চক্রব্যুহ,২২,২৩

0
105

#চক্রব্যুহ,২২,২৩
মোহাম্মদ মনোয়ার
[বাইশ]

‘বিকেল চারটা, শ্রীপুর থানা, ওসির কক্ষ।‘

ওসি কামরুজ্জামান সাহেবের কক্ষে বসে আছে হাসিব আর আরিফ। ওদের সামনে তিনজন। হাতকড়া খুলে দেয়া হয়েছে। ওসি সাহেব তার চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

একটার দিকে ফোন করে ওসি কনফার্ম করেছিলেন লিস্টের চারজনের তিনজনকে ধরে এনেছেন। কিন্তু হাসিব তাকে বলে দিয়েছেন সাড়ে তিনটায় আসবেন। একটায় না এসে সাড়ে তিনটায় কেন থানায় যাবে, আরিফ একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। দুটোর সময় থানা থেকে একটু দূরে এসে গাড়ি থামিয়েছেন। কিন্তু গাড়ি থেকে নামেননি। আরিফের কাছে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিছু প্রশ্ন করেছেন। কল লিস্ট ধরে ধরে মিলিয়ে দেখেছেন। ঠিক সাড়ে তিনটায় থানা কমপ্লেক্সে গাড়ি ঢুকিয়েছেন। থানায় ঢুকেই ওসি সাহেবের সাথে দেখা করেছেন। পনের মিনিটের মত সময় নিয়ে ব্রিফিং করেছেন। হাসিব কী করবেন, আরিফ বা ওসি সাহেবের দায়িত্ব কী হবে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরপরে উনার খাস কামরায় ঢুকে গেছেন সাথে আনা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে। একটু পরে যখন বের হলেন, তাকে দেখে রীতিমত চমকে গেছে দুজনেই। কমপ্লিট স্যুট টাই পরেছেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কাঁচা পাকা নকল মোছ-চাপদাড়ি আর সাথে মাথায় ডলসি গ্যাবানার ‘হোগান’ ক্যাপ। পুরোদস্তুর ‘ইংলিশ জেন্টেলম্যান’ দেখাচ্ছে।

-এখানে সুলতান শাহ কে?

হাসিব সামনে বসা তিনজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিনজন পরস্পরের দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না।

-দেখুন আমি ঢাকা থেকে এসেছি। আপনাদের সাহায্য করতে। আপনারা আমাকে কো-ওপারেট না করলে কী করে সাহায্য করব?

এবারও তিনজনেই চুপ করে রইল। উত্তর দিল না।

-ইমতিয়াজ আহমেদ সাহেবের সাথে কথা হয়েছে একটু আগে। শুনেই রওয়ানা দিয়েছি। উনি নিজেই আমাকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছেন। ব্যাপারটার গুরুত্ব নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

এবার একটু নড়েচড়ে বসেছে তিনজনই। কিন্তু মুখ খুলল না কেউ।

-জিসান আহমেদ এন্ড গং দের পক্ষ হয়ে একটা ডাবল মার্ডার কেসের মামলায় আহমেদ ল ফার্মের কয়েকজন ব্যরিস্টার লড়াই করেছিলেন। চার বছর আগের সেই ডাবল মার্ডার কেসের প্রধান আসামী ছিলেন জিসান আহমেদ। দুই নম্বর আসামী ছিলেন সুলতান শাহ। দশ দিন করে দুই দফায় রিম্যান্ড এ নেয়া হয়েছিল তাদের। দুরূহ মামলায় জামিনসহ অভিযোগ থেকে আসামীদের পুরো মুক্ত করা হয়েছিল। সেই আহমেদ ল ফার্মের প্রধান আমি। ব্যারিস্টার সৌরভ আহমেদ।

