#চন্দ্রপুকুর,২য় পর্ব,০৩
-ঈপ্সিতা শিকদার
সদ্য পনেরো বছরের যামিনীর নিজেকে রক্ষার্থে তিন কবুল বলে আপন করে নিতে হলো তার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী মেহমাদ শাহকে। তবে মেহমাদের রাগান্বিত মুখশ্রী তাকে ভাবাচ্ছে তাহলে সে কি অর্থহীন এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো?
জমিদার মেহমাদ শাহ রহমতপুর গ্রাম পরিদর্শন করতে এসে খেয়াল গ্রামের মাঝে বিদ্যমান ভীড়, কাছে গেলে দেখে এক হিন্দু দম্পতি চৌদ্দ-পনেরো বর্ষী কিশোরীকে পতিতালয়ের সরদারনী মোহিনী দেবির নিকট বিক্রির চেষ্টা করছে। মেহমাদ আটকাতে গেলে তাকে নিজের মান ও অহং রক্ষার্থে বিয়ে করতে হয় সেই কিশোরীকে।
“না, মোহিনী দেবী। আপনি এই মেয়েটাকে ক্রয় করতে পারেন না। এ আমার আদেশ ও নীতি বিরোধী। আপনাকে আমি বহুবার বলেছি আপনি এবং আপনার সহকর্মীরাই হবে লতাবাড়ির (পতিতালয়) শেষ বাসিন্দা ও প্রজন্ম।” মেহমাদ শাহ হুংকার দিয়ে উঠে।
“আরে যেখানে বাগানীই ফল বিকাতে রাজি, সেখানে আমি না করার কে? উনারাই তো বিকাতে চাচ্ছে নিজের ভাগ্নীকে। তারা আর দায়িত্ব নিতে চান না যামিনীর, পরে তো মেয়েটা ভাতে শুকিয়ে মরবে। আমি সেখানে না করি কীভাবে? লতাবাড়িতে আর কিছু না হোক একমুঠ ভাত তো পাবেই।”
কিছুটা ঠাট্টার সুর মোহিনী দেবীর।
মেহমাদ ঘাড় ঘুরিয়ে যামিনীর মামা নীলকণ্ঠ দাসের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। তিনি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে।
“আপনি আপনার ভাগ্নীকে নিয়ে বাসায় ফিরে যান। লতাবাড়িতে কোনো নতুন মেয়ে নেওয়া নিষেধ।”
“ভুল বললে মার্জনা করবেন বাবু সাহেব। কিন্তু এই মাইয়ার দায়িত্ব আমি আর নিতে পারছি না। আমি আর পিছনে এক কানাকড়িও দিতে পারবো না। এ আমার জন্য বড়োই চাপের। এজন্য বাবু আপনি দয়া করে বাধা দিবেন না।”
মেহমাদ এক মুহূর্ত ভাবলো।
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। নিতে হবে না আপনার, এই কন্যার খরচাদির দায়িত্ব আমার। মাস শেষ হওয়ার আগে অর্থ নবাববাড়ি থেকে আপনার দুয়ারে পৌঁছে যাবে। মেয়েটাকে নিয়ে তবে বাড়ি যান এখন৷”
নীলকণ্ঠ আর বলার মতো কিছুই পান না। কিন্তু তাঁর স্ত্রী শতরূপা আঁতকে উঠেন। মোহিনী দেবী তাঁকে বেশ চড়া দাম দিবেন যামিনীর। এত অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ ছাড়তে তিনি চান না। নিজের ঘরেও তো লক্ষ্মীমন্ত দুটো মেয়ে আছে, তাদেরকে তো ও গ্রামের ঠাকুর পরিবারে বিয়ে দিতে হবে মোটা অঙ্কের পণ দিয়ে।
“না, না, জমিদার বাবু। এ হয় না। আমি এই জাত-ধর্ম ছাড়া মাইয়াকে আমার ঘরে এক মুহূর্তও রাখবো না। আমার ঘরেও দুটো মাইয়া আছে, তাদের বিয়ে দিতে হবে। এটা এমনেই কালা বেগুন, তার উপর বেজন্মা। এর তো বিয়ে হবেই না, তার জন্য আমার মাইয়াদের বিয়েতেও বাধা। এখন যদি বাড়ি থেকে বের করে দেই, পরে একটা উঁচ-নিচ হয়ে মারা গেলে তো সবাই আমাদেরই দুষবে। তার চেয়ে বরং মোহিনীর কাছেই থাকুক। ভাত-ডাল খেয়ে নিজের মতো বেঁচে তো থাকবে।”
‘জাত-ধর্ম ছাড়া মেয়ে’ কথাটি কর্ণগোচর হতেই বেশ অবাক হয় মেহমাদ। কারণ যার মামা-মামী হিন্দুধর্মাবলম্বী, তার ভাগ্নীও নিশ্চয়ই হিন্দুই হবে। সে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে নিজের খাস ভৃত্য মিনারের দিকে তাকায়।
