চক্রব্যুহ,১৪,১৫

0
119

#চক্রব্যুহ,১৪,১৫
মোহাম্মদ মনোয়ার
[চৌদ্দ]

রাত নয়টা। উত্তরা রাজলক্ষীর সামনে ভীষণ এক জ্যামে আঁটকে আছে হাসিবের নিসান এক্সট্রেইল ২০২০ মডেলের চকলেট রঙের এসইউভি। রিয়ারভিউ মিররে সামিহা অবন্তীর ফোলা চোখ দেখা গেল। ওড়নায় মুখ চেপে রেখেছে। সামিহাকে পিক আপ করতে কলাবাগান যেতে হয়েছিল। তাই বেশ দেরি হয়ে গেছে। নেভার দ্যা লেস। খালাম্মাকে এড়িয়ে ওকে রাজি করানো গেছে তাতেই আপাতত খুশি হাসিব। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে পেছন থেকে। আরিফ সামনের বাম পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে নিবিষ্ট মনে কল লিস্ট আর থানার প্যাপারস ঘাটাঘাটি করছে আর একটা নোট বইয়ে টুকটাক কিছু একটা টুকে রাখছে।

সামিহাকে বোঝাতে বেগ পেতে হয়নি। বুদ্ধিমতী মহিলা। ওদের চেহারা দেখে হয়ত কিছু আঁচ করে থাকবে। আরিফ মাথা নিচু করে শুধু বলেছিল, “একটু গাজীপুর যেতে হবে। সদর হাসপাতালে।” এতক্ষণ বেগম গুলজার হোসেনও ওদের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন। এশার নামাজের জন্য উঠে যেতেই আরিফ কথাগুলো বলেছে। শুনে কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর হঠাৎ দু’হাতে ওড়না চেপে ধরেছে মুখে। ফুঁপিয়ে উঠেছিল। কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়েনি। এই এত রাতে তাকে নিয়ে ঠিক কোথায় যাচ্ছে এই বিষয়টা বেগম গুলজার হোসেনকে বলা সম্ভব ছিল না। ছেলের লাশ সনাক্ত করতে যাচ্ছে, এটা কোন মা’কেই বলা সম্ভব নয়। উনাকে বেলায়েতের মৃত্যু সংবাদও দেয়া হয়নি। বৃদ্ধ বয়সে এত শোকের ধকল কাটানো খুব সহজ নয়। শাশুড়ি ঘরে ঢুকে দরোজা ভেজানোর সাথে সাথে সামিহাই বলল, চলুন যাওয়া যাক। আম্মাকে কিছু বলা ঠিক হবে না।

গাড়িতে উঠে কিছু সময় ঠিক ছিল। তারপর মুখে ওড়না চেপে একটানা ফুঁপিয়ে কান্না করছে। পরিচয়ের প্রথম দিনও এভাবেই কাঁদছিল সামিহা। এই মেয়েটির হয়ত ভালই কান্নার রোগ আছে। তবে এখনকার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। এই অবস্থায় কোন পুরুষও নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না। কিন্তু ঝামেলা বেঁধেছে অন্য জায়গায়। অমন বিকৃত লাশ দেখে আবার কী রিয়েক্ট করে ফেলে। গাজীপুর সদর হাসপাতালে বাল্যবন্ধু খাজা হাবিব সেলিম আছে। আজ ওর ডিউটি নেই। অফিস থেকে বের হবার সময়ে কথা হয়েছে। খাজা হাবিব সেলিম ওর অন্য কলিগদের জানিয়ে দিয়েছে। মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্স এর প্রয়োজন পড়লে সাহায্য পাওয়া যাবে।

-কীভাবে খোঁজ পেলেন জিজ্ঞেস করতে পারি?

