চন্দ্রপুকুর,শেষপর্ব (প্রথম ভাগ)
– ঈপ্সিতা শিকদার
মহল হতে প্রায় দশ মিনিটের দূরত্বে কূপ খনন করা হয়েছে। সেখান হতেই নবাব বাড়ির উদ্দেশ্যে জল আসে।
বর্তমানে আলখাল্লা, হিজাব, নিকাব পরিধান করে কলস নিয়ে গ্রামীণ নারীদের ন্যায় সেদিকে যেতে রওনা হচ্ছে যামিনী।
আজ প্রায় সাত দিন হয়ে গিয়েছে রোহিণীর মৃত্যুর। এতোদিন সবাই আড়াল হয়ে যোহরের ওয়াক্তের পরে বের হলেও আজ সবার সম্মুখেই যাচ্ছে সে। কলস কোলে তুলে অন্দরমহল থেকে তাকে বের হতে দেখে অবাক হয় প্রতিটি খাদিম। দাসীরা কানাঘুষা শুরু করে দেয়। যামিনীর ভঙ্গিমা নির্লিপ্ত।
জনাব আরহান করিম বাহিরের দিক হতে মহলের কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছে। কিছুটা নজরও রাখছে এদিক-ওদিক যদি আঁধারিয়া সৌন্দর্যমণ্ডিত নারীটির দর্শন পায়।
হুট করে মহলের সীমানাদেয়ালের মধ্যখানে দেখতে পায় যামিনীকে সে। রৌদ্রময় দুপুরে এই বাঙালি রমণী কলস ভর্তি জল নিয়ে মহলে প্রবেশ করছে।
মৃদু বাতাসে নিকাবটা বেশ কিছুটা সরে গিয়েছে, হিজাব দিয়ে ঘাম মুছতে ব্যস্ত যামিনী। আড়াল হতে ছবি তোলার প্রচেষ্টা করে যুবক। কিন্তু অসফল সে।
“স্যার! স্যার! ঐদিকে কী করছেন? এখানে আসুন। এইখানকার শটটা কোন এঙ্গেল থেকে নিলে ঠিক হবে বোধগম্য হচ্ছে না।”
দিনারের ডাকে আরহানের দৃষ্টি সরার সময়েই মহলে প্রবেশ করে ফেলে যামিনী। কাঙ্ক্ষিত রমণীকে না পেয়ে হতাশায় “ধুর” বোধক শব্দ উচ্চারণ করে নিজের দলের দিকে এগিয়ে যায় সে।
“কী হয়েছে স্যার? আপনাকে এমন হতাশ এবং বিষণ্ণ লাগছে ক্যানো?”
“ঐ মেয়ে, ঐ আঁধারিয়া সৌন্দর্য মূর্তিটিকে আবারও পেয়েছিলাম আমি। তবে আবারও হারিয়ে ফেললাম। একটি ছবি, শুধুমাত্র একটি ছবিই ভালো ভাবে তুলতে পারলেই হতো। কিন্তু না, এবার আমি আর অনুমতি ব্যতীত আড়াল হতে ছবি তোলার প্রচেষ্টা করব না। তার সম্মুখেই যাবো।”
আঁতকে উঠে আহিল। আতঙ্কিত ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করে,
“আপনার মাথা ঠিক আছে, স্যার? আপনি একটা প্রজেক্টের জন্য নিজে তো মরণফাঁদে পা রাখছেনই, আমাদেরও নিয়ে নিচ্ছে সাথে।”
‘চ’ বোধক ধ্বনি নির্গত হয় জনাব আরহান করিমের মুখ হতে। বিরক্তে মাখামাখা তার চাহনি।
“আরে অহেতুক কথা বোলো না তো। তেমন কিছুই হবে না। ঐ রমণী কোনো নবাব বংশের সদস্য নয়। নিজ হাতে পানির কলসি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো, এতো এতো দাসী থাকতে কোনো সম্ভ্রান্ত নারী তা করবে? যাই হোক আমি চুক্তিবদ্ধ হবো ঐ নারীর সাথে। অর্থ, সম্ভ্রমের লালসা হতে কোন নারী মুক্ত আর?”