সে কানে কানে জানায়,
“এক মুসলিম ছেলের সাথে প্রেম ছিল যামিনীর মায়ের। বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন তিনি, জন্মদানের সময় মৃত্যুবরণ করেন। মেয়ের বাপের হদিস মিলেনি আর। এজন্য মেয়ের ধর্ম-জাত নিয়ে একটা রেষারেষি রয়ে গিয়েছে, আবার বংশপরিচয় নিয়েও, জারজ আর কী।”
সব শুনে মেহমাদ পুনরায় নিজের সিদ্ধান্ত জানান,
“ঠিক আছে, তবে তার খরচের সাথে বাসস্থানের দায়িত্বও আমার। আমি সকল দায়িত্ব নিলাম যামিনীর।”
“এ কোনো কথা বললেন জমিদার বাবু? এটা তো আমাদের সমাজকে নষ্ট করা হলো। এক মাইয়ার দায়িত্ব পুরুষ নিতে পারে তখনই যখন তাদের বিয়া হয়। এটা তো শুধু আমাদের ধর্মের কথা নয়, আপনার ধর্মের কথাও। কী যেন বলেন আপনারা? মনে পড়েছে, গায়রে মারহাম। যামিনী কী করে একজন গায়রে মারহামের সাথে থাকতে পারে? এ তো অবৈধ!”
শতরূপা দাসের কথায় গ্রামের বেশ খাণেক মুরব্বিও সায় জানিয়ে উঠেন। তাঁদের সমর্থন পেয়ে আরও যেন পেয়ে বসেন শতরূপা। সুযোগ বুঝে গভীর ভাবে আক্রমণ করেন মেহমাদ শাহকে।
“বলি, আপনার যদি এতোই দরদ হয় এই অপয়া মেয়ের জন্য যে বিকাতে দিবেন না। তবে নিজেই বিয়ে করেন না যামিনী রে। দেখি আমরা!”
মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠে শতরূপার। তিনি জানেন যতো যাই হোক জমিদারের একমাত্র পুত্র তো আর কিছুতেই হাত বাড়াবে না এই জাতপাত হীন কৃষ্ণবর্ণা কিশোরীর দিকে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ তো বেশ দূরের কথাই।
এদিকে মেহমাদ শাহ ক্রদ্ধ। সে ভেবেই পাচ্ছে না সামান্য এক চাষার স্ত্রীর তার সম্মুখে এত দুঃসাহসিকতা দেখানোর সাহস কী করে হয়? রাগে রীতিমতো গলা চেপে ধরতে মন চাচ্ছে । তবে মেহমাদ শাহ তা করলো না। রাগী হলেও শীতল মস্তিষ্কের পুরুষ সে। খুব ভালো করেই জানে জোর দেখিয়ে আজ জিতলে গ্রামবাসীর মনে তার জন্য ভীতি তো থাকবে, কিন্তু তার আগেই সেই অহং, মান আর ঠাটবাট থাকবে না।
“মিনার, কাজী আর মাওলানা সাহেবকে ডাকাও। আজ এই মুহূর্তে এখানে জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের বিয়ে হবে নীলকণ্ঠ দাস বাবুর বোনের মেয়ের সাথে।”
মেহমাদ শাহের আহবানে চলে আসেন মাওলানা সাহেব। তিনি পরিস্থিতি বিবেচনা করেন প্রথমে। তারপর মুখ খুললেন,
“দেখো, যামিনীর বাপ যেহেতু মুসলমান, সেহেতু চলিত রীতিনীতি অনুযায়ী সেও মুসলিম৷ কিন্তু এতোকাল একটা হিন্দু পরিবারে সে বেড়ে উঠেছে ইসলামের কোনোরূপ ধরা-ছোঁয়া ছাড়া। তাই আমার হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী তার আবার ইসলাম গ্রহণ করা আবশ্যক। তবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে মন থেকে, বিয়ে করার জন্য নয়। এখন মা যামিনী তুমি জানাও তোমার সিদ্ধান্ত।”
“হুম, বলো মেয়ে। কী চাও তুমি?” গমগমে কণ্ঠে প্রশ্ন করে মেহমাদ শাহ।