“স্যার আপনি নিজে এখানে! স্যরি স্যার, আপনাকে একদম চিনতে পারিনি”, অবাক হয়ে উত্তর দিল মাঝখানে বসা প্রায় ছয় ফুট লম্বা ‘মান্যভার’ ব্রান্ডের হাল্কা ক্রিম রঙের পাঞ্জাবী পরা লোকটি। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। ফর্সা গোলগাল মুখ। চাপদাড়িতে পীরজাদা লাগছে দেখতে। বয়স খুব সম্ভবত চল্লিশ পার হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে এসে হাসিবের দুই পা ছুঁয়ে সালাম করে বসে রইল। এমন সম্ভ্রান্ত কেউ কারো পা ছুঁয়ে বসে আছে, এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। হাসিব আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখলেন।

-প্লিজ উঠুন সুলতান শাহ।

-স্যার। আমার অনেকদিনের আশা ছিল আপনার দেখা পেলে দু পা জড়িয়ে ধরব। আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম স্যার। আপনার মত সাক্ষাৎ দেবতা এই দেশে দেখা পাওয়া বিরল। সেই মামলায় আপনার ল ইয়ার ফার্ম লড়েছিল বলেই আজও বেঁচে আছি স্যার। রায় হবার আগের দিন আপনি ইংল্যান্ড চলে গেলেন। আপনার সাথে আর দেখা হলো না!

হাসিব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সুলতানের দু কাঁধ ধরে দাঁড়া করিয়ে দিলেন।

-না না। ঠিক আছে। আপনি বসুন।

সুলতান শাহ এর চোখে মুখে উজ্জ্বল এক হাসি লেগে আছে। সম্ভবত আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। অন্য দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জুয়েল আর করিম। দুজনের বয়স মধ্য তিরিশের ঘরে। এদের দেখতেও বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। ফুলহাতা শার্টের সাথে ক্যাজুয়াল প্যান্ট পরা। পায়ে দামী জুতো।

ব্রিফিং করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে এগুবেন হাসিব, আরিফ ধারণা করতে পারেনি। চোখ মুখের এক্সপ্রেশন লুকিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। হাসিবের কড়া নির্দেশ। কিছুতেই যেন তিনজনের কেউ বুঝতে না পারে ওদের এখানে আসার উদ্দেশ্য। ওসি কামরুজ্জামান অবশ্য মোবাইল থেকে মুখ উঠাচ্ছেন না। সুলতান শাহ এবার সিরিয়াস চেহারায় হাসিবের দিকে তাকাল।

-স্যার। কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আমাদের ধরে আনা হয়েছে কেন! জেলা কার্যালয়ে বিকেলে দলীয় মিটিং ছিল। একসাথে কার্যালয়ে যাব ভেবে ওদের দুজনকে আমার অফিসে আসতে বলেছিলাম। সেখান থেকে তিনজনকে মাদক মামলায় ওয়ারেন্ট দেখিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হলো। তবে স্যার, কিছুক্ষণের মধ্যেই দলের লোকজন টের পেয়ে যাবে। দলের লোকজন থানায় এসে ঝামেলা করতে পারে। ওসি সাহেবকে বুঝিয়ে বলেছিলাম। উনি শুধু বললেন এসপি স্যারের নির্দেশ।

থানায় ‘গ্রেফতার’ করে নিয়ে আসাটা সুলতান শাহ এর পছন্দ হয়নি। বেশ উচ্চ গলায় কথাগুলো বলে থামল। ওসি কামরুজ্জামানের মধ্যে ভাবান্তর দেখা গেল না। মোবাইলে তাকিয়ে রইলেন।

-না না। উনারা আমার নির্দেশ বুঝতে ভুল করেছিলেন। আপনাদের গ্রেফতার করে আনতে বলিনি। শুধু বলেছি থানায় নিয়ে আসার জন্য। একটা সেফ প্লেসে আপনাদের সাথে কথা বলতে চেয়েছি। নিরিবিলিতে। আলোচনা শেষ হলে আপনারা এখান থেকে চলে যাবেন। তবে আমি যেভাবে বলব, ইমতিয়াজ সাহেব নিজে অন্য কিছু না জানালে তা মেনে চলবেন প্লিজ।

-স্যার। বুঝতে পেরেছি আমাদের ভুল করে গ্রেফতার করেছেন ওসি সাহেব। কিন্তু কী নিয়ে এত জরুরী তলব, সেটা তো বুঝতে পারছি না স্যার!

