#চন্দ্রপুকুর,২১তম পর্ব,২২
– ঈপ্সিতা শিকদার
“চন্দ্র শাহের বিয়ে ভাঙা ঢোল দিয়ে! চন্দ্র শাহের বিয়ে ভাঙা ঢোল দিয়ে!”
যামিনী কাঁচা ঘুমের ঘোরে এমন অস্পষ্ট কথা শুনে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। পুনরায় একই বাক্য শুনতেই হতভম্ব হয়ে উঠে বসে। কক্ষের আশেপাশে তাকায়, কোথাও কেউ নেই। অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করে শব্দের উৎস বারান্দায় অবস্থিত।
ভীতিগ্রস্ত হয়। নয়নযুগল স্থির মেহমাদ শাহের নিদ্রারত মুখশ্রীর দিকে। দ্রুতো কম্পিত কণ্ঠে ডাকতে শুরু করে তাকে।
“বাবু মশাই! বাবু মশাই! তাড়াতাড়ি উঠেন না। কে যেন আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। উঠেন না!”
তন্দ্রাচ্ছন্ন যুবক উঠে বসে। কয়েক মুহূর্ত যায় যামিনীর কথা অনুধাবনে। হো হো করে হেসে উঠে সে।
রমণী বিস্মিত, দুঃখিত, রাগান্বিত। এতো বিশাল এক দুঃসংবাদ ও সতর্কবাণী জানালো আর মানুষটা কি না উপহাস করছো। হাসি থামিয়ে সবচেয়ে অমানানসই কাজটি সম্পন্ন করলো মেহমাদ।
“আমার অবুধ হরিণী” উচ্চারণ করেই কাছে টেনে নিল যুবক। দানবীয় এক চুম্বন করলো নরম অধরজোড়ায়।
ছাড়া পেতেই যামিনী রাগ মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করলো যুবকের দিকে। সে হেসে উড়িয়ে দিয়ে নিজে শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রেয়সীকেও দাঁড় করালো।
কপট গাম্ভীর্যপূর্ণ ভঙ্গিমা তার এবার।
“খুব ভয়ানক বিষয় এ তো! শত্রুরা আমাদের মহলে তবে আক্রমণ করেছে। এবার কী হবে চন্দ্রমল্লিকা? আমরা সবাই মারা যাবে? তবে যা-ই হোক মোকাবেলা তো করতেই হবে এ শত্রুর।”
যামিনী কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তার শীর্ণ হস্ত খানা আঁকড়ে ধরে বিবস্ত্র অবস্থাতেই বারান্দার দিকে অগ্রসর হয় সে। দ্বারে পৌঁছাতেই যামিনী ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে মাথা নত করে রেখে। নির্ঘাত এখন রক্তপাত হবে।
“আরে তাকাও তো বাচ্চা বাঘিনী। দেখো তোমার শত্রুকে।”
রমণীর ভয়ার্ত মুখশ্রী চিবুক ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠায় তার বাবু মশাই। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই। অধরজোড়ার মাঝে বড়ো একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়।
আপন মনে বিড়বিড়ায়,
“টিয়া পাখি!”
“হ্যাঁ গো জমিদারনি। এই টিয়া পাখিই তোমার গোপণ শত্রু, যে তোমার তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটিয়ে ছিল।”
“চন্দ্রপুকুরে যাব চন্দ্র শাহের বিয়ে খাব! চন্দ্রপুকুরে যাব চন্দ্র শাহের বিয়ে খাব!”
টিয়া পাখির কণ্ঠ শুনে হতবাক নবাবের বেগম। অবিকল মানব কণ্ঠ।
“এটা কার? কোথা থেকে এলো এখানে? আগে তো দেখিনি। কী সুন্দর দেখতে! কী সুন্দর কথা বলে!”
