#চন্দ্রপুকুর,১৭তম পর্ব,১৮
-ঈপ্সিতা শিকদার
অপেক্ষায় ইতি টেনে প্রবেশ করে মেহমাদ শাহ। উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানায় সকলে। বসতে ইশারা করে আসন গ্রহণ করে সে।
“কী হয়েছে দাদীজান? কী কারণে এতো তাড়া যে আমার বৈঠল খতম করারও অপেক্ষা করতে পারলেন না?”
“আমার শাহ, এসেছো যখন জানতেই পারবে। শান্ত হয়ে বসো। আয়েশা খাতুন!”
আয়েশা খাতুনকে ইশারা করতেই সে আড়াল থেকে টেনে এনে হাজির করে দাসীটিকে। যুবকের ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে।
“চন্দ্রমল্লিকা, এই দাসীকে এভাবে আঘাত করেছে। কতো বড়ো স্পর্ধা!”
“যামিনী এই অন্যায় কার্য সম্পন্ন করেছে তার প্রমাণ কী?”
“অন্দরমহলের প্রায় সকল খাদিম ও দাসীরা এই মেয়েকে আহত অবস্থায় খাঁস বাঁদী দিলরুবার সাথে চন্দ্রমল্লিকার কামরা হতে বের হতে দেখেছে। আর কোনো প্রমাণ চাই আমার সিংহ?”
যামিনী এতোক্ষণ নিঃশ্চুপ ছিল। এবার না পারতেই মুখ খুলে সে।
“আঘাত করেছি তা বলেছে এই কন্যা। ক্যানো করেছি তা বলেনি? এই দাসী আমার উপর নজর রাখছিল, গোয়েন্দাগিরি করছিল। আমি হাতেনাতে ধরেছি তাকে আমার চিঠির বাক্স করার মুহূর্তে।”
“এ জন্য তুমি তাকে আঘাত করবে? এই অন্দরমহলের একটা নিয়মনীতি আছে। সব কিছু সেই নিয়ম অনুসরণ করেই হয়। আমি যে এই অন্দরমহলের কর্তা আছি , তা কি ভুলে বসেছো তুমি? তুমি আমাকে অভিযোগ না করে নিজে বিচারকার্য সম্পাদনে হাত দিয়েছো! এর শাস্তি তুমি জানো?”
“যে নিজেই প্রধান অপরাধী, তাকে কী বলবো? দাসীটি তো আপনারই নাম উচ্চারণ করেছে। আপনিই তো দোষী দাদীজান!”
“আমার দিকে আঙুল তুলছো! এতো দুঃসাহসিকতা! এতো বড়ো বেয়াদবী! নতুন গজানো পাখা দিয়ে এতো উপরে উড়তে হয় না, মুখ থুবড়ে পড়ে নাহয় পক্ষী!
তোমারও সেই দশা হবে। শাস্তি তুমি পাবে, নাহলে তোমায় দেখে সাহস পাবে অন্যান্য কন্যারাও। আগামী এক মাসের জন্য জঙ্গলের উত্তরের অন্ধকার দালানের বন্দী থাকবে তুমি!”
“না, এ আপনি পারেন না।”
“আমি বেগম লুৎফুন্নেসা। অন্দরমহলে আমার রাজত্ব চলে, সব পারবো আমি। খাদিম চন্দ্রমল্লিকাকে বন্দী করো এই মুহূর্ত!”
দু’জন খাদিম এগিয়ে গেলে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহমাদ শাহ।
“থামো সেখানেই! কোথাও যাবে না চন্দ্রমল্লিকা!”