পায়ের কাছে পাশে রাখা চামড়ার ব্যাগের চেইন খুলে ভেতর থেকে পলিথিনে মোড়ানো একটা হাতুড়ি আর একটা পিস্তল টেবিলের উপর রাখলেন হাসিব। আরিফ আর ওসি জানত ব্যাপারটা। দুজনেই নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইল টেবিলে রাখা অস্ত্রের দিকে। হাতুড়ির মাথা আর কাঠের হাতলে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

-১৮ তারিখ সন্ধ্যার দিকে সাইফ খান মারা গেলেন। যার লাশ আপনাদের এমপি সাহেবের বাড়ির পুকুর থেকে উদ্ধার করা হলো!

এবার তিনজনেই প্রায় একসাথে “কী” বলে দাঁড়িয়ে গেছে। হাসিব পিঠ সোজা করে বসলেন।

-হ্যা। এই তথ্য পেয়েই ইমতিয়াজ সাহেব আমাকে ফোন করলেন। টেবিলের ওপরে রাখা অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

জুয়েল আর করিম অবাক চোখে টেবিলের অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সুলতান শাহকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ চমকে গেছে। চোখে মুখে হতভম্ব ভাব।

-স্যার। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সাইফ ভাই নেই!

সুলতান শাহ এর হতভম্ব ভাব আর অবাক হবার অভিনয় খুব একটা ভাল হচ্ছে না। আরিফের মনে হচ্ছে এই ‘ভদ্রলোকের’ হাত আছে সব কিছুতে।

-জ্বী। সাইফ খান ইমতিয়াজ সাহেবের খুব কাছের একজন। স্বভাবতই খুব ক্রুব্ধ হয়েছেন। উনি চারদিন পরে দেশে ফিরছেন। টিকেট কনফার্ম করে ফেলেছেন।

-কিন্তু আপনাকে ভাই এখানে কেন পাঠালেন!

-উনি নিজেই ভালো বলতে পারবেন আমাকে অনুরোধ কেন করেছেন। সাইফ খান আপনাদের পলিটিক্যাল পার্টির জনপ্রিয় নেতা। সাথে বিশাল ব্যবসায়ী। সবাই জানে এমপি সাহেবের সাথে সাইফ খানের দীর্ঘদিনের মনোমালিন্য, রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দ্বন্ধ। সাইফ খান এমপি সাহেবের জন্যই এবার নমিনেশন পাননি। এদিকে বেশ কয়েক মাস ধরে সাইফ খানের সাথে আপনাদের গন্ডগোল চলছিল। এই সুযোগে এমপি সাহেবের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আল্টিমেটলি তীর কিন্তু আপনাদের দিকেই যাবে। এসব ইমতিয়াজ সাহেবের অভিমত। আপনারা এক ঢিলে দুই পাখি সড়াতে চেয়েছেন। সাইফ খান এবং এমপি সাহেব।

শেষের দিকে বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন হাসিব। তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। চমকে গেছে সুলতান শাহ। হতভম্ব ভাবটা প্রকট দেখাচ্ছে এখন। এক গ্লাস পানি চাইল ওসি সাহেবের কাছে। গলা কেঁপে যাচ্ছিল। এক চুমুকে গ্লাস খালি করে হাতের চেটো দিয়ে ঠোঁট মুছল।

-সাইফ খানের সাথে শেষ কথা কবে হয়েছে আপনার? আমার সব তথ্য লাগবে। যদি বাঁচতে চান। ইমতিয়াজ সাহেবকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। উনি রাগ করেন, এমন কিছু কড়া উচিত হবে না আপনাদের। মোবাইল দেখে কনফার্ম করেন সাইফ খানের সাথে শেষ কবে কথা বলেছেন।

কাঁপা হাতে পকেট থেকে মোবাইল বের করল সুলতান শাহ। স্ক্রল করে কল লগ দেখল। গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় এবার মোটামুটি সফল হলো সে।