মেহমাদ শাহ মৃদু হাসে। এগিয়ে যায় সোনালী খাঁচা বন্দী পক্ষীর দিকে।
“এটা তোমার আমার চন্দ্রমল্লিকা। উপহার স্বরূপ। শহর থেকে আনা চন্দনা টিয়া। নাম চাঁদনি। তোমাকে দেওয়া হতো আগেই কিন্তু সুশিক্ষা দানে দেরি হলো। যাকগে উপহার কেমন লাগলো আমার আঁধার রাত্রির রাজকন্যা?”
“অনেক ভালো। এমন যা হৃদয়কে শীতল করে। সবচেয়ে ভালো বিষয় কী জানেন? তার কণ্ঠ অনেকটাই আপনার মতোন। যখন আপনি জমিদারির কাজে দূরে যাবেন, পৃথক হবেন আমার বক্ষ হতে, তখন তার সাথে কথা বলে হৃদয়ের যন্ত্রণা লাঘব করবো। আমার খুব যন্ত্রণা হয়, বারবার মন চায় আপনার সাথে কথা বলতে।”
“বাহ্! বাহ্! এ তো দেখা যাচ্ছে আমি নিজ হাতে নিজ চরণে কুড়াল মারলাম। নিজের সতীন কি না নিজেই আনলাম?”
বুকে অতি ধীরে আঘাত করলো যামিনী। অভিমানের সুরে নাক টেনে জিজ্ঞেস করলো,
“যাহ্! আপনার সব ঠাট্টা! আমাকে কি আপনার মনে পড়ে না?”
“মনে পড়ে, তবে তোমার ন্যায় না। আমি তো তোমায় রোজ দেখি।”
অনেকটা ঘোরের মাঝেই উত্তর দিল মেহমাদ শাহ।নিজের কথায় নিজেই যেন ঘাবড়ে গেল।
“মানে?”
“মানে স্বপনে দেখি তোমায় প্রিয়। এখন আবার আমি আবেগ দেখাই না কিন্তু আজ দেখিয়েছি বলে ঠাট্টা কোরো না আমায় নিয়ে।”
“কখনোই না।”
আরও শক্তভাবে লেপ্টে রইলো যামিনী তার প্রিয়তমের দেহে। দূর থেকে কেউ একজন দেখে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আড়ালে চলে গেল।
___
যামিনীর মন আজ বেশ সতেজ। আঙিনায় নিজের পোষা পক্ষী চাঁদনির সাথে প্রাতরাশ সাড়ার ইচ্ছে তার। তাই দাসীদের আদেশ করেছে শীতলপাটি বিছিয়ে তার বসার ব্যবস্থা করতে।
তৈরি হয়ে আঙিনায় আসতেই অবাক সে। তার বিনা শব্দ ব্যয়েই দাসীরা নিজ উদ্যোগে শরবত, কাবাব ও তালের পিঠার ব্যবস্থা করেছে মনোরঞ্জনের জন্য।
“বাহ্! বেশ মনোরম ব্যবস্থা তো আমার বসার জন্য।”
“ধন্যবাদ, বেগম। আপনার সন্তুষ্টি পেলেই আমি ধন্য।”
“দিলরুবা। আমার থলিটা দাও।”
দিলরুবা সায় জানিয়ে ছোট্ট কাপড়ের থলিটা এগিয়ে দেয়। যামিনী তা থেকে বেশ কিছু অর্থ উপহার দেয় তার জন্য বসার ব্যবস্থা করা দাসীদের।
“ধন্যবাদ, বেগম। ধন্যবাদ। সত্যি আপনি অনেক দয়াময়ী। আল্লাহ আপনাকে সুখী করুক। খুব দ্রুতো শাহাজাদি-শাহাজাদার মাতা করুক।”
“আমিন। এই অর্থ নিজেদের মধ্যে বিলিয়ে নেও। আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা কাউকে শূন্য হস্তে ফিরাই না, হোক সে আমার শত্রু বা শুভাকাঙ্ক্ষী।”
রমণী দিলরুবার সাথে বসে পড়ে আহার করার উদ্দেশ্যে। সুখময় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
আনমনেই ভাবে,
– চিঠিদাতা সত্যই বলেছিল। তার জন্য বড্ড বেশি লাভজনক হয়েছে এই বিবাহ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। বেগম তো সে পূর্বেই হয়েছিল তবে গতকাল হতে পেয়েছে বেগমের যথার্থ মর্যাদা।
“চন্দ্র-শাহ! চন্দ্র-শাহ! ভালোবাসা! ভালোবাসা!”