সামিহা গাড়িতে ওঠার পর এই প্রথম কথা বলল। অবশ্য হাসিব আর আরিফও নিজেদের মধ্যে কোন কথা বলেনি। আরিফ মাঝে শুধু একবার শ্রীপুর থানায় ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে ওরা আসছে।

হাসিব আরিফের দিকে ফিরে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বলল। ওরা ছিল একেবারে ডান দিকের লেনে। পেছনে একটি হ্যারিয়ার এসইউভি। একটানা হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। হাসিবের ইশারা পেতেই এক ঝটকায় দরোজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের গাড়ির ড্রাইভারের পাশে চলে গেল। হাতে তার বেরেটা ৯২ এফএস পিস্তল! গ্লাসে পিস্তলের বাট দিয়ে নক করল। ড্রাইভার প্রচণ্ড ভয়ে দুই হাত উঁচিয়ে ধরেছে। গাড়িতে কোন যাত্রী নেই।

“গ্লাস নামা হারামজাদা! পুলিশ!” চিৎকার দিয়ে উঠল আরিফ। গ্লাস নামাতেই পিস্তলের বাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মুখে আঘাত করেল আরিফ। ফিনকি দিয়ে নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে ছড়িয়ে গেছে। “হারামজাদা!” দুই চোখের মাঝখানে পিস্তল তাক করে ধরেছে। চিৎকার করেই কথা বলে যাচ্ছে। “গুলি করে তোর খুলি উড়িয়ে দেব! আর কখনো হর্ণ বাজাবি রাস্তায়? কানে ধর হারামজাদা। কানে ধর বলছি!”

আরিফের চিৎকারে ড্রাইভার দুই হাত তুলে কান চেপে ধরেছে।

-বল হারামজাদা। আর কোনদিন হর্ণ বাজাবি অকারণে?

-না স্যার। মাফ কইরা দেন।

চড়াৎ করে বা হাতে একটা থাপ্পড় বসাল ড্রাইভারের ডান গালে। হাতে কিছু রক্ত লেগে গেছে। ড্রাইভারের কলার চেপে ধরে জামাতে সেই রক্ত মুছল। তারপর এক দৌড়ে নিজেদের গাড়িতে চড়ে বসল।

-কূল ডাউন মাই বয়! এত জোরে মারতে বলিনি!

-স্যার। সারা জীবন ওর মনে থাকবে।

বলে একটু হাসল আরিফ। হাসিবও মিটিমিটি হাসছে। সামনের গাড়ি একটু মুভ করা শুরু করেছে। এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে হাল্কা গতি বাড়াল হাসিব। রিয়ার ভিউ মিররে একবার তাকিয়ে দেখল। সামিহার মুখ ভয়ে কাল হয়ে গেছে। ডান হাতে ওড়না মুখের উপর চেপে ধরা। চোখে রাজ্যের বিস্ময় আর ভয়। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে কী করে!

-আমি আসলে বাংলাদেশের সব থানা থেকে রিপোর্ট চেয়েছিলাম।

কাঁধ শ্রাগ করে একবার পেছনে তাকল হাসিব। এতক্ষণে সামিহার প্রশ্নের উত্তর দিল।

-আজ সন্ধ্যায় রিপোর্ট পেয়েছি। এর মধ্যে শ্রীপুর থানার রিপোর্টটা ভেরিফাই করতে চাচ্ছি।

পেছন থেকে ফের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। আরিফ বা হাসিব কেউ কথা বলল না। গাড়ি যখন টঙ্গি পার হচ্ছে, সামিহার কণ্ঠ শোনা গেল।

-আপনারা কি নিশ্চিত হয়েছেন আবরার মারা গেছে কিনা?

বেশ ফ্যাসফ্যাসে শোনাল সামিহার গলা। হয়ত কান্না করতে করতে ধরে এসেছে। কয়েকবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করল।

-আমাদের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক ম্যাম।

এবার আরিফ উত্তর দিল। “আচ্ছা” বলে সামিহা বাইরে তাকিয়ে রইল কিছুটা সময়।

সামনে একটা দোকান দেখে গাড়ি থামাল হাসিব। পকেট থেকে কিছু টাকা বার করে আরিফকে দোকানে পাঠিয়ে দিল। ঠিক জানে না হাসপাতালে কতটা সময় থাকতে হবে। কয়েকটি পানির বোতল, ডিম সেদ্ধ, একটা পাউরুটি আর কয়েকটি চিপসের প্যাকেট নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল আরিফ।