-গত পনের তারিখ সন্ধ্যায়। গাজীপুরে পার্টি অফিসে তার সাথে আমার একটা মিটিং ছিল সেদিন। তাকে কার্যালয়ে না পেয়ে ওখান থেকেই ফোন করি। যুগ্ম সম্পাদক হাবিব আমার সাথে ছিল তখন। সাইফ ভাইকে কে নাকি শ্রীপুরে যেতে বলেছিল। উনি সেদিন বিকেলেই শ্রীপুরে চলে গিয়েছিলেন। এরপরে আমার বা গাজীপুরের কারো সাথে উনার যোগাযোগ নেই।

-দেখুন। আমাদের ফার্ম সব সময়েই ইমতিয়াজ সাহেবের হয়ে লড়াই করবে। আপনি বা সাইফ খান, সবাই তার নিজের লোক। আপনাদের আইনি লড়াই এ বাঁচানোর দায়িত্ব আমার। ইমতিয়াজ সাহেব দেশে না ফেরা পর্যন্ত কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে চাইছি।

-বুঝতে পেরেছি।

বেশ ম্লান শোনাল সুলতান শাহের গলা। হাসিব হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক প্রশ্ন করলেন। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘আউট অফ দ্যা ব্লু’। আরিফ সত্যি সত্যি আকাশ থেকে পড়ল প্রশ্ন শুনে।

-ঢাকার কলাবাগানের আবরার হোসেন নামের ভদ্রলোককে কতদিন হলো চেনেন আপনারা?

সুলতান শাহদের সাথে কথা শেষ করে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছিল। ওসি কামরুজ্জামানকে বলে এসেছেন ওদের ঘণ্টা খানেক পরে ছেড়ে দিতে। আর ওদের সাবধান করে দিয়েছেন, যেন কোন ক্রমেই সাইফ খানের মৃত্যু সংবাদ পুলিশ প্রকাশ না করা পর্যন্ত আর কারো সাথে আলোচনা না করে। তাতে হীতে বিপরীত হতে পারে। ওরা ফেঁসে যেতে পারে।

গাড়িতে উঠে ‘ব্যারিস্টার সৌরভ আহমেদে’র কাপড় বদলিয়ে নিজের জামা কাপড় পরে নিলেন হাসিব। তবে মোছ আর দাড়ি রেখে দিলেন।

-বনানী যেতে হবে মনে আছে?

-স্যার! মনে আছে। একসময়ের ডাকাবুকা ছাত্রী নেত্রী খুরশিদা বেগমের বাড়ি।

“রাইট!” বলে আরিফের দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসলেন।

-বলতে পারবে দুপুর একটার সময়ে না যেয়ে চারটায় সুলতান শাহদের সাথে দেখা করার কারণ?

আরিফ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠে নিজেই উত্তর দিলেন।

-ওদের একটায় গ্রেফতার করা হলো। সাথে সাথে গেলে বলতাম কী করে ঢাকা থেকে গিয়েছি? তাই তিন ঘণ্টা দেরি করে ধীরে সুস্থ্যে থানায় গেলাম!

‘রাত নয়টা, বনানী প্লে গ্রাউন্ডের সাথে ছাব্বিশ নম্বর সড়ক। সাইফ খান এবং খুরশিদা বেগমের তিন তলা বাংলো বাড়ি।‘

-গাজীপুরের শ্রীপুর থানা থেকে ফোন দিয়ে আপনাদের কথা বলা হয়েছিল। আপনারা সম্ভবত সাইফ খানের নিখোঁজ সংবাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। প্রাইভেট গোয়েন্দা। ঠিক?

