#চক্রব্যুহ,১৬,১৭
মোহাম্মদ মনোয়ার
[ষোল]
রাত সোয়া একটা। বাইরে ঝিরিঝিরি ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। হাউজ বিল্ডিং পার হয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে চলেছে হাসিবের নিসান এক্সট্রেল। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে রাতের ঢাকা অন্য এক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। ইঞ্জিনের মৃদু গোঁ গোঁ আওয়াজের সাথে হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার পানির উপর দিয়ে টায়ার পিছলে যাবার ছড়াত শব্দ ছাড়া একেবারে শুনশান নিরবতা। গাজীপুর সদর হাসপাতাল থেকে রওয়ানা দিয়ে কেউ কথা বলেনি। সামিহা পেছনে বসে নিঃশব্দে বাইরে তাকিয়েছিল। মিনিট দশেক হবে পেছনের হেড রেস্টে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। রিয়ার ভিউ মিররে একটু পর পর তাকাচ্ছিল হাসিব। পাশের সিটে আরিফও গভীর ঘুমে। হঠাৎ হাসিব খুক খুক করে দুই তিনবার কাশি দিল। আরিফ আড়মোড়া ভেঙ্গে তাকিয়েছে। কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করল। নির্জন রাস্তা, বৃষ্টিতে নিয়নের আলো পেঁজা তুলার মত চারিপাশে গড়িয়ে পড়ছে। একটা ঘোরের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করল আরিফ। সামিহাও নড়েচড়ে বসেছে। বোঝার চেষ্টা করছে গাড়ি এখন কোথায়। আরেকবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল হাসিব।
-সামিহা। এই তিনদিনে আমার বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেছে। আপনাকে অফিসে পৌছেই ভাউচার ইমেইল করে পাঠিয়ে দেব। এখন একটা উপকার করতে হবে।
বড় করে হাই তুলল সামিহা। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কোথায় আছে বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক।
-বুঝিনি।
-আমাদের চুক্তি অনুযায়ী আপনাকে আমার প্রতিদিনের খরচ দেবার কথা ছিল। আনুমানিক বিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। গাড়ির তেল যোগ করলে আরো বেশিই হবে। আমাকে দশ হাজার টাকা বিকাশ করে দিন।
-এখন?
-জ্বী।
-বিকাশ একাউন্টে টাকা আছে কিনা ঠিক জানি না।
-টাকা আছে কিনা চেক করে দেখুন। আমার বিকাশ নম্বর আপনার কাছে নেই। এপসটা ওপেন করুন।
ভয়াবহ সময় পার করে এসেছে এইমাত্র। একটা ভয়ানক ট্রমার মধ্য দিয়ে এসেছে সামিহা। এই সময় কেউ এত নিষ্ঠুরভাবে এমন কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে? ভীষণ ক্লান্তিতে ঘুম চলে এসেছিল। সেই কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে এ কেমন রসিকতা? বিরক্তি চেপে রেখে ব্যাগ খুলে মোবাইল ফোন হাতে নিল সামিহা।
-কিছু টাকা আছে। সাত হাজার টাকা পাঠাতে পারব। নম্বর বলুন।
-০১৯৭৪৮০xxxx
হাসিব রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়েছিল। পকেটের মোবাইলে নোটিফিকেশনের টুং টাং শব্দ ভেসে আসল।
-দেখুন। পাঠিয়েছি।
পকেট থেকে ফোন বের করে চেক করে বা পাশের মগ হোল্ডারে রেখে দিল।
-ধন্যবাদ সামিহা। আমার সত্যিই অনেক উপকার হলো। আপনাকে নামিয়ে আমাকে কাফরুল থানায় যেতে হবে। পকেটে কোন টাকা ছিল না।
-না না। এটা তো আপনার প্রাপ্য টাকা।
মুখে হাসি ফুটিয়ে বলতে চাইল সামিহা। কিন্তু হতাশাভাব লুকোতে পারল না। গলার স্বর কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনাল। আরিফ আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। হাসিব খুব মৃদু ভলিউমে গান ছেড়ে দিল। ওস্তাদ গোলাম আলির গজল। “চুপকে চুপকে রাত দিন। আঁসু বাহানা ইয়াদ হ্যায়।“ বৃষ্টিস্নাত রাতে নিয়নের ক্ষয়ে পড়া ঝাপসা আলোয় কেমন একটা মায়া ছড়িয়ে পড়েছে গানটির সুরের যাদুতে।
…
ভোর সাড়ে পাঁচ। কাফরুল থানা।
সামিহাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আরিফকে নিয়ে থানার ওসির রুমে বসে আছেন হাসিব। ওসি হজরত আলি নিজের খাস কামরায় ঘুমিয়ে ছিলেন। হাত মুখ ধুয়ে উনিও যোগ দিলেন। টেবিলে চা আর সিঙ্গারা রাখা।
-নিন, শুরু করুন। আপনারা নিশ্চয় ভীষণ ক্লান্ত। এসপি আসগর স্যার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। দেখলেন? আমাকেও ঘুম ভেঙে আপনাদের সাথে বসতে হচ্ছে।
খিক খিক করে হেসে উঠলেন ওসি হজরত আলি। বয়স মধ্য পঞ্চাশের ঘরে। চাকরি করতে করতে জীবনের প্রতি বিরক্তি চলে এসেছে বলে মনে হয়। চেহারায় শকুনের ধুর্ততা। চোয়াল বসা। ঝাড়ুর শলাকার মত খাড়া খাড়া কাঁচা পাকা মোছ। দাঁড়ি ক্লিন সেভ করে এসেছেন মাত্রই। কথার ধরণ দেখে আরিফ খুব বিরক্ত হয়েছে। কিছু করার নেই। সারভিসে না থেকেও এটুকু সুযোগ পাচ্ছে। সেটাই অনেক। হাসিব অবশ্য বেশ হাসিখুশি মুখে বসে আছেন। ভেতরের কথা কখনোই তার অভিব্যক্তিতে ধরা পড়ে না।
-ভদ্র মহিলাকে ডাকা যাবে? আশা করি উপরের সব চাপ সামলে তাকে ভালই খাতির যত্ন করেছেন?
