চক্রব্যুহ,০৫,০৬

0
130

(গোয়েন্দা গল্প)

“চক্রব্যুহ,০৫,০৬
মোহাম্মদ মনোয়ার
[পাঁচ]

এই মুহুর্তে বেগম গুলজারের চেহারায় বেশ ভয়ের ছায়া দেখা গেল। হঠাত করেই মনে হয় তার ছেলের নিখোঁজের সাথে রাজনৈতিক কানেকশন দেখতে পেয়েছেন।

-খালাম্মা, নোট করে নিচ্ছি কথা। ফোন নম্বর, নাম ঠিকানা জোগাড় করে নেব। সামিহাও হয়ত কিছু সাহায্য করতে পারে। আচ্ছা খালাম্মা, বিয়ের পরেও কি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত আবরার?

-তা দিত। তবে ব্যবসার জন্য খুব একটা সময় বের করতে পারত না। শুক্র শনি দলবল বেঁধে আড্ডা দিতে আসত। নতুন নতুন ছেলেমেয়েও আসত।

-ছেলেমেয়ে? মানে মেয়ে বন্ধুও ছিল?

-সে কী বাবা! এই যুগের ছেলেপেলে তোমরা। তোমাদের মেয়েবন্ধু নেই?

আরিফ ফিক করে হেসে দিয়েছিল। হাসিবের ভাবান্তর হলো না । এই সময়ে রান্নাঘর থেকে সামিহা উঁকি দিল।

-আমি কি আসব চা নিয়ে?

বেগম গুলজারের চেহারায় বড় একটা পরিবর্তন খেয়াল করল আরিফ। সামিহার গলা শোনার সাথে সাথেই ঘৃণায় চোখ মুখ ছেয়ে গেছে। “হ্যা আসুন সাবিহা।“ হাসিব গলা চড়িয়ে বলল।

বিশাল এক ট্রে হাতে করে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসল সামিহা। হাসিব ইশারা করতেই আরিফ উঠে গেল সাহায্য করতে। ট্রের দিকে তাকিয়ে আনন্দ লুকিয়ে রাখতে পারল না! স্যান্ডউইচ, সমুচা ছাড়াও প্যাস্ট্রি কেক দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা! হাফ ছেড়ে বাঁচল, যে ক্ষুধা লেগে গেছে! তবে স্বীকার করতেই হয়, ভদ্রতা জানেন বটে মহিলা। মনে মনে প্রশংসা করল। প্রায় জোর করে ট্রে নিজের হাতে নিয়ে নিল। টেবিলে ট্রে রেখে খাবারগুলো সাজিয়ে রেখে বসল আরিফ। সামিহা উৎসুক দৃষ্টিতে হাসিবের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসিব তার চোখের ভাষা পড়তে পেরেছেন।

-সামিহা। আমরা আর বেশি সময় নেব না খালাম্মার কাছে। খালাম্মা বলছিলেন আপনাদের বেশ কিছু পারিবারিক এলবাম আছে। যদি কিছু মনে না করেন। সেগুলো কষ্ট করে নিয়ে আসা যাবে?

“হ্যা হ্যা, কেন নয়” বলেই দক্ষিণ দিকের এক ঘরে ঢুকে গেল।

-আচ্ছা খালাম্মা। আমরা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আবরারের বন্ধুরা কি প্রতি শুক্র শনিবারে বাসায় আসত? এখানে পার্টি করত?

-হ্যা বাবা। শুক্রবার সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েরা আসত। মাঝরাত পার করে আড্ডা দিত। আধুনিক ছেলেপেলে বাবা। হৈ হুল্লোড় নাচ-গান করে। ড্রিংক করে!

গলা খাঁকারি দিল আরিফ, কাঁধ শ্রাগ করল একবার। এ তো রীতিমত উচ্চবিত্তের পার্টি! হাসিব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। যেন এসব ডাল-ভাত টাইপ। প্রতিদিন এমন পরিবারের সাথে তার উঠা বসা।

-পার্টি শেষে সবাই বাড়ি ফিরে যেত না। কেউ কেউ থেকে যেত। ঠিক?

