#চক্রব্যুহ,০৩,০৪
মোহাম্মদ মনোয়ার
[তিন]
এই দিকে খুব বেশি একক বাড়ি নেই। আশে পাশে সব গুলোই হাইরাইজ বিল্ডিং, একটার গা ঘেষে আরেকটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। কলাবাগান দুই নম্বর লেন দিয়ে ঢুকে একটু এগুতেই গাড়ির জ্যামে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। পড়ন্ত বিকেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে বেশি দেরি নেই। গলিতে ঢুকতে বা পাশে ছোট একটা পুকুর দেখে খুব অবাক হয়েছে হাসিব উদ দৌলা। অল্প বয়সী দুটি বাচ্চা মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। সাথে গৃহকর্মী মতন একজন বয়স্কা মহিলা। ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই পুকুরের উল্টোপাশের বাড়িটাই দেখিয়ে দিল। গাড়ি পুকুরের পাশে রেখে স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন হাসিব উদ দৌলা। কিন্তু গাড়ি থেকে কেউ নেমে আসলো না।
-স্যার!
-হুম।
-স্যার। গত কয়েকদিনের পেপারের অন লাইন আর্কাইভ ঘেটে দেখেছি। আবরার হোসেন নামে কারো গুমের সংবাদ ছাপানো হয়নি। অনেক গুলো অনলাইন নিউজ পোর্টালও দেখে ফেলেছি। গত সাত দিনে কোন গুম বা নিখোঁজ সংবাদ নেই।
-হুম।
-সামিহা অবন্তীর মোবাইল কল লিস্টে র্যান্ডম নম্বর বেশি। কয়েকটি সন্দেহজনক নম্বর নোট করে রেখেছি।
-হুম।
-যে তারিখে উনি নিখোঁজ হয়েছেন, তার আগে পরে চারটি নির্দিষ্ট নম্বরে কথা বলতে দেখা গেছে বেশ কয়েকবার। এগুলোও নোট করে রেখেছি।
-হুম।
হাসিব উদ দৌলার চোখে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। উত্তর “হুম” এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আরিফ বুঝে গেছে এখন কথা বলে শুধু “হুম” শুনতে হবে। কথা না বাড়িয়ে সংবাদপত্র আর কল লিস্টে চোখ বুলাতে লাগল। হঠাত ড্রাইভিং সিটের থেকে দরোজা খুলে বের হয়ে এলেন হাসিব।
-আরিফ, নেমে আস। চল যাওয়া যাক।
চমকে উঠেছিল আরিফ। নোট বুক আর মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে নেমে এসে হাসিবের পাশে দাঁড়াল।
-বাড়িটা দেখে তোমার কী মনে হয় আরিফ?
প্লাস্টার খয়ে যাওয়া বেশ উঁচু দেয়াল। বেশ বড় আর উঁচু লোহার গেট। দেয়ালের উপরে তারকাটা আর ভাঙ্গা কাচ সেট করা। গেটের উপরের দিকে চার ইঞ্চি পর পর লোহার কাঁটা। আড়াই তলা বাড়ি। ছাদে দুটা রশির উপর কিছু কাপড় মেলে দেয়া।
-স্যার, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর হবে বাড়ির বয়স। রিসেন্টলি বড় কোন রেনোভেশন করা হয়নি। এক সময়ে একান্নবর্তী পরিবারের জন্য বানানো হয়েছিল। এখন মনে হয় সেই রমরমা নেই। পরিবারে লোকসংখ্যা সম্ভবত চার পাঁচ জনের বেশি নয়। ছাদে দুজন মহিলা আর একজন পুরুষের কাপড় শুকাতে দেয়া। অর্থাৎ বাড়িতে বাচ্চা বা অল্প বয়সী কেউ নেই হয়ত। পুরুষটির শুকাতে দেয়া কাপড় দেখে মনে হচ্ছে দারোয়ানের ড্রেস। খুব সম্ভবত অবস্থা পড়তির দিকে বাড়ির মালিকদের। তবে সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবার। চারিদিকে এত এপার্টমেন্টের মাঝে এমন একটি একক বাড়ি টিকে আছে। এর অনেক অর্থ হতে পারে। হয় বাড়িটি নিয়ে শরিকদের মাঝে মামলা চলছে। অথবা ব্যাংকে বন্ধক রাখা আছে। অথবা এদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল এবং কোন অবস্থাতেই নিজেদের আভিজাত্য টাকার কাছে বিক্রি করে দিতে রাজি নয়।
-গুড অবজারবেশন মাই ডিয়ার। চল, ভেতরে যাওয়া যাক!
