#চক্রব্যুহ,১৮,১৯
মোহাম্মদ মনোয়ার
[আঠারো]
জরুরী! জরুরী কথা! অবশেষে রুনি চৌধুরীকে ফোন করতেই হলো!
আরিফের দিকে মৃদু অবজ্ঞার হাসিতে তাকিয়েছেন হাসিব। চোখে মুখে দুষ্টুমির ছায়া।
-জরুরী কথা? ফোনেই বলুন।
একটু সময় নিল রুনি। কিছু একটা হয়েছে। গলার স্বরে ঘাবড়ে যাবার স্পষ্ট ছাপ।
-আপনাকে সামনা সামনি বলতে চাচ্ছি।
ভেঙে গেলেও মচকাবেন না এই মহিলা। ভাবল আরিফ।
-আপনি সাহায্য চাইলে ফোনেই বলুন। নয়ত কোর্টে আইনজীবীর মাধ্যমে কথা হবে আমাদের। আপনার নামে মামলা প্রক্রিয়াধীন। হয়ত ইতোমধ্যে জেনে গেছেন।
কঠিন স্বর হাসিবের। হাসিবের এই ক্ষণে বদলে যাওয়া কঠিন কোমল রূপ খুব উপভোগ করে আরিফ। তবে এবার সত্যিই ভেঙে গেছেন মহিলা।
-দেখুন আমি ব্যক্তিগত আর ব্যবসায়িক জীবনে যথেষ্ট ঝামেলায় আছি। নতুন করে ঝামেলায় জড়াতে চাই না আর। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
-আপনাকে হাজারীবাগ থানা থেকে ফোন করেছিল। তাই তো?
-হ্যা হ্যা।
-বেলায়েতের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল আপনার? সেটা জানতে চেয়েছিল ওরা। বলেছিলেন?
-বলিনি।
-আপনাদের কথার অডিও থানা থেকে চাওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানলয়ে। ওরা কি এই ইনফো আপনাকে জানিয়েছে।
-কী!
রীতিমত চমকে উঠেছে রুনি। নিশ্চয় এমন কিছু আশা করেনি।
-হ্যা। সিসিক্যামের ভিডিও পর্যালোচনা করে থানাকে বলে দিয়েছিলাম করণীয় কী।
-আপনি বলে দিয়েছেন! আপনি?
অবিশ্বাসের কণ্ঠ রুনির। রাগ, হতাশা আর দুঃশ্চিন্তায় এলমেলো হয়ে পড়েছে। রুনির অভিব্যক্তি দিব্য দেখতে পাচ্ছে আরিফ। হাসিবের এই ব্যাপারটা অন্য রকম। মানুষের আবেগ নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা সে সব সময়েই উপভোগ করে।
-হ্যা। আপনি আমাকে সহায়তা করতে চাইছেন না। আপনার বাসায় আমাদের সাথে আপনার ব্যবহার আপনি ভুলে যেতে পারেন। আমি ভুলিনি।
-আমি খুবই লজ্জিত। আসলে…
-আসলে কী? আমি বলে দেই। আপনি আমাকে যথেষ্ট হাল্কা ভাবে নিয়েছেন। আমার প্রোফাইলে রাজনৈতিক বা উঁচু মহলের চাপ বলে কোন শব্দ নেই। আমি আমাকে না সরালে কারো ক্ষমতা নেই আমাকে সরানোর। বেলায়েতকে গাড়ি চাপা দেবার সময়ে সে কারো সাথে কথা বলছিল। এবং কল লিস্ট অনুযায়ী অপরপক্ষ ছিল রুনি চৌধুরী। ফোনে কথা বলতে বলতে সে এলোমেলো হাঁটছিল। এতটাই আনমনা হয়ে পড়েছিল সে যে পেছনের গাড়ি বারবার হর্ণ বাজালেও খেয়াল করেনি। ড্রাইভারে যতটুকু দোষ ছিল, ততটুকু দোষ বেলায়েতেরও ছিল। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আপনাদের মাঝে কী কথা হয়েছিল।
রুনিকে হতবিহ্বল করে দিয়ে থামলেন হাসিব। রুনি শ্বাস নেবার স্পেস খুঁজে বেড়াচ্ছে।
-আমরা কি সিকিউরড লাইনে কথা বলছি?