চাঁদনির মানবীয় কণ্ঠ প্রেমাবেশ ও লজ্জায় চোখ নত করে হাসে যামিনী। আশেপাশের দাসীরা মিটিমিটি হাসছে ও কানাঘুষা করছে।
“দিলরুবা, বাবু মশাই মানে তোমার জমিদার বাবু দিয়েছে আমাকে এই পক্ষী উপহার স্বরূপ। কী আদুরে না দেখতে!”
অপ্রিয় নারীটিকে আসতে দেখতে পেয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবেই জানানোর ভঙ্গিমায় কথাটি বলে উঠে। সাথে সাথেই দাসীরা নিজেদের মাঝেই কলরব পড়ে যায় তাদের জমিদার ও জমিদারনির মধ্যকার ভালোবাসার প্রসংশা নিয়ে।
শাহাজাদি মেহনূর বাগানের বৈদ্যশালার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে ছিল। ঠিক তখনই এ রূপ দৃশ্য দেখে তার শুভ্র গায়ে যেন অম্লরসের ছিঁটে পড়ে।
ধমক দিয়ে উঠে সে,
“এখানে কী হচ্ছে? এতো কলরব ক্যানো? কাজ নেই তোমাদের? যাও, কাজে যাও।”
“শাহাজাদি, আপনি মেহমান। মেহমানদারী উপভোগ করুন। অন্দরমহলের কোথায় কাজ হচ্ছে বা কারা কাজ করছে না সেটার চাপ আপনার মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে না। দাদীজান আছেন, আম্মিজান আছেন, আমি আছি, এই অন্দরমহলের বেগম। আপনি এসবে মাথা ঘামাবেন না।”
যামিনীর শীতল কণ্ঠের শব্দের আঘাতে রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠে যুবতী। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বড় বড় পা ফেলে স্থান ত্যাগ করে।
বিড়বিড়ায়,
“সুখের দিন কাটিয়ে দাও আর কয়েকদিন। অন্ধকার তোমার আঁধারিয়া দেহের নিকট ধেয়ে আসছে।”
তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে রমণী আহার করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দাসীরা তার সুনামে পঞ্চমুখ।
“আমাদের একা ছেড়ে দাও, মেয়েরা। অনেক গল্প-গুজব হয়েছে, এখন কাজে হাত লাগাও।”
সকলে নত হয়ে যামিনীকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। দিলরুবা হেসে বলে,
“বেগম, আপনি তো আজ চমৎকার জবাব দিয়েছে শাহাজাদি মেহনূরকে! ঠিকই আছে, এমনই হওয়া।উচিত ঐ দুষ্টু নারীর সাথে।”
“হু, সবাই তার যোগ্য জবাব পাবে। বুঝবে আমি বেগম নবাবের, বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”
“তবে বেগম একটা কথা কিন্তু থেকেই যায়। যে মানুষটা আপনাকে এই তথ্য ও বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করছে তার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা কী ভেবেছেন?”
“হুম, ভেবেছি। তবে উত্তর পাইনি। তাই এই বৃথা ভাবনায় জলাঞ্জলি দিয়েছি। তাছাড়া তার উপদেশে আমার লাভ বৈকী ক্ষতি তো হচ্ছে না।”
“কিন্তু বেগম… ”
বাধা প্রদান করে যামিনী। বিরক্তির সুরে শুধায়,
“আহা! এখন খাওয়ায় মন দাও দিলরুবা। আমার অনেক ক্ষিধে পেয়েছে। কী মজাদার হয়েছে আজ কাবাব!