-হুম! প্রায় রাতেই অনেকেই থেকে যেত। কিন্তু কী করে বুঝলে কেউ কেউ থেকে যেত?

-না মানে, আপনাদের নিকট আত্মীয় তেমন আসে না এই বাড়িতে। এখানে অনেকগুলো রুম দেখেছি উপরে নিচে। নিচের রুমগুলোর তালা একেবারে নতুনের মত। প্রায়ই খোলা বন্ধ করা হয়। অর্থাৎ বাড়িতে মানুষ আসে এবং যারা আসে, তাদের অনেকেই শুধু ড্রয়িং রুম থেকেই বিদেয় নিয়ে চলে যায় না।

ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়েছেন। একটু সমীহার ভাব দেখা যাচ্ছে এখন।

-তা ঠিক বাবা। তিন চারজন প্রায় শুক্রবারেই থেকে যেত। শনিবার দুপুর বা বিকেলের দিকে ফিরে যেত।

-কোন মেয়ে বন্ধুও কি এভাবে থেকে যেত?

-হ্যা বাবা। অনেক মেয়েও রাতে থেকে যেত। এর মধ্যে সাফোয়ান নামের এক মেয়ে তো প্রায় রাতেই থেকে যেত!

আরিফ এবার বেশ বড় করে ঢোক গিলল! মিঃ হাসিব প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।

-এই পার্টি বা ছেলেমেয়েদের একসাথে রাত্রিযাপন। এ ব্যাপারে আপনি কিছু মনে করেন না?

-সে কী! ওরা বড় হয়েছে। আমাদের পরিবারে এসব নিয়ে সংস্কার ছিল না, সবকিছু স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখতাম। ওদের নিজেদের লাইফ স্টাইলে আমি কেন নাক গলাতে যাব বাবা! আমি আর ওর আব্বা আমাদের মত করে জীবন কাটিয়েছি। আমার শ্বশুর ছিলেন ব্রিটিশ আমলের ব্যারিস্টার। উনিও তার ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা দিতেন। আমরাও দিয়েছি। ওদের জীবন ওদের মত করে কাটাবে।

-হুম। কিন্তু সামিহা ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখত? মানে সাফোয়ান নামের যে মেয়ের কথা বলছেন, তাকে নিয়ে? রাত্রে এভাবে বাড়িতে পার্টি এলাউ করত?

-ও নিজেও সেসব পার্টিতে থাকত। ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে! বেশ কয়েক মাস ধরে কিছু একটা হয়েছে। সে ও শুক্রবারে বিকেলের দিকে বাইরে চলে যেত। ইদানিং দুজনের মধ্যে বেশ ঝগড়া চলছিল এসব নিয়ে।

-তাই? আর কোন সংবাদ দিতে পারবেন? মানে…

থামলেন হাসিব। গলা নামিয়ে মুখ সামনে এগিয়ে বেগম গুলজার হোসেনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। বুঝে গেছেন, এই ভদ্রমহিলা ছেলে বউকে অতটা পছন্দ করেন না। লোক দেখানো আদর আর অভিব্যক্তি শুধু!

-সে ও কি পার্টি করতে যেত? এমন কি হতে পারে না নিজেদের বাড়িতে গেল আব্বা আম্মাকে দেখতে?

বেগম গুলজার হোসেনও গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা শুরু করলেন। গোপনীয় কিছু শেয়ার করছেন যেন!

-ওর আব্বা আম্মা অনেক আগেই মারা গেছেন। এক বোন আছে উত্তরায়। সেখানে রাত্রে থাকার মত পরিস্থিতি নেই সেটা আমি জানি। ইদানিং প্রায় রাতেই সে বাইরে থাকে। কোথায় থাকে সেটা কখনো জিজ্ঞেস করিনি। স্বামী স্ত্রীর নিজেদের ব্যাপার। বুঝলে না?

