চক্রব্যুহ,০৭,০৮

0
148

#চক্রব্যুহ,০৭,০৮
মোহাম্মদ মনোয়ার
[সাত]

-হ্যালো কলাবাগান থানা?

-স্যার আপনি! এতদিন পরে!

-কে আজিম?

-জ্বী স্যার। আমি জানতাম আপনি আমার গলা শুনেই চিনতে পারবেন। স্যার কেমন আছেন?

-ভালো আছি আজিম। এই নম্বরটা ওসি প্রদীপ ব্যবহার করত না?

-ঠিকই বলেছেন স্যার। ওসি স্যার মিটিং এ। আমার পাশেই আছেন। স্যার অনেকদিন আপনার সাথে দেখা নাই। চলে আসুন থানায়।

আট নয় মাস আগে একটা কেসে সাব ইনস্পেক্টর আজিমুল করিমের সাহায্য নিয়েছিলেন হাসিব উদ দৌলা। চট্টগ্রাম পোর্টে একটা চোরাই চালান এসেছিল বেনামে। ওকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছিল আজিম।

-আজিম, আমি আসছি। কিন্তু কাজ করে দিতে হবে ভাই।

-স্যার কী কাজ বলুন। এখুনি রেডি করে রাখছি।

-“xx” কলাবাগান বশির উদ্দিন রোডের আবরার হোসেন আর তার স্ত্রী সামিহা অবন্তীর বিষয়ে কিছু খোঁজ চাচ্ছিলাম।

-স্যার! আমিই ভদ্র মহিলার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছিলাম। কী জানতে চাইছেন বলুন স্যার।

-এই দুজন আর ওই বাড়ির অন্যদের নিয়ে একটু ডিটেলস জেনে আমার জন্য রেডি রেখ। এক ঘণ্টা পরে আসছি।

-শিওর স্যার। ওই বাড়ি নিয়ে অনেক গল্প আছে। থানায় জয়েন করেই প্রচুর গল্প শুনেছি। আপনি চলে আসুন স্যার। আমরা আছি এখানে।

ফোন কেটে পাশে বসা আরিফের দিকে তাকালেন হাসিব। ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। গন্তব্য শান্তিনগর।

-স্যার। ড্রাইভার ছেলেটা তো পুরাই বদের বদ। প্রতিটা প্রশ্নের বাঁকা উত্তর দিল!

বলেই একটু হাসার চেষ্টা করেছিল আরিফ। আনমনা হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন হাসিব। রিয়ার ভিউ মিররে পেছনে একবার দেখে নিলেন।

-সে যে আস্ত বদ সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তোমার কি ওকে সন্দেহ হয়?

-কী বলেন স্যার! অবশ্যই হয়। ছেলেটা তো একটা আস্ত বাটপাড়। এত অল্প বয়সে বিয়ে করে তিন তিনটা মেয়ের বাবা। ভেবে দেখেছেন স্যার ও সংসার খরচ কী করে চালায়? নিশ্চয় দুই নম্বরি করে। গাড়ি তো সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকে। আমার মনে হয় ও ভাড়ায় গাড়ি চালায়। তেল চুরি করে।

-কিন্তু গাড়ি তো ধুলায় ধুসরিত দেখে আসলাম আরিফ।

-শুনলেন না স্যার বছিলাতে গত পরশু দুই কাঠা জায়গা রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে? এত টাকা কোথায় পেল সে? আমার তো মনে হয় মুক্তিপণ বাবদ টাকা পেয়েছে!

-মুক্তিপণ কার কাছে চাইবে? তার পরিবারের কাছেই তো? সামিহা বা খালাম্মা তো এমন কিছু বললেন না।

-স্যার, আমার মনে হয় আবরার সাহেবের আরেক বউ আছে। ওই যে সাফোয়ান না কী যেন নাম? উনার কাছে চাইতে পারেন। ড্রাইভার বেলায়েত অবশ্যই জানে আবরার হোসেনের সব কিছু। জানেন তো স্যার, ড্রাইভারেরা বাড়ির চর হয়। সব খবর তাদের কাছে পাওয়া যায় স্যার। আমার তো মনে হয় সাফোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক কিছু জানা যাবে!