হাসিব রসিকতা করার চেষ্টা করলেন। ওসি হজরত আলি হা হা শব্দ করে হেসে উঠলেন।
-সে আর বলতে মশায়!
তারপর হাঁক দিলেন। “এই রহমত, ম্যাডামকে এই ঘরে নিয়ে আয়।“ আবারো খিক খিক করে হাসতে লাগলেন। লোকটির কি হাসির রোগ আছে? আরিফ দুষ্টু প্রকৃতির অনেক অফিসার দেখেছে জীবনে। এই লোকটার আচরণে পুরনো কিছু ঘটনা বিদ্যুৎ চমকের মত মনের পর্দায় উঁকি দিয়ে গেল। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বোরকা পরা একজনকে দেখে চমকে উঠেছে আরিফ। মনে পড়ল সাফোয়ানের ফ্ল্যাটে বোরকা পরে দুজন মহিলা ঢুকেছিল!
বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা সেই মহিলা রুমে এসে ঢুকল। বেশ লম্বা। হাল্কা পাতলা গড়ন। হাতে পায়ে মোজা। চোখে এই রাতেও হাল্কা সানগ্লাস পরা। ভদ্র মহিলাকে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন ওসি।
-বসুন ম্যাডাম! এই ভদ্রলোকদের জন্য আপনাকে বসিয়ে রাখতে হয়েছে। আপনি বাসায় ফোন করে দিতে পারেন। উনারা দু একটা প্রশ্ন করে চলে যাবেন।
মাথা নিচু করে বসে পড়েছেন ভদ্রমহিলা এক পাশে রাখা দুই সিটের সোফা সেটে।
-আমি যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে ফোনটি কিনেছি। আপনাদের মানি রিসিপ্ট দেখানো হয়েছে। আমাকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি করার জন্য আপনাদের সবাইকে কঠিন সময় পার করতে হবে। আগেই জানিয়ে রাখছি।
-আপনার গার্জিয়ান হিসেবে কে আসছেন? একটা মুচলেকা দিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
বেশ নরম গলায় বললেন হাসিব। আরিফ চমকে হাসিবের দিকে তাকাল। কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না? হাসিব স্যার তো ভয় পাবার মানুষ নন!
ওসি হজরত আলিও চমকে গিয়েছেন। মুখ কালো হয়ে গেছে বেচারার। হয়ত ভেবেছিলেন ভোর রাতে বেশ খানিকটা ফালতু সময় কাটাতে হবে।
-আমার ফোন দিতে বলুন।
ওসির দিকে তাকিয়ে বলল বোরকা পরা মেয়েটি। বেশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। গলা শুনে বয়স তিরিশের কোঠায় মনে হচ্ছে। হাসিবের নরম কথায় হয়ত নিজেকে কেউকাটা কেউ ভাবছে। এক উচ্চতা আর গায়ের গড়ন ছাড়া অন্য কোন কিছুই অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। কঠিন পর্দা মেনে চলা মেয়ে মানুষ। কথা শুনে চরিত্র দাঁড় করাতে চেয়েছিল আরিফ। ব্যর্থ হল।
-স্যরি। আপনার ফোন নয় ওটা। ওটার ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে। ফোনটি পুলিশের কাছে থাকবে। আপনি আদালতে মামলা করতে পারেন। কিন্তু চোরাই মোবাইল রাখার অপরাধে আপনাকে সাজাই দেয়া হবে। মোবাইল ফোন নয়!