“যাবে না অর্থ কী? তুমি আমার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছো? নিয়মনীতির বিরোধিতা করছো? আজকে যদি চন্দ্রমল্লিকার তার শাস্তি হতে মুক্তি পায়, তবে অন্দরমহলে অবস্থিত কন্যাদেরও সে প্রশ্রয়দান করা হবে।”
মেহমাদ শাহ তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেগম লুৎফুন্নেসার দিকে।
“আপনিও তো রীতি বিরোধী কাজ করেছেন দাদীজান। নবাববাড়ির সদস্যের বিচারকার্য গোপনীয়তার সহিত সম্পূর্ণ করা হয়, যতোক্ষণ না তা কোনো অতি ঘৃণ্য অপরাধ না হয়। সেখানে আপনি বৈঠক খানায় বিচার বসিয়েছেন। আর আইন মোতাবেক শাস্তি চন্দ্রমল্লিকা পাবে, তবে দাসীদের জন্য প্রযোজ্য শাস্তি নয়। আমি নবাব মেহমাদ শাহ এই অন্দরমহলে সমেহ গোটা শেরপুরের নবাব দিব শাস্তি, অন্যকেউ নয়।”
রক্ত লাল চক্ষু নিয়ে যামিনীর হাত আঁকড়ে ধরে নিজের কক্ষের দিকে চলতে শুরু করে। কক্ষের প্রবেশ করে ছুঁড়ে ফেলে তাকে শয্যায়।
কোঁকিয়ে উঠে কিশোরী। ভীতিগ্রস্ত চাহনি তার।
“তোমার মস্তিষ্কে কী চলছে যামিনী? সামান্য ক্ষমতা পেয়ে আদব-কায়দা সব ভুলে বসেছো? গতকাল আমার সাথেও তুমি তর্ক করেছো, আমি বাচ্চামো ভেবেছি। মেনে নিয়েছি ভালোবাসি বলে। তাই বলে কি এই অন্দরমহলের সবাই তোমার ভুল ক্ষমা করবে? কী হলো কথা বলছো না ক্যানো?”
ঝরঝর করে আঁখিজল মুক্ত করে দেয় যামিনী। আকুতি করে শুধায়,
“আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাবু মশাই হুট-হাট গুপ্তচর দেখে। ঠিক-বেঠিক জ্ঞান শূন্য হয়ে আঘাত করে ফেলি। কী করতাম আমি তবে আপনি বলেন? আপনাকে বিবাহ করে আসার পর থেকে এমন সব কিছুর সম্মুখীন হচ্ছি, যা আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক ঠিক ভাবে ধারণও করতে পারে না।”
যুবক শান্ত হয় কিছুটা।
“দেখো কিশোরী, তুমি আমাকে বিষয়টা খুলে বলতে পারতে। দাসীকে আটক করে রাখতে পারতে। আঘাত করার প্রয়োজন ছিল না। ক্ষমতাকে নিজের বুদ্ধির উপর আচ্ছন্ন হতে দিয়ো না। তুমি চাইতে বা না চাইতেও আমার জটিল পৃথিবীতে জড়িয়ে গিয়েছো।
মানিয়ে তোমায় চলতে হবেই। আর আমি তোমার মামার মতো কোনো চাষী বা সাধারণ পুরুষ নয়। অনেক কিছু সামলাতে হয় আমার, তোমার জন্য প্রতিদিন অন্দরমহলের আসরে সময় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এই ভুল যেন আর না হয়।”
রমণী সায় জানিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেহমাদ শাহ ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে। এই নারীর অশ্রুপাত তার সহন সীমার বাহিরেই থাকে।
অধরজোড়া চিবুকে ছোঁয়ায়, ছোঁয়ায় নেন যুগলে। কানের কাছে যেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আসা অবধি আমার কক্ষেই থেকো।”
___
যামিনীকে শাস্তিস্বরূপ সাত দিন তথা এক সপ্তাহ নবাববাড়ির বাগানের অপর প্রান্তে তৈরি এক কামরার ঘরে নজরবন্দী থাকতে হবে তাকে। উক্ত ঘটনাটি থেকে সে বেশ বিচলিত। বুঝতে পারছে না কীভাবে পরিস্থিতি পুনরায় নিজের পক্ষে ঘুরাবে।
দুঃশ্চিন্তা বশত আজ মাথা ব্যথায় কাতর কিশোরী। দিলরুবা লেবু চা করে এনেছে। মাথায় দিয়ে দিচ্ছে নারিকেল তেল। চা পান করতে করতে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছে যামিনী।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনি চিন্তা করে নিজেকে আর অসুস্থ করবেন। আল্লাহ পরম করুণাময়, নিশ্চয়ই আপনার জন্য ভালো কিছুই রেখেছে। ঐ শয়তানগুলো আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
“আমিন দিলরুবা। তবে সেই ঘটনায় আমিও সমান দোষী। না ভেবেই ক্রোধের বশীভূত হয়ে অপকর্ম করে তাদের সুযোগ দিয়েছি। তবে বাবু মশাই এবং অন্দরমহলের খাদিম, দাসী ও অন্যান্য সদস্যরা আমার প্রতি অনেক অসন্তুষ্ট। তাদের নিজের পক্ষে কী করে আনবো সেই চিন্তাই করছি।”
ঠিক তখনই একজন দাসী প্রবেশ করে। অন্যান্য সময় অনুমতি ব্যাতীত কামরায় ঢুকায় যামিনী ক্রুব্ধ হলেও আজ শান্ত সে।
দাসী জানায়,
“আপনার নামের চিঠি পড়েছিল মেঝেতে।”
একই ঘটনা পুনরায় হতে দেখে একটু অবাক হয় রমণী। চিঠিটি হাতে নিয়ে পড়তেই ভ্রু সামান্য পরিমাণ কুঞ্চিত হয়।
চলবে…
#চন্দ্রপুকুর
||১৮তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যামিনীকে চিঠিটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে চমকিত হয় দিলরুবা। উদ্বিগ্নতার সহিত প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে বেগম? আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে ক্যানো? কী আছে ঐ চিঠিতে?”
