#চক্রব্যুহ
[এক]
মোহাম্মাদ মনোয়ার হোসাইন
শ্রাবণ মাসের তিন তিনটি সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এবারের আকাশে মেঘের ঘণঘটা তেমন নেই। জৈষ্ঠ মাসের গরম পিছু ছাড়ছে না যেন। অবারিত নীলাকাশ। পেঁজা তুলার মত নরোম আর হাসের পালকের মত সাদা রঙের ইতস্তত কিছু মেঘ। সেগুলো পূব আকাশে দাঁড়িয়ে আছে নিথর হয়ে। হাওয়া নেই।
সরকার ঘণ্টা ভিত্তিক লোড শেডিং চালু করেছে। ঢাকার এই দিকে নির্দিষ্ট দুই ঘণ্টার লোড শেডিং থাকার কথা থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। যখন তখন চলে যাচ্ছে।
ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হবার অবস্থা। বিল্ডিং এর মালিক জেনেরেটর চালু রাখতে বলেছেন দিনে এক ঘণ্টা। আইপিএসটা কেনা দরকার ছিল। হাতে টাকা নেই। দুই মাসের ভাড়া বাকি রয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা গতকাল এসে নোটিশ দিয়ে গেছেন।
হাফ স্লিভ শার্টের উপরের তিনটি বোতাম খুলে বারান্দায় এসে রেলিং এ ভর দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো হাসিব উদ দৌলা। দক্ষিণ পূর্ব কোনার দিকের এই বারান্দা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। রোদের তাপ দেখে বিষম খাবার অবস্থা। সূর্য দক্ষিণ দিকে হেলে পশ্চিমের পথে যাত্রা শুরু করেছে। অথচ মনে হচ্ছে মাথার ঠিক উপরের থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্নি বিতরণ করছে। সামনের দুটি বিল্ডিং এর ফাঁক গলে দূরের লেক দেখা যাচ্ছে। বাইনোকিউলারটা চোখে লাগিয়ে সেই দিকে তাকালো। গরমের থেকে মনোযোগ সরানোর ভাল একটা উপায়।
দশ বারোজন ছেলেমেয়ের একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের সঠিক সংখ্যা গোণার চেষ্টা করল কয়েকবার। সফল হলেন না। ছেলেমেয়েগুলো কী নিয়ে যেন প্রায় ছোটাছুটি করছে, চুপচাপ বসে নেই। শুটিং হচ্ছে মনে হচ্ছে। যদিও শুটিং এর যন্ত্রপাতি নেই। দুটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে তাকিয়ে জটলার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে কিছু একটা বলছে। ওহ! টিকটক ভিডিও শুটিং হচ্ছে মনে হয়। মনে মনে খুশি হলেন হাসিব উদ দৌলা। কী যে এক ট্রেন্ড চলে এসেছে আজকাল। উঠতি বয়সের ছেলেপেলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে রং বেরঙের অদ্ভুত সাজসজ্জা করে কী সব ভিডিও করছে। সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করছে। লাখ লাখ তাদের ফলোয়ার। এটা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন হাসিব উদ দৌলা। অর্থনৈতিক সক্ষমতা সাপেক্ষে দেশগুলোর সামাজিক অবক্ষয়ের ট্রেন্ডের গ্রাফ পর্যালোচনা করেছেন। রুচির ব্যাপারটা নিয়ে আশ্চর্য এক ফল দেখতে পেয়েছেন সেই ট্রেন্ডে। আর্থিক সঙ্গতি আর পড়াশোনার সাথে রুচির ব্যাপারটা সরাসরি জড়িত। উন্নয়নশীল আর অনুন্নত দেশগুলোয় জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ সামাজিক অবক্ষয়ে সরাসরি আক্রান্ত। তাদের রুচি নিম্ন শ্রেণির। তাদের রুচির প্রকাশে সৃষ্টিশীলতা থেকে সেক্সুয়াল ডাইভারশন বেশি। বিভিন্ন দেশের টিকটক বা শর্ট ভিডিও পর্যালোচনা করে হাসিব উদ দৌলা এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে বেশ সন্তুষ্ট।