এবার ভীষণ ঝাঁজাল গলায় উত্তর দিলেন হাসিব। সবাই একটু নড়েচড়ে বসেছে তার গলার স্বরে হঠাৎ এত পরিবর্তন দেখে।
-হজরত আলি সাহেব। আমি উঠছি। উনাকে উনার লিগ্যাল গার্জিয়ানের হাতে ছেড়ে দিন। কয়েকটি শর্ত মানবেন উনি। উনার এনআইডি কার্ড আপনাদের কাছে রাখবেন। আর আমি ক্লিয়ারেন্স না দেয়া পর্যন্ত উনি আপনার থানায় রিপোর্ট না করে ঢাকা শহর ত্যাগ করতে পারবেন না। দুপুর বারটায় উনাকে সহ আপনার ফোর্স যমুনা ফিউচার পার্কে তল্লাশিতে যাবে। ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যবস্থা করে নেবেন, তল্লাশির সময় সাথে থাকবেন উনি। আমার আজ বিকেলে চারটার মধ্যে মূল চোরের হদিস চাই। এসপি আসগর স্যারের কাছে রিপোর্ট করবেন। আরিফ উঠ।
…
-চল তোমাকে একটু ঘুমোবার সুযোগ করে দেই। দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমোবার সুযোগ পাবে। ঠিক বারোটায় খাবার টেবিলে কফি খেতে খেতে গল্প করব।
গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন হাসিব। আরিফ তার আচরণের কোন অর্থই বুঝতে পারেনি। বিশেষ করে হাসপাতালে যাবার পর থেকে হাসিবকে একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকছে। মিরপুর ডিওএইচএস অফিসে পৌছে দুজনেই শাওয়ার নিয়ে নিল। সাইফুদ্দিন ডিমের অমলেট আর লাল আটার রুটি করেছিল। কোন মতে নাস্তা শেষ করে আরিফ উঠে গেল। ওর জন্য পূব দিকের একটা রুম বরাদ্দ করা আছে এই অফিসে। রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল।
…
দুপুর সাড়ে বারটা। মিরপুর ডিওএইচএস। চক্রব্যুহ অফিস।
দু মগ কড়া করে কফি বানিয়ে খাবার টেবিলে রাখল সাইফুদ্দিন। নাস্তা শেষে বসেছিল দুজনে। সাইফুদ্দিন বেচারার মন খারাপ। কোন কিছুই আর শুনতে পায়নি। একবার মিনমিন করে বলেছিল, আমারে কইলে সেই কক্ষন কইয়া দিতাম কেডাত কিডন্যাপ করছে। হাসিব কটমট করে তাকিয়েছে। বেচারা মাথা নিচু করে রান্না ঘরে চলে গেল দুপুরের খাবার আয়োজন করতে। ও চলে যেতে হাসিব এসপি হামিদুল্লাহ বাশার স্যারের গত রাতে হাসপাতালে আসার ঘটনা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন।
-প্রাথমিকভাবে জটিল মনে হলেও ধীরে ধীরে কুয়াশা সরে যাচ্ছে আরিফ!
বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে হাসিবকে। আরিফ ভেবে পেল না এতসব জটিলতার মধ্যে আশার আলো কোথা থেকে পেলেন স্যার। নিজেকে পুরোই এলেবেলে লাগছে।
-কাফরুল থানায় যে মহিলাকে দেখলে তার ব্যাপারে তোমার পর্যবেক্ষণ কী আরিফ?
-স্যার। উনার নামটাও তো জিজ্ঞেস করেননি! কিছুই বুঝিনি স্যার।
বেশ মজা পেয়েছেন বলে মনে হল হাসিবকে।
-হা হা হা! মহিলার নাম রেবতি আহসান। প্রাইম এশিয়া ব্যাংকের ডিএমডি আহসান সাহেবের কনিষ্ট কন্যা। অবিবাহিতা।
-কী করে জানলেন স্যার!
আরিফ নিজেই কুয়াশায় হাবুডুবু খাচ্ছে।
-ওসি হজরত আলি হাসপাতালে থাকতে রিপোর্ট করেছিল।
-মেয়েটিকে সন্দেহ করছেন না? সাফোয়ানের ফ্ল্যাটে দুজন বোরকা পরিহিতা মহিলাই কিন্তু ট্র্যাসপাস করেছিল।
-রাইট। তুমি ঠিকই বলেছ। যে-ই জড়িত থাক, সাফোয়ানের মৃত্যুর পেছনের কারণ নিয়ে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে পৌছেছি।
-বলেন কী স্যার! কখন পৌছুলেন! আমরা তো সব সময় একই সাথে ছিলাম স্যার!