কাছে যেতে উঁচু গেটের বাম পাশে দেয়ালে নাম ফলক চোখে পড়ল। “বেগম গুলজার মহল”, স্থাপিত- ১৯৭৯ সন। গেটের ডান দিকে দেয়ালের উপর প্রায় ভাঙ্গা কলিং বেল। সাবধানে চেপে ধরল আরিফ। গির্জার ঘণ্টাধ্বনির মত আওয়াজ। কলিং বেল বাজতেই একটি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। কেউ একজন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। একটু পরেই কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল এগিয়ে আসছে।
-কে?
-আমি হাসিব উদ দৌলা। অবন্তী ম্যাম আসতে বলেছেন।
সাথে সাথে দরোজা খুলে গেল। আনসারের ড্রেস পরা একজনকে দেখা গেল উঁকি দিতে। পাঁচ ফিট সাত আট ইঞ্চি লম্বা, কালো গায়ের রঙ। গালে কালো চাপ দাড়ি। চোখ নিস্প্রভ। প্রচুর সিগারেট খায়। এত দূর থেকেও গায়ের গন্ধ ভেসে আসছে।
-ভেতরে আসুন স্যার। আমি কবির, এই বাড়ির দারোয়ান স্যার।
ওদের ভেতরে ঢুকতে দিয়েই ডান পাশের ছোট একটা ঘরের দিকে ছুটে গেল কবির। একটা বিশাল সাইজের এলসেশিয়ান কুকুর বাঁধা সেই ছোট ঘরের গ্রিলের দরোজার সাথে। সম্ভবত কুকুরের জন্য এই ঘর তৈরি করা হয়েছে। ঘরটা বাড়িটার মত অত পুরনো নয়। খুব বেশি হলে সাত আট বছর আগের বানানো। কুকুরটি অনবরত ঘেউ ঘেউ করছে। কবির ওকে শান্ত করল মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে।
তিন থেকে সাড়ে তিন কাঠার ওপর বাড়ি। ঢুকতেই সামনে এক চিলতে খালি জায়গা। কুকুরের ঘরের পাশে গ্যারেজে একটা টয়োটা করোলা জি গাড়ি পার্ক করা। ২০০৬ মডেলের ওশ্যান ব্লু রঙের গাড়ি। ধুলোয় ঢেকে আছে। ড্রাইভার কী কারণে আছে বোঝা গেল না। তিনটি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পোর্চে উঠতে হয়। এরপরেই মূল দরোজা। ওক কাঠের ভারি দরোজা। আভিজাত্যের ছোঁয়া লেগে আছে নিখুঁত কারুকার্জে। কবির দরোজা ঠেলে দিতেই বিশাল হলরুমের মত ঘর দেখা গেল। দুই পাশের দেয়াল জুড়ে প্রচুর পেইন্টিং। হলরুমটিতে তিনটি দুই পার্টের দরোজা। মূল দরোজার উল্টোদিকে একটি। বাকি দুটো দুই পাশে। তিনটেই বাইরে থেকে শেকল টেনে তালা দেয়া। একটি বাঘডাসা জাতীয় কোন প্রাণীর চামড়া লাগানো বা পাশের দেয়ালে। ডান পাশে দেয়ালে দুটো হরিণের শিং ঝুলে আছে। ঘরটিতে চারটি ভিক্টোরিয়ান সোফাসেট পেতে রাখা চারিদিক ঘিরে। বিশাল ওক কাঠের শোকেস সামনের দিকে দরোজার ডান পাশে। বিভিন্ন দেশের নানা জাতীয় শোপিস দিয়ে ঠাসা। বিপরীত দিক দিয়ে একটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। কবির ওদের থেকে একটু এগিয়ে ছিল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে ওকে অনুসরন করল দুজন।
হাসিব উদ দৌলা কবিরের পেছনে। ওর একটু পেছনে আরিফ। সিঁড়িতে পা রেখেই হাসিব পেছনে ফিরে আরিফের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, “ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে রাখ খুঁটিনাটি।“ আরিফ উপরে নিচে দুইবার মাথা ঝোঁকাল।