হাসিবকে প্রায় পনের বছর পরে মনে করতে পারেনি ভদ্র মহিলা। নকল দাঁড়ি আর মোছ দেখে হাসিবকে সহসা কারো চিনতে পারার কথাও নয়।

এক তলার পুরোটা জুড়ে বসার ঘর। বাইরের সবুজ লনে গোল করে বানানো ঝর্ণার ঠিক মাঝখানে শ্বেত পাথরের বিশাল এক নারী মুর্তি। এক বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিক থেকে পানি মা আর বাচ্চাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। আলোছায়ায় খুব মনোরম একটি দৃশ্য। ঝর্ণা থেকে একটু দূরে সুইমিং পুল। পুলের পাশে তিনটে বিচ ইজি চেয়ার। বিত্ত বৈভবের কমতি নেই কোন। ওদের সামনে মার্বেল পাথরের টেবিল। দশ বার রকমের ফল দিয়ে সাজানো। সাথে আইসক্রিম।

-জ্বী। ঠিকই বলেছেন।

-কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

-আপাতত একটা প্রশ্ন করে উঠে যাব। উত্তর দিতে চাইলে দিতে পারেন। তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। সাইফ খানের ব্যাপারে খুব সম্ভবত কাল বা পরশু আপনাকে ‘ফার্ম’ কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারব।

-কিছু মুখে দিন আগে। আমার বাড়ি থেকে কাউকে না খেয়ে যেতে দেই না আমি।

ভদ্রমহিলা বয়স লুকিয়ে রেখেছেন ভালই। আরিফের থেকে তিন বছরের সিনিয়র। নিয়মিত জিম করেন। খাবার দাবারেও নিশ্চয় খুব বাছ বিচার করেন। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও চেহারায় আভিজাত্য ভাব ফুটে আছে। হয়ত অতি ধনী বলে আপনা আপনি ব্যাপারটা ঘটে গেছে।

-না। আমাদের সারারাত কাজ করতে হবে। প্রশ্নটা করেই চলে যাব।

-অন্তত এক টুকরো আপেল মুখে দিন!

-ধন্যবাদ ম্যাডাম। প্রশ্নটা করছি। সামিহা অবন্তী নামের কাউকে চেনেন আপনি?

ভূত দেখার মত চমকে উঠেছেন খুরশিদা বেগম। এমনিতেই ফর্সা। কিন্তু প্রশ্নটা শুনে মুখের রং আরো সাদা হয়ে গেছে। তাকে এখন দেখাচ্ছে সাদা তেলাপোকার মত।

(চলবে।)

#চক্রব্যুহ

[তেইশ]

‘রাত্রি এগারটা। মিরপুর ডিওএইচএস। চক্রব্যুহ অফিস।‘

খুরশিদা বেগমের বাড়ি থেকে ফিরে দুজনেই গোছল সেরে খাবার টেবিলে বসেছে। সাইফুদ্দিন অল্প সময়ে তেমন কিছুই রান্না করতে পারেনি। ফ্রিজে অনেকদিন আগের ইলিশ মাছের চারটা টুকরা ছিল। সাদা ভাত। সাথে বগুড়ার লাল আলুর ভর্তা আর সরিষার তেলে শুকনো মরিচ আর ঝুরি করা পেঁয়াজের সাথে মুচমুচে ভেজে দেয়া গরম গরম ইলিশ মাছের টুকরো। মুশুর ডালের চচ্চড়ি। সাইফুদ্দিন মাথা নিচু করে ওদের প্লেটে খাবার বেড়ে দিল।

-আরিফ, তদন্তের গতিপথ এতক্ষণে বুঝে গেছ কোন পথে গিয়েছে?

-স্যার। মনে হয় বুঝতে পেরেছি কিছুটা। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থই নয়। ব্যবসায়িক দ্বন্ধও এখানে সমানভাবে জড়িয়ে আছে।

-ঠিকই বলেছ তুমি। ক্ষমতা আর টাকার লোভ। এই দুইটি লোভ মানুষকে কী করে একেবারে অন্ধ করে করে ফেলে তা এই কেস তার যথার্থ প্রমাণ। সাথে যদি একজন পুরুষের জীবনে থ্রি ডব্লিউ জড়িয়ে যায়, তাতে সে কতটুকু নিচে নামতে পারে, সেটার প্রকৃষ্ট উদাহরণও এই হত্যাকাণ্ড আর গুমের মধ্যে ফুটে উঠেছে।

-জ্বি স্যার। থ্রি ডব্লিউ! সেই যে বলেছিলেন এদের থেকে শত হাত দূরে থাকতে। উমেন, ওয়াইন এন্ড ওয়েজাহ। মেয়ে মানুষ, নেশা দ্রব্য আর জুয়া!

