#চক্রব্যুহ,০৯,১০
মোহাম্মদ মনোয়ার
[নয়]
বিশাল লিভিং রুম। রুচিশীল ফার্নিচার চারিদিকে। এক পাশে ওক কাঠের ওপর মিশরীয় নকশায় করা সোফা সেট, সম্ভবত আমদানী করা। আরেকপাশে ইটালিয়ান ডিভান। অরিজিন্যাল চামড়ায় মোড়ানো। সাথে দেশীয় নকশায় হাতিলের চমৎকার সোফা সেট। একটি টার্কিশ কাঠের দোলনা হাতিলের সোফা সেটের পাশে। লম্বা করে লিভিং রুমের কোণার দিকে পঁচাশি ইঞ্চির সনি টিভি। টিভির দুই পাশে মিশরীয় প্যাপিরাসে বাঁধাই করা দুটি ফ্রেম। তিন পাশের দেয়ালে দেশি বিদেশী নামি শিল্পির অরিজিন্যাল পেইন্টিংস। দরোজা দিয়ে ঢুকতেই উল্টোদিকের দেয়ালে আবরার আর ফাইয়াজের পাশাপাশি দাঁড়ানো পাঁচ ফিট বাই তিন ফিট বিশাল পোর্ট্রেট ছবি। কলাবাগানের বাড়িতে এলবামে দুই ভাইয়ের ছবি দেখে আরিফের সন্দেহ হয়েছিল এরা জমজ ভাই কিনা। এই বিশাল পোর্ট্রেট ছবিতে দুই ভাইকে একেবারেই জমজ বলে মনে হচ্ছে! একই নাক-চোখ-মুখ-ঠোঁট-হাসি। এমনকি ভুরু জোড়াও এক, ঘণ আর কালো!
লিভিং রুম দেখে আন্দাজ করা যায় ফ্ল্যাটটি চার পাঁচ হাজার স্কয়ার ফুটের কম হবে না। আরিফের মুখে হাসি ফুটে উঠল ব্যাপারটা মেলাতে পেরে। লিফট থেকে নেমে বা পাশে দুটো আর ডান পাশে একটি ফ্লাটের মহত্ব আবিষ্কার করে পুলকিত বোধ করছে। ফাইয়াজের বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য ছিল তাহলে! নাকি রুনি নামের রহস্যময়ী এই নারী নিজে ব্যবসার হাল ধরে এই শানশৌকত বৃদ্ধি করেছে? নাকি গোপন কোন চাবিকাঠির ছোঁয়ায় এইসব কিছু। যা অন্যেরা জানে না?
চমৎকার একটা পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে চারিদিক থেকে। কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। তবে বেশ ট্যাংগি নোট। ওয়াই এস এল এর একটা পারফিউমের নাম মনে পড়ে গেল হাসিবের। সেবার দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে ঐশীর জন্য কিনে এনেছিল। ঐশী! নামটা উঁকি দিতেই মিশে গেল মাথার ওপরে জেনেরালের তিন টনের ক্যাসেট টাইপ এসির অতি মৃদু গুনগুন শব্দে। ওদের বসতে বলে ভেতরে চলে গিয়েছে রুনি। দরোজা খুলে দেবার সময়ে রুনির পেছনে যে বাচ্চা মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল, সে এক কোণায় সোফার হাতল ধরে ওদের দিকে একটানা তাকিয়ে ছিল। শিশু মনের জানার আর দেখার আগ্রহ। ফাইয়াজের সাথে ভালো মিল চেহারায়। গোলাপি আর সবুজে মেশানো ফুলেল একটি ফ্রক পরে আছে। খালি পা। বয়স ছয় সাতের মত হবে। আরিফ বেশ কয়েকবার ওকে কাছে ডাকল। মিষ্টি হাসি দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করল। কিন্তু মেয়েটির অবাক দৃষ্টির পরিবর্তন হলো না। বড় বড় চোখ করে ওদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে রইল। কাছে আসল না। ভেতর থেকে ওর মায়ের ডাক শোনা গেল, “অধরা!” আচ্ছা, অধরা নাম! “আসি মা” বলে সে ভেতরে চলে যেতে তের চৌদ্দ বছর বয়সের এক মেয়ে ট্রে হাতে লিভিং রুমে ঢুকল। পোশাকে মনে হচ্ছে এ বাড়িতে রুনির কাজের সহায়তাকারী। টেবিলের উপর ট্রে নামিয়ে চলে যাবে, হাসিব ইশারা করে থামিয়ে দিলেন। প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাত ভর্তি চকলেট বের করে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। আশ্চর্য! চকলেট হাতে পেতেই মিষ্টি একটা হাসিতে ওর চোখ মুখ ভরে উঠল। ফ্রক একটু উঠিয়ে সালোয়ারের কুঁচে চকলেটগুলো গুঁজে নিল। হাসিব আবার ইশারা করতেই মেয়েটি মাথা উপরে নিচে করে ভেতরে চলে গেল।
মেয়েটি চলে যেতেই সোফায় হেলান দিয়ে নিবিষ্ট মনে কিছু একটা ভাবনায় ডুবে গেলেন হাসিব। আরিফের ক্ষুধাবোধ আবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে। কলাবাগানের বাড়িতে তেমন কিছু খেতে পারেনি। খেতে গেলে হাসিবের কথোপকথন থেকে মনোযোগ সরে যাচ্ছিল। তাই দুটো সমুচা আর একটা স্যান্ডউইচে কাজ সেরেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে। কিন্তু ট্রে’র উপরে দুই কাপ গ্রিন টি ছাড়া আর কিছুই নেই। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এত বড়লোকের এত ছোটলোকি দেখে।
রুনি চৌধুরী ওদের বসতে বলে ভেতরে চলে যাবার পর বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে। ছবির সেই লাস্যময়ী লাবন্যে মোড়ানো রুনির সাথে বাস্তবের রুনির কোনই মিল নেই। এক ধাঁধা বটে! কেমন রুক্ষ্ণ খসখসে চেহারা। চোখে মুখে হালকা পুরুষালী ছায়া। ওদের হাসিমুখে ভেতরে আসতে বললেও সেই চোখে একরাশ বিরক্তি চেপে বসা ছিল। আরিফের মনে হচ্ছিল “সামথিং ইজ ভেরি রঙ উইথ দিস উইমেন!”