-নিশ্চিন্তে থাকুন। আমাদের কথোপকথন কেউ ‘ট্যাপ’ করছে না।
-তারপরেও। প্লিজ আসুন না আমার এখানে। চা খেয়ে যাবেন।
গ্রীন টি’র কথা এখনো মনে আছে আরিফের। ‘ওয়াক’ করে শব্দ করে মুখের সামনে হাত নিয়ে আসল।
-দেখুন মিস রুনি। আপনি কিছু লুকোতে চাইলে আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব না। কী কথা হয়েছিল, সেটা বললেই যথেষ্ট। কেন হয়েছিল সেটা না জানালেও চলবে। পুলিশ থেকে যদি আপনাদের কল রেকর্ড উদ্ধার করা হয়, এবং দেখা যায় আপনার যোগসাজশে বেলায়েত ঘটনা ঘটিয়েছিল, আপনি কী করে পার পাবেন সেটা একবার ভেবে দেখেছেন? আপনাকে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি বলেই জেনেছি। নয়ত এত বড় ব্যবসা সামলানো অন্য কারো জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যেত।
রুনি বিচলিত ছিল। সরাসরি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।
-না না। ওভাবে বলবেন না। আমি আসছি আপনার কাছে। কোথায় আছেন সেটা বলুন। মুখোমুখি কথা বলি।
…
“সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। মিরপুর ডিওএইচএস। চক্রব্যুহ অফিস”
সাইফুদ্দিন দুই মগ কফি রেখে গেছে খাবার টেবিলে। হাত মুখ ধুয়ে হাসিব আর আরিফ কল লিস্ট চেক করছিল। নিকুঞ্জ থানা থেকে ফোন এসেছে। নিকুঞ্জ থানার ইনস্পেক্টর হাবিব ফোন করেছেন।
-স্যার। আফসানা সাফোয়ান ম্যাডামের চুরি যাওয়া ফোনের আসল চোর ধরা পড়েছে!
-ওহ! দারুণ সংবাদ। তার আগে বলুন আমি যে বলেছিলাম ইন্ট্রুডার দুজনেই পুরুষ, বোরকার আড়ালে ও বাড়িতে ঢুকেছিল। আপনারা আবার ভুল করে মেয়ে আসামী গ্রেফতার করেননি তো?
-হা হা হা। না স্যার। পুরুষ আসামীই ধরা হয়েছে!
-কখন ধরেছেন? দুজনকেই ধরেছেন?
-জ্বী স্যার। দুজনকে একসাথে পাওয়া গেছে। আজ দুপুরে। বেড়িবাঁধ এলাকার সাদেক খান রোড এর এক পান সিগারেটের দোকানে বসে চা সিগারেট খাচ্ছিল দুজনে। তবে এর আগে ‘ডাল’ খাবার আলামত পাওয়া গেছে স্যার।
-হা হা হা! ডাল, মানে ফেন্সিডিল? যাহোক, এদের থেকে কথা আদায় করতে পেরেছেন কি?
-স্যার, দুজনেই পিওর ড্রাগ এডিক্টেড। উল্টাপাল্টা কথা বলছে। একজন বলছে আবরার হোসেনকে নিজের হাতে খুন করেছে। আরেকজন বলছে সাফোয়ানের কাছে দুই লক্ষ টাকা পাওনা ছিল। সেই টাকা আদায়ের জন্য বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা ওকে বিষ বা ড্রাগ কিছুই খাওয়ায়নি।
-একটা নম্বর ট্র্যাক করতে বলেছিলাম। ওটার কী খবর?