-তুমি ঘুমোতে যাবার পরে তোমার সব কাগজপত্র নিয়ে বসেছিলাম। সাফোয়ানের ফোনের চোর ধরা আসল উদ্দেশ্য নয়। যার বা যাদের থেকে মোবাইল ফোনটি এসেছে, তারাই আমার টার্গেট। তোমার কল লিস্ট থেকে মোটামুটি টার্গেট খুঁজে পেয়েছি! ওসি হজরত আলির কাছ থেকে যমুনা ফিউচার পার্কে তল্লাশির রিপোর্ট পেলে কনফার্ম করব।
আরিফ আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। হাসিব উঠে দাঁড়িয়ে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন । হতাশ হয়ে পড়ল আরিফ। যখনই কোন কিছু জানার জন্য ভেতরে জ্বলে পুড়ে যায়, ছটফট করা শুরু করে, হাসিব ঠিক সেই সময়েই চুপ করে যাবে। কিছুপর হাসিবের সম্ভবত “দয়া” হল। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে খাবার টেবিলে কফির মগ রেখে বসে পড়লেন।
-এসপি হামিদুল্লাহ বাশার স্যারকে কথা দিয়েছি। ওই লাশটি সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছি। দাঁড়াও। ইমেইল চেক করি। কয়েকটি ফোন নম্বরের কল লিস্ট চেয়েছিলাম শ্রীপুর থানায়। এসপি আসগর স্যারের মাধ্যমে গত সাতদিনে নিখোঁজ সংবাদের একটি লিস্ট চেয়েছি দেশের সব থানায়। ওসব এসে পড়ার কথা এর মাঝে।
সত্যি সত্যি ইমেইলে সব লিস্ট পেয়ে গেছেন হাসিব। একগাদা প্রিন্ট নিয়ে টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন কাগজ।
-সাফোয়ানের মৃত্যু রহস্য বের করতে পারলে অনেকখানি এগিয়ে যাব। চেইনের লিংক জোড়া লাগিয়েছি। উইক লিংক খুঁজে পাব সাফোয়ানের ফোন ঠিক কার কাছ থেকে এসেছে এটা উদ্ধার করতে পারলে।
আরিফ কাগজগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। সাফোয়ানের মৃত্যু এবং শ্রীপুরের লাশ। হাসিব দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। হাজার হলেও এসপি হামিদুল্লাহ বাশার নিজেই আগ্রহী ওই লাশ নিয়ে। বেচারা ভীষণ চাপে আছেন। হাসিব তার এক সময়ের বসের সমস্যাও সমাধান করে দিতে চাইছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। এসবের মধ্যে আবার সামিহা অবন্তীর স্বামী আবরার সাহেবের ব্যাপারটা না হাসিব ভুলে যান। একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল আরিফ। হঠাৎ হাসিবের ফোনে রিং টোনে চমকে উঠেছে।
-হ্যালো রশিদ? হ্যা হ্যা। পেয়েছেন? আহ! সুসংবাদ! না না। ঠিক আছে…হ্যা হ্যা। মনে আছে। বিকাশে কিছু টাকা পেয়ে যাবেন। পরে দরকার পড়লে ফোন দেব। আর হ্যা, যেটা বলেছিলাম। সন্দেহজনক কিছু নজরে আসলে আমাকে ফোন দেবেন। আচ্ছা…রাখছি তাহলে।
আরিফ হা হয়ে হাসিবের কথাবার্তা শুনছিল। রুনিদের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সুপারভাইজার রশিদ ফোন দিয়েছিল! ‘ওহ! রুনি!’ ভাবল আরিফ। ‘এখন যতই কান্নাকাটি অনুরোধ করি, এই ক্যারেকটারকে গলান যাবে না।‘ হতাশ হয়ে টেবিলের উপর রাখা কাগজের স্তূপে চোখ ডোবানোর চেষ্টা করল। মন বসছে না।
-তোমার কি মনে আছে আরিফ?
আশার আলো দেখতে পেল আরিফ। ‘এবার স্যার বলবেন!’ চোখে মুখের অভিব্যক্তিতে প্রশ্ন লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করল।
-কোন ব্যাপারটা স্যার?
-নিখোঁজ হবার আগে আগে আবরার সাহেব তৈয়ব শামসের কাছ থেকে বিশ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল? আরো দশ লাখ টাকা তার প্রয়োজন ছিল?
বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে উঠেছিল। ভেবেছিল স্যার ফোনালাপ শেয়ার করবেন। ‘উফ! স্যার কি কখনোই সহজ করে কিছু ভাবতে পারে না?’ একরাশ হতাশা এবার সে কোনমতেই লুকোতে পারল না।
চলবে।
#চক্রব্যুহ
[সতেরো]
-স্যার! টাকার জন্যই কি আবরার হোসেন নিখোঁজ হয়েছেন?
হাসিব উদ দৌলা চেয়ারে হেলান দিলেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। কোন উত্তর দিলেন না। আরিফ জানে এই সময়ে আর কোন প্রশ্ন করে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। শ্রীপুর থানা থেকে পাওয়া কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার। কফি খেতে ইচ্ছে করছে। আপনার জন্য আনব এক মগ?
-মন্দ হয় না। নিয়ে এসো। তোমার হাতে এক্সপ্রেসো বেশ হয়!
দুই মগ এক্সপ্রেসো কফি নিয়ে এসে দেখে হাসিব বারান্দায় পায়চারী করছে। টেবিলে মগ দুটি রেখে বারান্দায় উঁকি দিয়ে ছোট করে ডাক দিল। “স্যার!”