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে একটি কাঠের দোলনা দেখা গেল। তার চারপাশে চারটি সোফা পেতে রাখা। এগুলো ভিক্টোরিয়ান নয়। মডার্ন যুগের ফার্নিচার। বাহুল্য বর্জিত। সেগুন কাঠের। ফোমের গদি, সোনালী কাজের কাভার। এই রুমের চারিদিকে চারটি দরোজা। একটা ওপেন কাউন্টার রান্নাঘর। ফ্যামিলি লিভিং রুমের সাথেই ডাইনিং, রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া। লিভিং রুমের বা পাশে বিশাল এক বইয়ের শোকেস। একটু চমকে উঠেছিল হাসিব। এত বই! পুরনো বইয়ের ঘ্রাণে একটা মাদকতা আছে। চারিদিকে সেই ঘ্রাণে ম ম করছে। ওরা দোতলায় উঠে আসতেই মধ্য তিরিশের ভদ্রমহিলা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। দেখে সামিহা অবন্তি মনে হল। তার পাশে সোফায় বসেছিলেন সৌম্য চেহারার আনুমানিক আশি বছর বয়সের মহিলা। উনিও উঠে দাঁড়াতে আরিফ বাধা দিল। “না না ম্যাম, আপনি বসুন।“ এরপর হাসিব উদ দৌলার দিকে তাকিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল।
-উনি চক্রবুহ্য প্রাইভেট গোয়েন্দা ক্লাবের হাসিব উদ দৌলা। আমি স্যারের সহকর্মী।
-ওহ! আপনারা ওদিকটায় বসুন। আমি সামিহা অবন্তী। উনি আমার শাশুড়ি আম্মা। বেগম গুলজার হোসেন।
এরপর দারোয়ান কবিরের দিকে তাকাল সামিহা অবন্তী।
-বেলায়েতকে আসতে বলে দাও।
কবিরের যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন, রানু, এদিকে এসো।
-যদি আমাদের কথোপকথন রেকর্ড করতে চাই তাতে আপত্তি আছে?
সামিহা অবন্তীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন হাসিব।
-না, না। তা কেন! আপনাদের তদন্তের স্বার্থে যা কিছু করার করবেন।
বলে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল সামিহা অবন্তী। কিন্তু সেই হাসিতে বিষাদ লেগে আছে। বেগম গুলজার হোসেন টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি পরে আছেন। সাদা জমিনে নীল পাড়। আঁচলে হাল্কা বেগুনির ছোঁয়া। বেশ রুচিশীল মহিলা। এবং অভিজাত! আরিফের সেরকমই মনে হল। সামিহা অবন্তী পাকিস্তানি লন পরে আছে। হাল্কা ঘিয়ে রঙের জমিনের উপর ঘণ কাজ করা কামিজ। শিফন জর্জেট ওড়না ডান কাঁধ দিয়ে ফেলে রাখা। মুখে কড়া মেকাপ। বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলো আরিফ। পয়ত্রিশ? তিরিশ হলেও অবাক হবে না ও। টানা দুটি চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত। দেখতে অনেকটা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নারীদের মত। হাত দুটো বেশ ফর্সা। তাহলে মেকাপে এত বাহুল্য কেন? এক্সপ্রেশন আড়াল করতে চাইছেন? ভাবনা এগুলো না। পেছনে দারোয়ান আরেকজনকে নিয়ে এসেছে। রানু নামের কাজের মহিলাও চলে এসেছে। তিনজনেই সামিহা অবন্তীদের সোফার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। সামিহা অবন্তী ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রানু মেয়েটার চোখে মুখে ভয়। শ্যামলা গায়ের রঙ। শুকনা, হ্যাংলা পাতলা। মুখের চামড়া বেশ ঝুলে পড়েছে। একটু কুঁজো বলে মনে হলো। তবে দারোয়ান কবির বা ড্রাইভার বেলায়েতকে ততটা বিচলিত দেখাচ্ছে না। ড্রাইভার বেলায়েতের বয়স খুব সম্ভবত তিরিশ পার হয়নি। আরিফের কাছে ওকে “বাটপার” বলে মনে হল। চোখে মুখে সেই ছাপ স্পষ্ট। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছে। জিন্সের প্যান্টের সাথে আয়রন করা গাঢ় সবুজ ফুল স্লিভ শার্ট টাগ ইন করা। পায়ে বেশ দামী কেডস পরা। এডিডাস। সম্ভবত কপি জুতো। কপি হলেও দাম তিন হাজার টাকার কম হবে না। আরিফ সবাইকে খুঁটিয়ে দেখে হাসিব উদ দৌলার বা পাশে গিয়ে বসে পড়ল।
আরিফ বসতেই ঘরে পিন ড্রপ সাইল্যান্স নেমে আসল। কাঁধ শ্রাগ করে গলা খাঁকারি দিল হাসিব।
-সামিহা অবন্তী ম্যাম। যদি সংক্ষেপে বলতেন কবে থেকে আবরার সাহেব নিখোঁজ হলেন?