মনে হলো বেশ আধুনিক মনের মানুষ এই বেগম গুলজার হোসেন। চেহারা ও সাজসজ্জার আভিজাত্যের সাথে ব্যবহার এবং মানসিকতায় মিল আছে। তবে মনে প্রশ্ন জাগছে থেকে থেকে। এই দেশের সমাজ ব্যবস্থা মধ্যবিত্তের ধারণায় বেড়ে উঠেছে। অতি উচ্চ শ্রেণির মূল্যবোধ মধ্যবিত্তের কাছে অবক্ষয়ের মত। হয়ত এই অবক্ষয়টা সত্য। মূল্যবোধের অবক্ষয় কি এই পরিবারের ধ্বংসের মূল সমস্যা? ভাবল আরিফ। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারল না। “আপনারাও নিন না” বলে টেবিলে রাখা খাবার থেকে একটা স্যান্ডউইচ উঠিয়ে নিল। হাসিব উদ দৌলা কিছু না বলে নড়েচড়ে বসলেন। অবচেতন ভাবে ডান পা বা পায়ের উপর তুলে দিয়েছেন। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। দুচোখ বন্ধ করে দু’হাতে মাথার পেছনে চেপে ধরেছেন। স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে আরিফ হাসিবের দিকে ঝুঁকে আসল। গুনগুন করে নিজের মনে কথা বলছেন। খুব অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেল কথা কয়টা।

“সামিহা কোথায় রাত্রিযাপন করে? আবরারের হারিয়ে যাওয়া কেন? পারিবারিক কারণ? ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিশোধ? নাকি বন্ধুদের সাথে শত্রুতা? অথবা অলৌকিক ব্যাখ্যাতীত কোন ঘটনা? ফাইয়াজের অন্তর্ধানের সাথে কোন সম্পর্ক?”

গুনগুন থামিয়ে এবার মুখ খুললেন হাসিব।

-সরাসরি প্রশ্ন করি। আপনি তখন বলছিলেন আপনার বড় ছেলে আবরারের নিখোঁজের ব্যাপারে সামিহার হাত আছে। কোন কারণ?

একটুও সময় নিলেন না বেগম গুলজার হোসেন। চেহারায় হঠাত করে পরিবর্তনটা খেয়াল করল ওরা দুজনেই।

-আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওর কারণেই আমার ছেলে আজ নিখোঁজ হয়েছে!

কিন্তু উনি কথা শেষ করতে পারলেন না। দরোজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। সামিহা অবন্তী শাশুড়ির পেছনে এসে দাঁড়াল। হাতে তিনটি মোটা মোটা ছবির এলবাম।

-বিরক্ত করলাম না তো?

প্রশ্নটা করে হাত বাড়িয়ে দিল। আরিফ হাত বাড়িয়ে এলবাম তিনটি নিয়ে টেবিলে রাখল। সত্য সত্যই ভীষণ বিরক্ত হয়েছে সে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। হাসিব তার স্বভাবসুলভ হাসিটা ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে রেখেছে।

-না না! বিরক্ত হব কেন? আমাদের কথাবার্তা শেষ। আপনি বসুন। আমরা একসাথে ছবি দেখি। তারপর আপনার সাথে একান্তে কথা বলব!

সামিহা অবন্তী একটি এলবাম বাড়িয়ে দিল আরিফের হাতে।

-আম্মা, আপনার ডিমেনশিয়ার ওষুধ খাবার সময় হয়ে এসেছে। আছরের নামাজের সময়ও চলে যাচ্ছে।

বেগম গুলজার হোসেন উঠতে চাচ্ছিলেন না। সামিহাকে নিয়ে মাত্রই কথা উঠেছে, এর মাঝেই তাকে উঠে যেতে বলা হচ্ছে!