ফিচেল হাসি ফুটে উঠে পুরুষটির মুখশ্রীতে। যেন খুব ধূর্ততার সহিত শক্তভাবে নিজের পরিকল্পনা করেছে।
যামিনী অন্দরমহলে ফিরে আসলে শ্রবণগত হয় দাসীদের কিছু কথোপকথন। কলস মেঝেতে রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
“দেখেছিস শাহাজাদি মেহনূর এসে ডুবিয়ে দিয়েছে বেগম চন্দ্রমল্লিকার ভালোবাসার তরী।”
“তা যা বলেছিস! পূর্বে রাজ-রানীর ন্যায় থাকতো, এখন নিজের জলটাও নিজের টেনে আনতে হচ্ছে। আমার তো মনে হচ্ছে কতোদিন বাদে তো মহল হতেও বাহিরে চলে যাবে।”
“হুম, এখন হতে তো শাহাজাদিকে ‘বেগম’ বলে সম্বোধন করার অভ্যাস করা উচিত।”
যুবতী জমিদারনি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না।
“বেয়াদব, বদমাশ কন্যা! তোমাকে খুন করে ফেলবো আমি!”
চিৎকার করে গলা টিপে ধরে দাসীটির যামিনী। তার চেঁচানোতে অনেকেই ছুটে আসে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসার সাহস করে না।
দিলরুবা ও মোহিনী যেয়ে বাধাদান করে।
“বেগম কী করছেন এসব? ছাড়েন তাকে! ছাড়েন! বেগম লুৎফুন্নেসা বা অন্যকেউ জানলে অনর্থ হয়ে যাবেন।”
একদফা রক্তচক্ষু নিয়ে দাসী দুটোর দিকে তাকিয়ে জলের কলস পুনরায় তুলে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। দিলরুবা ও মোহিনীও তাদের কড়া মেজাজে খাণিক বকে মনিবের পিছন পিছন যায়।
যামিনী নিজের কক্ষে এসে ক্রোধে প্রতিটি বস্তু ছুঁড়ে ফেলছে। দেহে আঘাত লাগছে কি না তাতেও ধ্যান নেই তার। দিলরুবা ছুটে এসে ধরে তাকে।
“মোহিনী ঘড়া থেকে জল এনে দাও বেগমকে। বেগম আপনি শান্ত হন।”
ক্রোধেও সন্দেহ করা হতে বাদ গেল না যামিনী। আড়চোখে দেখলো মোহিনীর কলস হতে জল পানপাত্রে ঢালাকে। দ্বিধাহীন ভাবে ডগডগ করে জল টুকু পান করে নেয় রমণী।
“বেগম, আপনি শান্ত হন। এতোটা ভেঙে পড়লে কী করে মোকাবেলা করবেন শত্রুদের? গোটা নবাববাড়ি আপনার শত্রু, আপনার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে দিচ্ছে শাহাজাদি মেহনূরকে।”
“হ্যাঁ, যা বলেছো দিলরুবা আপা। আমার তো মনে হয় এখন সবাইকে বিশেষ করে ঐ শহুরে বাবুদের জানিয়ে দেওয়া উচিত আমাদের বেগমই শেরপুরের আসল জমিদারনি।”
“তবে এমন ভাবে জানাতে হবে যেন সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।”
বাক্যটি শেষ করতেই ধমক দিয়ে উঠে যামিনী,
“বের হও! বের হও আমার কক্ষ হতে! এই মুহূর্তে আমার নজরের সামনে হতে বিদায় হও নাহলে আমি কি করবো আমিও জানি না।”
তার ধমকে যেন কম্পিত হয় প্রতিটি দেয়ালও। দ্রুতো বের হয়ে যায় দুই খাঁস দাসী।
