ওর ছিলো না। স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর হয়তো ওর মনে হয়েছিলো এবার আমাদের সম্পর্কের দিকে তাকানো উচিত। মানুষের একটা আকাঙ্খা পূর্ণ হওয়ার পর আরেকটা আকাঙ্খা তৈরী হয়৷ নবনীরও তাই হয়েছিলো।
– তারপর?
– এরপর দিলাম ওকে ডিভোর্স। মাস দুয়েক যাওয়ার পর বাবাকে বললাম মেয়ে খুঁজো। বাবা বললো,
– সবেমাত্র ডিভোর্স হলো। এখনই বিয়ে করবি! বউটার জন্য কি একটুও কষ্ট হবে না তোর?
আমি বললাম,
– না, হবে না। পাত্রী কি তুমি খুঁজবে নাকি রাস্তা থেকে যাকে পাবো তাকেই তুলে এনে বিয়ে করবো বলো?

সেদিন থেকেই শুরু হলো আমার জন্য পাত্রী খোঁজা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here