-আপনাদের বসিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ!
দুজনেই চমকে উঠেছিল। আরিফ তো রীতিমত দাঁড়িয়ে পড়েছে। এ কী! দরোজা খুলে দেয়া সেই নারী আর এই নারী তো এক নয়! গলার স্বর একই, তবে দেখতে মোটেই এক নন! মেক আপ ক্যান মেক দিস মাচ অফ ডিফারেন্স! আরিফের কাছে এই ট্রান্সফরমেশনটা বিশাল ধাঁধা হয়েই রইল। সেই সাথে ওর সন্দেহের তীর ধীরে ধীরে সাফোয়ান থেকে সরে যেতে লাগল। ভদ্রমহিলা বেশ সময় নিয়ে মেক আপ নিয়ে এসেছেন। ছবির রুনির সাথে এখন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র মেক আপ করেই নিজেকে আমূল বদলে ফেলতে পারেন যে নারী, সে অনেক কিছুই বদলে ফেলতে পারবেন। বসতে বসতে ভাবল আরিফ।
-না না। আপনাকে বরং ধন্যবাদ জানাতে চাই। একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা সময় চেয়েছে, আর আপনি জরুরী মিটিং পিছিয়ে দিয়ে আমাদের সময় দিয়েছেন। আমাদের কাজের ধরণটা এমন যে সবাইকে আগের থেকে খবর দিয়ে আসাটা হয়ে উঠে না সব সময়। আপনাকে যেমন আগেভাগে সময় জানিয়ে আসতে পারিনি। তারপর বলুন কেমন আছেন!
“হো হো” শব্দে হেসে উঠলেন ভদ্র মহিলা। বেশ কিন্নর কণ্ঠের হাসি। মুগ্ধ হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। আর মেক আপের অদ্ভুত গুণ। দেখতে অনেকটা ভারতীয় অভিনেত্রী বিদ্যা বালানের মত লাগছে এখন। এমন রূপের ঝলকে অনেক পুরুষই বিগলিত হয়ে পড়বে।
-আপনাদের আজ বিশেষ সময় দিতে পারব না। আগেই বলেছিলাম একটা জরুরী মিটিং এটেন্ড করতে হবে। স্যরি বলে রাখছি!
হাসতে হাসতেই কথাগুলো বললেন রুনি চৌধুরী। এতদিন ধরে অফিস বন্ধ রেখে কী এমন জরুরী মিটিং, আরিফ সেটা ভাবছিল।
-আমরা নিজেরাও বেশি সময় নেব না। আপনার অনুমতি পেলে আরিফকে বলব আমাদের কথাবার্তা রেকর্ড করে নিতে।
-স্যরি। আমি চাই না আমার কোন কথা পরবর্তিতে অফিশিয়ালি ইউজ করা হোক। থ্যাংক ইউ ফর ইউর আন্ডারস্ট্যান্ডিং।
-ওকে ম্যাম। নো প্রবলেম এট অল।
-বলুন কী জানতে চাইছেন। ফোনে যতটুকু বলার বলেছি। এরপরেও আপনাদের এখানে আসার অনুমতি দিয়েছি শুধুমাত্র এটাই প্রমাণ করার জন্য যে আবরারের নিখোঁজের ব্যাপারে কোনভাবেই আমি জড়িত নই।
“আবরার” শব্দটির উপর বেশ জোর দিয়েছেন রুনি। আরিফের কাছে খুব দৃষ্টিকটু লেগেছে স্বামীর বড় ভাইয়ের নাম ধরে ডাকতে শুনে।
-আপনার হাজব্যন্ড ফাইয়াজ সম্বন্ধে যদি কিছু বলতেন। ফোনে আবরার সম্বন্ধে আপনার মতামত যেটুকু শোনার শুনে নিয়েছি। পরে কোন সময় আরো কিছু জিজ্ঞাসা থাকলে আপনাকে ফোন করে জেনে নেব।
-ফাইয়াজ খুব বোকা ছেলে ছিল। আমি ভেবেও পাই না অমন বোকা এক ছেলের প্রেমে পড়ে আমি ঘর পালিয়েছিলাম কী করে।
-বোকা বলতে…
-আবরার ছোট ভাইকে ঠকিয়ে সব কিছু নিজের নামে করে নিচ্ছিল। ফাইয়াজের নামে থাকা প্রচুর সম্পত্তি আবরার নিজের নামে লিখে নিয়ে বিক্রি করে জুয়ার পেছনে উড়িয়েছে।
-বলেন কী!