-ওহ এসেছ তুমি?
ভুলে গেলেন কি কফি বানাতে গেল সে? এত বেশি আনমনা দেখাচ্ছে হাসিবকে!
-স্যার, কফি এনেছি। টেবিলে রাখা। এখানে নিয়ে আসব?
-ও! না না। আমিই আসছি। চলো।
চেয়ারে বসে কফির মগ উঠিয়ে এক চুমুক দিয়েছেন হাসিব। চেহারায় তৃপ্তির একটা ভাব। তারমানে কফিটা ভালই বানিয়েছে সে!
-শোনো আরিফ। তোমাকে দুটো কাজ দিচ্ছি। তোমার মোটর বাইক নিয়ে এক টান দিয়ে রুনিদের ফ্ল্যাটে চলে যাবে। সুপারভাইজার রশিদ সিসি ক্যামের রেকর্ড করা ভিডিও দেবে। ওখান থেকে যাবে হাজারীবাগ থানায়। বলে রেখেছি। ওরাও তোমাকে বেলায়েতের গাড়ি এক্সিডেন্টের সিসি ক্যাম ভিডিও দেবে। বেশ বড় ফাইল হবে। এই যে, ১২৮ জিবির এই পেন ড্রাইভটা নিয়ে যাও সাথে। তুমি আসলে একসাথে বনানী যাব। এক্সপ্রেস ডেভলপার কোম্পানির হেড অফিসে। এমডি আবির হাসান সাহেবকে এসপি আসগর স্যার বলে রেখেছেন। কিছু ইনফো সংগ্রহ করতে হবে।
আচ্ছা! তাহলে সুপারভাইজার রশিদ তখন ফোনে সিসি ক্যাম রেকর্ডের কথা বলেছিল! মনে মনে খুশি হলো দায়িত্ব পেয়ে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হবার জন্য দাঁড়িয়েছে, দেখে হাসিব পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে হাতে নিয়েছে।
-হ্যালো নাসিম। তোমাকে আর একটা নম্বর দিচ্ছি। এই নম্বরটির গত এক মাসের কল লিস্ট চাই আমার। হ্যা, হ্যা। হুম। আজই দেবে। যত দ্রুত সম্ভব। নম্বরটা টুকে নাও। ০১৭১১২xxxxx।
নম্বরটি কার শোনা হলো না। ফোন কেটে আবার আরেক নম্বরে ফোন দিয়েছেন হাসিব। আরিফকে ইশারায় বসতে বললেন। মুখে বললেন, ‘শ্রীপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এবাদত হোসেন।‘ লাউড স্পিকার অন করে দিয়েছেন।
-স্যার বলছি। কেমন আছেন?
-ভাল।
-লাশটি আইডেন্টিফাই করা গেল?
-না স্যার। জোর চেষ্টা করছি। ক্লু পাচ্ছি না স্যার।
-হুম। কাল রাত হয়ে গিয়েছিল। তোমাদের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট এ ঠিক কী বলেছ শোনা হয়নি। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট কে তৈরি করেছিল?
-স্যার আমিই তদন্তকারী অফিসার।
-গুড! ময়না তদন্তের প্রাথমিক ফল কি হাতে এসেছে?
-জ্বী স্যার।
-একটা ইনফরমেশন দিন। কতদিন আগে মারা গেছে সে?
-স্যার এক মিনিট। দেখে বলছি…। হ্যা স্যার। ডাক্তারের মতে তিন দিন আগে। অর্থাৎ আঠারো তারিখ দুপুরের পর পর। ভিসেরা রিপোর্ট পেলে অবশ্য আরো বিস্তারিত জানা যাবে। সম্ভবত রাতের অন্ধকারে পুকুরে ফেলে রেখে গিয়েছিল। লাশ উদ্ধার করেছি উনিশ তারিখ ভোরে। এরপর থেকে মর্গে আছে। সুরতহাল রিপোর্ট এমনই দিয়েছিলাম স্যার। কীভাবে খুন করা হয়েছে বলব?
-না, না। তার প্রয়োজন নেই। আচ্ছা রাখছি। কোন খবর পেলে আমাকে সাথে সাথে জানাবেন। তাহলে রাখছি।
আরিফ নিরবে শুনছিল। আঠারো তারিখ হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ আবরার হোসেনের নিখোঁজ হবার তিনদিন পরে। এমন কি হতে পারে না এটা আবরার হোসেনেরই লাশ? তবে কি সামিহা অবন্তি ইচ্ছে করে নিজের স্বামীকে অস্বীকার করেছে? মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সামিহা অবন্তির হাসি। লাশ দেখার পরে সে এমন অদ্ভুত আচরণ করল কেন? কী তার সাইকোলজি?