একবার পেছনের তিনজনের দিকে তাকিয়ে তারপর শাশুড়ির দিকে ঘুরল সাবিহা অবন্তী।
-ইন ডিটেলস বলার প্রয়োজন নেই। একেবারে সংক্ষেপে বলুন। পরে আমি প্রশ্ন করে বাকিটুকু শুনে নেব।
শাশুড়ির সম্মতি পেতে সামিহা অবন্তী বলতে শুরু করলেন।
-আপনাকে তো আগেই বলেছি ওর বন্ধু তৈয়ব শামসের কথা। ওর বিজনেস পার্টনার। ওদের অফিস উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরে। প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে গিয়ে ফিরে আসত রাত নয়টা দশটার দিকে। কোনদিন ফিরতে দেরি হলে ফোন করে জানিয়ে দিত। শুক্র শনি দুদিন ও যেত না। ওর বন্ধু সেই দুইদিন ম্যানেজ করতেন। গত ১৫ জুলাই রাত এগারোটার সময়েও ফিরে না আসায় আমি আম্মাকে বলি ওর কথা। আম্মাই ফোন দেয় ওর নাম্বারে। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল। আমি ওর বন্ধু শামস ভাইকে ফোন করি। উনি বললেন আবরার তো সন্ধ্যা সাতটার দিকেই বের হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত ট্র্যাফিক জ্যামে আঁটকে আছে। এরপর সারারাত চেষ্টা করেছি। ওর ফোন নম্বর বন্ধ। ওর অন্যান্য সব বন্ধুকে ফোন করেছি। কেউ বলতে পারে না ওর কথা।
কথা থামিয়ে শাশুড়ির দিকে তাকাল সামিহা। এরপর উনাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। শাশুড়ি ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। হাসিব উদ দৌলা সামিহাদের সোফার পেছনে দাঁড়ানো তিনজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন চলে যেতে। তারপর বেগম গুলজার হোসেনের দিকে তাকালেন।
-ওদের সাথে তো পরিচয় হলই। আপনাদের কথা আগে শুনি। এরপর ওদের একজন একজন করে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলে নেব।
তিনজনের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে খুব নিচু স্বরে হাসিব কথা শুরু করলেন।
-স্যরি সামিহা অবন্তী ম্যাম। আমি আপনাকে এটুকু ভরসা দিতে পারি, আপনার স্বামী বেঁচে থাকলে যে করেই হোক উনাকে আপনাদের সামনে হাজির করতে পারব। শান্ত হোন প্লিজ!
মুখ তুলে তাকাল সামিহা অবন্তী। কান্নায় চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। শাশুড়ি বেগম গুলজার হোসেন শাড়ির আঁচল দিয়ে খুব যত্ন করে ওর চোখের পানি কাজল মুছে দিলেন।
-থানায় কখন জানিয়েছিলেন?