-জ্বী। আমার শ্বশুর জীবিত থাকতে ঢাকার আনাচে কানাচেতে প্রচুর সম্পত্তি করে গিয়েছিলেন। ফাইয়াজদের পুরনো পল্টনে পাঁচ কাঠা জায়গার ওপরে বাড়ি ছিল। আবরার আমার বিয়ের আগেই সেটা বিক্রি করে দিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেছিল। কয়েকমাস বিভিন্ন দেশে ঘুরে ফুর্তি করে ক্যাসিনোতে সেই টাকা উড়িয়ে এসেছিল। তারপর এলিফ্যান্ট রোড বাটার সিগন্যালে তিন কাঠার উপর সাত তলা মার্কেট কাম বাড়ি ছিল। আমার বিয়ের পর পর সেই বাড়িটিও আবরার বিক্রি করে দিয়েছিল।
-এত টাকা! সে সব নষ্ট করে ফেলেছিল? আপনার শাশুড়ি বা সামিহা এ ব্যাপারে কিছু বলতেন না?
-আবরার গুণ্ডা টাইপের ছেলে ছিল। শাশুড়ি মা খুব ভয় পেতেন তাকে। বাড়িতেও প্রচুর ভাঙচুর করত। আর হ্যা। দুই হাতে টাকা ওড়াত। স্বামী স্ত্রী মিলে সব টাকা লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছিল।
-আশ্চর্য! কিন্তু সামিহা ম্যাডামতো চাকরি করেন!
-তা সে করে। কিন্তু কবে সে চাকরিতে ঢুকেছে? এর আগে দুই হাতে টাকা ওড়াত সে। মধ্যবিত্ত এলাকায় থেকেও ওদের বন্ধুরা সব উঁচু শ্রেণির। তাদের সাথে তাল মেলাতে নিশ্চয়ই প্রচুর খরচ করতে হত। সব শেষ করে বাধ্য হয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। সেখানেও নষ্টামি করে বেড়ায় সে টাকার বিনিময়ে। কতজনের সাথে তার সম্পর্ক সেটা খোঁজ নিয়েছেন? সামিহাকে আপনাদের কাছে সহজ সরল বলে মনে হয়েছে? সে নিজেই স্বামীর সাথে মিলে বাবা মা’কে পটিয়ে সব কিছু আবরারের নামে লিখে নিত। আপনারা খেয়াল করেছেন নিশ্চয়। আমার শাশুড়ি মা কিন্তু আবরারকে একেবারেই দেখতে পারেন না। একটা কথা আউট অফ দ্যা কন্টেক্সট বলছি। আমার শাশুড়ি আম্মা কিন্তু ফাইয়াজের নিখোঁজের জন্য আবরারকেই দায়ী করে।
-হ্যা হ্যা। উনি সেটা আমাদের বলেছেন অবশ্য। আর খেয়াল করেছি ফাইয়াজের আর আপনাদের প্রতি একটা সফট কর্নার আছে উনার। ভালো কথা। সামিহা অবন্তি আর আবরার সাহেব। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল বলতে পারবেন?
-ওই ডাইনিটা কীভাবে যেন আবরারকে বশ করে রেখেছে। নয়ত আবরারের মত মদ-জুয়া-নারী আসক্ত একজন পুরুষের সাথে এত দীর্ঘ দিন এক ছাদের নিচে থাকা সম্ভব নয়। চরিত্রের দিক থেকে দুজন দুজনের জন্য পারফ্যাক্ট ম্যাচ বলতে পারেন।
-পারফ্যাক্ট ম্যাচ হলে তো দারুণ। সামিহা ম্যাডামকে তাহলে সন্দেহ করছেন না?
-অবশ্যই পারফ্যাক্ট ম্যাচ। সেটা শুধু শয়তানির বেলায়। কে জানে ডাইনিটা নিজেই খুন করে হাইজ্যাকের নাটক করছে কিনা!