হাসিব বা হাত ঘুরিয়ে সময় দেখলেন। পাটেক ফিলিপের বিখ্যাত ৫৭১১ সিরিজের মডেল ঘড়ি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরিফ গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাসিবও একটা এলবাম হাতে তুলে নিলেন। মুখে স্মিত হাসি।

-আপনি নামাজ পড়ে ওষুধ খেয়ে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি।

বেগম গুলজার হোসেন একেবারে পূর্বদিকের রুমটিতে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলেন।

-আমরা কয়েকটা ছবি মোবাইল ক্যামেরায় নিতে চাইব। আপনার আপত্তি নেই তো ম্যাডাম?

আরিফ এই প্রথম মুখ খুলল।

-না, না, সে কী! আপনাদের আমিই ডেকে এনেছি তদন্ত করতে। ফিল ফ্রি টু আস্ক মি এনিথিং। আর কোন তথ্য বা অন্য কিছুর প্রয়োজন পড়লে আমাকে জানাবেন প্লিজ।

-আচ্ছা সামিহা, সেই দিনের কথা সংক্ষেপে যদি বলতেন। মানে যেদিন থেকে আপনার স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন।

হাতে ধরা এলবামের মাঝামাঝি একটা পৃষ্ঠা খুলে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে হাসিব জিজ্ঞেস করলেন।

-ও সাধারণত সন্ধ্যা সাতটার দিকে অফিস থেকে বের হয়। এত দুরের রাস্তা। আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে যায়।

-উনি কি আপনাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতেন।

সামিহা অবন্তীকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন হাসিব।

-না, সাধারণত অফিসের একটা মাইক্রোবাস এসে ওকে নিয়ে যেত। টাইমিং না মিললে বা গাড়িটি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে ও উবার ডেকে চলে আসত। একবার দুবার এসি বাসে করে এসেছে। তবে যাবার সময়ে সব সময়েই অফিসের গাড়িতে করে যেত।

-সেদিন উনি কীভাবে আসছিলেন। আপনি বলেছিলেন ওর পার্টনারের সাথে কথা বলেছিলেন। কিছু জেনেছিলেন?

-ভালো কথা মনে করেছেন। আমি আসলে জিজ্ঞেস করিনি।

-উনার পার্টনার তৈয়ব শামস উনার কী ধরণের বন্ধু ছিলেন। মানে উনারা কি বাল্যবন্ধু?

-না। আপনাকে বলেছিলাম ও একটা সময় ছাত্র রাজনীতি করত। শামস ভাই যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। এটাও বলেছিলাম আবরার যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। ওখানেই পরিচয়।

-হুম। তৈয়ব শামস সাহেবের ফোন নম্বর আর অফিসের এড্রেসটা যদি বলতেন।

“একটু ধরুন” বলে উঠে গেল সামিহা। ঘরে ঢুকে একটি ফোন হাতে নিয়ে ফিরে এসে সোফাতে বসল।

-উনার তো অনেকগুলো নম্বর। এই যে এই নম্বরটি নিন। এটা উনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। অফিসিয়াল নম্বর নয়। ০১৭১৫xxxxxx…

-আবরার সাহেবের ভিজিটিং কার্ড হবে?

-হ্যা হ্যা হবে। এখুনি চাই?

আরিফ মুখ খুলল, “ম্যাডাম, এখন হলেই ভালো হয়, আরো অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আপাতত আপনার পর্বটা দ্রুত শেষ করে ফেলি। তদন্তের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হবে আপনার সাথেই। তাই না?”

সামিহা অবন্তী আবারো উঠে দাঁড়াল। ঘরে ঢুকে পড়তেই আরিফ মুখ হাসিব উদ দৌলার কানের কাছে নিয়ে এলো।

-স্যার, খেয়াল করেছেন? ফোন ট্র্যাকিং এ কিন্তু এই মোবাইল ফোনের কথা উল্লেখ করা নাই। উনি অন্য ফোনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন!

-আজকাল প্রায় সবাই দুটো বা তিনটা ফোন ইউজ করে। এতে অবাক হবার কী আছে আরিফ? তুমি কি সেজন্যেই উনাকে আবার ভেতরে পাঠালে?

-হ্যা স্যার। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। এই ফোনটি উনি সবসময় ব্যবহার করেন। প্রাইমারি ফোন। আমাদের কল দিয়েছিলেন সেকেন্ডারি ফোন দিয়ে!