-স্যার। কথা হয়েছে সেই ভদ্রলোকের সাথে। আপনি যে নামগুলো সাজেস্ট করেছিলেন। ইনি তাদের একজন।
হাসিব এই সময়ে ইনস্পেক্টরের কথা কেড়ে নিলেন।
-কে? জিসান আহমেদ?
-জ্বী স্যার। উনিই!
-এক কাজ করুন। এদের সাথে জিসান আহমেদের কথা বলিয়ে দিন। জিসানই ওদের পাঠিয়েছিল আফসানা সাফোয়ানের বাড়িতে। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে নন বেইলেবল কোন মামলায় ওয়ারেন্ট বের করে ওকে ধরে নিয়ে আসুন। তারপর কথা বের করুন। আমার হাতে সময় নেই। কাল বিকেলের মধ্যেই রেজাল্ট চাই। আপনি আমার কাজের ধরণ জানেন। চেইনের সব লিংক জোড়া দিতে না পারলে সমাধানে আসতে পারছি না।
-জ্বী স্যার। সেটা আমরা ভাল করেই জানি স্যার। ডি আই জি শোয়েব চৌধুরী স্যার সেদিন এই মামলায় আপনার সংশ্লিষ্টতার কথা শুনে বেশ খুশি হয়েছেন। আমি এক পার্টিতে ছিলাম। স্যার বলছিলেন আপনার মেধা, কঠোর পরিশ্রম আর লেগে থাকার ক্ষমতা নিয়ে। কাল দুপুরের মধ্যেই সংবাদ পাবেন স্যার।
ফোন কেটে আরিফের দিকে তাকালেন। তারপর কফির মগ থেকে এক চুমুক কফি খেলেন। বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কফি। “সাইফুদ্দিন” বলে হাঁক দিলেন। “সাইফুদ্দিন। আরো দুই মগ কফি চাই আমরা। কুইক!”
চেহারার এই এক্সপ্রেশনের সাথে সাইফুদ্দিনের ভালোই পরিচয় আছে। তদন্তের শেষের দিকে স্যার যখন ঘোরের ভেতরে থাকেন, সেই সময়ে এমন দেখা যায়। সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “স্যার, তাইলে মনে হয় আমারে নিয়া ঘুরবার সময় আইসা গেছে। মামলা ডিসমিস!”
হো হো করে হেসে উঠলেন হাসিব। হাসতে হাসতেই ওর কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
-এখন কড়া করে কফি বানিয়ে নিয়ে আয়। কফি ভালো হলেই তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব। ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড!
এদিকে আরিফ ছটফট করছিল। সে অনেক কিছুই জানে না। স্যার কখন এসব ভেবেছেন বা ওকে না জানিয়ে আর কার কার সাথে কথা বলেছেন, সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিল। সাইফুদ্দিন রান্না ঘরে ঢুকে যেতেই আরিফ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
-স্যার! জিসান আহমেদ কী করে এর মধ্যে এসে গেল! আবরার হোসেনের বাড়িতে উনি ছাড়াও আরো অনেকেই জুয়ার আসরে বসতেন। স্পেসিফিক্যালি উনাকেই কেন সন্দেহ করলেন?
-আবরার হোসেনের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। পোস্টটি অনলি মি করে রেখেছিল কয়েকদিন। এরপর ডিলিট করে দেয়। চার মাস আগের পোস্ট ছিল ওটা। নাসিমকে দিয়েছিলাম ওর প্রোফাইল চেক করতে। ওর খুব ঘনিষ্ট বন্ধু আদনান বাংলাদেশের সেরা হ্যাকারদের একজন।
হাসিব থেমে গেলেন এটুকু বলে। আরিফের মন ভরল না। সাইফুদ্দিন কফি নিয়ে এসেছে। দুজনেই মগ তুলে দুই এক চুমুক দিলেন নীরবে। আরিফ আর অপেক্ষা করতে পারল না।
-স্যার, তারপর?