যামিনী সিদ্ধান্ত নিবে আর কী, থরথর কাঁপছে বিপদাশঙ্কায়। বস্তুত, সে কোনো ধর্ম সম্পর্কেই পুরোপুরি জ্ঞাত নয়। বিষয়টা এমন যে তাকে এতোটাই নিচু দৃষ্টিতে দেখতো সকলে, যে সে হিন্দুত্ব বা ইসলাম দুটোর একটি ধর্মের বিষয়েও আগ্রহ দেখালে মানুষ কটুবাক্য শুনাতে ভুল করতো না। বিশেষ করে তার মামীর গালাগাল ও বাজে কথায় তো সবচেয়ে বেশি আহত হতে হতো। সবকিছু মিলিয়ে দু’ধর্ম, বিশেষ করে হিন্দু সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে উঠায় ইসলাম সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞাত। তবে এতো কিছু এখন বিবেচনায় আনছে না রমণী। তার ভাবনা শুধু একটাই নিজের দেহকে বাজারে নামা থেকে বাঁচানো।
আর না ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত করেই সে চোখ-মুখ খিঁচে জবাব দেয়,
“আমি রাজি। আমি আবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করমু। তবুও আমায় এই নরকের সরদারনির কাছে একা ফেইলা যাইবেন না বাবু মশাই।”
অবশেষে মাওলানা সাহেবের হাত ধরে যামিনী পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং গোটা গ্রামকে সাক্ষী রেখে স্ত্রী হয়ে উঠে জমিদারের। তবে আদৌ কি এই বিবাহ বন্ধনের কোনো মূল্য আছে?
এই বিয়েতে মুখে হাসির ঝলকানি শুধু মাওলানা সাহেবের আর যামিনীরই। মেহমাদের মুখশ্রী বিক্ষুব্ধ, গ্রামবাসীর চোখেও অস্পষ্ট এক অসন্তুষ্টি আছে, কারো চোখে আবার ঈর্ষা। আর শতরূপা ও নীলকণ্ঠ দাস? তাঁদের চেহারায় তীব্র আক্রোশ, অসন্তুষ্টি ও হতাশা সদ্য বিবাহিত দম্পতির প্রতি। আসলে এত মোটা অঙ্ক হাতছাড়া হলে কে বা আনন্দিত হবে? যতোই সেই অর্থের বিপরীতে এক মেয়ের জীবন নষ্ট হোক। নিজের কন্যা তো আর না।
মেহমাদ শাহ যামিনীকে গাড়িতে বসতে আদেশ করে। রমণীও কাঠপুতুলের মতোন সেই আদেশ পালন করে।
যুবক ফিরে এসে নীলকণ্ঠ দাসের একদম কাছে এসে দাঁড়ায়। বুক কাঁপছে নীলকণ্ঠ দাসের।
“আপনার স্ত্রীর অনেক সাহস দাস সাহেব। জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের সাথে মুখে মুখে কথা বলে, তর্ক করে, আপত্তি করে। পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসেরই একটা মূল্য আছে, সাহেব। যা সবাইকেই দিতে হয়। আপনার বউয়ের সাহস প্রদর্শনের একটা মূল্য আছে। আপনি আজ থেকে চার বছর অবধি আমার কোনো জমি ভাড়া নিতে পারবেন না। আর ভিটেমাটির ভাড়া দিবেন প্রতিমাসে দ্বিগুণ হারে। আর যদি এই মূল্য দিতে না চান তবে তালাক দিয়ে আপনার স্ত্রীকে শ্বশুরগৃহে রেখে আসুন।
এখন দূর হন আমার নজরের সামনে থাকে। অন্যথায় আমার আক্রোশের গরলে না সমাপ্তি হয় আপনার।”
শেষ দু’বাক্য বেশ চেঁচিয়েই বলে মেহমাদ শাহ। ভীতিগ্রস্ত হয়ে মাথা নত করে ফেলে গোটা গ্রামবাসী।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে দাস দম্পতির। নীলকণ্ঠ দাস ও শতরূপা দাস উত্তেজিত, ভারাক্রান্ত গলায় মার্জনার আবেদন করতে শুরু করেন।
“হুজুর, মাফ করেন আমাদের। এত বড়ো শাস্তি দিবেন না। বাচ্চাদের নিয়ে না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় হবে না আমাদের। দয়া করুন জমিদার বাবু, দয়া করুন।”
তাদের প্রবাহমান নোনাজল, কান্না, উৎকণ্ঠা, আকুতি সবটাই কর্ণগোচর হয় মেহমাদ শাহের। তবে এ যেন যুবকের জন্য এক শ্রুতিমধুর ধ্বনি, যা তাকে শান্তি দিচ্ছে। যার প্রমাণ তার মুখশ্রীর উদিত বাঁকা হাসি। নির্বিকার ভাবে স্মিত হাসির সহিত গাড়িতে উঠে বসে সে।
যামিনী আনমনেই বিড়বিড়ায়, “কী নিষ্ঠুর আপনি বাবু মশাই!”