যামিনীর নিজেকে বদ্ধ উন্মাদ বোধ হচ্ছে। কী হচ্ছে বা কী করবে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। পরক্ষণেই প্রতিশোধ ও ক্রোধের তাড়না তাকে জড়িয়ে ফেলে, চোখের জল দু’হাতে মুছে ফেলে সে।
“বাবু মশাই, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আর ভরসা রাখতে পারছি না আপনার উপর। আর না! না, আর অপেক্ষা নয়। এখন এমন কিছু করতে হবে যাতে শুধু গোটা শেরপুর ক্যানো ঐ শহুরে বাবুরা, এমন কী গোটা দুনিয়ে যেন জানে আমি বাবু মশাইয়ের বেগম।”
___
মেহমাদ শাহ সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে কামরায় ফিরে। দ্বার খুলতেই দেখতে পায় শাহাজাদি মেহনূরকে।
শীতল ভঙ্গিমার সহিত এগিয়ে যায় যুবক তার দিকে। রমণী সাথে সাথে দৃষ্টি নত করে উঠে দাঁড়ায়।
“আসসালামু আলাইকুম, আমার শাহ। কেমন আছেন?”
“তুমি এখানে কী করছো মেহনূর? আর সারাদিনের প্রায় পুরোটাই তো আজকাল তোমার সাথেই থাকা পড়ছে বাধ্যতামূলক ভাবে। এই প্রশ্নের অর্থ কী?”
ছলছল দৃষ্টির সহিত তার চোখে চোখ রাখে শাহাজাদি। অপ্রাপ্তি, বিরহবেদনার এক তীব্র আর্তনাদ যেন ছলকে পড়ছে তার আঁখি হতে। ঠোঁটের কোণে কোমল হাসি।
“আর কতো এমন উপেক্ষা করবেন শাহ? আর তো দিন দুয়েক তারপর তো চলে যাবোই শেরপুর ত্যাগ করে। আপনার তো প্রিয় বন্ধু ছিলাম আমি, আবারও সেই স্থানটুকু দিন না আমায়।”
যুবককে যদিও ছুঁতে পারে না তার নমনীয় কণ্ঠ, আক্ষেপসূচক কথাবার্তা। হয়তো ভালোবাসা নেই বলেই তার জন্য এতো কঠোর হৃদয়। তবে অবাক হয় ভিষণ। মেয়েটাকে এতো কোমল, এতো ভাঙাচুরা ভাবে কখনও দেখেনি সে।
“তুমি নিজেই সেই স্থান হতে পদত্যাগ করেছিলে আমার বিশ্বাস ভেঙে। দাদীজান, আম্মিজান না বুঝুক, না জানুক তুমি তো জানতে আমি আমি কতোটা ভালোবাসি আমার চন্দ্রমল্লিকাকে।
তুমি জানতে দাদীজান আমার থেকে কথা নিয়েছিলেন যদি আমি তোমায় বিবাহ করি তবেই এই মহলে জায়গা পাবে আমার চন্দ্রমল্লিকা। অন্যথায় তাকে খুন করতেও হাত কাঁপবে না দাদীজানের।
আমি বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সবাই আমায় হতাশ করলেও আমার ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধুটি আমার হস্তখানা কখনোই ত্যাগ করবে না। তুমি আমাকে ওয়াদা করলে তুমি এই বিবাহ করবে না কোনোক্রমেই।
আমি বিশ্বাস করে রাজি হলাম। অথচ, তুমি কী করলে? তুমি আমার ভালোবাসাকে আমার হতে ছিনিয়ে নেওয়ার ধ্বংসলীলায় মেতে উঠলে? তখন বন্ধুত্বের কথা মনে পড়েনি তোমার?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবতী। অনুতাপে মাখামাখি ভঙ্গিমা তার।