-বিকেলে রুনি ফোন দিয়েছিল আমাকে।

রুনি নাম শুনে হাসিব রিয়ার ভিউ মিররে পেছনে তাকিয়ে দেখল কয়েক সেকেন্ড। আরিফ ঘুরে পেছনে তাকিয়েছে। সামিহা হয়ত কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু চোখে মুখে দ্বিধার ছায়া। বোতল খুলে ঢকঢক করে কিছু পানি খেয়ে ওড়নায় মুখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

-আপনারা মনে হয় গিয়েছিলেন ওর ওখানে।

-হ্যা।

আরিফ উত্তর দিল।

-ও বলল আপনাদের তেমন সময় দিতে পারেনি।আর…

ওড়না মুখে চেপে ধরে কিছু একটা ভাবল সামিহা। বলবে কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। গাড়ি গাজীপুর চৌরাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছে। এখান থেকে হাসপাতাল বেশি দূর নয়। হাসিব আগ্রহ দেখাল না। একমনে গাড়ি চালাতে লাগল। অবশ্য আরিফ বেশ উশখুশ করছিল শোনার জন্য। অবশেষে কৌতুহল দমন করে রাখতে পারল না।

-আর?

চোখ মুছে আরিফের দিকে তাকাল সামিহা।

-রুনি বলল আপনারা অনেক বাজে বিহেভ করেছেন ওর সাথে। আর ওদের এপার্টমেন্টের রুলস ভেঙেছেন। অবশ্য আগেই আপনাদের বলা উচিত ওর ভাইয়ের সম্বন্ধে। ওর বড় ভাই মহসিন চৌধুরী ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের বড় নেতা। রাজনৈতিক ভাবে ভীষণ ক্ষমতাধর আর প্রভাবশালী। সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রীর সাথে উনার বেশ সখ্যতা আছে। মেইনলি ভাইয়ের জোরেই ও আজ এভাবে টিকে আছে। আবরারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেও ওর টিকিটি কেউ ধরতে পারবে না, এটা সে ভাল করেই জানে। আসলে ওর ভাইয়ের নাম মনে করিয়ে দিতেই ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাদেরকে ভাইয়ের নাম জানাব কিনা। ও বলেছে “অবশ্যই” জানাবে।

অবশ্যই শব্দটায় বেশ জোর দিল সামিহা। গাজীপুর চৌরাস্তায় সারাদিন অকারণে জ্যাম বেধেই থাকে। এই রাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। এমন সময়ে হাসিবের ফোনে রিং। নিকুঞ্জ থানার হাবিবের ফোন।

-হ্যালো!

ব্লুটুথে ট্রান্সফার করে নিয়েছে ফোন কল।

-স্যার সুসংবাদ আছে।

-সুসংবাদ?

-জ্বী স্যার। সাফোয়ানের ফোনের আইএমইআই ট্র্যাক করা হয়েছে।

“সাফোয়ান” শব্দটা বলেই চুপ করে গেলেন হাসিব। অবচেতন মনে উচ্চারণ করে ফেলেছেন। পেছনের সিটে বসা সামিহা আবন্তির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। আরিফ আর সামিহা সাফোয়ানের নাম শুনতে পেয়েছে। সামিহা হয়ত ওর বলার ঢং দেখে কিছু একটা আঁচ করেছে।

-কী হয়েছে সাফোয়ানের?

হাসিব একবার রিয়ারভিউ মিররে সামিহার দিকে তাকিয়ে দেখল, কিন্তু কথার উত্তর দিল না।

-হাবিব। গুড জব। আমি আপনাকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি। গাড়ি ড্রাইভ করছি।

সামনেই গাজীপুর সদর হাসপাতাল। সামিহা নড়েচড়ে বসেছে।

-আরিফ। শ্রীপুর থানার ওসি সাহেবকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর সব ব্যবস্থা করা আছে কিনা।

-জ্বী স্যার।

খুব নিচু গলায় ফোনে কথা বলে হাসিবের দিকে তাকাল আরিফ।

-স্যার। সব কিছু রেডি আছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন উনারা।

হাসপাতালের মেইন গেটের পাশে পুলিশের হুড খোলা একটা জিপ গাড়ি দেখা পার্ক করা। ওটার সামনে একটা পাজেরো স্পোর্টস এসইউভি। নম্বর প্লেটে চোখ পড়তেই চমকে উঠেছেন হাসিব। জেলা পুলিশ সুপার হামিদুল্লাহ স্যার এখানে এই এত রাতে কী করছেন! একটু এগিয়ে গাড়ি থামাতেই দুজন মহিলা কনস্টেবলকে নিয়ে শ্রীপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এবাদত হোসেনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।

-স্লামুয়ালাইকুম স্যার। অনেকদিন পরে দেখা। কেমন আছেন স্যার?