___
এক কান দু’কান হতে হতে নবাববাড়িতে পৌঁছে গেল মেহমাদ ও যামিনীর বিয়ের খবর। মেহমাদের দাদীজান বেগম লুৎফুন্নেসার রাগের সাথে তরতর করে বাড়ছে পেশারও। নার্স রুমি তাঁর পাশে বসে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। জমিদার নবাব আলিউল শাহ ছেলে সহ ড্রাইভার, দেহরক্ষী ও মিনারকে বারবার কল করছেন। কিন্তু প্রতিবারই একই উপায়ে প্রত্যাখ্যান, ফোন বন্ধ করে রেখেছে হয়তো সকলেই।
পুত্রের এমন কুকর্ম শুনে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন মেহমাদ শাহের মা বেগম নূর বাহার। তাঁর যে বহু ইচ্ছে ছিল ভ্রাতুষ্পুত্রী আয়েশা অথবা ননদের কন্যাদের থেকে একজনকে পুত্রবধূ করে আনার। শান্ত শুধু নবাব পরিবারের একজন, তিনি হলেন মোর্শেদা খাতুন। মেহমাদ শাহের প্রিয় আম্মাজান।
অবশেষে অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে মেহমাদ শাহের আগমন ঘটে অন্দরমহলে। সবাই ক্ষোভে নিজ স্থান থেকে উঠে দাঁড়ায় তাকে দেখে। নবাব পরিবারের সকলে মেহমাদ শাহকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে তার পূর্বেই কিশোরী তথা যামিনী ছোটো ছোটো পদচারণায় পাশে এসে দাঁড়ায় স্বামীর।
নবাব আলিউল শাহ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে,
“এসব কী শুনছি আমি মেহমাদ? এই মেয়ে কে তোমার সাথে?”
বেগম নূর বাহার তো যামিনীর প্রথম দর্শন পেয়ে এতোটাই স্তম্ভিত ও হতাশ হন তিনি দাঁড়ানো থেকে ধপাস করে বসে পড়েন নরম শিমুল তুলোর গদির উপরে। ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেন।
“কী হলো তুমি উত্তর দিচ্ছো না কেন মেহমাদ? তোমার বাবা কিছু জিজ্ঞেস করছে তো!”
“জী, আব্বা হুজুর। আমি বিয়ে করেছি এই মেয়েকে। সে এখন ধর্মীয়ভাবে আমার স্ত্রী। এই নবাববাড়ির পুত্রব…”
“খবরদার মেহমাদ! ঐ কথা মুখ দিয়ে আর উচ্চারণ কোরো না। এই চালচূলোহীন কালি কখনো নবাববাড়ির পুত্রবধূ হতে পারে না। চালচুলোহীন, কালো রঙ একবার মানলাম, কিন্তু জারজ ও জাত-ধর্ম ছাড়া এক মেয়ে হবে আমার নাতির বধূ! আমার শের, আমার রাজপুত্র এই কাজ করবে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ছিঃ!”