-সাফোয়ানের ফোন নম্বর আছে না তোমার কাছে? নিয়েছিলে?

-হ্যা স্যার। নিয়েছিলাম। মোবাইলে সেভ করা আছে।

-একটা ফোন দাও। তোমার নিজের মত করে প্রশ্ন কর। আমি একটু ভাবি বিষয়টা নিয়ে।

এরপর একেবারেই চুপ করে গেলেন হাসিব। আরিফ জানে স্যার ওর কথার কোন গুরুত্বই দেননি। মুখে মুখে বলে গেছেন। অথচ ভাবছেন অন্য কিছু।

দারোয়ান কবির ওই বাড়িতে আছে বিশ বছরের বেশি সময় ধরে। খুবই বিশ্বস্ত। কথা বার্তায় খুবই সহজ সরল। তবে কাজের মেয়ে রানুকে বেশ চালাক মনে হয়েছে। অনেক কিছু গোপন রাখছিল। কেন গোপন রাখতে চাইছে? রুনিকে রানু এবং বেলায়েত বেশ পছন্দ করে বলে মনে হলো। সামিহার সামনে অবশ্য চেষ্টা করছিল লুকাতে। কিন্তু আরিফ ঠিকই বুঝে গেছে। সাফোয়ান নামের মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে চব্বিশ পঁচিশ হবে। হাত ব্যাগ থেকে তার তিনটি ছবিটি বের করে খুঁটিয়ে দেখল। হাল্কা পাতলা গায়ের গড়ন। গায়ের রঙ শ্যামলা। শ্যামলা হলে কী হবে, চোখে মুখের উজ্জ্বলতায় সে অপরূপ রূপসী। একহারা মুখ। মাথা ভরা দীঘল কালো চুল। স্ট্রেইট করা। সামনে ব্যাং, নাক অবধি একরাশ চুলের আনাগোনা। সামিহার মতে সাফোয়ান একজন ফুল টাইম প্রস্টিটিউট। একা এক ফ্ল্যাট নিয়ে নিকুঞ্জ দুই এ থাকে। তার বিশ্বাস সেই ফ্লাটের ভাড়া এবং সংসার খরচ আবরারই চালাত। কথাটা সত্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বয়সী একটা মেয়ে কোন চাকরি বাকরি না করে একা এক ফ্লাট ভাড়া নিয়ে কী করে থাকছে? নিজেকে যদিও র‍্যাম্প মডেল হিসেব পরিচয় দেয়। টিভি বা মুভিতে এখনো আসেনি। হয়ত খুব শিগ্রি নাম লেখাবে। অনেক পুরুষের সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক আছে এ ব্যাপারে আরিফ নিশ্চিত। ওর তীব্র সন্দেহ এই মেয়েটিকে নিয়ে। অথচ হাসিব তার কথা পাত্তাই দিতে চাইছে না। সাফোয়ানকে ফোন দিতেই এক রিং এ ফোন উঠালো।

-হ্যালো কে বলছেন?

নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত পরিচয় দিল না আরিফ। মনের খবর জানতে এটুকু মিথ্যের আশ্রয় নিতেই হলো।

-আমি পুলিশের ইনস্পেক্টর আরিফ উজ জামান বলছি। আপনার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলা যাবে?

ও পাশে নিরবতা। নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ে যাওয়া মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আরিফের চোখ মুখ মৃদু হাসিতে ভরে উঠল। প্রায় মিনিট খানেকের বিরতি নিল মেয়েটি। হয়ত নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে।

-আবরার সাহেব যে নিখোঁজ আপনি কি জানেন?