“আমি জ্ঞাত আমার পথ ভুল ছিল, তবে বিশ্বাস করো আমার ভালোবাসায় এক বিন্দু খাঁদ কখনোই নেই। আমি আমার সবটুকু দিয়ে তোমায় নিজের করে চেয়েছি আমার শাহ, এতোটা ভালোবেসেছি তোমায় যে নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছি।
যাকে যখন ভালোবাসা কী বা কেমন বোধ করতে পারিনি তখন হতে চেয়েছি তাকে কী করে অন্যের হতে দেখে সহ্য করে নিতাম? তুমি পারবে চন্দ্রমল্লিকাকে অন্যের হতে দেখতে? আমি সহ্য করতে পারিনি। তোমার প্রতি আসক্তি আমায় অন্ধ করে তুলেছিল। আমি দুঃখিত, অনুতপ্ত তার জন্য আমায় ক্ষমা করো।”
অবিরাম ধারায় আঁখিজল বেয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কপোল। মেহমাদ শাহ তবুও কঠোর ও নীরব। হয়তো এই নারীটির স্থানে তার প্রেয়সী হলে এতোক্ষণে স্থান হতে বক্ষে। ভালোবাসা এক অতি বিশেষ নেশা, যা সবার উদ্দেশ্যে জন্ম নেয় না।
“তুমি নিজের কক্ষে ফিরো মেহনূর। বেশ রাত্রি হয়েছে।”
চরণতলে মাথা রেখে ফেলে শাহাজাদি মেহনূর ভালোবাসার তাড়নায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে জানায়,
“আমি সত্যি অনেক ভালোবাসি আপনাকে, আমার শাহ। আপনি হয়তো জানেন না আব্বাজান ও দাদীজানের সাথে কী চুক্তি হয়েছে আমায় এখানে পাঠানোর বিপরীতে। এখান হতে প্রস্থান করলেই আমার বিবাহ হয়ে যাবে শহুরে এক বিশিষ্ট ধনী পুরুষের সাথে।
আমি আমার মন-প্রাণ দিয়ে সদা আপনাকে স্বামী বলে মেনেছি। আমি কী করে সহ্য করবো অন্যকারো স্পর্শ? সারাজীবন বেগম চন্দ্রমল্লিকার দাসী রূপে এই অন্দরমহলে কাটিয়ে দিব, তবুও আমায় আপন করে নিন। দয়া করুন।”
যুবক মনে মনে ক্রোধান্বিত হলেও নিজেকে সামলে নেয়। বাহু ধরে দাঁড় করায় নারীটিকে। কণ্ঠ যথাসম্ভব নমনীয় রেখে বলে,
“দেখো মেহনূর, তুমি যা বলছো তা কখনো সম্ভব নয়। তোমার জন্য এ বিবাহ করাই উত্তম নাহলে তুমি কখনও সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। এখন তুমি নিজের কামরায় ফিরে। বিদায়।”
শেষ দুই বাক্য কিছুটা কঠোরতার সাথেই উচ্চারণ করে মেহমাদ শাহ। মুখে আঁচল চেপে ছুটে বেরিয়ে যায় মেহনূর। মনে মনে প্রার্থণা করে হৃদয় ভাঙার এই করুণ আর্তনাদ এই পুরুষটিও যেন একদফা বোধ করতে পারে।
___
দিলরুবা সবার হতে লুকিয়ে মহলের পিছনের ভাগে এসেছে। সেখানে অপেক্ষারত একজন খাদিম রূপী সম্ভ্রান্ত নারী।
“আসসালামু ওয়ালাইকুম বেগম।”
মোর্শেদা খাতুন সালামের জবাব দেওয়ায় সময় ব্যয় করতে অনিচ্ছুক। তাই সরাসরি প্রশ্ন করেন,
“ঐদিকের কী অবস্থা? মেহমাদের উপর কি পুরোপুরি বিতৃষ্ণা এসেছে চন্দ্রমল্লিকার?”