এসব ভাবতে ভাবতে সিসি ক্যামের রেকর্ডেড ড্যাটা আনতে চলে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে যাবে, হাসিব ফোনে তখন আরেকটি নম্বরে ডায়াল করলেন। এবারও লাউড স্পিকার অন করে রিং করেছেন। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ শোনা মাত্রই হাসিব উত্তর দিলেন।
-হ্যালো কামাল?
-জ্বী স্যার! স্যার অনেকদিন পরে! কেমন আছেন স্যার?
-ভাল আছি। কাল রাতে গিয়েছিলাম তোমাদের এলাকায়।
-জ্বী স্যার। এমপি স্যারের পুকুরে যে লাশ পাওয়া গেল সেটা দেখতে এসেছিলেন। আমি আজ সকালে খবর পেয়েছি স্যার। আপনি জানিয়ে আসলে তখন থাকতাম স্যার।
-ওই লাশ নিয়ে কথা বলার জন্যই তোমাকে ফোন দিয়েছি।
-স্যার, লাশের পরিচয় বৃত্তান্ত লাগবে? কী নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে স্যার। লাশ দেখে আমার মত মানুষও ভয় পেয়ে গেছে স্যার!
-ভয় পাবারই কথা। আমিও এমন হিংস্রতা খুব বেশি দেখিনি। শোনো। অন্য একটা কাজ করে দিতে হবে।
-স্যার বলুন। কামালের কাছে অসম্ভব বলে কোন শব্দ নেই স্যার। আপনাকে আগেও অনেক ইনফরমেশন জোগাড় করে দিয়েছিলাম স্যার। এই কামাল ছাড়া আর কেউ এত নির্ভুল সংবাদ দিতে পারবে না স্যার।
-আমি জানি। সে জন্যেই তো তোমার নাম স্মরণ করা। লাশটি এমপি সাহেবের পুকুরে পাওয়া গেছে। প্রাথমিক ময়না তদন্তে তার হত্যাকাণ্ড হবার কিছু পরে পুকুরে ফেলে দেয়া হয়েছিল। তারমানে কী দাঁড়াল বলতে পারবে কামাল?
-স্যার। আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ। আপনি বলে দেন।
-তারমানে যাকে খুন করা হয়েছে সে অন্য অঞ্চলের মানুষ হতে পারে। তবে খুনি তোমাদের এলাকার। স্থানীয়। লাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খুনী হয়ত একা নয়। খুনের সাথে অনেকে জড়িত। কিন্তু স্থানীয় একজন হলেও সেই খুনের সাথে জড়িয়ে ছিল। তারা বেছে বেছে এমপি সাহেবের পুকুর বেছে নিয়েছে।
-জ্বী স্যার! তাইতো!
এই পর্যায়ে বোঝা যাচ্ছিল কামাল বেশ অবাক হয়েছে। আরিফ মনে মনে খুশি হয়েছে নিজের অবজারভেশন মিলে যাওয়াতে।
-এমন নৃশংস খুন করার মত কে কে আছে খোঁজ নাও। খুনটি পলিটিক্যাল কারণে হতে পারে। আবার স্রেফ কিডন্যাপিং এর কারণে হতে পারে। যে কারণেই খুন হয়ে থাকুক, এমন কে কে থাকতে পারে আমাকে তাদের নাম আর মোবাইল নম্বর বের করে দেবে।
-স্যার ধরে নেন কাজটা হয়ে গেছে। … স্যার…
-কাজটা যে হয়ে যাবে সেটা আমি জানি। কিন্তু তোমাকে সময় দেয়া যাবে না। তোমাদের এসপি স্যার যে আমাকে ভীষণ ভালবাসেন সেটা নিশ্চয় তুমি জান?
-জানি স্যার। আজ তো সবাই বলাবলি করছে আপনাদের মিল মোহাব্বত নিয়ে।
-ইয়েস। উনার সম্মানের দিকে তাকিয়ে কাজটা করছি। তুমি কাল সকাল দশটার মধ্যে আমাকে জানাবে। লোক লাগিয়ে দাও।
-স্যার…
আমতা আমতা করতে লাগল কামাল নামের ইনফরমার ছেলেটি।
-বুঝতে পেরেছি। দশ হাজার টাকা বিকাশ করছি। ভাগ করে দাও যাদের কাজে লাগাচ্ছ। তাহলে রাখছি।
-জ্বী জ্বী স্যার। ফোন দেব আপনাকে স্যার।
ফোন কেটে দিয়ে মৃদু হেসে আরিফের দিকে তাকালেন হাসিব।
-কিছু বুঝতে পারলে আরিফ? স্যারের কাজ করে দিতে পকেট থেকে কিছু টাকা গচ্চা দিতে হলো। জানোই তো। থানার তদন্তে একটু ঢিলেমি থাকে। সাথে থাকে রাজনৈতিক বা বিভিন্ন উঁচু মহলের চাপ। আমি চাইছি সঠিক তথ্য। অতি অল্প সময়ে।
-জ্বী স্যার। বুঝতে পেরেছি। আর তখন বলেছিলেন সিসি ক্যামের রেকর্ডেড ভিডিও নিয়ে আসতে। যাব আমি?