-হ্যা। ওকে তো ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না অনেকদিন হলো। আমাকে কি সন্দেহ করছেন?

আরিফের মনে হলো মেয়েটি আবরার সাহেবের নিখোঁজ সংবাদ ভালোভাবেই জানে এবং সে নিজেই কোন ভাবে জড়িত!

-আরে না! কী বলেন! সামিহা ম্যাম থানায় মামলা করেছেন। আমার উপর তদন্তের ভার পড়েছে। আপনার নম্বর মামলার এজাহারে উল্লেখ করা ছিল। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ফোন দেয়া।

গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কথা বলছিল আরিফ। ওপাশে আবার কয়েক মুহুর্তের নিরবতা।

-বলুন কী জিজ্ঞেস করতে চাইছেন? কিন্তু আইনগত কিছু হলে আমি কিন্তু উত্তর দেব না। সে ক্ষেত্রে আমার উকিলের সাথে কথা বলতে হবে আপনার।

-না না ম্যাডাম। তেমন কিছু জিজ্ঞেস করব না। আবরার সাহেবের সাথে আপনার শেষ দেখা কবে হয়েছে?

-দেখা? হুম…এই তো আটদিন আগে আমার এখানে এসেছিল অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে।

-পনের তারিখ থেকে উনি নিখোঁজ। মানে তার নিখোঁজ হবার তিনদিন আগে আপনার সাথে শেষ দেখা। তাই তো?

-হতে পারে। পাঁচদিন আগে নিখোঁজ হয়েছে?

অভিনয়টা ভালোই জানে সাফোয়ান নামের মেয়েটি। আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে।

-কেন ম্যাডাম! আপনার সাথে প্রতিদিনের যোগাযোগ ছিল না তার?

-আপনার কেন মনে হচ্ছে তার সাথে আমার প্রতিদিন যোগাযোগ হত!

-ম্যাডাম, উনার মোবাইল ফোন আমাদের কাছে আছে। হোয়াটসএপে আপনাদের প্রতিদিন পাঁচ ছয় ঘণ্টা করে কথা হত। চ্যাট হত।

একেবারেই অন্ধকারে ঝোপের উপর কোপ মারা যাকে বলে! টোপটা কাজে লেগেছে! বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। আমতা আমতা করছে সাফোয়ান।

-সত্যি বলুন তো উনার সাথে আপনার শেষ কবে দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে?

এবার আর সময় নিল না মেয়েটি।

-ও যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল। সেদিন ওর বিয়ে বার্ষিকি ছিল। আমি মানা করেছিলাম আসতে। কিন্তু শুনছিল না। অফিস থেকে বের হবার আগে একবার কল দিয়েছিল।

-এরপর?

-উত্তরা থেকে এখানে আসতে আধা ঘণ্টার বেশি ওর লাগত না। সেদিন এক ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলেও ও আসেনি দেখে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ পাই।

-হুম। সামিহা বা ও বাড়ির কাউকে এর মধ্যে জিজ্ঞেস করেননি?

-না। বুঝতেই পারছেন আমার পক্ষে ও বাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করাটা সমীচীন হতো না। আমি নিজেই বিভিন্ন সোর্সের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারা কেউ আবরারের নিখোঁজের ব্যাপারে কিছু জানে না।

-তৈয়ব শামসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন?

হাওয়াতে বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে আরিফ। টোপ ভালোই কাজে দিচ্ছে!

-হ্যা। উনি কিছু বলতে পারেননি। আপনার নাম ইনস্পেকটর আরিফ না কী যেন বললেন?

-হ্যা। আমি আরিফ বলছি।

-দেখুন আরিফ সাহেব। আমি আর কোন প্রশ্নের উত্তর দেব না।

-সমস্যা নেই ম্যাডাম। আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রেখে দিচ্ছি তাহলে। সমন নিয়ে গ্রেফতার করে দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে নেব। তখন দেখা হবে আমাদের। ভালো থাকবেন।

বলেই খট করে ফোন রেখে দিল আরিফ। হাসিবের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মিটিমিটি হাসছে।

-স্যার হাসছেন!