“হ্যাঁ, প্রায় অনেকটাই বেগম। আমার মতে এখনই মোক্ষম সময় শেষ চাল দেওয়ার। তবে মানতে হবে বেগম চন্দ্রমল্লিকার বোকামিকে। মহলে আসতে না আসতেই আমার মতো একজন অতিরিক্ত চাটুকারিতা করা দাসীকে পেয়ে গেল, বিশ্বাসযোগ্য ভাবলো। অথচ, একবারও ভাবলো না এই নবাববাড়িতে বছরের পর বছর কেটে যায় কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য একজন মানুষ পাওয়া যায় না।”
“আমি তো জানতাম আমার দিলরুবা। তাই তো এই বিবাহের সংবাদ শুনতেই তোমাকে পাঠালাম শিকার দালান। আমি তো জানতাম যতোই নবাব বংশের রক্ত হোক বুদ্ধি তো চাষারই হবে। তার উপর তোমার মিথ্যে আনুগত্যের অভিনয়ও তো লাজবাব। যাকগে মোহিনী দেখেনি তো তোমায় আসতে?”
“না, বেগম। আমি তো জ্ঞাত তাকে আরমান বাবু রেখেছে বেগম চন্দ্রমল্লিকার উপর নজরদারি করতে।”
“ঠিক আছে। চিঠিটা লিখা হলে পৌঁছে দিয়ো এমনভাবে যেন সন্দেহ না জন্মায়।”
“অবশ্যই বেগম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার চার প্রজন্ম আপনার বংশের নুন খেয়েছে, আপনাকে হতাশ হওয়ার সুযোগ আমি দিব না।”
“আমি জানি আমার দিলরুবা।”
দুই নারী এবার আলোচনা করতে বসে চিঠিটা কীভাবে সাজাবে যেন এই ফাঁদে পা রাখেই যামিনী।
___
মোহিনী, গুলবাহার খাতুন ও এসপি সাহেব তার থানায় এসেছেন। গোপণ আলোচনায় বসতে। টেলিফোনের অপরপাশে আরমান শাহও স্থির।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম এবং এস.পি সাহেব। কেমন আছেন আপনারা?”
“ভালো আর থাকতে দিলে কোথায় তোমরা? তোমরা না কি আরও বখশিশ দাবী করছো জানালো মোর্শেদা।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ্ বেগম। এ তো সরাসরি ডাহা মিথ্যে কথা! কে করেছে এই অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে! আমাদের কেউ একটুও অধিক অর্থ দাবী করেনি।”
শুনে তিনজনের ললাটেই সূক্ষ্ম ভাঁজ স্থির হলো। গুলবাহার খাতুন আরমান শাহকেও জানায়।
“কিন্তু মোর্শেদা তো আমায় উলটো কথাই বলল। ভাবীজান, এসপি সাহেবকে টেলিফোনটা দেন।”
“আসসালামু আলাইকুম, সাহেব। আমি তো আপনাকে পূর্বেই বলেছিলাম ঐ নারী পূর্ণরূপে ছলনাময়ী। কোনো ভৃত্যই অধিক অর্থের দাবি করেনি। নিশ্চয়ই সকল অর্থ ঐ নীলকণ্ঠ দাসের পিছনে ঢালছেন।”
‘নীলকণ্ঠ দাস’ নামটি কর্ণগোচর হলে বুক ধ্বক করে উঠে আরমান শাহের। অতীতের তীব্র ক্ষতগুলোতে পুনরায় জ্বালাতন শুরু হয়।
“নীলকণ্ঠ দাস? কে সে? আর ক্যানোই বা তাকে অর্থ দেয়?”