-কিন্তু আবরার সাহেব তো এক্সিডেন্ট করে মারা গেছেন…
এটুকু বলেই থেমে গেলেন হাসিব। একবার কাঁধ শ্রাগ করলেন। রুনি চৌধুরীর চেহারা দেখার মত হয়েছে। কিন্তু হাসিব কোন এক কারণে আবরারের মৃত্যুর ব্যাপারটা আর চালিয়ে গেলেন না। রুনি চৌধুরী চুপ করে শুনছিলেন।
-আমি আসলে জানতে চেয়েছিলাম ফাইয়াজের কোন খোঁজ পাননি আর?
-মিঃ হাসিব। আপনি খুব সম্ভবত আবরারের নিখোঁজ রহস্য নিয়ে কাজ করছেন। ফাইয়াজের নয়!
-মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ ম্যাম! আপনি হয়ত জানেন, একটা ঘটনা আরেকটা ঘটনাকে টেনে নিয়ে আসে। আপনার হাজব্যান্ডের নিখোঁজ রহস্যের সাথে আবরারের নিখোঁজ হবার ব্যাপারটায় প্যাটার্নে মিল আছে। এটা আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।
রুনি এই সময়ে দাঁড়িয়ে গেল। রাগে রীতিমত কাঁপছে সে।
-আপনি জানেন কী বলতে চাচ্ছেন? হাউ ডেয়ার ইউ! আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন?
-মোটেই নয় ম্যাম। আপনি শান্ত হোন। একটা ইনফরমেশন আপনাকে শেয়ার করি। আমার রেকর্ডে আজ পর্যন্ত ফেইলিয়ার বলে কোন শব্দ নেই। যদি কোন ভাবে আপনি বা অন্য কেউ জড়িত থেকেও থাকেন, নিশ্চিত থাকতে পারেন সেটা আমি বের করে আনবই।
হাসিবকে এমন কঠোর হতে খুব কমই দেখা যায়। এমন জোর দিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন, আরিফ একবার হাসিবের দিকে একবার রুনির দিকে তাকাতে লাগল। মেন্টাল গেইম! বেশ জমে উঠেছে।
-অবশ্যই সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই মিঃ হাসিব। কিন্তু আমি ফাইয়াজের নিখোঁজের ব্যাপারে আপনাদের কিছু জানাতে চাচ্ছি না।
-দুই ভাইয়ের নিখোঁজের প্যাটার্ন একেবারেই এক। আপনি সহযোগিতা না করলেও আবরারের নিখোঁজ হবার কারণ বের করার সাথে সাথে ফাইয়াজের নিখোঁজ হবার রহস্যও বের করব মিস রুনি। সেটা আপনার পছন্দ না ও হতে পারে। এনিওয়ে, আজ আমরা উঠব। ধন্যবাদ আপনাকে সময় দেবার জন্য!
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে লিভিং রুমের দরোজা খুলে বাইরে পা বাড়াল হাসিব। পেছনে পেছনে আরিফও অনুসরণ করল। বাইরের দরোজার হাতলে মাত্রই হাত রেখেছে হাসিব, পেছন থেকে রুনির ডাক শুনতে পেল।
-শুনুন!
হাসিব দরোজার হাতল ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে সে নিশ্চিত ছিল রুনি আবার ডাকবে। এবার রুনিকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। মনে হয় বেশ ভয় পেয়েছে হাসিবের কঠোর আচরণে। অথবা ভয় পাবার অভিনয় করছে। যে মেক আপের আড়ালে নিজেকে এত সুন্দর করে লুকিয়ে রাখতে পারে, সে অভিনেত্রী হিসেবে মন্দ হবে না নিশ্চয়! তবে আরিফ মনে মনে খুব খুশি হয়েছে রুনিকে অসহায় দেখতে পেয়ে।
-আয়াম এক্সট্রেমলি স্যরি ফর মাই রুড বিহেভিয়র। একটু বসবেন? আজ আমার মুডটা ঠিক ভালো নেই সকাল থেকেই।
-না না ঠিক আছে। আমাদের আজ তাড়া আছে। আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। আপনার সাথে ফোনে কথা বলে জেনে নেব যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে।
হাসিবের মধ্যে সত্যিই অনেক তাড়া দেখা গেল। আরিফ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই বাসায় আরো একটু সময় চাইলেই ওরা কাটাতে পারত। রুনির থেকে আরো অনেক কথা বের করতে পারত। স্যারের মন মর্জি বোঝা বড় ভার।
-আচ্ছা। তাহলে আর রিকোয়েস্ট করছি না বসার জন্য। তবে এটা ঠিক, আমি চাচ্ছি না ফাইয়াজের নিখোঁজের ব্যাপারে নতুন করে তদন্ত শুরু করবেন। ওটা মীমাসিংত ঘটনা।
বেশ নরম শোনাচ্ছে রুনির কণ্ঠস্বর। পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে বলল।
-আদালতে ফাইয়াজকে মৃত দেখান হয়েছে, তাই তো?