-এই জন্যই তোমাকে আমার এত পছন্দ আরিফ। ভালোই ঘোল খাইয়েছ মেয়েটিকে। অল্প বয়স। খারাপ সংসর্গে বখে গিয়েছে। বাস্তবতা কী জিনিস টের পাবে আর কিছুদিন পর।

-স্যার। চারিদিকে এত ঘটনা ঘটছে। এসব দেখে এরা নিজেদের শুধরে নেয় না কেন সেটাই বুঝতে পারছি না। কদিন আগেই বারিধারা গ্রুপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আনহাজের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে নরসিংদীর মেয়ে ফারহা মারা গেল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অথচ টাকার বিনিময়ে সেই কেস আত্মহত্যা মামলায় চলে গেল। এসব দেখেও কি এসব মেয়েরা সাবধান হতে পারে না স্যার?

হাসিব উত্তর দিতে মুখ খুলেছিল। কিন্তু আরিফের ফোনের বিকট রিং টোনে থামতে হলো।

-আরিফ, তুমি তো আমাকে হার্ট এটাক করাবা! সেদিনও বললাম রিং টোন বদলাও। ধর ফোন। মেয়েটিকে আরো একটু ঘোল খাওয়াও। আর, কল শেষ হবার সাথে সাথেই রিং টোন বদলে ফেলবে!

“জ্বী স্যার” বলেই ফোন রিসিভ করল আরিফ।

-হ্যালো ইনস্পেক্টর আরিফ বলছেন?

সাফোয়ানের ফোন। আরিফ ভেবেছিল মেয়েটি কল ব্যাক করবে। কিন্তু এত দ্রুত করবে সেটা ভাবতে পারেনি। অথচ হাসিব ঠিকই বুঝে গিয়েছিল সাফোয়ানেরই ফোন এটা। একটু অবাক হয়েছিল শুনে।

-হ্যা বলছি। বলুন।

-আপনার সাথে মুখোমুখি দেখা করা যাবে? আমার কিছু কথা বলার ছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার! প্লিজ হেল্প মি!

(চলবে।)

#চক্রব্যুহ

[আট]

শান্তিনগরের বাড়িটা খুঁজে পেতে সময় লাগল না বেশি। মূল সড়কের পাশেই উঁচু দেয়াল ঘেরা একটি চারতলা বাড়ি। বাড়িটির এক অংশ ভাঙ্গা। ভাঙ্গা অংশের দিকের দেয়ালের ওপর বেশ নাম করা এক ডেভলপার কোম্পানির সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। দেয়ালের এই অংশে নতুন একটা করোগেটেড স্টিলের গেট দেখা যাচ্ছে। নির্মান সামগ্রী আনা নেয়ার জন্য বানানো হয়েছে। সাইন বোর্ডে দেখা যাচ্ছে এগারো তলা হাই রাইজ কমার্শিয়াল কাম এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হচ্ছে এখানে। যেমন ভেবেছিল হাসিব। এই বাড়ি ঘিরে দুই ভাইয়ের মধ্যে ভালোই সমস্যা চলছিল। এই বাড়িটির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল কি? সাবিহা অবন্তী ভালোই চেপে গেছে বাড়িটার ব্যাপারে। ইতোমধ্যে ডেভলপার কোম্পানি কাজ শুরু করে দিয়েছে এমনটা সে বলেনি। ফাইয়াজ নিখোঁজ দুই বছরের ওপর। রুনি একাই সব করছে! চিন্তিত হয়ে ভাবছিল আরিফ। রুনি ম্যাডাম হয়ত সাহায্য করতে পারবে এখানে ঠিক কী হচ্ছে। হাসিবের কথায় বাস্তবে ফিরে এল আরিফ।