“মেহমাদ শাহের স্ত্রী চন্দ্রমল্লিকা তথা যামিনীর মামাজান সে। ক্যানো অর্থ দেয় ঠিক-ঠাক জানতে পারিনি, তবে যতোটুকু বোধগম্য করতে পেরেছি যামিনীর পরিচয় আড়াল করতেই অর্থ প্রদান করেন তিনি বাবু।”
“এস.পি আমার যামিনী নামক কন্যার ছবি ও সকল তথ্য চাই। দ্রুতো।”
“আমি খুব দ্রুতো সময়ের মধ্যেই পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে ছবি পাঠাতে একটু ঝামেলা তো হবেই।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, এসপি। কাজ দেখতে চাই।” অস্থির হয়ে আদেশ করেন আরমান শাহ। তাঁর ক্যানো যেন মানুষটিকে খুব করে চেনা মনে হচ্ছে।
___
এতো বছর পর আবারও ঐ অজ্ঞাত চিঠিদাতার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। আবারও চিঠি এসেছে যামিনীর উদ্দেশ্যে।
তবে এবারের চিঠিটা বেশ ছোটো-খাটো। চিরকুট বলাই শ্রেয়।
পড়া শুরু করে সে,
“প্রিয় চন্দ্রমল্লিকা,
আমাকে নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি? আমি জানি এখন কতোটা বিপর্যস্ত অবস্থায় তুমি। অতীতেও বহুবার তোমায় বিপদ হতে বাঁচিয়েছি, এবারও সহায়তা না করে পারলাম না। জমিদার নবাব শাহের বিশেষ কামরাটি সম্পর্কে তো তুমি জ্ঞাত। সে কামরায় বিশেষ একটি লাল মলাটের ফাইলে বিভিন্ন কাগজ-পত্র আছে, তাতে তোমাদের বিবাহের সকল তথ্য উল্লেখিত।
যদি তুমি কোনোভাবে সে কাগজটি জনাব আরহান করিম হকিংসের হাতে তুলে দিতে পারো, তবে সাপও মরবে না, লাঠিও ভাঙবে না। অর্থাৎ, সবাই জেনেও যাবে তুমিই বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আবার তোমার উপর দোষারোপও যাবে না। ক্যানো না, জনাব আরহান করিম হকিংস কখনও এই উদঘাটনের কৃতিত্বে অন্যকাউকে অংশীদার করবে না।
ইতি,
তোমার শুভকাঙ্ক্ষী।”
চিঠিটা পড়ে এক গোলকধাঁধায় পড়ে যায় রমণী। একদিকে তার মস্তিষ্ক বলছে এই শুভকাঙ্ক্ষীর কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাব আজ অবধি তার উদ্দেশ্যে অহিতকর হয়নি, আর হৃদয় বলছে নিজের জন্য লাভজনক কিছু করতে যেয়ে বাবু মশাইয়ের সাথে বেইমানি না হয়ে যায়।
মাথা ধরে বসে পড়ে যামিনী মেঝেতে। কোন পথে পা বাড়াবে সে এবার কে জানে।
কোনোদিকে না তাকিয়ে সে ছুটলো মেহমাদ শাহের কামরার দিকে। গতানুগতিক ভাবেই সেখানে মিনার দাঁড়িয়ে।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বাবু মশাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছি।”
“দুঃখিত, বেগম। জমিদার বাবু এখন শহুরে বাবুদের সাথে কথা বলছেন। এই মুহূর্তে কারো অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষেধ, বিশেষ করে আপনার। কারণ আপনি তো জাননেনই…”
আর বলতে না দিয়েই যামিনী হনহন করে চলে আসে নিজের কামরায়। এতোটাই অযোগ্য বোধ করে তাকে নবাব! মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে বিড়বিড়ায়,
“ভালোবাসা, বিশ্বাস সব পুড়ে ছারখার,
শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে পিছুটানও,
আর থাকবে না কিছু আমাদের মাঝে,
জয় হবে ক্ষমতার যে কোনো শর্তের বিপরীতে।”
___
গভীর রাত্রি, যামিনী মেহমাদ শাহের কামরায় প্রবেশ করে। মানুষটি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। একদফা সরল চেহারার এই হৃদয়ঘাতকের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে ফেলে। আর রাখবে না কোনো পিছুটান।
এই কামরার প্রতিটি কোণা তার পরিচিত। তার চাবির তোড়া অতি সহজেই পেয়ে যায়। খুব সতর্কতার সাথে তা আড়াল করে প্রহরীদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
পরদিন ফজরের আযান দিতে ঘণ্টা খাণেক বাকি। ধীরে ধীরে অন্দরমহল হতে বের হয় যামিনী। বিশেষ এই কামরায় সম্মুখে পাহারারত প্রহরীরা ঝিমাচ্ছে ঘুমে।
“এ কী দশা! তোমরা এভাবে তন্দ্রাবিষ্ট হয়ে পাহারা দিচ্ছো মহলের!”