-রাইট!

তারপর সাইফুদ্দিনের দিকে তাকালেন।

-সাইফুদ্দিন! তোকে গোয়েন্দা বানানো যাবে না। তুই হবি ফাইভ স্টার হোটেলের চিফ কুক! তোকে আমি পর্যটন কর্পোরেশনের রান্নার কোর্সে ভর্তি করে দেব। তার আগে পড়াশোনা শুরু করবি। তোর হাতে যাদু আছে। ইলিশ মাছের তেলটা দিয়ে কী মুচমুচে শুকনো মরিচ ভেজেছিস! আহ! অমৃত! ঠিক না আরিফ?

আরিফও এমনটাই ভাবছিল। সত্যিই সাইফুদ্দিফনের হাতে যাদু আছে।

আবার কথা বলা শুরু করলেন হাসিব।

-আরিফ। আমরা নিজেদের ভুল কখন বুঝতে পারি?

-স্যার যখন আমাদের ফিরে যাবার আর কোন পথ খোলা থাকে না!

-ঠিক বলেছ। ফিরে যাবার সব পথ রুদ্ধ হবার পর মনে হয়, এ আমি কী করেছি!

আরিফের মনের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ। টেনশনে ওর মাথা ঠিক কাজ করছে না। এই সময়ে ইন্টেলেকচুয়াল কথাবার্তা মাথায় ঢুকবে না। সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল।

-স্যার, আবরার সাহেবের নিখোঁজ রহস্যের কোন কূল করতে পারলেন? আমার মাথায় তো হাজার প্রশ্ন স্যার।

আরিফের হাজার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন হাসিব। তবে উত্তর দিলেন। নিজের মত করে।

-কূল কিনারা? মনে হয় হয়েছে। আরো একটু কাজ করতে হবে। চেইন গড়ে ফেলেছি আরিফ। আজ রাতে বাড়ি ফিরে যাবে। নিশ্চয় অয়োকা আমাকে ভুল বুঝে আছে। ওকে সময় দাও কয়েকদিন। আমি এর মাঝে চেইনের লিংকগুলো নিয়ে ভাবব। কিছু শক্ত প্রমাণের খোঁজে এদিক সেদিক যাব। আজ রাতে পুরো রেস্ট নেব। ব্রেন একটু বিশ্রাম চাচ্ছে। সকালে উঠে ঠিক করব কোথা থেকে শুরু হবে। ভালো কথা। এই পর্যন্ত আমাদের খরচের একটা হিসাব রেডি করে রাখবে।

-স্যার। আমি তো সব খরচের হিসাব সাথে সাথেই টুকে রেখেছিলাম।

-ভেরি গুড। স্প্রেডশিটে বসিয়ে ভাউচার বানিয়ে রাখবে। কাল বিকেলে এসে কাজটা করে যেও।

-জ্বী স্যার।

এরপর আর কথা এগুলো না। আরিফ একরাশ হতাশা নিয়ে বিদায় নিল। সাইফুদ্দিন ওর পিছে পিছে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করেছিল। বেচারাকে দেবার মত যথেষ্ট তথ্য ওর কাছে ছিলও না।

পরদিন বিকেল চারটা বাজতেই আরিফ চক্রব্যুহ অফিসে ফিরে এসেছে। কিন্তু হাসিবকে পাওয়া গেল না। তার রুমটি তালা দেয়া। সাইফুদ্দিন বসে বসে বিটিভিতে বাচ্চাদের কার্টুন দেখছিল। লিভিং রুমে তিনটি কাঠের চেয়ার পাতা। তার একটিতে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল আরিফ, “কী রে, আমাদের স্যার কোথায় গেলেন?”