-তারপর তো সহজ। তাই না? এই জিসানের কাছেই তিন স্টেকে চল্লিশ লাখ টাকা হেরে বসেছিল আবরার হোসেন। টাকা দিতে না পেরে সাফোয়ানকে ওর হাতে তুলে দেয়। আবরার কিন্তু এর আগেও বেশ কয়েকবার জুয়ার বোর্ডে হেরে সাফোয়ানকে বিভিন্ন জনের হাতে তুলে দিয়েছিল। এইসব সাংকেতিক ভাষায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অনলি মি করে রাখত। জিসানকে একদিন খুন করবে, এমন কথাও লিখেছিল একদিন। আমাদের অনেকেরই ডায়রি লেখার অভ্যাস আছে না? ডায়রিতে যেমন আমাদের মনের অনেক কথা লিখে রাখি, আবরার হোসেনও তার পোস্টে অমন করে লিখে রাখত। তবে পোস্টগুলো অনলি মি করে রাখা থাকত।
আরিফ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে শুনে। উঁচু মহলের এই অতি নোংরা দিক নিয়ে শুনেছিল আগে। জুয়ার বোর্ডে হেরে নিজের স্ত্রী’কেও অন্য কারো কাছে তুলে দেয়ার ঘটনা। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুর মুখোমুখি হওয়া এই প্রথম।
-স্যার! ফেসবুকের মত একটা প্লেসে এগুলো লিখে রেখে গেছে! এমন বোকামি সে কী করে করেছিল? এটা কি স্যার ক্রাইম সিনে অলক্ষ্যে কিছু ক্লু রেখে যাওয়া টাইপ তাহলে!
-অনেকটাই তাই। তবে এটা আধুনিক যুগের ভার্চুয়াল ক্লু।
এমন সময়ে কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল। সাইফুদ্দিন দরোজা অল্প ফাঁক করে নাম পরিচয় জেনে ফিরে এসেছে।
-স্যার। রুনি চৌধুরী নামের এক “ক্যাংটা” মহিলা আইছেন। আপনে নাকি আইতে কইছেন তারে?
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠেছে। তারপর সাথে সাথেই নিজেদের সংবরণ করে নিল। বাইরের দরোজা খুব বেশি দূরে নয়। “দুষ্টু” বোঝাতে “পুংটা” আর তার অপভ্রংশ এই “ক্যাংটা”। কোথা থেকে যেন এই শব্দ মুখে তুলে নিয়েছে সাইফুদ্দিন। সুযোগ পেলেই শব্দটা ব্যবহার করে। তাই বলে রুনি চৌধুরীর মত কোন নারীর ক্ষেত্রে এই বিশেষণ ওদের ধারণার বাইরে ছিল।
ইশারা করে নিয়ে আসতে বলে দিলেন হাসিব। একটু পরেই রুনি চৌধুরীকে দেখা গেল। হাসিব ওকে শর্ত দিয়েছিলেন একা আসতে হবে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই চারিদিকে তাকিয়ে হয়ত বোঝার চেষ্টা করল কতটুকু নিরাপদ সে এখানে। গোল্ডেন পিংক স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে গোল্ডেন জরির কাজ করা ভারি জামদানি শাড়িতে বেশ অভিজাত লাগছে রুনিকে।
-সাইফুদ্দিন, গ্রীন টি নিয়ে আয় ম্যাডামের জন্য।
আরিফ অনেক কষ্টে হাসি থামিয়েছে। সাইফুদ্দিন তার ক্যাংটা গেস্টের জন্য চা করতে রান্না ঘরে চলে গেল।
-বি কমফোর্টেবল রুনি।
-থ্যাংকস। এখানে আমরা এই চারজন ছাড়া আর কেউ কি আছি?