জমিদার গিন্নির ধমকে কম্পিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় প্রহরীরা। ভয়ে তটস্থা তারা।
“যাও তোমরা! যেয়ে দ্রূতো চোখে-মুখে জল দিয়ে আসো! অকর্মের ঢেঁকি যত্তসব!”
তাৎক্ষণাৎ দৌড় লাগায় প্রহরীরা। যামিনী বিজয়ীর হাসি দেয়। তারা যতোক্ষণে আসবে ততোক্ষণে তার কার্য সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
একের পর এক চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করলে চতুর্থ প্রচেষ্টাতেই দরজা খুলে যায়। রমণী প্রবেশ করে অবাক। একদম ভিন্ন এক কামরা। এক পাশে বিশাল উঁচু তাকে বিভিন্ন ধরনের বই রাখা।
আরেকপাশে বেশ কয়েকটি চৌপায়ায় বেশ কিছু কাগজ-পত্র ঠাঁসা। আছে প্রায় সাত-আটটি টেলিফোন, রেডিও। আছে ক্যামেরা। আছে বিভিন্ন জাতীয় বস্তু ও যন্ত্র, যা চেনা নেই যামিনীর।
বিস্ময়ে ঠোঁট গোল হয়ে যায় তার। তবুও নিজেকে সামলে নেয়। চোখ বুলায় কাঙ্ক্ষিত লাল রঙা ফাইলটির উদ্দেশ্যে। খাণিকটা সময় খোঁজাখুঁজি করতেই দেরাজের মধ্যে তা পেয়েও যায়। তার উপরে খুব স্পষ্ট ভাবে লিখা ‘চন্দ্রপুকুর’।
আঁচলের নিচে আড়াল করে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দ্রুতো স্থান ত্যাগ করে সে। আড়াল হতে এ দৃশ্য দেখে মোর্শেদা খাতুনের দেহে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রতিশোধ পূরণের।
চাবির তোড়া জায়গা মোতাবেক রেখে কামরায় ফিরে আসে যামিনী। এখন প্রধান চিন্তা, জনাব আরহান করিমের নিকট কী করে এই কাগজ-পত্র হস্তান্তর করবে?
___
ভরা দুপুরবেলা, কাঠফাটা রৌদ্রে দাঁড়িয়ে যামিনীর উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করছে জনাব আরহান। আজ যে করেই হোক এই কন্যার সাথে ‘ব্ল্যাক বিউটি’ প্রজেক্টের বিষয়ে কথা বলতে হবে তার। কারণ আগামীকাল ভোরেই শেরপুর ত্যাগ করবে তারা।
তার অপেক্ষার অবশান হয়। কলস কোলে যামিনী আসে। তার কোমরে গুঁজা আছে সেই ফাইলটিও। মহলের সীমানা পেড়িয়ে ফেললেই যুবক ছুটে যায় তার দিকে।
“এই যে রমণী! একটু দাঁড়ান!”
আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরে যুবতী। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। যে মানুষটির সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে, সে-ই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
চলবে…