-আরিফ, তুমি দারোয়ানকে পুলিশের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো দু ভাই সম্বন্ধে কতটুকু জানে। ডেভলপার কোম্পানির শ্রমিক বা দারোয়ান বা অন্য কেউ কিছু বলতে পারবে না। তুমি রুনিদের অংশের দারোয়ানের সাথে কথা বলবে। আর ডেভলপার কোম্পানির ফোন নম্বর টুকে নাও। আমি আশেপাশে খোঁজ নিয়ে আসছি। পনের মিনিট সময় পাবে তুমি। গো।

বিশাল রট আয়রনের গেট। এক পাশে ছোট কেচি গেট। লোক চলাচলের জন্য। কাউকে গেটের আশেপাশে দেখা গেল না। দেয়ালে খুঁজে পেতে কলিং বেল চেপে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লুঙি পরা কাউকে এদিকে আসতে দেখা গেল।

-কাকে চাই?

সাদা পোষাকের পুলিশের মত ওয়ালেট বের করে ফাঁক করে দেখাল। চাকরিকালীন পরিচয় পত্র। দারোয়ানের পক্ষে বোঝার কথা নয় পরিচয়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ডান হাত তুলে সালাম দিয়ে তড়িঘড়ি করে গেট খুলে দিল।

-আমি ভেতরে যাব না। আপনি দরোজার ওপাশ থেকেই কথা বলতে পারেন।

দারোয়ান শ্রেণি সাধারণত “আপনি” শুনতে অভ্যস্ত না। এই দারোয়ানের অভিব্যক্তিতে দ্বিধা আর সংশয় দেখা গেল।

-স্যার। কী হইছে কিছুই তো জানি না। এই বাড়িতে কিছু হয় নাই। সেইটা বলতে পারি স্যার।

-বাড়ির মালিকের নাম জানেন?

-স্যার এইখানে দুইটা বাড়ি। আপনি কি এই বাড়ির মালিকের নাম জিগাইছেন?

-বেশি চালাকি করবেন না। আমি জানি এই বাড়ির দুই অংশ। এই অংশের মালিক কে?

-স্যার এই অংশের মালিক তো আবরার স্যার। ওই যে ভাঙছে যেটুকু, সেইটার মালিক রুনি ম্যাডাম।

-কেন? পুরো বাড়ি তো দুই ভাইয়ের নামে। রুনি ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। সে কীভাবে এই বাড়ির মালিক হবেন?

-স্যার। বড়লোক মানুষগো আমরা কী আর বুঝমু? দুই ভাই আজিব কিসিমের ছিল। সম্পত্তি ভাগাভাগি করার নামে নিজেরা নিজেরা মারামারি কইরা দুই ভাই ই মরল।

-মরল মানে? আবরার সাহেব আবার কবে মারা গেলেন?

-কন কী স্যার। এই যে হুনলাম উনি মইরা গেছেন গাড়ি এক্সিডেন্টে!

-গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছেন মানে? কার কাছে শুনলেন?

-ভাড়াটিয়ারা বলাবলি করতেছে।

হাত ঘড়ি দেখল আরিফ। হাসিব উদ দৌলার পনের মিনিট মানে পনের মিনিট। হাতে সময় নেই। খুব চাইছিল ভাড়াটিয়াদের সাথে একটু কথা বলে আসবে।

-ফাইন। ভাড়াটিয়ারা কোথা থেকে শুনল? সত্য কথা না বললে থানায় নিয়ে ডলা দিতে বাধ্য হব কিন্তু।

এবার বেশ জোড়ে একটা ধমক দিল আরিফ। দারোয়ান সোজা দাঁড়িয়ে আবার স্যালুট দিল!