-ভোর পাঁচটার দিকে কলাবাগান থানায় জানিয়ে আসি। ওসি থানায় নতুন এসেছেন। চাইছিলেন জিডি করি যেন। আমি একাই গিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। বাসায় ফিরে এসে আম্মার সাথে কথা বলি। আম্মাই বললেন শুধু অভিযোগ জানিয়ে আসতে। জিডি বা মামলা না করতে। আমরা নিজেরা কয়েকদিন খোঁজ নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেব কী করা যায়।
-হুম। কিছু মনে করবেন না সামিহা অবন্তী ম্যাডাম। আপনাদের কোন সন্তান?
নড়েচড়ে বসলেন সামিহা অবন্তী।
-আমাকে শুধু সামিহা বলে ডাকবেন প্লিজ। ম্যাম বলতে হবে না। খুব লজ্জা পাচ্ছি ম্যাম ডাক শুনে। হ্যা, আমাদের এক কন্যা সন্তান আছে। সে দার্জিলিং এ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করে। সামনে দূর্গা পূজার আগে আর কোন ছুটি নেই ওর।
-বয়স কেমন ওর? কোন ক্লাসে পড়ছে?
-ও সামনের আগস্টের দশ তারিখে চৌদ্দ বছরে পড়বে। ক্লাস এইটে পড়ছে।
-আপনার কি আর্লি ম্যারেজ ছিল?
আরিফ মনে মনে হেসে দিল। দারুণ এক ট্রিকস। যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, সে খুব খুশি হয়ে যায় নিজের বয়স কমাতে পেরে। বুঝতে পারল সামিহার প্রকৃত বয়স অনুমান করতে চাচ্ছে স্যার। সাথে ওর সম্মন্ধে ভাল একটা ধারণা। মনোযোগ দিয়ে শুনছে কথোপকথন।
-হ্যা হ্যা। আমার তো আঠারো উনিশ বয়স হতেই বিয়ে হয়েছিল।
এমন সময়ে শাশুড়ি কিছু বলতে চাইলেন। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলে গেলেন।
-আমি তখন সবে ইন্টার পাস করেছি। আম্মু মারা গেলেন তখন। কাকা ফুফুদের কথায় বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
-আচ্ছা! আমরা আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আবরার সাহেবের নিখোঁজ নিয়ে…
-ও আবরার! তুমি আমাকে একা ফেলে কোথায় হারিয়ে গেলে!
আবার ডুকরে কেঁদে উঠল সামিহা অবন্তী। দুই হাতে ওড়না চেপে ধরে কিছুক্ষণ কেঁদে তারপর থামল। কথার ফাঁকে ফাঁকে হেঁচকি দিচ্ছিল হঠাত হঠাত।
-সেদিন আমাদের সতেরতম বিয়ে বার্ষিকী ছিল। কেক কিনে এনেছিলাম। ওর প্রিয় কিছু ডিশ রান্না করেছিলাম। আর সেই রাতেই ও নিখোঁজ হয়ে গেল!
ওড়নায় দুই চোখ চেপে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সামিহা। শাশুড়ি বেগম গুলজার হোসেন বেশ মমতায় বউমার মাথায় ডান হাত রাখলেন। এরপর হাসিবের দিকে কেমন ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকালেন।
-আমার বড় ছেলে আবরার যে এভাবে একদিন নিখোঁজ হয়ে যাবে তা আমি অনেক আগেই জানতাম। ছোট ছেলে ফাইয়াজ যেভাবে হারিয়ে গেল, আবরারকেও সেভাবে একদিন হারিয়ে যেতেই হত!
চলবে।
#চক্রব্যুহ
…
[চার]
বেগম গুলজার হোসেনের কথায় আরিফ চমকে মিঃ হাসিব উদ দৌলার দিকে তাকাল। যেন কিছুই হয়নি, সারল্যমাখা চাহনিতে মিঃ হাসিব উদ দৌলা একইভাবে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে বসা বৃদ্ধা মানুষটির দিকে। ভারি মেকাপের আড়ালেও সামিহা অবন্তীকে দেখে মনে হচ্ছে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। শাশুড়ির ডান হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ইশারায় কিছু একটা বলল।
-এই বাড়ির উপর খারাপ জিনিসের আছর আছে। সব আমার কপাল বুঝলে তোমরা। এত অপঘাত আমাকে দেখতে হয়? নিজের সন্তানের মৃত্যুর ভার যে কী কঠিন বাবা। সেটা যদি তোমরা বুঝতে! আমার কলিজার টুকরা ফাইয়াজের অভিশাপ লেগেছে ওর। বউমা। তুমি আমাকে বাধা দিও না। সব বলতে দাও!