এমন সময়ে হাতে একটা কার্ড বক্স নিয়ে এসে সোফায় বসল সামিহা। দুটো কার্ড এগিয়ে দিল।

-এই যে ওর কার্ড।

হাত বাড়িয়ে কার্ড নিল দুজনেই। হাসিব “ধন্যবাদ” বলে প্রশ্নে চলে গেল।

-সামিহা। আপনার জা এর নাম যেন কী?

-আমার জা? মানে ফাইয়াজের স্ত্রী?

-জ্বী।

-ওর নাম রুনি। পুরো নাম রুনি চৌধুরী।

-অর্থাৎ উনি উনার হাজব্যান্ডের সারনেম নেননি, নাকি রিসেন্টলি চেঞ্জ করে আগের নামে ফিরে গেছেন?

-ও কখনোই নাম পরিবর্তন করেনি।

-কতদিন হলো ফাইয়াজ নিখোঁজ?

-প্রায় দুই বছর হতে চলল।

হাসিব এলবামের পাতা উল্টিয়ে ছবি দেখছিল। রুনি একজন দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিল। দুই ভাইয়ের চেহারায় বেশ মিল। ভালো করে খেয়াল না করলে বুঝতে কষ্ট হবে। ছবি দেখতে দেখতে হঠাত করেই এলবাম বন্ধ করে আউট অব দ্যা বক্স প্রশ্ন করে বসলেন।

-আপনি কি রুনিকে সন্দেহ করেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সামিহা মোটেই সময় নিল না।

-অবশ্যই সন্দেহ করি। আপনি এইমাত্র যে ছবিটা দেখছিলেন, সেটা আমাদের চার বছর আগের বিয়ে বার্ষিকীর। আমাদের গ্রুপ ছবি দেখে আপনাদের মনে হতে পারে একান্নবর্তী পরিবার হিসেবে আমাদের খুবই সুখের সংসার ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই রাতে রুনি আর ফাইয়াজ অকথ্য ভাষায় আমাদের সাথে ঝগড়া করেছিল। আমার শ্বাশুড়ি ওদের পক্ষ নিয়েছিলেন।

-আপনার স্বামী তো চার বছর ধরে তৈয়ব শামসের সাথে ব্যবসায় আছে বললেন। ফাইয়াজ কি একাই আপনার শ্বশুরের ঠিকাদারি ব্যবসা সামলাত?

-এই ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়েই যত গণ্ডগোল শুরু। ফাইয়াজ আমার সহজ সরল স্বামীকে ঠকিয়ে ব্যবসার লাইসেন্স নিজের নামে করে নেয়। এই কুট বুদ্ধির পেছনে রুনি দায়ী। ব্যবসা আর টাকা পয়সার সমস্ত কিছু ফাইয়াজ দখল করে নেয়। বুঝতেই পারছেন, আমাদের কী ভয়ানক দুঃসময় গিয়েছে সেই সময়। আমার নামে একটা প্লট ছিল বসুন্ধরায়। আমার আব্বা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্লট বিক্রি করে আবরারকে এক কোটি টাকার ব্যবস্থা করে দেই। ও এই টাকা নিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করেছিল।

(চলবে।)

গোয়েন্দা গল্প

#চক্রব্যুহ

[ছয়]

সামিহা অবন্তীকে বেশ বিচলিত দেখা গেল। একটু ছটফট ভাব। স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা? এতগুলো টাকা কোন স্ত্রী তার স্বামীকে ব্যবসার জন্য দেবে, এটা অবিশ্বাস্য। তবে যে তার পার্টি করে বেড়ানো? বাইরে রাত কাটানো? আরিফের ঠিক মাথায় ঢুকছিল না এসব। হাসিব এই সময়ে আরিফের কানে কানে কিছু একটা বলল।

-আপনার সাথে কথা বলে আমরা এই বাড়িটা একটু ঘুরে দেখব। তারপর নিচে যেয়ে ড্রাইভার, দারোয়ান আর কাজের মেয়ের সাক্ষাৎকার নেব। আপনার কোন আপত্তি নেই তো?