-স্যার। রুনি ম্যাডাম কাউরে কিছু বলতে নিষেধ করে দিছেন।

ও! এই খবর! রুনি ম্যাডাম তাহলে নিজেই এসে খবরটা সবাইকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন! আবরার হোসেন এক্সিডেন্টে মারা গেছেন? মানে কী! আশ্চর্য! ভাবনার মাঝেই অতি পরিচিত শিসের শব্দে পেছনে ফিরে তাকিয়েছে আরিফ। হাসিব উদ দৌলা ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। ইশারা দিয়ে গাড়িতে উঠতে বললেন। আরিফ বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিলেন হাসিব।

-কী শুনলে আরিফ?

-স্যার। এই বাড়ির দারোয়ান তো বলছে দুই ভাই ই নাকি মারা গেছে!

-হুম! আমি সেই রকমই ধারণা করেছিলাম। আর কী শুনলে?

-আবরার সাহেব নাকি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।

-হুম। এটাও ধারণা করেছিলাম। রুনি এমনটাই ছড়িয়েছে। তাই না?

স্যারের এমন মন্তব্যে অবাক হলো না আরিফ। অনেকদিন ধরে এই তুখোড় বুদ্ধিমান মানুষের সাথে কাজ করছে। ইন্টিউশন বা অন্য কোন যাদুমন্ত্রে স্যার ঠিক কীভাবে কীভাবে যেন টের পেয়ে যায় মনের ভাবনা। শুধু মাথা উপর নিচে করল।

-স্যার, আমরা কি এখন কলাবাগান থানার দিকে যাব?

-না। আমরা রুনি ম্যাডামের বাসায় যাচ্ছি। ফোন করেছিলাম। বেশ উৎফুল্ল মনে হলো আমরা যাচ্ছি শুনে। বেশ ইন্টারেস্টিং হতে যাচ্ছে মিটিংটা।

আচ্ছা। স্যার তাহলে ওকে দারোয়ানের সাথে কথা বলতে পাঠিয়ে রুনি ম্যাডামের সাথে কথা বলেছে? নাকি অন্য কিছু করেছে? অন্য কিছুর খোঁজ করেছে? রুনি দুই ভাইয়ের মৃত্যুর কথা প্রচার করে দিয়েছে। কেন? কী তার উদ্দেশ্য? ফায়দা লুটতে চাইছে কি সে? নাকি শুধু হিংসা, দ্বেষ, রাগ আর অপছন্দ থেকে এই কথা রটিয়েছে? এমনও তো হতে পারে, সে সত্যিই জানে কী ঘটেছে আবরারের সাথে। হয়ত সত্যিই সে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে! অথবা সে নিজেই হয়ত তাকে গুম করে হত্যা করেছে সম্পত্তি দখলে নিতে!

ফাইয়াজের নিখোঁজ হবার পরে এই কয়েক বছরে রুনি নিজেকে প্রমাণ করেছে সে একাকী ব্যবসা সামলাতে পারে। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সামিহা অবন্তীর চেয়ে ওর অনেক বেশি। সাথে ওর ব্যক্তিত্ব আন প্যারালাল। শাশুড়ি বা ওই বাড়ির দারোয়ান, ড্রাইভার বা কাজের মেয়ের কাছেও রুনি বেশি গ্রহণযোগ্য। ওর স্বামী নিখোঁজ আজ দীর্ঘদিন। একা একা সংসার এবং ব্যবসা সামলাতে পারে যে নারী, সে অবশ্যই খুব শক্ত ধাঁচের। মানুষকে সম্মোহিত করার ক্ষমতা ওর স্বভাবজাত। ঠিকাদারি ব্যবসার মত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবসায় প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা এটাই প্রমাণ করে। আবরার সাহেব যদি সত্যিই তার স্বামীর মত নিখোঁজ হয়ে পড়েন বা মারা যান, রুনির ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা করলে সবচেয়ে সুবিধাভোগী সে ই হবে। আরিফের মাথায় জেঁকে বসেছে ভাবনাটা। কিন্তু হাসিব উদ দৌলার কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ল।