চিন্তা বেশিদূর গড়াতে পারল না। সাইফুদ্দিন দরোজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, মাথা নিচু করে আছে। সম্ভবত পায়ের নখ দেখছে খুঁটিয়ে। ছেলেটা বেশ বোকাসোকা। অফিসের একমাত্র কর্মচারি। কোন কাজই ঠিকঠাক করতে পারে না। তবে ওর একটি গুণের কথা স্বীকার করতেই হবে। অসাধারণ কফি বানাতে পারে। এক্সপ্রেসো কফির ব্লেন্ডটার সুগন্ধি নিজের হাতের থেকেও ওর হাতে ভালো ফুটে। বড় হয়েছে রায়েরবাজার “মুরগি হাসান” নামের এক বস্তি পাড়ায়। নামটা খুব ইন্টারেস্টিং। জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, স্যার, জালাল হাসান হইল গিয়া ধরেন ফারমের মুরগির ব্যবসা করেন। হেই থিকা হের নাম হইল মুরগি হাসান।
তিন বছর ধরে হাসিব উদ দৌলার সাথে আছে ছেলেটি। ওদের দেশের বাড়ি ফরিদপুরের কানাইপুর। বাবা ঢাকায় রিক্সা চালাত আর মা ধানমণ্ডি এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ছুটা বুয়ার কাজ করত। তিন বছর আগে কোরবানির ঈদের তিনদিন পরে ঢাকা ফেরার পথে বাস এক্সিডেন্টে বাবা মা আর বড় বোন মারা গেল। হাসিব উদ দৌলা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছিলেন একটি সুরত হাল রিপোর্ট আনতে। কলাবাগানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পড়ুয়া এক মেয়ে গলায় ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তার “বয়ফ্রেন্ড” ওদের “বেরুমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিও” ফেসবুক আর ইউটিউবে প্রকাশ করে দিয়েছিল। ডোম ঘরের পাশে এই ছেলেটিকে সেই সময়ে মাটিতে গড়িয়ে কাঁদতে দেখেন। দশ বার বছরের হ্যাংলা পাতলা আর ছোটখাট, কুচকুচে কাল মত দেখতে ছেলেটি সেই থেকে তার সঙ্গী। বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটত। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। তিন মাসের মাথায় ঘোষণা দিল আর স্কুলে যাবে না। জিজ্ঞেস করায় মাথা নিচু করে উত্তর দিয়েছিল, “স্যার, মাথাত কিচ্ছু ঢুহে না।“
-কিছু বলবি?
-স্যার, কেডায় জানি ফুন দিছে।
দুই হাত পেছনে করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাইফুদ্দিন। হাসিব উদ দৌলার সামনে এলেই সে মাথা নিচু করে রাখে। মনে হয় পায়ের আঙুল গোনা আর নখের উপর ছোট ছোট সাদা ফুটকিগুলো গভীর পর্যবেক্ষণ করাই ওর একমাত্র কাজ।
-কই ফোন, দে!
হাত বাড়িয়ে ফোন এগিয়ে দিল সাইফুদ্দিন। চারটা মিসড কল। অপরিচিত নম্বর থেকে। ফোনের লক খুলে কল ব্যাক করলেন। সাথে সাথেই ও প্রান্তে এক মেয়েলি কণ্ঠ শোনা গেল।
-হ্যালো হ্যালো? “চক্রবুহ্য” অফিস?
-হ্যা!
-আমি কি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হাসিব উদ দৌলার সাথে কথা বলতে পারি?
উৎকণ্ঠা আর শ্লেষ্মা মেশানো কন্ঠস্বর।
-হুম। হাসিব উদ দৌলা বলছি।
নাম বলার পরে ফোনের ওপাশে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। প্রায় দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন হাসিব উদ দৌলা। তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যালো, কেউ কি আছেন ওপাশে?”
হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ওপাশের মহিলা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন কোন কথা না বলে। হাসিব উদ দৌলা ফোন কানে চেপে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কন্ঠ শুনে মধ্যবয়সী মনে হয়েছিল। কান্নার শব্দ শুনে অবশ্য কনফিউজড হয়ে গেলেন। অল্প বয়সী বাচ্চা মেয়ের কান্নার মত শোনাচ্ছে।
-আমাকে সাহায্য করতে পারবেন মিঃ হাসিব?
কোনরকমে কান্না থামিয়ে বললেন ওপাশের অপরিচিতা।
-শিওর ম্যাম। আমার কাজই আপনাদের সাহায্য করা। প্লিজ বলুন।
গলার স্বরে যথাসম্ভব আশ্বস্তের স্বর ধরে রেখে বললেন হাসিব উদ দৌলা।
-মিঃ হাসিব। আমার হাজব্যান্ড গত চারদিন ধরে নিখোঁজ। উনাকে খুঁজে বের করে দিন প্লিজ!
[চলবে]