বেগম নূর বাহার কাঁদতে কাঁদতে শুধান,
“না, আম্মিজান। মেহমাদের কী দোষ? সব দোষ এই অমবস্যা কন্যার! নিশ্চয়ই মন্ত্রতন্ত্র করে আমার বাঘের মাথাটা খেয়েছে।”
সবাই নিজেদের মতো কথা শুনিয়েই যাচ্ছে মেহমাদ শাহ ও বিশেষ করে যামিনীকে। কারণ দোষ দুজনেরই হোক না কেন সমাজ নারীর দোষই আগে দেখবে। যামিনী ভয়ে কুঁকড়ে যেয়ে মেহমাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়। মেহমাদ নির্লিপ্ত ভাবে বিনা কোনো শব্দে সকলের অভিযোগ, গঞ্জনা ও তিরস্কাত গ্রহণ করে নিচ্ছে।
পরিশেষে অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে সে বলল,
“বিয়েটা হয়ে গিয়েছে আব্বা হুজুর, দাদীজান, আম্মিজান। ইচ্ছাকৃত ভাবে না হোক, হয়েছে তো। এই কন্যার দায়িত্ব অস্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আপনারা অনুগ্রহ করে আমাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে আমাদের গ্রহণ করে নিন।”
“কোনোদিনই না! এই স্ত্রীলোককে এই বাড়িতে আমি প্রবেশ করতে দিব না। যদি করে তবে তা হবে আমার এই নবাববাড়িতে শেষদিন তা মনে রেখো।”
“আম্মিজান, এমন করবেন না। ছোটো মানুষ নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছে, ক্ষমা করে দিন।”
মোর্শেদা খাতুনের কথায় আরও তেঁতে উঠেন বেগম লুৎফুন্নেসা। কথায় আছে যাকে লাগে না তার চালচলনও ভালো না।
“চুপ থাকো খাতুন! তোমার সাহস কী করে হয় আমার সিদ্ধান্তে নাক গলানোর! এই অন্দরমহলে শুধু বেগম লুৎফুন্নেসার রাজত্ব চলে তা কি ভুলে বসেছো?”
“দাদীজান, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি। এই বাড়িতে তাকে আপনার অনুমতি ছাড়া আনবো না। আপনি দয়া করে আমার কাজের ক্ষোভ আম্মাজানের উপর দিয়ে তুলবেন না।”
মিনতি করে বাক্যগুলো উচ্চারণ করে যামিনীর হাত ধরে সেখান থেকে প্রস্থান করে মেহমাদ শাহ। সদরদরজায় দাঁড়িয়ে কল করে মিনারকে।
“ঘোড়ার গাড়ি বের করো মিনার। বনের শিকার দালানে যাবো।”
তার কল কাটার একটু বাদেই চোখের সম্মুখে উপস্থিত হয় ঘোড়ারগাড়ি। যামিনীকে হতভম্বের মতোন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহমাদ শাহ ভ্রুঁ নাচিয়ে জিজ্ঞেসু চাহনি নিক্ষেপ করে।
যামিনী তাড়াতাড়ি মাথা ডানে বামে নেড়ে গাড়িতে চড়ে বসে। চড়ে বসে যুবক নিজেও। ঘোড়া গাড়ি সমেত গভীর নীরবতার মধ্যে চলতে শুরু করে নিজের গন্তব্যের দিকে।
___
আগরবাতি, হাসনাহেনা ও আতরের সুগন্ধে মুখরিত আলিশান কক্ষে লাল বেনারসি পরে বসে আছে যামিনী। এই দালানে আসতেই তাকে দাসীদের দায়িত্ব দিয়ে চলে যায় মেহমাদ শাহ।
দাসীরা তাদের বিয়ের কথা হয়তো আগে থেকেই জানতো। তাই নিজে উদ্যোগেই তাকে হাম্মামখানায় নিয়ে যেয়ে দুধ, চন্দন দিয়ে গোসল করিয়ে দামী বস্ত্রে, অলংকারে, সজ্জায় সাজিয়ে তুলে তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
যাওয়ার আগে এক বাঁদী দিলরুবা কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বেগম, আজ প্রথম রাত্রি আপনাদের। শুনেছি আপনাদের পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে, নির্ঘাত তবে প্রেমের বিয়ে। তাই প্রথম প্রদর্শনেই মন আটক করে নিয়েন জমিদার বাবুর, নাহলে খুব দ্রুতোই আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন নবাব পরিবারের কার্যকলাপে।”
যামিনীর গলা শুকিয়ে যায় ভয়ে। সে খুব করে বলতে চায় এ প্রেমের বিয়ে না, জোরজবরদস্তির বিয়ে, হয়তো মূল্যহীন এক বিয়েও। না আছে রূপ, না আছে বংশ পরিচয় বা ভালো ইতিহাস। তবে নবাবের মন সেখানে কি করে যোগাবে সে?