-ভাল কথা। চল আমিও যাই তোমার সাথে। মাথাটা ধরে আছে। তোমার মোটর সাইকেলে চড়লে ফ্রেশ হাওয়ায় মাথা ধরাটা কমবে মনে হয়। চল যাওয়া যাক।
…
*বিকেল পাঁচটা। বনানী কামাল আতাতুর্ক লেন। এক্সপ্রেস ডেভলপার কোম্পানির হেড অফিস।*
এমডি আবিদ হাসান সাহেব অফিসে ছিলেন না। উনি জরুরী কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছেন। হাসিবদের অবশ্য এমডি সাহেবের অফিস রুমে বসতে দেয়া হয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মধ্য তিরিশের সুঠাম দেহের এক যুবক ঢুকে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ডিরেক্টর আরফান হাসান । চেহারায় একটা বনেদি ভাব রয়েছে। কথা ও আচরণেও সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এমডি সাহেবের চেয়ারে বসতে বসতে খুব করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন আবিদ হাসান সাহেব কথা দিয়েও উপস্থিত থাকতে পারেননি বলে। হাসিব বেশ খেয়াল করে দেখেছে। অতি ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণীর মানুষজন বাবা, মা, ছেলেমেয়ে বা ভাইবোনদের সম্মোধন করে বিশেষ কায়দায়। যেমন এমডি সাহেব। চেয়ারম্যান ম্যাডাম। ছোট সাহেব ইত্যাদি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। “এমডি সাহেবের তরফ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”, কথা শুরুই হয়েছে এইভাবে!
-আপনি হয়ত জানেন আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য।
খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলেন হাসিব।
-জ্বী। আমি এমডি সাহেবের কাছ থেকে অল্প জেনেছি। তাছাড়া প্রোকিউরমেন্ট ডিপার্টমেন্টের জেনেরাল ম্যানেজার সাহেবও জানিয়েছেন। বলুন কী কী জানতে চাচ্ছেন।
-হয়ত অবগত আছেন আমি এক বিশেষ তদন্তে এখানে এসেছি। এক ভদ্রলোকের মিসিং কেইস নিয়ে কাজ করছি।
-অল্প জেনেছি। পুলিশের হেড অফিস থেকে ফোন এসেছিল আপনাকে যেন সব ধরণের সহায়তা করা হয়।
এতক্ষণে বোঝা গেল এত নম্র ভদ্র আচরণের পেছনের কারণ। আরিফ ফিক করে হেসে দিয়েছিল। ডান হাত মুষ্ঠিবিদ্ধ করে হাসি আর চেহারার এক্সপ্রেশন আড়াল করার চেষ্টা করল।
-ধন্যবাদ। আমাকে শুধু অল্প কিছু ইনফো দিয়ে সাহায্য করতে হবে। রুনি চৌধুরীর শান্তি নগরের বাড়িতে আপনারা কাজ শুরু করেছেন। প্রজেক্টের নাম রুনি এক্সপ্রেস নিলয়।
-জ্বী। ওটার কাজ বেশ এগিয়ে গিয়েছে।
-বাড়িটা তো পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে দুই ভাইয়ের নামে নামজারি করা ছিল। বাটোয়ারা দলিল হয়েছিল কি?
-একটু দেখতে হবে। …হ্যা, মনে পড়েছে। করা হয়েছিল। নয়ত আমাদের টিম এত বড় রিস্ক নিতে সাহস করত না।
-কিন্তু আমার কাছে কিছু ইনফো আছে। বড় ভাই আবরার হোসেন মামলা করেছিল কয়েক মাস আগে। তার সিগনেচার নকল করে নাকি বাটোয়ারা দলিল করা হয়েছিল।
এবার কিছুটা সময় নিলেন আরফান হাসান। “স্যরি” বলে ইন্টারকমে কাউকে ডেকে পাঠালেন। তারপর হেসে বললেন, আমাদের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান আনিসুজ্জামানকে ডেকে পাঠিয়েছি।
লম্বা, হ্যাংলা পাতলা গড়নের এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যে একগাদা ফাইল নিয়ে কামরায় ঢুকল।
-উনি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। আপনি উনাকে প্রশ্নটি করুন প্লিজ।
হাসিব একই প্রশ্ন আনিসুজ্জামান সাহেবকে করলেন। উনি ফাইল ঘেটে দেখলেন কিছুক্ষণ।
-স্যার। হ্যা। একটা আপত্তি মামলা করেছিলেন আবরার হোসেন। তবে উনি নিজেই আবার সেই আপত্তি মামলা উঠিয়ে নিয়েছেন। মামলা খারিজ হয়ে গেছে।
মনে হলো বেশ অবাক হয়েছেন হাসিব উদ দৌলা। আরিফের অবশ্য মনে হয়েছে স্যার নিখুঁত অভিনয় করছেন।
-আচ্ছা! কবে নিস্পত্তি হলো!