-আরিফ, নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আবরার সাহেব নিশ্চিত বড় কোন ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেটা কি পারিবারিক দ্বন্দ্ব নাকি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নাকি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নাকি পরকীয়ার দ্বন্দ্ব নাকি অন্য কোন কারণ? নাকি জুয়াড়িরা তাকে সরিয়ে দিয়েছে টাকা খুইয়ে? নাকি উনার আম্মার মতে অশুভ কিছুর হাত আছে! আসলেই কি এমন কোন কিছু আছে যার জন্য একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে ওই পরিবারে? কিসের জন্য তাকে হারিয়ে যেতে হলো? তার এই হারিয়ে যাওয়ায় কে বেশি সুবিধা পেল? উদ্দেশ্য বল আর মোটিভ। কে পেছনে আছে?

-স্যার, এই কথাগুলো আমিও ভাবছি। এই বাড়িতে আসার আগ পর্যন্ত সাফোয়ানকে সন্দেহ করছিলাম। এখন তো রুনি ম্যাডামকে সবচেয়ে সুবিধাভোগী মনে হচ্ছে। এক আবরার হোসেনের মৃত্যুতে সে অনেক কিছুর মালিক হয়ে যাবে। রুনির মত বুদ্ধিমতি মেয়ের সাথে সামিহা অবন্তী পেরে উঠবেন না। পারিবারিক ব্যবসা দখলে নিয়ে নিয়েছেন। শান্তিনগরের বাড়িও সে দখল করে ফেলবে। আর দেখেই তো আসলাম স্যার, আবরার সাহেবের আম্মা কিন্তু ফাইয়াজ আর রুনিকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। আবরারকে দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না। যে ছেলে এতদিন নিখোঁজ, সেটার জন্য খুব একটা দুঃশ্চিন্তা করতে দেখা যায়নি উনাকে। বরং হারিয়ে যাওয়া বড় ছেলের বিরুদ্ধে এত কিছু কী করে বললেন! আমার মনে হয় স্যার উনার নামে থাকা বাড়ি কোন ক্রমেই সামিহা অবন্তীর মত পার্টি করে বেড়ানো বা পর পুরুষে আসক্ত ছেলে বউকে দিয়ে যাবেন না। উনি রীতিমত সামিহাকে ঘৃণা করেন। রুনির জন্য আলাদা একটা সফট কর্নার আছে উনার। আর ড্রাইভার বলছিল সপ্তাহের বেশীরভাগ দিনে উনি এই বাড়িতে আসতেন। দুই নাতনির সাথে সময় কাটাতেন। কোন কোনদিন ওদের কলাবাগানের বাড়িতে নিয়েও যেতেন। নাতনিদের কথা বললেও বলতে হয় আবরার সাহেবের কন্যা সন্তানের চাইতে ফাইয়াজের কন্যাদ্বয়ের সাথে বেগম গুলজার হোসেন বেশি ক্লোজ।

-ঠিকই বলেছ আরিফ। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, ব্যবসায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি সে কখনোই। শান্তিনগরের বাড়ি ভাড়া দিয়েই সংসার চলত। টাকার দেনায় ডুবে ছিল আবরার সাহেব। জুয়ার বোর্ডে বড় স্টেকে খেলা উনার ছোটবেলার অভ্যাস। খালাম্মা বলেছেন ছোটবেলা থেকেই সে এমন। কয়েকটা স্টেকে জিতে গেলেও সে কিন্তু আলটিমেটলি লুজার। ব্যবসা বল, রাজনীতি বল, বন্ধুত্বে বল, সে একজন বড়মাপের লুজার ছিল। সামিহা অবন্তী পর পুরুষে মজে আছে এটাই প্রমাণ করে দাম্পত্য জীবনেও সে লুজার। এমন কী দীর্ঘদিন নিখোঁজ আছেন, এটা জানার পরেও জন্মদাত্রী আম্মার সাপোর্ট পাচ্ছেন না। তার থেকে বড় লুজার আর কে হতে পারে বল!