-না না। কোন সমস্যা নেই।

আরিফকে ইশারা করতে চার পাঁচটি ছবি মোবাইলে তুলে নিচে তাদের নাম লিখে নিল। কয়েকজনের ফোন নম্বর পাওয়া গেল সামিহার কাছে।

-রুনি ম্যাডামের বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর পাওয়া যাবে?

-হ্যা হ্যা। এই যে ফাইয়াজের একটা কার্ড দিচ্ছি। এখানে বাড়ি কাম অফিসের ঠিকানা আছে। ফোন নম্বরটি সেভ করে নিন।

মোবাইল নম্বর সেভ করে নিল আরিফ। কার্ডের একটা ছবি তুলে নিল। বাড়ির ঠিকানা মনিপুরি পাড়া। হাসিব উদ দৌলার কপালে গভীর ভাঁজ ফুটে উঠেছে। কিছু একটা বিষয় তাকে বেশ ভাবাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

-এটা কি রুনিদের নিজেদের বাড়ি? মানে রুনিদের বাবার বাড়ি?

-না, এখানে ফাইয়াজ ফ্লাট কিনেছিল। ওর ঠিকাদারি অফিস একই বিল্ডিং এর দুই তলায়।

-ঠিকাদারি ব্যবসা কে দেখাশোনা করেন? এখনো আছে সেই ব্যবসা?

-আছে। রুনি নিজেই ব্যবসা দেখছে।

-আপনার স্বামী কি ফাইয়াজ হারিয়ে যাবার পরে পৈত্রিক ব্যবসা ফিরে পেতে চায়নি?

-ওই বদ মেয়েটা ফাইয়াজ নিখোঁজ হবার আগেই সব কিছু নিজের নামে লিখে নিয়েছিল। এমনকি ফ্লাটটিও!

-হুম। মনে হচ্ছে রুনি ম্যাডাম বেশ বৈষয়িক। একটু প্রসাঙ্গান্তরে যাই। এই বাড়িটি কার নামে?

একটু চমকে গিয়েছিল সামিহা।

-এই বাড়িটা আমার নানা শ্বশুরের ছিল। উনি আমার শাশুড়িকে লিখে দিয়েছিলেন। এখনো আম্মার নামেই আছে।

-আপনাদের শ্বশুর বাড়ির আর কোন প্রোপার্টি?

-শান্তিনগরে তিনতলা একটা বাড়ি আছে।

-ঠিকানাটা?

সামিহা ঠিকানা বলতে আরিফ নোট করে নিল।

-বর্তমানে কি ভাড়া চলছে? বাড়িটা কার নামে?

-হ্যা ভাড়া চলছে। বাড়িটা আমার শ্বশুরের নামে ছিল।

-ছিল বলতে?

-এখন দু ভাইয়ের নামে। ফাইয়াজের অংশ রুনি ডেভলোপারদের দেয়া নিয়ে আবরারের সাথ বেশ গণ্ডগোল হয়েছে।

-কতটুকু জায়গার উপর বাড়ি?

-দশ কাঠার উপর।

আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল হাসিব। আরিফ মনোযোগ দিয়ে নোট টুকে রাখছিল। হাসিবের হঠাত করে নতুন প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য একবারের জন্য তাকিয়েছিল সামিহার দিকে। বেশ বিরক্ত মনে হচ্ছে উনাকে। নিশ্চয় আশা করেনি ডিবির অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র পুলিশ ইনস্পেক্টর তাকে এত জেরা করবে।

-আপনার কী মনে হয়? আপনার শাশুড়ি কোন ছেলেকে বেশি ভালোবাসতেন?

-উনি আগাগোড়াই ফাইয়াজকে ভালোবাসতেন। দেখেননি, উনি ফাইয়াজের হারিয়ে যাবার পেছনেও আবরারকে দায়ী করেন?