কিশোরী নির্বিকার চিত্তে চিঠিটি এগিয়ে দেয়। দিলরুবা চিঠি পড়ে দ্বিধান্বিত।
“বেগম চিঠিতে তো আপনাকে হতাশ করার মতো কোনো তথ্য নেই। আপনাকে সাহায্য করার জন্য খাঁস উপায় বলেছেন বটে চিঠিদাতা। তবে চিন্তার ভাঁজ কেন ললাটে?”
“সেটাই তো চিন্তার বিষয় দিলরুবা। এতদিনে এতো টুকু তো বোধগম্য হয়েছে এই নবাববাড়ি আস্ত একটা সাপ ভর্তি দ্বীপ। সেখানে আমাকে কেউ বিনা কারণে সাহায্য ক্যানোই বা করবে? তার নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে, যা অকাম্য।”
দিলরুবাও চিন্তিত হয়।
“তবে আমাদের যতো দ্রুতো সম্ভব জানতে হবে এই চিঠিদাতার পরিচয়। তবে তা কী করে করবো সেটাই ভাববার বিষয় বেগম।”
“উহু, বর্তমানে এখান থেকে কী করে বের হওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”
বলতে বলতেই রমণীর চোখ যেয়ে পড়ে বৃষ্টিস্নাত পিচ্ছিল সম্মুখের পথটিতে। বাঁকা হাসি ফুটে উঠে মুখশ্রীতে।
___
বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে বসে আছে মেহমাদ শাহ। তিনি সালাত আদায়ে ব্যস্ত। সালাম ফিরাতেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন পৌত্রের দিকে।
“আমার সিংহ, তুমি এখানে? আজ আবার এই বৃদ্ধা, কুৎসিত দাদীজানের কথা মনে পড়লো কীভাবে?”
জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ান দাদীজান। যুবক মৃদু হাসে।
“নবাবের প্রিয় নারী, যার রূপের জৌলুসে সবাই জ্বলতে তাকে এসব কথা মানায় না দাদীজান। আপনার রূপ আমার প্রাসাদের নূর।”
“যাও তো ছেলে আর খোশামুদি করতে হবে না। কী বলতে এসেছো তা শোনাও।”
“আপনি জ্ঞাত দাদীজান আমি কী বলতে এসেছি। এভাবে আর কতো দিন চলবে? কতো দিন গোট্য ধরনীর হতে আড়াল করবো এই নবাব বংশের রহস্য?”
ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। আপন মনেই কী যেন বিড়বিড়ান। যা শ্রবণগোচর হয় না মেহমাদ শাহের।
“প্রতিবারের মতো এবারও নীরব আপনি। ঠিক আছে, থাকুন! তবে মনে রাখবেন দাদীজান, আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। সূর্য একদিন আপন আলোয় উদিত হয়ে সবটা জানিয়ে দিবেই লোকসমাজে। কতো দিন আড়াল করা যাবে?”