-হ্যা।
আর কিছু না বলে খুট করে দরোজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল হাসিব। আরিফ হন্তদন্ত হয়ে পেছনে পেছনে প্রায় দৌড়ে গেল। পেছনে দরোজা বন্ধ করার শব্দ ভেসে আসল। লিফট চলে এসেছে। দুজনে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
-আরিফ, লিভিং রুমে সিগারেটের গন্ধ পেয়েছ?
-না তো! আমি তো খুব দামী একটা পারফিউমের গন্ধ পেলাম শুধু!
-চোখ কান খোলা রাখলেই শুধু হয় না আরিফ। নাকও খোলা রাখতে হয়।
(চলবে।)
#চক্রব্যুহ
[দশ]
লিফটে উঠেই হাসিব চোখ কান নাক খোলা রাখার কথাটা বলার পরে একেবারেই চুপ করে গেছে। আরিফ মনে করার চেষ্টা করল লিভিং রুমে আদৌ কোন সিগারেটের গন্ধ পেয়েছিল কিনা। মনে করতে পারল না। স্যারের কথা সত্য হলে ওরা বাড়িতে ঢোকার আগে আগে ওখানে কেউ সিগারেট খাচ্ছিল। রুনি হয়ত ওদের আসার সংবাদে দ্রুত পারফিউম ছড়িয়ে দিয়েছিল। পুরুষহীন একটি বাড়িতে সিগারেটের গন্ধে গোয়েন্দাদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। হয়ত এই কারণেই সে পারফিউম ছড়িয়েছে। পুরুষমানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে আসতেই পারে। কিন্তু যে বাড়িতে পুরুষ থাকে না, সে বাড়িতে অতি নিকট কেউ না হলে সিগারেট খাবেন না। এমন তো নয়? রুনি চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে এমন মানুষের আনাগোনা হয় এই বাড়িতে। আবরারের নিখোঁজ হবার ব্যাপারটাতে এমন কেউ জড়িত নয় তো?
নিচে নেমে হাসিব সোজা দারোয়ানের কাছে চলে গেল। মনে হচ্ছে আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছেন হাসিব। হাসিবদের দেখা মাত্র সালাম দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে।
-তোমাদের ভিজিটর লগটা আবার একটু বের কর।
সরাসরি আদেশ করলেন হাসিব। ভিজিটর লগ আনতে বলে বা হাত ঘুরিয়ে তার বিখ্যাত পাটেক ফিলিপ ঘড়িটির দিকে একমনে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে এই ঘড়ির ভেতরে কোন সংবাদ লুকিয়ে! আরিফও উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কিছু দেখা যায় কিনা!
-লগ বইতে বার তারিখের পর থেকে দেখা যাচ্ছে। তোমাদের এখানে প্রতি মাসে নতুন বই শুরু করা হয় নাকি একটা বই শেষ হলে আরেকটা বই শুরু কর?
-স্যার, প্রতি মাসে নতুন বই ব্যবহার করা হয়।
-তোমাদের এপার্টমেন্ট এ কোন ম্যানেজার বা সুপারভাইজার এমন কেউ নেই?
-আছেন স্যার। সুপারভাইজার একজন আছেন। রশিদ নাম। ডাকব তাকে?
-হ্যা। তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।
ভিজিটর লগ বই থেকে কয়েক পাতার ছবি তুলতে বলায় আরিফ সেগুলো তুলে নিল। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে এক প্রায় প্রোঢ় লোককে আসতে দেখা গেল। কালো গ্যাবার্ডিন কাপড়ের প্যান্টের উপর সাদা ফুলহাতা সুতির শার্ট। টাগ ইন করা। পায়ে ক্যানভাসের কেডস। এসেই সালাম দিল ওদের।
-স্যার, কিছু হয়েছে?
পরিচয়ে জানা গেল রশিদ আর্মির সুবেদার ছিল এক সময়ে। বিশ বছর আগে রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন। এই এপার্টমেন্ট শুরু হবার সময় থেকে এখানে আছেন। তাও প্রায় বছর চৌদ্দ হবে। ওদেরকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। বেশ পরিপাটি করে সাজানো। চারিদিকে স্বচ্ছ কাচে ঘেরা। এসির শীতল বাতাসে হাত পা জমে যাবার অবস্থা।
-আমাদের দু তিনটা ইনফো দিয়ে সাহায্য করতে হবে রশিদ।
-স্যার বলুন। আমার পক্ষে যতটুকু দেয়া সম্ভব সব বলতে পারব। তবে স্যার এর থেকে বেশি কিছু হলে ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছ থেকে জানা যাবে।
-আপনাদের ভিজিটর লগ বুক এ মাসের বারো তারিখ থেকে শুরু করা হয়েছে। যেটা সাধারণত মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হবার কথা।
বেশ জোরের সাথে “মাসের এক তারিখ” উচ্চারণ করলেন হাসিব উদ দৌলা। সুপারভাইজারকে কিছু একটা চিন্তা করতে দেখা গেল। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করল।
-স্যার। প্রথম লগ বইটি পানিতে নষ্ট হয়ে গেছিল। ম্যানেজমেন্ট কমিটি থেকে বলা হয়েছে নতুন বই শুরু করতে।
-ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে কি রুনি চৌধুরী ম্যাডাম আছেন?