তার ভাবনার মাঝেই নবাব দরজায় খুলে প্রবেশ করে কক্ষে। হাতে থাকা ছোট্ট সিন্ধুকটি টেবিলে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করে,
“নাম কী তোমার কিশোরী?”
মাত্র এতোটুকু কথাতেই আশঙ্কা ও ভীতিতে লোম দাঁড়িয়ে যায় রমণীর। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“যামিনী।”
মেহমাদ এগিয়ে আসে বিছানার দিকে। যামিনী বিছানার মোলায়েম চাদর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ত্রাসে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায় অনতিবিলম্বেই। যুবক তার দিকে ঝুঁকে…
চলবে…
#চন্দ্রপুকুর
||৩য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
মেহমাদ শাহ এগিয়ে আসে বিছানার দিকে। যামিনী বিছানার মোলায়েম চাদর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ত্রাসে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায় অনতিবিলম্বেই। যুবক তার দিকে ঝুঁকে চিবুক ধরে মুখ উঠিয়ে বলে উঠে,
“তোমাকে আমি চন্দ্রমল্লিকা বলে ডাকবো। চন্দ্রমল্লিকা!”
এতোটাই নিকটবর্তী বাবু মশাই, যে তার প্রতিটি শ্বাস ছিটকে পড়েছে যামিনীর মুখশ্রীতে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত চলে যায় তার।
অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করে,
“চন্দ্রমল্লিকা?”
“হ্যাঁ, কোনো আপত্তি আছে তোমার চন্দ্রমল্লিকা?”
ছোটো ছোটো চোখ করে তাকায় মেহমাদ যামিনীর দিকে। কিশোরী নিজের মামা-মামীর হাল মনে করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দশা ভীতিতে।
“ন-না, না, বাবু মশাই। আমার কোনো আপত্তি থাকবো ক্যা? আমার কোনো সমস্যা নাই, আপনি যেই নামেই ডাকেন।”
“হুম, ঐ সিন্দুকে হিরের ও স্বর্ণের দুটো হার আছে, মোহরানা স্বরূপ। সামলে রেখো।”
নিরুত্তাপ যামিনী। মেহমাদ শাহ ভীষণ ক্রোধান্বিত হয় পড়ে উপেক্ষিত হয়ে। রমণীর শীর্ণ বাহু শক্তভাবে ধরে পালঙ্ক থেকে টেনে হিচড়ে নিচে নামায়। ডান হাত পিছনে মুচড়ে নিজের বুক বরাবর মিশিয়ে দাঁড় করায় যুবক।
হিসহিসিয়ে বলে,
“আর কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে উপেক্ষা করার সাহস করবে না। কোনোদিনও না! আমি জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ, এই ধরনীর বুকে দাঁড়িয়ে আমাকে অবজ্ঞা কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না কেউ! মেহমাদ শাহকে উপেক্ষা করার অর্থ নিজের সর্বনাশ নয় ধ্বংস ডেকে আনা। ধ্বংস! বুঝেছো?”
যামিনী উত্তর দিবে কী, সে ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়াভিভূত। উত্ত্রাসে তার গা ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। তার হৃৎপিন্ড থেকে নির্গত ধুকপুক শব্দ যা প্রকাশ করে দিচ্ছে।
মেহমাদ শাহের জন্য এই ধুকপুকানিই যেন মহৌষধী হলো। সমুদ্রের প্রকাণ্ড ঢেউয়ে যেমন হারিয়ে যায় সেখানে বিদ্যমান সব তেমন ভাবেই হৃদয়ের সব ক্রোধ মিলিয়ে যায় বায়ুতে। নিজের রোষানলের বিনাশ সূচনা ও সীমাকে আজও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলো না যুবক।
নিজেকে শান্ত করে ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে সে পুনরায় মুখ খুলে,
“ভালো থাকতে চাইলে আমার আর নবাব বাড়ির রীতিনীতিতে নিজেকে সিদ্ধ করে ফেলো। ছোটো থেকে ছোটো ভুলও আমার নিকট পাপ, যার কোনো ক্ষমা নেই। সামান্য ভুলেও নিমিষেই শাস্তি পেয়ে যাবে, ভয়ানক শাস্তিই হয়তো। আমার ক্রোধের অন্ত আছে, তবে সীমা নেই। কথাগুলো এই ছোট্ট মস্তিষ্কে ঠিকভাবে এঁটে নেও।” কিছুক্ষণের বিরতি।
“খাদিম! খাদিম! মরেছো না জবাবে তালা লাগিয়ে বসেছো সকলে?”