আরিফকে দেখে সাইফুদ্দিনের চোখ ঝিকমিক করে উঠেছে। ভেবেছে নতুন ‘কেসটা’র আদ্যোপান্ত শুনতে পাবে।

-স্যারে হেই বিয়াইন বেলায় কই জানি বাইরাইয়া গেছে গা। কইয়া গেল আইজ আর ফিরব না।

-স্যার মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে যাননি? ফোন বন্ধ পাচ্ছি।

-সেইটা তো জানি না স্যারে ফোন নিছেন কিনা।

আরিফ কয়েকবার ফোন করল। ফোন বন্ধ। এটা নতুন নয়। হাসিব উদ দৌলা কোন তদন্তের শেষ পর্যায়ে এসে এমনটা করেন। দেখা গেল দুই দিন তিনদিন ফোন বন্ধ। তাকে কোথাও খুঁজেও পাওয়া যায় না। আরিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কম্পিউটারে বসে গেল। স্পেডশিটে ডে ওয়াইজ ডাটা এন্ট্রি করে যোগ করে রাখা। সেখান থেকে অটোমেটেড ভাউচার তৈরি করে নেয়া। বেশি সময় লাগল না। দুই ঘণ্টায় সব শেষ করে একবার চেক করে নিল। তারপর কয়েকটি প্রিন্ট আউট নিয়ে রাখল। এতটা সময় সাইফুদ্দিন পাশে ঘুরঘুর করছিল।

-স্যার! এই পরথম আমি কিছুই জানলাম না।

মুখ কালো হয়ে আছে। এক মগ এক্সপ্রেসো কফি টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

হেসে দিল আরিফ। সে নিজেই বা কতটুকু জেনেছে!

-কী শুনবি? এত ঘটনা। তোকে বলতে গেলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে রে!

-তাও। আপনে আমারে কইতে কইতে দেখবেন নতুন কোন বুদ্ধি পাইছেন!

সত্যিই তো! এমন তো হতেই পারে। হঠাৎ মনে পড়ল সাইফুদ্দিনকে হাসিব স্যার সামিহা অবন্তির বাড়িতে কী এক কাজে পাঠিয়েছিলেন।

-আচ্ছা তোকে সব বলব। তার আগে তোকে একটা কথা বলতে হবে। আগে বল বলবি কিনা?

সাইফুদ্দিনের চোখ চিকচিক করে উঠেছে।

-জিগান আগে। কোন বিষয় জানবার চান!

-তোকে স্যার সামিহা অবন্তি ম্যাডামদের কলাবাগানের বাড়িতে পাঠিয়ে ছিল।

-কলাবাগান? হ। মনে পড়ছে। কিন্তু স্যারে তো মানা কইরা দিছে কিছু কইতে!

-তাহলে আমিও বলব না কিছু। তুই যদি বলিস, তাহলেই আমার কাছে সব জানতে পারবি!

সাইফুদ্দিনের চেহারায় স্পষ্ট দ্বিধাবিভক্ত ভাব ফুটে উঠেছে। কিছুক্ষণ ভাবল। মনে হয় সাহস ফিরে পেয়েছে। অথবা ঔৎসুক্য তার দৃঢ়তাকে হারিয়ে দিয়েছে।

-কিছু ছবি তুলতে গেছিলাম।

-ছবি তুলতে মানে?

-হ। স্যারে আমারে ছবি তুলতে পাঠাইছিল। রানু নামের কামের বেডি আছে না ওই বাড়িতে? তারে ঘুষ দিয়া ছবি তুইলা নিয়া আইছিলাম।

-ছবিগুলো কোথায়? তোর তো রদ্দা মার্কা একটা ফোন। ঝাপসা ছবি উঠে।

-হ। ওইডা দিয়াই তো তুলছিলাম।

-কই দেখি দেখি!

-স্যারে তো দেইখা কী জানি করছে। সব ডিলিট কইরা দিছে।

-ওহ শিট! তোর মনে আছে কিসের ছবি তুলছিলি?