-এবাদত কেমন আছ ভাই!

-স্যার আপনাদের দোয়ায় ভাল আছি। স্যার, সুপার স্যার নিজেই এসেছেন আপনার আসার খবর পেয়ে। উনি গাড়িতে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আমরা ম্যাডামকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনি দেখা করে আসুন। তারপর একসাথে মর্গে যাব।

“মর্গ” শব্দটা শুনতেই সামিহা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে। মহিলা কনস্টেবল দুজন দুপাশ থেকে গাড়িতে উঠে এসে সামিহাকে জড়িয়ে ধরল। “কাঁদে না বোন, আপনি আসুন আমাদের সাথে।“

(চলবে।)

#চক্রব্যুহ

[পনেরো]

-স্যার স্লামুয়ালাইকুম। স্যার, কেমন আছেন?

হামিদুল্লাহ বাশার তখন ডিবির প্রধান ছিলেন। চমকপ্রদ কিছু রহস্য উদঘাটন করেছিল হাসিব এই চৌকস অফিসারের নেতৃত্বে। গোয়েন্দা কাজের হাতেখড়ি সত্যিকারে তার সময়েই হয়েছিল। তখনো বিয়ে করেনি। একা একা পুলিশ লাইনে থাকত হাসিব। একসাথে কাজ করতে করতে একটা সময় সম্পর্কটা অনেকটা বড় ভাই আর ছোট ভাইয়ের মত হয়ে গিয়েছিল। হামিদুল্লাহ বাশার দারুণ বুঝতে পারতেন হাসিবের প্রতিটা মুভমেন্ট। এমন চৌকস আর মেধাবী ছাত্র পেয়ে উনি খুব গর্ব করতেন। উনার এই অতিরিক্ত আদর আর আহ্লাদের কারণেই জটিল সব কেস ওর ভাগ্যে জুটত। উনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিটা কেস সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করেছিল হাসিব।

সম্পর্কটা এত গভীরে পৌছেছিল যে সে অনেকটাই তাদের পারিবারিক সদস্যে পরিণত হয়েছিল। ভাবির আতিথেয়তা সে কখনোই ভুলতে পারবে না। মাঝে মাঝে গভীর রাত হয়ে যেত তদন্ত কাজে। হামিদুল্লাহ তাকে সেই অসময়ে বাসায় নিয়ে যেতেন। ভাবি ছিলেন একেবারে নিরহংকার আর মাটির মানুষ। তাকে ছোট ভাইয়ের মতই আদর যত্ন করতেন। সব মিলিয়ে হামিদুল্লাহ বাশারের প্রতি হাসিবের সম্মানটা অন্যরকম। স্যার এসেছেন শুনে আবেগ ধরে রাখতে পারেনি হাসিব।

-হাসিব ভাল আছি! কতদিন পরে তোমার সাথে দেখা। তোমার নাম শুনে মনে হল আমার ছাত্রটিকে একবার দেখে আসি। তাই চলে এলাম!

-স্যার! আপনি আমার গুরু। আপনি এসেছেন এখানে। এরচেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! ভাবি অর্নারা কেমন আছেন স্যার?

এসপি হামিদুল্লাহ বাশার যদিও খুব ক্যাজুয়ালি কথা বলছিলেন, তবে তার কথার সুরে আর অভিব্যক্তিতে কিছু একটা ছিল। হাসিবের মন বলছে বড় কোন কারণ রয়েছে।

-সবাই বেশ ভাল আছে হাসিব। গাড়িতে উঠে বস। দু’মিনিট কথা বলি তোমার সাথে।

হুম। যা ভেবেছিল হাসিব। গোপনীয় কিছু আছে। অন্যদিকে ঘুরে গাড়িতে উঠে বসতেই সাথের কনস্টেবল আর ড্রাইভার দরোজা বন্ধ করে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে।

-স্যার। আপনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

-ঠিকই ধরেছ হাসিব। গাজীপুরে বদলির পর থেকে এখানে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। তুমি তো জানো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি আমার ধাঁতে নেই।

-স্যার বুঝতে পারছি।

-তুমি সার্ভিসে থাকলে আমার কাছে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে ফেলতাম হাসিব। সেটা তো আর হচ্ছে না। রাজনৈতিক চাপ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।

-বুঝতে পেরেছি স্যার। আপনি বলুন। যতটুকু পারি আমার সাধ্যমত সাহায্য করব স্যার।

-এই যে লাশটি আইডেন্টিফাই করতে আসলে। এই কেসের কথাই ধর!