“তা যাতে না হয় কখনো সেটা দেখার দায়িত্বই তোমার, এজন্যই তোমায় নবাবের সিংহাসনে বসানো হয়েছে। আর যা হয়েছে, হচ্ছে তা সকলে অগ্রগতি ও মঙ্গলের জন্যই। নিজের মস্তিষ্ক ও হৃদয় থেকে এসন অহেতুক চিন্তা বহিষ্কার করো এবং প্রাপ্ত মর্যাদা রক্ষা ও দায়িত্ব পালনে মনযোগ দাও।”
“আমার ওয়াদা দাদীজান, আমার তরফ হতে এতো টুকুও কমতি পাবেন না কার্য সম্পাদনে। তবে যা হওয়ার একদিন না একদিন হবেই।”
“সেই দিন কোনো দিন না দেখাক আল্লাহ।”
“আমিন। যাকগে সেসব আপনারা শহরে যাকে গদিতে বসিয়েছেন সে আজকাল একটু বেশিই নাক গলাচ্ছে শেরপুরের জমিদারি ও কাজকারবার নিয়ে। এটা নিঃসন্দেহে আমার পছন্দনীয় নয়। আমি বাধ্য হচ্ছি ব্যবস্থা নিতে। এতো টুকুই জানাতে চাই আপনাকে।”
কথা টুকু সমাপ্ত করেই হনহন করে বেড়িয়ে গেল সে। বেগম লুৎফুন্নেসাকে ভীষণ চিন্তিত দেখালো।
___
মেহনূর হৃদয় নাচছে যামিনীর পরাজয়ে। তীব্র আনন্দে সে নৃত্য করতে শুরু করলো। রত্নাও বেশ আনন্দিত তাকে প্রফুল্ল দেখে।
“রত্না, আজ আমি বেজায় খুশি। পাচককে (রাঁধুনি) যেয়ে বলো ক্ষীর আর আমের শরবত করতে। আমার তরফ থেকে গোটা অন্দরমহলে বিলিয়ে দেও।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
ক্ষীর ও আমের শরবত তৈরি হলে অন্দরমহলে দাসী ও খাদিমদের মাঝে মেহনূর ও রত্না নিজে উপস্থিত থেকে বিলিয়ে দেয়।
“আজ আমি বেশ আনন্দিত মেয়েরা। কেউ তার যোগ্য অবস্থানে পৌঁছয়েছে। আমার আনন্দ তোমাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। উপভোগ করো ভোজন।”
সবার মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায় শাহাজাদি মেহনূরের বচনে। কারণ সবাই খুব ভালো ভাবেই জ্ঞান যামিনীর দিকে ইশারা করেছে সে। সাথে শাহাজাদির উদারতা নিয়েও বলাবলি করছে সকলে।
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্দরমহলে দিলরুবার হাতে ভর দিয়ে প্রবেশ করে যামিনী। তার পরনে কালো উত্তরীয়, মুখশ্রী দৃশ্যমান শুধু। কিছুটা ক্লান্ত দেখালেও সতেজ হাসি ঠোঁটে লেগে আছে।
যুবতী ভ্রু কুঞ্চিত হয় তাকে দেখে।
“তুমি এখানে কী করো? তোমার শাস্তির সময়কাল তো এখনও সম্পন্ন হয়নি। সাহস কী করে হয় শাস্তি অমান্য করার!”