-হ, মনে আছে।

-কিসের ছবি? বল বল!

হঠাৎ সাইফুদ্দিন চুপ করে গেল। মাথা নিচু করে রেখেছে।

-কী হলো বল!

-স্যার। বেঈমানি করবার পারুম না!

ঠিক দুইদিন পরে হাসিবের ফোন। আরিফ তখন অয়োকাকে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছে। সাতদিন পরে ডেট। ওদের প্রথম সন্তান। ডাক্তার নিশ্চিত করে বলতে পারছে না ছেলে না মেয়ে। আল্ট্রাসনোগ্রামে নাকি স্পষ্ট বোঝা যায়নি। ওদের অবশ্য খুব শখ একটি পুতুল পুতুল মেয়ে হবে। অয়োকার মত। নাকটা একটু বোঁচা বোঁচা হবে। চোখ দুটো হবে কুতকুতে। এক মাথা ভর্তি চুল। ওর মত শ্যামলা হোক আর অয়োকার মত ধবধবে ফর্সা, তাতে কিছু যায় আসে না। সন্ধ্যা এখনো নামেনি। চারিদিক থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে।

-স্যার! আপনি? কোথায়?

-তুমি কি এক ঘণ্টার মধ্যে সামিহা অবন্তিদের কলাবাগানের বাড়িতে আসতে পারবে?

-জ্বী স্যার। পারব! অয়োকাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছি। মটর সাইকেল নিয়ে এক টানে চলে আসব স্যার!

-ওকে। তুমি চলে আস। আমি ওদের বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করব তোমার জন্য।

বলেই ফোন কেটে দিলেন হাসিব। কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে আরিফ “ধুরো” বলে ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে দিল।

-তুমি এত উতলা হচ্ছো কেন? সামিহাদের বাড়িতে ডেকেছে তোমাকে মানে উনার তদন্ত করা শেষ। একটু পরেই তো সব জেনে যাবে! শান্ত হও এখন।

আরিফের বা হাত দুই হাতে ধরে হাল্কা করে চাপ দিয়ে ধরে রাখল অয়োকা।

-তোমার টেনশন দেখে দেখে আমারও টেনশন বেড়ে যায়। সেটা কি বুঝো না?

-স্যরি বুচির মা!

এত আদর আদর করে বুচির মা বলেছে। অয়োকা ফিক করে হেসে দিল। আদর করে আরিফ অয়োকাকে বুচির মা বলে ডাকে। প্রথম প্রথম অয়োকা খুব রিয়েক্ট করত। “আমাকে খোঁটা দেয়া হচ্ছে। না?” অবশ্য আরিফ কখনো রেগে থাকলে ওর নাম ধরে ডাকে। তখন “বুচির মা” শোনার জন্য ওর মনটা আনচান করে খুব!

-এই শোন! আমার কিন্তু খুরশিদা বেগমকে সন্দেহ হয়।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল অয়োকা। বেশ বুদ্ধিমত্তার দীপ্তি ছড়িয়ে ওর মুখে। আরিফের কখনো কখনো মনে হয় অয়োকারই গোয়েন্দা হওয়া উচিত। ও নয়।

-আমারও তাই মনে হয়। তোমাকে সত্যি বলি? আমার কেন যেন মনে হয় খুরশিদা বেগমের স্বামী সাইফ খানের সাথে তার বড়সড় কোন গণ্ডগোল চলছিল। খুব সম্ভবত ক্রস ফায়ারে পড়ে সাইফ খানের মৃত্যু হয়েছে। সাইফ খান আবরারকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলেছে।

-ক্রস ফায়ার মানে? তুমি লাশের যে বর্ননা দিয়েছিলে, তাতে কোন ক্রমেই ক্রস ফায়ারে সে মারা যায়নি।

-ক্রস ফায়ার বলতে আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ক্রস ফায়ারে মৃত্যুর কথা বুঝাইনি। বলেছি, দুই মাফিয়া গ্যাং এর পাল্লায় পড়ে সাইফ খানকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল!

(চলবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here