-আপনার চাকরি কেমন চলছে? কোন ভিজিটিং কার্ড?

কাঁধে ঝোলানো পার্স টেবিলের উপর রাখা। বেশ ছোট সাইজ। মোবাইল ফোন রাখার পরে আর বিশেষ জায়গা থাকবে বলে মনে হয় না। সেখান থেকে একটা কার্ড বের করে হাসিবের হাতে তুলে দিল সামিহা।

-ভালো। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হওয়াতে কিছু সুবিধা আছে। ছুটির এপ্লাই করেছিলাম আবরারকে খুঁজে না পাওয়ায়। পনেরদিনের ছুটি পেয়েছি।

-বেশ ট্যুরে থাকতে হয় মনে হয় আপনাকে?

-কী করে বুঝলেন?

-ওয়ান অফ দ্যা ডিরেক্টর ইজ নোউন টু মি।

-আচ্ছা।

সামিহা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। এমনকি ডিরেক্টরের নামও জানতে চাইল না। আরিফ খেয়াল করল ব্যাপারটা।

আবার প্রসঙ্গ বদলালেন হাসিব।

-আপনি কাউকে সন্দেহ করেন আপনার স্বামীর অন্তর্ধান নিয়ে?

সামিহার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্নটি করলেন হাসিব। সামিহা একবার ডাইনে বামে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, রুনি আমার এক নম্বর সন্দেহের লিস্টে। এরপর ওর বন্ধু তৈয়ব শামস।

-খালাম্মা এক ছেলের নাম বলছিলেন। বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন! মাসুদ নাম। কী কারণে এসেছিল মনে করতে পারবেন?

-হ্যা হ্যা। মনে পড়েছে। কিন্তু আম্মা তো ওদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন!

-দারোয়ান আর ড্রাইভার?

-ঠিক জানি না।

-ড্রাইভার সেদিন সারাদিন কোথায় ছিল?

একটু ভাবল সামিহা। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। হাসিব ঠিক শুনতে পায়নি।

-স্যরি! শুনতে পাইনি!

-সকালের দিকে আমি ওকে নিয়ে নিউমার্কেট গিয়েছিলাম মাসের শুকনো বাজার করতে। ভালো কথা মনে করিয়েছেন। সাধারণত দুপুরে খাবারের পরে ও দারোয়ানের রুমে ঘুমোত। বিকেলের দিকে কোন প্রয়োজন হলে গাড়ি বের করতে বলতাম। আম্মাও মাঝে মাঝে এদিক সেদিক যেতেন। কিন্তু যতটুকু মনে পড়ে সেদিন বিকেল চারটার দিকে ওকে একবার খোঁজ করেছিলাম। দারোয়ান কবির বলেছিল ও বাড়িতে নেই। কোথায় যেন গেছে! কোথাও গেলে জানিয়ে যেত। সেদিন সে না জানিয়ে চলে গিয়েছিল।

-ড্রাইভার বেলায়েত কি ঢাকায় থাকে? ওর পরিবার?

-ওর পরিবার বরিশালে থাকে। ও রায়ের বাজারের দিকে এক মেসে থাকে।

-ওকে ফোন করেছিলেন সেদিন আর?

-রাতে যখন আবরারকে ফোনে পাচ্ছিলাম না, তখন একবার ওকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ও ফোন ধরেনি। স্পষ্ট মনে আছে রিং হয়েছিল! আমি এত টেনশনে ছিলাম আবরার ফিরে না আসাতে। ড্রাইভারের কথা আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম।

খুব যুক্তিযুক্ত মনে হলো না কথা। কিন্তু হাসিব সেটা বুঝতে দিল না।

-আবরার সাহেবের কি লোন ছিল কোথাও। ব্যক্তিগত কারো কাছে। বা ব্যাংক এ?