-স্যার সেটাও অনেকদিন হবে। দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে।
আনিসুজ্জামান আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। ডিরেক্টর সাহেবের দিকে অনুমতি পাবার অপেক্ষায় আছেন বলে মনে হলো।
-আপনি বিস্তারিত বলতে পারেন আনিস সাহেব।
আরফান হাসান সম্মতি দিলেন।
-স্যার। ইনফ্যাক্ট আমরা পুরো বাড়ি নিয়ে কাজ করছি। প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট রাজউকে নতুন প্ল্যান জমা দিয়েছে। দুই ভাইয়ের অংশ একত্র করে সেখানে ডেভলপ করা হবে।
হাসিব চমকে আরিফের দিকে একবার তাকালেন। আরিফের কাছে হাসিবের এই চমকে ওঠাটাও ‘ফেইক’ বলে মনে হল।
-মানে বলতে চাইছেন আবরার সাহেব নিজেই আপনাদের কাছে তার অংশের জন্য যোগাযোগ করেছিলেন?
“অনেকটা তাই”, এবার উত্তর দিলেন আরফান হাসান।
-সাইনিং মানি হিসেবে তাকে আমাদের পক্ষ থেকে অতগুলো টাকা দেয়া সম্ভব ছিল না। উনার হয়ত প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিল। সাইনিং মানি যা অফার করা হয়েছিল তাতে উনি রাজি হননি। শেষে আমাদের কাছে জমিটা বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। এখানেও সমস্যা বেঁধেছিল। আমাদের বিজনেস পলিসি হলো যৌথ মালিকানায় প্রজেক্ট করা। আমাদের সব প্রজেক্ট যৌথ প্রজেক্ট। অর্থাৎ মালিকের শেয়ার থাকে সেখানে।
-তাহলে সমাধান হলো কী করে?
-আপনি তো জানেন হাসিব সাহেব। আবরার সাহেব এমন অবস্থায় অন্য ডেভলপার কোম্পানির কাছে যেয়ে সুবিধা করতে পারতেন না। সাধারণত পারিবারিক জটিলতার এই ধরণের কেসে নতুন ডেভলপার সেখানে যাবে না। এটা এক ধরণের ব্যবসায়িক এথিক বলতে পারেন। অন্য কারো কাছে বিক্রি করতে হলেও বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হত। সেটা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হত। উনি আসলে রুনি চৌধুরীর কাছে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন! আমরা রুনি চৌধুরীর সাথে নতুন এগ্রিমেন্টে কাজ শুরু করেছি।
হাসিব আবার রীতিমত চমকে আরিফের দিকে তাকিয়েছে। আরিফের কাছে ব্যাপারটায় একটু খটকা লেগেছে। এতদিন স্যারকে সে চেনে। কখনো তার মুখে কোন অভিব্যক্তিই ধরা পড়ে না। আজ হঠাৎ এমন পরিবর্তন! বারে বারে চমকানোর ভাণ করছেন!
-খবরটির জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমরা আজ উঠব।
বলেই উঠে দাঁড়িয়েছেন হাসিব। আরফান হাসান আর আনিসুজ্জামানও উঠে দাঁড়িয়েছেন। আরফান সাহেবের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন হাসিব।
-ইট ওয়াজ নাইস টু মিট ইউ মিস্টার আরফান হাসান। উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট।
-ইট ওয়াজ মাই প্লেজার। আপনার আর কোন সংবাদ জানার থাকলে নির্দ্বিধায় চলে আসবেন। আপনাদের জন্যও আমার শুভ কামনা রইল।
অফিস থেকে বের হয়ে হাসিব আর কোন কথা বললেন না। নিসান এক্সট্রেইল এসইউভি’র ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলেন। আরিফ সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসে সিট বেল্ট লাগাল।
-আবরার ফাইয়াজদের শান্তিনগরের বাড়িতে তোমাকে দারোয়ানের সাথে কথা বলতে পাঠিয়ে আশেপাশে খোঁজ খবর নিয়েছিলাম আরিফ। অনেকগুলো খবর পেয়েছিলাম। সেগুলো ভেরিফাই করতে এখানে এসেছিলাম।
ওহ! তাহলে স্যার এই কাজ করেছেন সেদিন! কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করল আরিফ। রুনি চৌধুরীর বাড়ি না বলে আবরার ফাইয়াজদের বাড়ি বলেছেন হাসিব।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এসি অন করেছেন, তখনই হাসিবের মোবাইল ফোনে রিংটোন। স্পিকার অন করে ফোন কানে তুললেন। মুখে মৃদু এক অবজ্ঞার হাসি। যেন জানতেন এই ফোন কল আসবেই!
-হাসিব সাহেব?
-জ্বী বলছি। রুনি চৌধুরী?
-জ্বী।
-বলুন কী করতে পারি?
-আপনার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা শেয়ার করার ছিল। এখন আসতে পারবেন? আমি বাড়িতেই আছি।
চলবে।