-না। একেবারে নিরাপদ। এখানে সিসি ক্যামেরা নেই। বা ট্যাপিং করার কোন যন্ত্রপাতিও নেই। মোবাইল সিগন্যাল জ্যামিং করারও ব্যবস্থা রাখিনি এখানে।
রুনিকে সম্ভাষণ করতে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল হাসিব। নিজের চেয়ারে বসতে বসতে কোমরের কাছ থেকে তার অতি প্রিয় ওয়ালথার টিপিএইচ পয়েন্ট টু টু বোরের পিস্তলটা বের করে আলগোছে টেবিলের উপরে রেখে দিল। রুনি হাসিবের উল্টোদিকে আরিফের পাশে বসেছে। আরিফ অবিশ্বাস আর বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কল্পনায় রুনির হা করা মুখ দেখে ফেলেছে। পাশ ফিরে রুনির দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না।
-রুনি চৌধুরী। আপনাকে আমি সর্বোচ্চ সহায়তা করব। বিনিময়ে সব খুলে বলবেন। বেলায়েতকে কীভাবে ব্যবহার করেছিলেন। সেটা। আর আবরার হোসেন নিখোঁজ হবার দুদিন পরে আপনার ফ্ল্যাটে একজন ট্র্যাসপাস করেছিল। সেই ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাই আমি।
(চলবে।)
#চক্রব্যুহ
[উনিশ]
রুনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার সামনে রাখা পিস্তলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের চোখকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। একবার ভেবেছিল একা একা অপরিচিত জায়গায় আসাটা উচিত হবে কিনা। বাস্তব জীবনে সে যথেষ্ট সাহসী মেয়ে। ঠিকাদারি পুরুষ প্রধান একটা ব্যবসা। প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপর মহল, রাজনৈতিক ও অন্যান্য নানাবিধ জায়গা থেকে আসা চাপ সামলে সে ব্যবসা শুধু টিকিয়েই রাখেনি, খুব দ্রুত উপরে উঠেও গেছে। এটা ঠিক, মাথার উপরে ভাই ছায়া হয়ে আছেন। তবুও প্রতিদিনের হাজারো সমস্যা তাকে একা একাই সামলাতে হয়। আজ ব্যতিক্রম হয়েছে। নিজেকে এই প্রথম খুব নিঃসঙ্গ আর অসহায় লাগছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। হাসিব উদ দৌলার কঠিন ব্যক্তিত্ব তাকে পরাভূত করে ফেলেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করছে অভিব্যক্তিতে নিজের দুর্বলতা ঢেকে রাখার। গলাটা শুকনো ঠেকছে।
-এক গ্লাস পানি পেতে পারি?
গলাটা সম্ভবত হাল্কা কেঁপে উঠেছে। ডান হাত মুখের সামনে নিয়ে দুই তিনবার কাশি দিয়ে মুখ আড়াল করল।
সাইফুদ্দিন রান্না ঘর থেকে উঁকি মেরে “ক্যাংটা” অতিথির দিকে তাকিয়ে ছিল। এক গ্লাস পানি এনে টেবিলে রেখে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসল। পানি টেবিলে রেখে আসতে রুনির চোখের দিকে এক নজর দেখে এসেছে সে। কথাবার্তা শুনে ওর মনে হচ্ছে এই মহিলাই গুম নাটকের মূল হোতা।
-রুনি, আপনি শুরু করুন।
হাসিবের কথায় নিজেকে একটু ফিরে পেয়েছে রুনি।
-আমি আবরারের নিখোঁজের সাথে মোটেই জড়িত নই।
টেবিলে রাখা পিস্তল রাশান রুঁলের মত এক পাঁক ঘুরিয়ে দিল হাসিব। পাঁচ ছয়বার ঘুরে পিস্তলের নল রুনির দিকে স্থির হলো।
-ফাইয়াজের সাথে বিয়ে হবার আগে আবরারের সাথে আপনার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাকে বাদ দিয়ে ফাইয়াজকে বিয়ে করেছিলেন কেন?