-স্যার!

-লাশ এখনো সনাক্তই হয়নি। কে জড়িত কিছুই জানি না। এই অবস্থায় উপর থেকে চাপ আসছে খুব দ্রুত একশনে যেতে। মুস্কিল হয়েছে অনলাইন আর অফলাইনে এই লাশ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়ে গেছে। তুমি আসছ জেনে বেশ ভরসা পেয়েছি। অন্তত যদি সনাক্ত করা যায়।

-স্যার যদি একটু বসেন তো আধা ঘণ্টার মধ্যেই জানাতে পারব।

-হ্যা হ্যা। আমি বসছি। এমপি সাহেব নিজে ফোন দিয়েছেন। তার বাংলো বাড়ির পুকুর থেকেই এই লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বুঝতেই পারছ আমার উপরে চাপ কতটুকু। ভাল কথা। কোন নিউজ চ্যানেল বা বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তুমি দেখে সরাসরি আমার কাছে চলে আসবে।

এসপি হামিদুল্লাহ বাশারকে সালাম দিয়ে হাসপাতালের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হাসিব ভাবছিল কেসটির জটিলতা নিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে কোন কুল কিনারা করে উঠতে পারছে না। এমপি সাহেবের বাংলো বাড়ির পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে! বাড়ি কি সিকিউরড ছিল না? অন্য সব রাজনৈতিক নেতাদের মত মনে হয় এই এমপি সাহেবেরও শত্রুর অভাব নেই। কেউ কি তাকে ফাঁসাতে লাশটি এখানে ফেলে গেছে? নাকি তার নিজের কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত? নাকি এই লাশ তার নিজের বা দলের কোন প্রিয়ভাজনের? ভাবনা বেশি দূর এগুলো না। সাথের কনস্টেবল পথ দেখিয়ে মর্গের কাছাকাছি চলে এসেছে। সামিহা মর্গের বাইরে একটা চেয়ারে ভাবলেশহীন চেহারায় বসে আছে। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া। শুধু চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুজন মহিলা কনস্টেবল ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। হাসিবকে দেখেই এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। চাকরি জীবনে এমন পরিস্থিতি সে অনেকবার সামাল দিয়েছে। ফাঁসির আসামীর সময় যখন ঘনিয়ে আসে, সে নিজে থেকেই দ্রুত মৃত্যু কামনা করে। মানসিক চাপ এক সময় তাকে আঁকড়ে পাকড়ে ধরে। সামিহাকে নিজের মত করে কান্নার সুযোগ দিয়ে সে আরিফকে এক পাশে ডেকে নিল। তারপর এসপি স্যারের এখানে আসার কারণ বলল। আরিফ মনোযোগী শ্রোতার মত শুনে গেল। তবে মনের ভেতর সাফোয়ান নামটি তোলপাড় তুলছে। হাসিব তখন গাড়িতে কী শুনেছে? হাসিব নিজেই প্রসঙ্গ তুললেন।

-সাফোয়ানের মোবাইল ফোন ট্রেস করা গেছে। এক “ভদ্র মহিলা”র কাছে ছিল ফোন। কাফরুল থানায় আঁটকে রেখেছে। তাকে ছেড়ে দিতে উপর থেকে চাপ আসছে। এখান থেকে সরাসরি ওখানে যেতে চাইছি। তুমি তো দুদিন বাড়িতে যাওনি। যেতে পারবে আমার সাথে? নাকি বাড়িতে ফিরে যাবে?