ফাইয়াজ নিশ্চয় খুব প্রিয় সন্তান ছিল। নামটি উচ্চারণ করার সাথে সাথেই বৃদ্ধার দুই চোখের কোণে পানি দেখা গেল।
-আম্মা, উনারা এসেছেন আবরারের ব্যাপারে কথা বলতে। প্লিজ ফাইয়াজের কথা এখন থাক।
-কেন থাকবে? রুনির দুই সন্তান এতিম হবার পেছনে কে দায়ী ছিল? আল্লাহ ওদের ক্ষমা করবে ভেবেছ?
সামিহা অবন্তীর হাত ছড়িয়ে আঁচল দিয়ে দুই চোখ মুছলেন বেগম গুলজার হোসেন। সামিহা অবন্তী মিঃ হাসিবকে চোখের ইশারা করল। কাঁধ শ্রাগ করে ছোট করে কাশি দিল মিঃ হাসিব।
-খালাম্মা। ফাইয়াজের নিখোঁজ হবার কথা জেনে খুব কষ্ট পেলাম। আমি অল্প হলেও জানি পুত্র হারানোর কষ্ট কেমন। আমার ছোট ভাই রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে আজ প্রায় চার বছর হলো। মা এখনো সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফাইয়াজের কী হয়েছিল, কেমন ছিল সে, আপনার কাছে সমস্তকিছু শুনব। আজ যদি অনুমতি দেন আপনার বড় ছেলে আবরারকে নিয়েই কথা বলি?
-তোমাকে বলে রাখছি মিঃ হাসিব। এই বাড়ির প্রতি কোণায় কোণায় মৃত্যু লেখা। আমরা সবাই অপঘাতেই মারা পড়ব। আর শোন, আমার বড় ছেলে আবরার খুব একটা ভালো মানুষ ছিল না। বউমা, যতই ওর ভাল বলতে চাও তুমি।
-আম্মা! দোহাই লাগে চুপ করুন! আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আবরার বেঁচে আছে কিনা, কোথায় কীভাবে আছে! ও আল্লাহ!
আবারো দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করেছে সাবিহা অবন্তী।
-সামিহা ম্যাম…প্লিজ!
ওড়না দিয়ে চোখ মুছে তাকাল সামিহা।
-প্লিজ! শুধু সামিহা বলুন।
-আচ্ছা ম্যাম! ও স্যরি! সামিহা!
-হ্যা।
সামিহার গলা ভারি হয়ে আছে কান্নায়। চোখ দুটি রক্ত জবার মত লাল।
-কীভাবে শুরু করতে চান আপনারা?
-আরিফ, কী মনে হয় তোমার? আমরা কি খালাম্মার কথা আগে শুনব?
-স্যার, আমার মনে হয় সেটাই ভাল হবে। উনি এ বাড়ির মুরুব্বি।
-হ্যা আরিফ। আমিও তাই ভাবছিলাম।
অনুমতির জন্য সাবিহার দিকে ফিরে চাইল মিঃ হাসিব।
-সামিহা, আমরা কি উনার সাথে একাকী কথা বলতে পারি?
সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল সামিহা।
-ঠিক আছে। আপনারা গল্প করুন। আমি বরং আপনাদের জন্য চা নিয়ে আসি। গ্রীন টি চলবে? বাসায় ব্লাক টি নেই। কফি দিতে পারতাম, কিন্তু সেটাও নেই!
আরিফ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই মিঃ হাসিব বলে উঠল, “না না। আপনি ব্যস্ত হবেন না। গ্রীন টি হলেই দারুণ হবে! সাথে আর কিছু আনতে যাবেন না যেন। অফিস থেকে আমরা লাঞ্চ করেই এসেছি। তাই না আরিফ?”
-হ্যা স্যার। লাঞ্চ করেই তো রওয়ানা হলাম!
মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে কথাগুলো বললেও মনটা খারাপ হয়ে গেল। হাসিবের ফোন পেতে আর দেরি করেনি। মহাখালি থেকে সাথে সাথেই চলে এসেছিল। মহাখালিতে এসেছিল এক বন্ধুর ছোট বোনের বিয়ের দাওয়াতে। সেটা না খেয়েই চলে এসেছে। আর এখন শুনছে শুধু গ্রীন টি খেয়ে থাকতে হবে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
বেগম গুলজার হোসেন মনে হয় খুব করে চাইছিলেন একাকী কথা বলতে। সামিহার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে সাথে সাথে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “এই মেয়েটা একটা আস্ত কালসাপ। তোমাদের খালু কি দেখে যে এই মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসেছিল! ও এই বাড়িতে আসার চারদিনের মাথায় প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে। রান্না করার সময় রানুর মার শাড়িতে কি করে যেন আগুন লেগে গেল। আমি এই বাড়িতে বউ হয়ে আসারও আগের মানুষ সে। সেই আগুনে রানুর মা মরল। এই যে রানুকে দেখলে, এরই মা। শোন, সামিহার স্বভাব চরিত্র খারাপ জ্বিনের মত। ও এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকে একে একে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকল। আবরারের আব্বা মারা গেলেন কুকুরের কামড় খেয়ে। ফজর নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বাড়িতে ফিরছেন, কোত্থেকে এক পাগলা কুকুর এসে তাকে কামড়ে দিল। এই যুগে কারো জলাতংক হয় জানতাম না। দশদিন ভর্তি ছিলেন পিজি হাসপাতালে। এর বছর খানেক পর আমার শাশুড়ি মা মারা গেলেন ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে। বুঝলে বাবারা, একদিন আমার ছোট ছেলে ফাইয়াজ হারিয়ে গেল। আবরার নিজেও একটা শয়তান, বউটাও একটা শয়তান। আমার কি মনে হয় জান? আবরার মারা গেছে। আর এই বলে রাখলাম, সামিহার হাত আছে ওর মৃত্যুতে। এই মেয়ে দুদিন পরে আমাকেও খুন করে গায়েব করে ফেলবে।“
নিশ্চয় এই বাড়িতে ঘন ঘন বড় ধরণের কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। হয়ত নেহাত কো ইন্সিডেন্ট। বুড়ির মনে তীব্র সন্দেহ গেঁথে গেছে। সামিহা বউ হিসেবে এই বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই আগুন লেগে একজন মারা গেল। কুসংস্কার। বুড়িকে ঘাটিয়ে লাভ হবে না। আরিফ মনে মনে ভাবল। তবে, আবরারের নিখোঁজের ব্যাপারে কেন যেন সামিহার হাত আছে বলে মনে হলো। যদিও এখনো তদন্ত শুরুই হয়নি। মরে আছে না বেঁচে আছে সেটারও কিছুই জানে না।
-আচ্ছা খালাম্মা। আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাচ্ছি। জবাব না দিতে চাইলে অসুবিধা নেই।
-বল।
-আপনাদের শরিক? মানে আবরারদের কাকা মামারা? তাদের সাথে সম্পর্ক কেমন?
-ওর আব্বারা তিন ভাই দুই বোন। ওর আব্বা সবার বড়। দুই বোন কানাডায় থাকে। দুই ভাই থাকে এমেরিকায়। আবরারের বড় কাকা দেশে। ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে আছে এডিশনাল সেক্রেটারি হিসেবে। সবাই প্রতিষ্ঠিত। আগে যোগাযোগ কিছু ছিল। কয়েক বছর ধরে সেটা কমে এসেছে। বিশেষ করে ফাইয়াজের নিখোঁজের পর থেকে। আর আমার দিকে তেমন কেউ নেই। আমরা মূলত ওপার বাংলার চব্বিশ পরগণার মানুষ। আমার এক ভাই আছেন এই দেশে। রাজশাহী ভার্সিটির প্রফেসর সে। সেখানেই তার সংসার।
-হুম। অর্থাৎ পারিবারিক কোন্দল বা এমন কিছু নেই!