ভীষণ চমকে গেছে রুনি। আরিফের মুখ রীতিমত “হা” হয়ে গেছে। কী শুনছে সে! রুনি মাথা নিচু করে ফেলেছে। হয়ত কথা হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। একবার কাঁধ শ্রাগ করল রুনি। হাসিবকে পড়তে পারছে না সে।
-আবরারের নিখোঁজের সাথে এই প্রশ্নের কী সম্পর্ক?
নিজেকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টা। হাসিব তাকে বুদ্ধিতে কাবু করে ফেলেছে। ভেবে আরো অসহায় লাগছে নিজেকে।
-প্রতিশোধ। যদি বলি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছেন?
-ফাইয়াজের সাথে পরিচয় হবার পরে বুঝতে পারি আবরার ঠিক আমার মত নয়।
-ইয়েস। আবরার বোকা। এবং আবেগি। আপনার আর ফাইয়াজের মত ধূর্ত নয় সে। কাজেই আবরারকে ছুঁড়ে ফাইয়াজের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুললেন। তবে ফাইয়াজের সাথে বিয়ে করার পরে দেখলেন, আবরার ফাইয়াজের চেয়ে কম ধূর্ত নয়। সে একে একে পারিবারিক সবকিছু দখলে নিয়ে নিচ্ছে।
-হ্যা। অস্বীকার করছি না।
-আবরার আপনাকে ঘৃণা করত। কোন পুরুষই নিজের প্রেমিকাকে আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে দেখতে রাজি নয়। আবরারের এই চরিত্র কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
-অস্বীকার করব না। এই কারণেই আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যাই। এক বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ফাইয়াজকে ভালোবাসার সাথে সাথে তাকে প্রটেকশন করাটাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ওর প্রাপ্য সম্পত্তি পাবার ব্যাপারে আমার ইনভলমেন্টের দরকার ছিল।
-আবরারকে গুম করতে চেয়েছিলেন কেন? স্বামী হত্যার প্রতিশোধ?
“কী!” বলে লাফিয়ে উঠেছে রুনি।
-শান্ত হোন। বসুন।
চেয়ার টেনে বসে পড়ল রুনি।
-আপনার অনেক জটিলতা আমাকে হতবিহ্বল করেছে মিস রুনি। আপনি চাইছেন না। তাই ফাইয়াজের নিখোঁজ হবার ব্যাপারে তদন্ত করার আগ্রহ আমার নেই। আবরারকে কেন গুম বা হত্যা করতে চেয়েছিলেন, সেটা জানার চেয়েও জরুরী বেলায়েতকে কীভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন সেটা জানা। একটা নিরাপরাধ ছেলের প্রাণ কেন কেড়ে নিতে চাইলেন? কী লুকোতে চেয়েছিলেন?
দুই হাতে মাথা চেপে ধরেছে রুনি। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। খুব সম্ভবত কাঁদছে। আরিফ মন্ত্রমুগ্ধের মত হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকিয়েছে রুনি। দু ফোঁটা অশ্রুজল চোখের কোণায় উঁকি দিয়েছে।
-বেলায়েত জানত আবরারের ‘হোয়্যার এবাউট’। আবরারের সাথে ওর যোগাযোগ ছিল।
…
-হ্যালো কামাল, তোমার সকালের দিকে ফোন দেবার কথা ছিল। এত দেরি করলে? কিছু জানতে পারলে?
-স্যার। সেটার জন্যই তো ফোন দিলাম।
উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে কামাল। আরিফের দিকে তাকিয়ে ফোনকল স্পীকারে দিয়ে দিলেন হাসিব।
-স্যার! লাশের পরিচয় জানলে আপনিও চিনতে পারবেন। থানা থেকে আমাকে ফোন দেয়া হয়েছিল। আমি বলে দিয়েছি আপনাকে না জানিয়ে কিছুই বলতে পারব না।
-ঠিক করেছ কামাল। নাম বল।
-স্যার সাইফ খান। ক্ষমতাসীন দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক। গত বারে যিনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
-হোয়াট! কী বলছ তুমি! তুমি নিশ্চিত?