যামিনী কেঁপে উঠে মেহমাদ শাহের গলা ফাটানো চিৎকারে। ভয়ে গুটিয়ে মিশে যায় পালঙ্কের সাথে।
পরক্ষণেই প্রহরী দরজা খুললে কক্ষে উপস্থিত হয় ভৃত্যবর্গ। মাথা নিচু করে একজন মার্জনার আবেদন করে উঠে,
“বিলম্বের জন্য দুঃখিত জমিদার বাবু। আমরা রাত্রির ভোজন পরিবেশনের ব্যবস্থা করছিলাম উত্তর পাশের আঙিনায়।”
ইশারায় সায় দিয়ে আড়চোখে যামিনীর দিকে একপলক তাকায় যুবক।
“নবাববাড়ির অন্দরমহলের মহাপরিচারিকাকে খবর দাও, আগামীকালই যেন এসে পড়ে। বেগমকে নবাব বাড়ির রীতিনীতিতে সিদ্ধ হতে হবে। আর মিনারকে ডেকে…”
বাক্যটি শেষ করার পূর্বেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে মেহমাদের খাস ভৃত্য মিনার। মাথা নত করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় জানায়,
“শাহ, নবাব বাড়ি থেকে খবর পাঠানো হয়েছে আপনাকে এই মুহূর্ত বাড়ির পথে রওনা হওয়ার জন্য।”
একটু বুঝে উত্তর দেয়,
“আচ্ছা, তবে গাড়ি বের করো মিনার। আমি আসছি।”
মিনার নত দৃষ্টিতে সালাম জানিয়ে তাকে সম্পাদিত কার্য সম্পন্ন করতে প্রস্থান করে। ভৃত্যবর্গ তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে।
“আমাকে একা ছাড়া হোক।”
তারা সালাম জানিয়ে চলিত নিয়ম অনুযায়ী কক্ষ থেকে বের হয়। যামিনী তা দেখে ভাবে,
-এরা এভাবে পিছনে দু’কদম হেঁটে বের হচ্ছে কেন?
“আগামীকাল মহাপরিচারিকা, সাথে নবাববাড়ির শিক্ষিকাও আসবেন। তাঁদের থেকে সঠিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ কোরো। আমি পরবর্তী বার এখানে আসলে পরিবর্তন চাই তোমার আচার-ব্যবহারে নতুবা পরিণাম তোমার চিন্তা-ভাবনার বাহিরে হবে।”
যামিনী ভীতচিত্তে তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। যা দেখে বাঁকা হাসি দিয়ে বের হয়ে যায় মেহমাদ শাহ। রমণীর স্বস্তির শ্বাস ফেলে তার বিদায়গ্রহণে।
বিড়বিড়ায়,
“এই রূঢ়ভাষী মানুষটার ক্রোধানলেই না পুড়ে ভস্ম হয়ে যাই আমি।”
___
বিছানায় গা এলিয়ে বসে চন্দ্র আর মেঘের লুকোচুরি দেখছিল যামিনী। এই কক্ষের এক বিশেষত্ব হলো গোটা এক দেওয়াল জুড়ে জানালা, আর সেই জানালার থেকে খুব কাছ ঘেঁষেই পালঙ্ক। আহা কী মনোরম এক দৃশ্য! চাঁদনি বিলাস করছে যেন কিশোরী।
রাত গভীর হয়েছে, শোনা যাচ্ছে শেয়াল সহ অন্যান্য জীবজন্তুর ডাক শ্রবণগত হচ্ছে। এমন কালে দরজায় কড়াঘাত করে কেউ। যামিনী বিছানা থেকে উঠে বসে। বুঝতে পারছে না কী করবে।
এদিকে বাহিরে অপেক্ষারত দিলরুবা অনেকটা সময় সাড়া না পেয়ে মুখ দিয়েই অনুমতি চায়,
“বেগম, আমি দিলরুবা। আসতে পারি?”