ভেবে অবাক হচ্ছে আরিফ। এই কয়েক ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করেই স্যার আবরার হোসেনকে নিয়ে এমন চমৎকার বিশ্লেষণে চলে এসেছেন। তবু ওর মনে ক্ষীণ সন্দেহ। রাজনীতি বা জুয়া বা ব্যবসা বা পারিবারিক বা অন্য কারণে নয়। রুনিই ওর হারিয়ে যাবার জন্য দায়ী।

গাড়ি ফার্মগেট পার হয়ে মনিপুরি পাড়ার গলিতে চলে এসেছে। গলি দিয়ে বেশি দূর যেতে হলো না। পান সিগারেটের এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল। এসেট খান ভিলা। বারো তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। সাইনবোর্ড দেখে মনে হলো বেশ কয়েক ফ্লোরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস এখানে। দারোয়ানকে নিজেদের পুলিশের লোক বলে পরিচয় দিতেই সালাম ঠুকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

-রুনি চৌধুরী কি উনার অফিসে এখন?

-না স্যার। উনার অফিস তো কয়েকদিন ধরে বন্ধ। দুপুরের দিকে বাইরে গিয়েছিলেন। এখন বাসাতেই আছেন।

-কত তলায় ফ্লাট উনার?

-স্যার লিফটের পাঁচ। লিফট থেকে নেমেই ডান পাশের ফ্লাটটি ম্যাডামের।

-আচ্ছা। ঠিক কতদিন ধরে উনার অফিস বন্ধ? কিছু জানো?

-স্যার। তা তো ঠিক মনে নেই।

-তোমাদের ভিজিটর বুক দেখে বল।

আবরার সাহেবের হারিয়ে যাওয়ার সাথে রুনির অফিসের বন্ধের তাহলে কোন কানেকশন আছে? আরিফের মনে সন্দেহ আরো দৃঢ় হতে থাকে। দারোয়ান ভিজিটর লগ বুক নিয়ে এসেছে। কয়েক পাতা উল্টিয়ে একটা তারিখের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। হ্যা, আরিফ যা ভেবেছিল! ষোলো তারিখ থেকে অফিস বন্ধ!

লিফট থেকে নামতে দেখা গেল বাদিকে দুটি ফ্লাট আর ডান দিকে একটি। কলিং বেল চাপ দিতে বাচ্চা একটা মেয়ের গলা শোনা গেল। “কে?” বেশ আদুরে গলা বাচ্চা মেয়েটির। বয়স কত হবে? অনুমান করার চেষ্টা করল আরিফ। সাত? আট? এমন সময়ে দরোজা খুলে এক ভদ্রমহিলা উঁকি দিলেন।

-আপনারাই কি চক্রবুহ্য অফিস থেকে এসেছেন?

-জ্বী। আমি হাসিব উদ দৌলা। আর ও আমার সহকারী আরিফ উজ জামান।

মিষ্টি একটা হাসি ভদ্রমহিলার চোখে মুখে।

-আসুন। আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

দরোজা পুরো খুলে দিলেন এবার। আনুমানিক পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি লম্বা। শরীরের গড়ন বেশ ভারি। কাঁধের একটু নিচে পর্যন্ত স্ট্রেইট করা চুল। গায়ের রং শ্যামলা। উঁচু করে ভুরু প্লাগ করা। এছাড়া চেহারায় আর কোন বিশেষত্ব নেই। আঙ্গুল তুলে ডান পাশের একটা দরোজা দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

আরিফ ভদ্রমহিলাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। সেই অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। আড়চোখে হাসিবের দিকে তাকাল। যথারীতি তার চোখে মুখে কোন পরিবর্তন নেই। কলাবাগানের বাড়ির এলবামে দেখা ছবির সেই রুনি কোন ক্রমেই ইনি হতে পারেন না!

(চলবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here