-জ্বী স্যার। আমি নিশ্চিত। এখন কী করব স্যার?
আরিফ খেয়াল করল হাসিব ফোন কানে ধরে পায়চারী শুরু করে দিয়েছেন। অথচ স্পীকার অন করেই এতক্ষণ কথা বলছিলেন! পায়চারী করতে করতে তার প্রিয় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। আরিফ দরোজায় দাঁড়িয়ে রইল।
-আমি এসপি হামিদুল্লাহ বাশার স্যারের সাথে কথা বলছি এখনই। তোমার বিকাশ একাউন্টে আরো কিছু টাকা চলে যাব। সবার মুখ বন্ধ করে দাও। আমি ফোন না দিলে নিজের থেকে আমাকে আর ফোন দেবার প্রয়োজন নেই। বুঝতে পেরেছ?
-জ্বী স্যার। আমাদের সবার মুখ বন্ধ থাকবে।
‘ওকে বাই’ বলে ফোন কেটে দিয়ে অন্ধকারে বাইরে তাকিয়ে রইলেন হাসিব। আরিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল পরিস্থিতি। এমন হাই প্রোফাইল একজন রাজনৈতিক নেতার খুন হবার ঘটনায় প্রশাসনে আলোড়ন তুলে যাবে। হাসিব স্যার কি এর সাথেও জড়িয়ে যাবেন? খুব সম্ভবত এসপি হামিদুল্লাহ বাশার স্যারকে ফোন করেছেন এবার। কানে চেপে ধরে খুব আস্তে আস্তে কথা বলছেন। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল আরিফ। লাশের পরিচয় দিলেন। ও পাশের কথা শোনা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল এসপি স্যার উত্তেজনায় ফুঁসছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার অধীন এলাকায় এমন হাই প্রোফাইল রাজনৈতিক নেতা খুন হয়েছেন। নিশ্চয়ই প্রচণ্ড চাপে পড়ে গেছেন। আবার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এমপি সাহেবের বাংলো বাড়ির পুকুর থেকে। একই রাজনৈতিক দলের দুজন হাই প্রোফাইল ব্যক্তি।
-হ্যা হ্যা স্যার। …জ্বী স্যার। না স্যার। সমস্যা নেই স্যার।… আপনি বলেছেন, এটা আমার জন্য শিরোধার্য। …অবশ্যই আমি তদন্তের সাথে থাকব স্যার… আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন স্যার।
আরো কিছুক্ষণ ‘স্যার স্যার’ বলে ফোন কেটে দিয়ে আরিফের দিকে তাকালেন হাসিব। খুব হতাশায় ঘেরা সেই চেহারা। এক মামলার তদন্ত চলছে। এই সময়ে আরো একটা কঠিন তদন্তে জড়াতে হচ্ছে। হতাশায় ভোগাটাই স্বাভাবিক।
-স্যার। কি সিদ্ধান্ত নিলেন। সাইফ খানের কেসটা নিচ্ছেন আপনি?