যামিনী উত্তর না দিয়ে তার সাথে আসা খাদিমের দিকে তাকায়। তড়িৎগতিতে মুখে খুলে সে,
“জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ বেগমের ভুল মার্জনা করেছেন। মুক্তো করেছেন তাঁকে।”
শাহাজাদি তেজস্বী মুখশ্রী পাণ্ডুর হয়ে উঠে। কিশোরী দিলরুবার হাত ছেড়ে নৈশব্দে অত্যন্ত ধীর পদচারণায় কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়ায় তার।
ফিসফিস করে বলে,
“আমাকে আটকে রাখা এতো সহজসাধ্য নয়। আমি ঐ সৈনিক নয় যে ব্যর্থতার স্বাদ নিয়ে পরাজিত হয়, আমি ঐ সৈনিক যে ব্যর্থতার স্বাদ নিতে নিতে জয়ের সিঁড়ি চড়ে। আমার ঢাল কোনো বংশ বা মর্যাদা বা পদবী নয়। আমি ভালোবাসার আশ্রয়ে বাঁচি, আমার শক্তি ভালোবাসা, মর্যাদাও। আর ভালোবাসার কোনো দিন মৃত্যু হয় না, তাই আমার শক্তিও কোনো দিন শূন্য হবে না।”
শাহাজাদি মেহনূর রাগে, দুঃখে, হতাশায় কোনো কিছু উচ্চারণই করতে পারে না। বড়ো বড়ো পা ফেলে স্থান ত্যাগ করে দ্রুতো।
কক্ষে পৌঁছেই আয়নার দিকে পানপাত্রটি ছুঁড়ে ফেলে। ভেঙে চৌচির আয়না।
“শাহাজাদি মেহনূর, আপনি শান্ত হন। আঘাত লেগে যাবে আপনার।”
“কীভাবে শান্ত হবো আমি রত্না? কীভাবে? ঐ মেয়ের মুখশ্রী বারবার মনে করিয়ে দেয় আমার পরাজয়।”
“শাহাজাদি, বেগম লুৎফুন্নেসার কথা মনে করুন। তিনি বলেছিলেন এই যুদ্ধ করতে হয় শীতল মস্তিষ্কে। ক্রোধ নিয়ে নামলে টিকা যায় না। সামনে এমন অনেক উপায় আসবে। জমিদার বাবু সর্বদা শেরপুরে থাকবেন না বেগমকে রক্ষা করতে।”
রত্নার বাণী ঔষধির ন্যায় কাজ করে। রাগের অগ্নি নিবে চতুরতার দ্বার খুলে। নতুন পরিকল্পনা করার ভাবনায় ডুবে সে।
___
যামিনী কক্ষে বসে আয়েশ করে বসে কচি মুরগির গোশতো খাচ্ছে। এই স্বল্প সময়ে শাস্তির তৈল ও মশলা হীন সিদ্ধ সবজি খেয়ে অতৃপ্ত হয়ে উঠেছিল সে।
মেহমাদ শাহের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকে গোশতো তার প্রতিদিনের খাদ্য। পূর্বে তো দাস বাবু প্রতি রবিবার পরিবার সমেত গোশতো আহার করলেও তার ভাগে হাড্ডি বাদে কিছুই জুটতো না।
অতিরিক্ত দ্রুতো খেতে যেয়ে গাল-মুখে ভোজন লেপ্টে যাচ্ছে যামিনীর। তাও সেদিকে ধ্যান নেই। গলায় খাবার আটকে গেলেই হুশ হয় তার। দিলরুবা পানি পান করায়।
“শান্ত হয়ে আহার করুন, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। কেউ আপনার ভোজন তুলে নিয়ে যাবে না।”
লজ্জিত হয় কিশোরী। এবার বেশ ধীরে-সুস্থে খেতে শুরু করে।
“আচ্ছা, জেনেছো কেন সবাইকে ক্ষীর খাওয়াচ্ছে শাহাজাদি মেহনূর?”
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। আপনার শাস্তি পাওয়া উপলক্ষে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন শাহাজাদি।”
খাবারের চামচ রেখে দেয় যামিনী। বিক্ষুব্ধ হয়।
“দুষ্টু আত্মা! অন্যের মন্দ হতে দেখতে ভালো লাগে, তাই না? আমাকে ফিরে আসতে দেখে নিশ্চয়ই সব আনন্দ ঘুচে গিয়েছে শাহাজাদির।”
মনে মনে ভাবতে শুরু করে রমণী তার মুক্তি পাওয়ার পরিকল্পনার সফলতা নিয়ে। মুহূর্তের মাঝেই ক্রোধের অন্তরালে কুটিল হাসি দেখা দেয়।
___
আঁধার নেমেছে ধরনীর বুকে। তবুও ব্যস্ত এই নগরীতে অনেকের চোখেই তন্দ্রা নামার নাম নেই। তেমনই একজন মানব বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ির নেশায় মত্ত। তীব্র আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।
আপন ভাবনাতে বিভোর হয়ে বিড়বিড়ান তিনি,
“পুরুষের হাতে যার জন্ম, নারীর হাতেই তার ধ্বংস হবে। এক হৃদস্পন্দনে সবটা ধ্বংস হবে, টেরও পাবে না গোটা শেরপুর। তবে দর্শক ও সাক্ষী হবে সকলে। ইনশাআল্লাহ!”
চলবে…