-জ্বী স্যার। উনি কমিটির চেয়ারম্যান।
-সত্যি করে বলবেন। স্পেসিফিক্যালি রুনি ম্যাডামের আদেশেই লগ বই চেঞ্জ করা হয়েছে কিনা।
মুখ কালো হয়ে গেছে সুপারভাইজার রশিদের। মাথা চুলকাতে লাগল।
-আচ্ছা ওসব থাক। আমাকে শুধু এটুকু ইনফো দিয়ে সাহায্য করুন। গত পনের দিনে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে এই এপার্টমেন্টে?
-স্যার, এখানে অফিস আছে, এপার্টমেন্টও আছে। প্রতিদিনই তো কত কিছু ঘটছে!
-স্পেসিফিক্যালি বলছি। রুনি ম্যাডামের এপার্টমেন্টে কিছু ঘটেছে? যেটা হয়ত অন্য সময়ে স্বাভাবিক বলে আপনার কাছে মনে হতে পারে।
আবারো চিন্তাক্লিষ্ট দেখাল সুপারভাইজার রশিদকে। ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাল কিছুক্ষণ। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
-স্যার! এক মিনিট। এই সংবাদটা দেয়া যায় কিনা ভাবছি। কিন্তু স্যার পুরো ঘটনা আমি জানি না।
-আপনি নির্ভয়ে বলুন। আমরা তদন্তের স্বার্থে এই তথ্য গোপন রাখব।
তবুও একটু আমতা আমতা করতে দেখা গেল সুপারভাইজার রশিদকে।
-স্যার। এই বয়সে আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। রুনি ম্যাডাম নিজেই এই কমপ্লেক্স এর ওউনারস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। উনি কোনভাবে টের পেলে আমার চাকরি চলে যাবে স্যার।
আরিফ উত্তেজনা সামলাতে পারছিল না। একবার হাসিব আর সুপারভাইজারের দিকে তাকাচ্ছিল উদ্গ্রীব দৃষ্টিতে। নিশ্চয় রহস্যের কিনারা পাওয়া যাবে এই রুনি চৌধুরীর কাছেই!
-আপনি নিশ্চিত থাকুন।
বলেই আশেপাশে তাকালেন হাসিব। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছেন।
-এই রুমে সিকিউরিটি ক্যাম নেই, তাই তো?
-হ্যা স্যার। তবে এই রুমের বাইরে গেটের ওপরে আছে।
হাসিব প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দ্রুত এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে সুপারভাইজার রশিদের শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিল!
-এবার বলুন রশিদ। আর কতটুকু জানেন!
বেচারা ঘাবড়ে গিয়েছে। একবার গলা খাঁকারি দিল। তারপর হাসিবের কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় কিছু কথা বলল। আরিফ হতাশ হয়ে তাকিয়েছিল। কিছুই শুনতে পায়নি ও।
-হুম রশিদ। আপনাকে ধন্যবাদ সংবাদটা শেয়ার করার জন্য। আমার মোবাইল নম্বর সেভ করে নিন। ০১৭xxxxxxxx।
সুপারভাইজার রশিদ তার ফোনে নম্বরটি সেভ করতেই তাড়া দিলেন হাসিব।
-আরিফ। চল যাওয়া যাক।
বলেই হনহন করে দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন হাসিব। মেইন গেটের কাছে আসতে দারোয়ান সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আরেকবার স্যালুট দিয়ে দরোজা খুলে দিল। সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। গুমোট গরম। রাত্রে খুব সম্ভবত ঝড় বৃষ্টি হবে।
গাড়িতে উঠে আর কোন কথা বলেনি হাসিব। আরিফ মনে মনে খুব ছটফট করছিল। সুপারভাইজার হাসিবের কানে কানে কী বলেছে? কেন তাকে না শুনিয়ে শুধুমাত্র হাসিবকে বলেছে? কেন এত গোপনীয়তা? রুনিকে নিয়ে গুরুতর কোন সংবাদ? অথচ জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারল না। হাসিব কোন এক গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। হয়ত হিসেব নিকেশ করছেন কিছু একটা। গাড়ির গতিপথ দেখে আন্দাজ করে নিল কলাবাগান থানার দিকেই যাচ্ছে। রাস্তায় এদিকে তেমন জ্যাম নেই। আরিফের ভাবনা সত্য করে দিয়ে একটু পরেই গাড়ি কলাবাগান থানার সামনে এসে পড়ল। থানা কমপ্লেক্সের ভেতরে পার্কিং করে আরিফকে কিছু না বলেই চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন হাসিব। আরিফ তার পিছু নিল।
-স্লামু আলাইকুম স্যার।
সেকেন্ড অফিসার আজিম ওসির রুমে ছিল তখন। ওদের দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল।
-স্যার! কতদিন পরে দেখা! আমাকে এভাবে ভুলে গেলেন স্যার! আপনার নম্বর চেঞ্জ করেছেন। পুরনো নম্বরে কতবার যে ফোন করেছি আপনাকে! স্যার বসুন বসুন!
একেবারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আজিম। যেন বুঝে উঠতে পারছে না স্যারকে কীভাবে আরো সম্মান দেখান যায়। হাসিব মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে আজিমকে বুকে টেনে চেপে ধরে পিঠ চাপড়ে দিলেন। ওসির চেয়ার খালি। খালি চেয়ারের দিকে ঈংগিত করতে মাথা নাড়াল আজিম।
-স্যার এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যারের বাসায় গেছেন। আপনার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ছিলেন স্যার। আর স্যার, যদি ভুল না করি, উনিই আমাদের আরিফ স্যার?
হেসে হাত বাড়িয়ে দিল আরিফ। কথাবার্তায় শুধু নয়, আচার আচরণেও বেশ স্মার্ট আজিম।
-হ্যা, আপনার নাম খুব শুনেছি আমাদের স্যারের কাছে!
-আজিম, আজ বেশিক্ষণ বসব না। একটু নিরিবিলি বসে কেসটা নিয়ে ভাবতে হবে। যদি সংক্ষেপে বলতে…
-স্যার, আমার পক্ষে এই অল্প সময়ে যেটুকু খবর বের করা সম্ভব বের করে ফেলেছি। স্যার কি এখনো দুধ ছাড়া ব্ল্যাক কফিতে এক চামচ চিনি খান?
-হা হা হা! তোমার তাহলে সেসব বেশ মনে আছে আজিম! হ্যা। এক কাপ কফি হলে মন্দ হত না।
কফির কথা শুনে আরিফের পেটের ক্ষুধাবোধ আবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। সে জানে, না চাইলেও থানায় সিঙ্গারা, সমুচা আর প্লেইন কেক পাওয়া যাবে। হাসিব কফি খেতে রাজি হওয়াতে মনে মনে বেশ খুশি হল ও। তবুও বলা যায় না, যে মেজাজ মর্জি। কখন আবার কিছু মুখে না দিয়েই বের হয়ে যায়!
-স্যার। এই যে একটা ফাইল করে রেখেছি। এখানে অনেকগুলো মামলা, অভিযোগ আর জিডির কপি আছে। সব কিছুই ওই একটি বাড়ি ঘিরে!
বেশ মোটা একটা ফাইল এগিয়ে দিল আজিম। এত ঘটনা ঘিরে আছে একটি বাড়ি ঘিরে! আরিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
-সামিহা ম্যাডাম নিজেই এসেছিলেন ভোরের দিকে। আমি জিডি আকারে নিতে চেয়েছিলাম। তখনো আসলে জানতাম না সে কোন বাড়ির স্ত্রী। ওসি স্যার ছিলেন না। উনি থাকলে বলতে পারতেন। যাইহোক। হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন। তেমনি ব্যস্ততার সাথে অভিযোগপত্র লেখা শেষ হওয়া মাত্রই চলে গেছিলেন। শুধুমাত্র অভিযোগনামা লিখতে পেরে অবশ্য একটু স্বস্তিবোধ করেছিলাম তখন।জিডি করলে তদন্তের ঝামেলা হত। উঁচু কারো তদবির আসলে দৌড়ঝাঁপ করতে হত। পরে ওসি স্যারকে ঘটনা বলতে উনার প্রথম কমেন্টটা এখনো মনে আছে স্যার। “এটাই শেষ নয় আজিম। ও বাড়ি থেকে আরো অনেক দূর্ঘটনার খবর থানাতে আসবে।“
-আচ্ছা! তারপর?
বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন হাসিব। আজিম থেমে যেতে বেশ বিরক্ত হয়েছেন। আরিফ আজিমের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।
-ওই বাড়িটা ঘিরে প্রচুর রহস্য আছে স্যার।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে আজিম। একজন আর্দালিকে ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে থেমে গেল। আরিফ “স্যরি স্যার” বলেই একটা সিঙ্গারা হাতে তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিল। আর্দালি ট্রে নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতেই আবার শুরু করল আজিম।
-স্যার। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন ও বাড়িতে ভূতের আছর আছে!