“জী, আসেন।”
প্রহরী দরজা খুলে দেয়। কক্ষের অভ্যন্তরে হাসিমুখে প্রবেশ করে দাসী।
“বেগম, আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত দাসী দিলরুবা। আপনি ভোজন কি এখানেই করবেন না কি আঙিনায় বা ভোজনশালায় খানা পরিবেশন করবো?”
“যদি সমস্যা না থাইকা থাকে, তাহলে এখানেই দিন।”
“অবশ্যই বেগম। আমরা আপনার সেবায় নিয়োগপ্রাপ্ত দাসী, আপনি শুধু আদেশ করবেন। তবে আমাকে বা অন্যান্য দাস-দাসীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন না করে ‘তুমি’ করে ডাকবেন দয়া করে, জমিদার বাবু বা অন্যকেউ শুনলে রাগ করবেন আপনার উপর।”
যামিনীর অস্বস্তি কাটলো। স্মিত হাসি ফুটে উঠে। এই যুবতীকে বেশ ভালো, আন্তরিক ও আপন লেগেছে তার।
দাসীরা কক্ষের মধ্যিখানে ছোটো এক চৌকি পেতে মখমলের কাপড় বিছিয়ে তার উপর প্রায় সাত পদের খাবার সাজিয়ে রাখে। এতো পদ চিত্তাকর্ষক খাবার দেখে যামিনীর মুখে পানি এসে যায়। তার ভাত ও লবণ দিয়ে পেটপুরে খাওয়া পড়েনি বহুদিন, ভালো খাবার তো দূরে থাক।
“সব আমার জন্য?”
“হ্যাঁ, বেগম।”
সাথে সাথেই চৌকির সম্মুখে বিছানা পাটিতে বসে খেতে শুরু করে কিশোরী। তার কুম্ভকর্ণের ন্যায় খাওয়া দেখে চাপা হাসে দিলরুবা। গলায় খাবার ঠেকে যায় যামিনীর তাড়াহুড়ো করার দরুন।
দিলরুবা দ্রুত যেয়ে পানি এগিয়ে দেয়।
“ধীরে-সুস্থে খান বেগম। তাড়াহুড়ো করবেন না।”
যামিনী ধীরে ধীরে আহার সমাপ্ত করে। অতিরিক্ত আহারের কারণে তার হাত-পা যেন অসার হয়ে আসে। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে সে।
দিলরুবা শরবত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা পান করুন ভালো লাগবে। তা সময় কেমন কাটলো আজ বেগম নবাবের সাথে? আর আজ নিম্নে রাতটার জন্য তো আপনার জমিদার বাবুকে বেধে রাখা উচিত ছিল। অবশ্য আপনার যা শীর্ণ দেহ, নির্ঘাত চাপ নিতে পারেননি।”
যামিনী মুখমণ্ডলে সাজানো বিস্তৃত হাসি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় এ কথা শুনে। বিমর্ষতাপূর্ণ চাহনি তার।
“জোরজবরদস্তির বিয়ে দিয়ে, এই কালো কুৎসিত রূপ দিয়ে কী করে আটকাবো বাবু মশাইকে দিলরুবা?”
দিলরুবার প্রশ্নসূচক চাহনি। কিশোরী একে একে খুলে বলে তার বিবাহের বাস্তবতা।
সব শুনে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে দিলরুবা শুধায়,
“তবে তো সামনে আপনার বড়োই বিপদ। জমিদার পরিবার, বিশেষ করে বড়ো বেগম লুৎফুন্নেসা তো দিন-রাত এক করে ফেলবে আপনাকে জমিদার বাবুর জীবন থেকে বের করতে। উনি আজ পর্যন্ত কোনো সাধারণ ঘরের স্ত্রীলোককে বেগমের গদিতে টিকটে দেননি, যতোই স্বামীর সমর্থন থাক। সেখানে যদি জমিদার বাবুই আপনার পাশে না থাকে… তবে তো একদম আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন। যতো দ্রুত সম্ভব জমিদার বাবুর হৃদয় বন্দী করুন, নাহলে আপনাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।”
যুবতীর কথা শ্রবণগোচর আতঙ্কে শিউরে উঠে যামিনী। মেহমাদ শাহের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একবার নিজের দেহকে তো নিরাপদ করেছে, এবার নিজের আশ্রয় বাঁচাতে যুবকের মন যোগাবে কী করে?
চলবে…