-না না। তেমন কিছুই নয়। তবে স্যার আমাকে ছেড়েও দিলেন না। অন্য সব ডিপার্টমেন্টের তদন্তে আমাকে সাথে থাকতে বললেন। বুদ্ধি পরামর্শ দিতে বললেন। বলতে পার আমি ডাইরেক্টলি তদন্তে যুক্ত না হয়েও থেকে যাচ্ছি ছায়ার মত।
-স্যার। এই সাইফ খানের একটা কেস আপনি তদন্ত করেছিলেন। আমার এখনো মনে আছে স্যার।
-ঠিকই বলেছ। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে সরকারের মধ্যেও যথেষ্ট সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন। রুবাইবা চৌধুরীর মত নাম করা নায়িকাকে তার কারণেই আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিতে হয়েছিল। সেই কেসটা আমিই হ্যান্ডেল করেছিলাম। তদন্তে প্রমাণ করেছিলাম এই কেসে তার সরাসরি ইনভলবমেন্ট ছিল, এক নম্বর আসামী করে রিপোর্ট দিয়েছিলাম। চারপাশের সব মহলের থেকে প্রচণ্ড চাপে পড়েছিলাম এফআইআর এ মিথ্যে তথ্য দিতে। তার নাম সরিয়ে ফেলতে। এসপি হামিদুল্লাহ বাশার স্যার আমার পাশে ছিলেন বলেই সেই যাত্রায় বেঁচে যাই। তাকেও কিন্তু এর মাশুল দিতে হয়েছে। প্রমোশন আটকে গিয়েছিল। স্যার একক প্রচেষ্টায় সেই সময়ে আমার অবধারিত বদলিটা ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। বলতে পার সাইফ খান আমার প্রিম্যাচুরড অবসর নেবার পেছনে অল্প হলেও ভূমিকা রেখেছিলেন।
-স্যার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিছু তথ্য চাইবার ব্যাপারে ফোন করতে চেয়েছিলেন!
-হ্যা হ্যা। এত এত ঘটনা একসাথে এসে হাজির হয়েছে! শরিফ আহমেদকে ফোন করে আবরার হোসেনের সব একাউন্টের ব্যাপারে তথ্য চাও। আমার নামের সাথে এসপি আসগর স্যারের নামও উল্লেখ করবে। তাকে উপযুক্ত সম্মানী দেয়া হবে এটাও জানিয়ে রাখবে।
-জ্বী স্যার।
…
‘রাত্রি সাড়ে এগারটা। চক্রব্যুহ অফিস। বারিধারা ডিওএইচএস।‘
সাইফুদ্দিন রাগে গজগজ করতে করতে এই একটু আগে ঘুমোতে গিয়েছে। এই প্রথম সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। হাসিব উদ দৌলার কাছে পাত্তা পায় না বলে আরিফের কাছে এসেছিল। আরিফ তখন ঘুমোবার আয়োজন করছে। নিজের সন্দেহের কথা বলে গিয়েছে। রুনি তার প্রথম সন্দেহ। বেলায়েতকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে। সাফোয়ানের মৃত্যুও আবরারের জন্য হয়েছে।
সাইফুদ্দিন চলে যেতেই দরোজায় মৃদু টোকা।
-আরিফ।
-স্যার।
দরোজায় ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকলেন হাসিব।
-তোমার বাড়িতে চলে যাওয়া উচিত। অয়োকা একা একা সামলে উঠতে পারছে না। এখন চলে যাও। কাল সকাল সকাল চলে এসো।
আরিফও ভাবছিল এমন কিছু। বাড়িতে মন পড়ে আছে। অয়োকা একা একা কী করে সামলাচ্ছে। আবার এই তদন্ত থেকে দুরেও থাকতে ইচ্ছে করছে না।
-মনে আছে রুনি বলে গেল আবরারের শেষ লোকেশন গাজীপুরের শ্রীপুরে? সাইফ খানের লাশও সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দুজনের নিখোঁজ বা খুন হবার সময়টাও কাছাকাছি। আজ সারারাত ভাবব ব্যাপারটা নিয়ে। তুমি ঘুরে এস বাড়ি থেকে।
হাসিব ঢোকার সাথে সাথে আরিফ বিছানায় উঠে বসেছিল। ‘হোয়াট’ বলে এবার লাফ দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে।
-নাসিমের কাছে সাইফ খানের ফোনের সব তথ্য চেয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যাব।
-স্যার। অয়োকা শক্ত মেয়ে। একা একা সমস্যা হলে আমাকে ফোন করত। রাতটা থেকে যাই স্যার?
(চলবে।)