আরিফের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। এডভান্স স্টেজে। ভাগ্যিস ওর শাশুরি মা কয়েকদিন আগে ওদের কাছে এসেছেন। আর কেউ না থাকলেও সে বাড়ি ফিরে যেত না। এমন ঘটনাবহুল তদন্তের মাঝ পথ থেকে কোনক্রমেই যেতে পারে না সে।

-স্যার, আপনার সাথে যেতে পারব। বাড়িতে শাশুড়ি আম্মা আছেন।

-তাহলে খুবই ভাল হলো। কাফরুল থানা থেকে অবশ্য বলেছে ভদ্র মহিলা নাকি যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে ফোনটি কিনেছে। উনাকে নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কে যাব। ফোর্স তৈরি রাখতে বলেছি। মূল চোরকে ধরতে পারলে রহস্যের কিছু কিনারা করতে পারব।

সামিহা নিজেকে সামলে নিয়েছে। এখন সে পায়চারী করছে। মহিলা কনস্টেবল একপাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। শ্রীপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এবাদত ওদের ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিল।

-স্যার চলুন যাই। লাশ ফ্রিজার থেকে বের করা হয়েছে।

“লাশ” শব্দটা শুনে সামিহা আবার ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়েছে। হাসিব এগিয়ে গেলেন।

-সামিহা। চলুন। দেখে আসি।

হাসিবের কথার সুর না “ভরসা” না “আদেশ” এর। তবে কিছু একটা অবশ্যই ছিল। সামিহা টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল।

ফ্রিজার ঘরের সামনে ট্রলির ওপরে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি লাশ রাখা। পাশে একজন ডোম আর ডিউটি ডাক্তার। সামিহাকে মহিলা কনস্টেবল দুজন দুপাশ থেকে দুহাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেল। আরিফ আর এবাদতকে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়াল হাসিব। ডোম ধীরে ধীরে প্রথমে লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দিল।

“ও মা গো” বলেই এক চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল সামিহা। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে। দূর থেকে লাশের মুখায়ব দেখার চেষ্টা করল হাসিব। খুনি প্রফেশনাল। নিখুঁত কোপে কপাল থেকে নাক মুখ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। দূর থেকে দেখেই আন্দাজ করে নিলেন, হত্যাকাণ্ডের পরে ঠাণ্ডা মাথায় তার মুখে জখম করা হয়েছে। মাথা ভারি কোন কিছু দিয়ে থেঁতলে দেয়া হয়েছে। আরিফের চোখে এক ফোঁটা জল এসে চোখের কোণায় আঁটকে আছে। এবাদত ভাবলেশহীন চেহারায় দাঁড়িয়ে। ও নিজেই লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে বলে ব্যাপারটা সয়ে নিয়েছে। মুখ আর মাথা দেখে এক নজরে আসলে কিছুই বোঝার উপায় নেই। হাসিব ডোমের দিকে ইশারায় পুরো কাপড় খুলে দিতে বলল। ডোম ধীর হাতে সাদা কাপড় সরিয়ে নিল। নিষ্ঠুর হাতে খুনি লাশের পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়েছে। “আ পার্ভার্টেড সান অফ আ বিচ”, মনে মনে গালি দিল হাসিব। সামিহাকে মহিলা কনস্টেবল দুজন আবার দাঁড়া করিয়ে দিয়েছে। একটু ঝুঁকে দেখেই এবার “হো হো” হাসিতে ভেঙে পড়ল সামিহা। হঠাৎ কনস্টেবল দুজনার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েই এক দৌড়ে বাইরে চলে এসেছে। হাসপাতালের মূল গেটের দিকে দৌড় দিয়েছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হো হো করে হাসছিল সামিহা। হাসিবের ইশারা পেতেই এবাদত আর আরিফ এক দৌড়ে সামিহাকে ধরে ফেলল।

হাসিবের নিসান এক্সট্রেইল গাড়ির পেছনের সিটে চুপচাপ বসে আছে সামিহা। দুপাশে কনস্টেবল দুজন। হাসিব ড্রাইভিং সিটে উঠে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। আরিফ আর এবাদত একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

-এই লাশ কি আপনার স্বামীর?

একটু ধাতস্থ হয়েছে সামিহা। গোঙানো বেশ কমে এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে দুই চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।

-না। এটা আমার স্বামীর লাশ নয়!

(চলবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here