-হ্যা, তা বলতে পার। জমি বা সম্পত্তি নিয়ে কোন্দল হবার মত তেমন কিছু ঘটেনি। কেউ তো নেইই যে সম্পত্তির ভাগ চাইবে। এ বাড়িতে বাইরের মানুষ বলতে আমার দুই ছেলের কিছু বন্ধু বান্ধব যা আসত।
-আচ্ছা খালাম্মা। আপনাদের পারিবারিক ছবির এলবাম যদি থাকে, একবার দেখতে চাইতাম।
-এলবাম আছে অনেকগুলো। সামিহা আসুক। আনতে বলে দেব।
-তাহলে আপাতত উনার ছোটবেলা নিয়ে শুনি। এই যেমন ছোট বেলায় কেমন ছিল। কোথায় পড়াশোনা করেছেন।
-এই ছেলেটা ওদের বংশের বড় ছেলে। যে বছর দেশে দুর্ভিক্ষ হলো, সেই বছর ওর জন্ম। বংশের বড় ছেলে বলে সবার আদর পেয়েছে। আদর পেতে পেতে বখে গেছিল সেই ছোট বেলাতেই। পাড়ার সব খারাপ ছেলেদের সাথে মিশত। ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলে পড়েছে। তারপর ঢাকা কলেজে পড়ল। ঢাকা কলেজে থাকতে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে গেল।
-এরপর?
-এরপর ঢাকা ভার্সিটি থেকে অনার্স করেছে। মাস্টার্স করেছে।
-চাকরি করেছে নাকি প্রথম থেকেই ব্যবসা করত?
-চাকরি করার প্রয়োজন পড়েনি। ওদের আব্বার তো প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল। খুব নাম করা ঠিকাদার ছিলেন ওদের আব্বা। ওরা দুই ভাই-ই পড়াশোনার পর ওদের আব্বার সাথে ব্যবসায় ঢুকে পড়ে।
-উনার বন্ধু কেমন ছিল?
-ও তো ছোটবেলা থেকেই খুব আড্ডাবাজ ছিল বাবা। প্রতিদিন দশ বারোজন করে বন্ধু বাসায় এসে ভিড় করত।
-কোন বিশেষ বন্ধু ছিল? যাদের সাথে বেশি মিশতেন?
-হ্যা। ওর চার পাঁচজন বন্ধু ছিল। এই যেমন হারুন, শিমুল, আজিম, গুড্ডু এরা।
-সবাই কি স্থানীয়?
-আজিম আর শিমুল পুরনো ঢাকার ছেলে। সারাদিন এরা একসাথে আড্ডা দিত।
-রাজনৈতিক বন্ধু?
-হুম। তাও ছিল অনেক। মহসীন আর জীবন বলে দুজন ছিল এরা খুব আসত। একসাথে অনেক কিছু করেছে এরা।
-এদের সবার সাথেই কি ভাল সম্পর্ক ছিল? কারো সাথে কখনো বিবাদে জড়িয়ে ছিল?
-মারামারি লেগেই থাকত। খুব বদ মেজাজি ছেলে আমার। যার তার সাথে মারামারি করত। কত যে বিচার শালিস এসেছে ওর নামে! বন্ধুদের সাথেও মারামারি হত। কিন্তু ওকে গুম করার মত বা মেরে ফেলার মত তেমন কিছু ছিল না। ওরা ওর অনেক পুরনো বন্ধু।
-রাজনৈতিক কোন শত্রু? বিরোধী দলের?
-নাম বলে শেষ করা যাবে না বাবা। ফায়সাল বলে একটা ছেলের কথা শুনতাম খুব।
-কতদিন আগে সেটা?
-এই ধর বছর সাত আট তো হবেই।
-রিসেন্ট, মানে এই কিছুদিনে এমন কিছু শুনেছেন? আবরার নিজে বলেছে বা সামিহা?
-হ্যা হ্যা বাবা! মনে পড়েছে! এই তো গত মাসে মাসুদ না কী নামের একটা ছেলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। যে ভয় পেয়েছিলাম বাবা সেদিন!
-কী অভিযোগ নিয়ে এসেছিল মনে আছে?
-কে নাকি কোথায় খুন হয়েছে। খুনিদের সাথে নাকি আবরারের চেনা পরিচয় আছে। আবরারকে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল বাবা। আমি ওদের হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়েছিলাম। আমার কান্নাকাটি দেখে বলে গেছিল “এবারের মত মাফ করে দিলাম।“
চলবে।