-আমি আসলে অতকিছু বলতে পারছি না। ওর বিজনেসের জন্য টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় কী হচ্ছে আমাকে ও শেয়ার করত না। তবে বেশ কিছুদিন আগে শুনেছিলাম ব্যাংক লোনের কিস্তি ঠিকমত দিতে পারছে না। সেটা কী ওদের কোম্পানির নাকি ওর ব্যক্তিগত সেটা বলতে পারছি না। শান্তিনগরের বাড়ি নিয়েও কী সব ঝামেলা চলছিল। রুনি এ ব্যাপারে ভাল বলতে পারবে।

-খালাম্মার কাছে পার্টি নিয়ে শুনেছি। আপনি কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।

এই সময়ে সামিহার চোখে মুখে স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ ফুটে উঠতে দেখা গেল। কিছুটা বিরক্তও হয়েছে বলে মনে হলো।

-ওহ! আম্মা তাহলে এসব নিয়ে আলোচনা করে ফেলেছে! না, আমি আর ওই বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।

-পার্টিতে কি জুয়া খেলা হত?

-কয়েক স্টেক খেলা হত। আপনারা হয়ত শুনেছেন গত কয়েক মাস আমি আবরারের এই সো কল্ড পার্টি এটেন্ড করতাম না। বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে যে হ্যাংলাপনা চলত, সেটা স্ত্রী হিসেবে আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। গত দুই তিন মাসে কেমন স্টেকে খেলা হত জানি না। তবে এরা খুব বড় স্টেকেই খেলতে পছন্দ করত।

-আপনার স্বামী কি জুয়া ভাগ্য কেমন?

একটু ডাইনে বামে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কিনা। এতক্ষণে ভাল করে কান পাততে ওরা শাশুড়ির ঘর থেকে হাল্কা সুরে করান তেলাওয়াত শুনতে পেল।

-সাত আটদিন আগে এক রাতে বেশ মাতাল ছিল আবরার। বিছানার উপর দাঁড়িয়ে পাগলের মত হা হা করে হাসছিল!

-ইন্টারেস্টিং! তারপর?

আরিফ যদিও ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে পেল না। মদ খেয়ে মাতাল এক লোক হাসবে না কাঁদবে, সেটায় ইন্টারেস্টিং কী থাকতে পারে!

-বলছিল সায়মানকে আজ লুটে নিয়েছি! পাশের ঘর থেকে আম্মা শব্দ পাচ্ছিলেন। “কী হয়েছে বৌমা করে কয়েকবার” জিজ্ঞেসও করেছিলেন উনি। আমি ওকে টেনে হিঁচড়ে শুইয়ে দিয়েছিলাম। পরে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি কী ঘটেছিল সেই জুয়ার আসরে।

-সায়মনের ফোন নম্বর পাওয়া যাবে?

-আমার কাছে নেই। তবে শামস তৈয়বের কাছে পেতে পারেন। উনারা কমন ফ্রেন্ড ছিলেন।

হঠাত করেই দাঁড়িয়ে পড়ল হাসিব।

-থ্যাংকস সামিহা। চলুন নিচে যেয়ে ওদের সাথে একটু কথা বলি।

-চলুন।

সামিহা উঠে দাঁড়িয়েছে।

-খালাম্মা মনে হয় কোরান তেলাওয়াত করছেন?

-হ্যা, আম্মা আসরের নামাজের পরে কোরান শরীফ নিয়ে বসেন। আমি বলে দেব উনাকে।

নিচে নামতেই সামিহা সিঁড়ির পাশের দেয়ালে এক সুইচ টিপে দিল। “ওরা ড্রাইভার বেলায়েতের রুমে আছে। কলিং বেল চেপে দিলাম। আপনারা বসুন। ওরা চলে আসবে।“

-অনুমতি দিলে নিচ তলার কয়েকটা ছবি তুলে নেব।

সামিহা কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। আরিফকে ইশারা করতে ও মোবাইল ফোনে চারিদিকের ছবি তুলে নিল।

ড্রাইভার বেলায়েত সামনের দরোজায় নক করেই ঢুকে পড়ল, ওর পেছনে পেছনে দারোয়ান কবির আর কাজের মেয়ে শরিফা ঢুকল।

(চলবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here