বলেই হো হো করে হেসে উঠল আজিম। যেন খুব মজার একটা কথা বলেছে। ঠিক তখনি বাইরে কাছে ধারে কোথাও মেঘের বিজলি চমকে উঠল। জানালা দিয়ে সেই আলো ঘরের ভেতরে এসে ছড়িয়ে যেতেই বিকট বজ্রপাতের শব্দ। বজ্রপাতের শব্দ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথেই থানার ঠিক বাইরে রাস্তার উপরে ট্রান্সফরমার বার্স্ট হবার শব্দে পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠেছে। গুম গুম শব্দ কমে আসতে আসতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়ে নিঃসীম অন্ধকারে ঢেকে গেল সব কিছু। খুব সম্ভবত একটা ইদুর আরিফের পায়ের উপর দিয়ে দৌড় দিয়েছে। “বাবা গো, মা গো” বলে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল। ওর চিৎকার আর লাফ দেখে আজিম আবার হো হো করে হেসে উঠল। “আরে ওটা ইদুর ছিল। কোথাও লুকিয়ে ছিল, বজ্রপাতের শব্দে বাইরে বের হয়ে এসেছে। বৃষ্টির আন্দাজ পেলে এরা এমনিতেও গর্ত থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। আপনি বসুন স্যার। ভূত আসেনি এখানে!” ওর হাসি এখনো থামেনি। হাসতে হাসতেই ড্রয়ার খুলে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বালিয়ে টেবিলের উপরে রাখল।
-স্যার। এই ফাইলে মোটামুটি সব কিছু পাবেন। আপনি ফোন দেবার পরে ওই বাড়ি সংক্রান্ত সমস্ত কাগজ পত্র বের করে একবার পড়লাম। শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল পড়তে পড়তে। ওই বাড়ির লোকজন সবাই এক্সট্রা অর্ডিনারি। নাহলে একের পর এক এত ঘটনা কী করে ঘটতে পারে?
আরিফ দ্বিতীয় সিঙ্গারায় মাত্র কামড় দিয়েছে। অমন সময়ে ওর ফোনে রিং টোন। হাসিবের বকা খেয়ে রিং টোন বদলে ফেলেছিল। ভূতের ভয় আর নতুন রিং টোন। সব মিলিয়ে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। ফোনে রিং হতে তাই ঠিক বুঝতে পারছিল না এটা ওরই ফোন। এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। আজিম খেয়াল করেছে।
-স্যার, আপনার পকেটের ফোনে রিং টোন বাজছে! ফোন ধরুন!
বলেই আবার জোরে হেসে উঠেছে। হাসিব জানেন এই ছেলেটির হাসির রোগ রয়েছে। চট্টগ্রামে ওর সাথে কাজ করার সময়ে প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হত হাসি শুনে। পরে খেয়াল করে দেখেছেন, ও না হাসলেই বরং চারিদিক কেমন যেন নির্জীব হয়ে পড়ত।
-হ্যালো কে বলছেন? সামিহা ম্যাম? কী ব্যাপার বলুন তো?
সামিহার নাম শুনে হাসিব এবং আজিম দুজনেই চমকে তাকিয়েছে আরিফের দিকে।
-কী বললেন? ড্রাইভার বেলায়েত গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে? কী! মারা গেছে! মানে? হ্যা হ্যা! হাসিব স্যার আছেন আমার সাথে। কোথায় ঘটেছে বললেন? হ্যা হ্যা। হুম। স্যারকে জানাচ্ছি। জানাবো আপনাকে। হুম। রাখি। টেক কেয়ার!
ফোন কানের থেকে নামিয়ে হাসিবের দিকে তাকাল আরিফ। বিহ্বল আর উদ্ভ্রান্ত এক দৃষ্টি।
-স্যার, কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফেরার পথে সামিহা ম্যাডামদের ড্রাইভার বেলায়েত গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। স্পট ডেড। জিগাতলা পোস্ট অফিসের কাছে। ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। ক্রিম কালারের একটা টয়োটা প্রিমিও গাড়ি এসে ওকে চাপা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। হাজারিবাগ থানা থেকে নাকি জানানো হয়েছে সম্ভবত ডেলিবেরেটলি চাপা দেয়া হয়েছে। আশেপাশের লোকজন অনেকেই দেখেছে ঘটনাটা!
মুখ হা করে কথা শুনছিল আজিম। আরিফ ফোন কেটে দিতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
-স্যার! ওসি স্যার ঠিকই বলেছিলেন। আরো কত যে দূর্ঘটনার সংবাদ আসবে ওই বাড়ি থেকে!
আজিমের কথা শেষ হতে দিলেন না হাসিব উদ দৌলা। আরিফকে “ওঠ” বলে তাড়া দিয়ে নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। বেচারা আরিফ। দ্বিতীয় সিঙ্গারার বাকি অংশ মুখে পুরে উঠে দাঁড়াল। আজিম বুঝতে পেরেছে হাসিব আর এখানে সময় নষ্ট করতে চাইছেন না।
-স্যার কি হাজারিবাগ থানায় যাচ্ছেন?
-হ্যা। পরে দেখা হবে আজিম। ভালো থেকো।
(চলবে।)