মিইয়ে যায় খাঁস বাঁদী। নামিয়ে ফেলে দৃষ্টি মেঝেতে।
“যথা আজ্ঞা, বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”
___
মেহমাদ শাহের ব্যবসায়িক সফরে শেরপুরের বাহিরে যেতে হবে আজ। তার তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখ খানা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যামিনী। আলতো হাতে স্পর্শ করছে তার মুখশ্রী।
ভাবছে, এই মানুষটি কি তার হওয়ার ছিল? নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশিই আল্লাহ তাকে দিয়ে দেয়নি? কোথায় এতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেহমাদ শাহ, যে কি না পাড়াগাঁয়েও সকলের স্বপ্নের পুরুষ সে কি না তার মতো পোড়াকপালির স্ত্রী! ভাবতেই বক্ষ খানা কেমন যেন ভার লাগে, অধরজোড়া তিরতির কম্পিত হয়।
ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে আবেগ অনেক ক্ষেত্রেই নয়৷ যামিনী তো কৈশোর কাটাচ্ছে, তার আবেগে ভাসাই স্বাভাবিক। শক্ত করে ঝাপটে ধরে প্রিয়তমে নিজের সবটুকু আবেগ ঢেলে দেয় তার অধরে।
মানুষটির ঘোর ভাঙে তন্দ্রার, তার ঘোর ভাঙে প্রেমের। লজ্জায় সিক্ত তখন রমণী, দ্রুততার সহিত সরে যেতে চায় শয্যা থেকে। তার শীর্ণ দেহ খানা ততক্ষণে বন্দী হয়েছে কঠোর দেহের বন্ধনে।
“প্রেম সব নিদ্রায় ডুবলেই পায়। একটু জাগ্রতচিত্তেও ভালোবাসার রঙ লাগাও, চলেই তো যাব। যদি ফিরে না আস…”
অধরে তর্জনী রাখে যামিনী। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে যায় মেহমাদ শাহের বচন। প্রিয়তমার ভয়ার্ত নয়ন দুটোতে যেন ডুবেই যাচ্ছে যুবক।
“আস্তাগফিরুল্লাহ, বাবু মশাই। এমন অলক্ষণে কথা বলবেন না তো। আপনার কিছু হলে আমি যে সর্বস্বান্ত নয়, নিঃস্ব হয়ে যাব। আপনি একটি বিশালাকার বৃক্ষের ন্যায়, আমি হলাম কি না সেই লতা যে আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচি। আপনি নেই, তো আমি নেই।”
মেহমাদ শাহ কিছু বলে না। তার মুখমণ্ডলে শুধু চওড়া হাসির কলরব।
“ভোর হয়েছে আমার তৈরি হতে হবে। চলো, এবার উঠা যাক।”
“তা তো যাবেনই। আপনার শুধু এই চন্দ্রমল্লিকার হতে পৃথক হওয়ার বাহানা চাই।”
এলোকেশ হাত খোপা করতে করতে উঠে দাঁড়ায় সে। গায়ে তার এলোমেলো শাড়ি। কোনোরকম গুছিয়ে নেয় সে। একবার অমুধাবনও করে না কারো ঘোরলাগা দৃষ্টি তার প্রতিটি কোষে কোষে আবদ্ধ।
“এভাবে কী দেখছেন? আপনি উঠুন৷ আমি আপনার স্নানের ব্যবস্থা করে আছি।”
যামিনী চলে যায়৷ মেহমাদ শাহ যাওয়ার পানে তাকিয়ে আনমনেই আওড়াই,
“ভালোবাসা, ভালোবাসা, অন্যরকম এক নেশা। পোড়ায়, জ্বালায় তবুও রাখি অনুরাগে তাকেই।”
“পুড়তে ভালোবাসেন বলেই তো পোড়েন। তবে দোষটা কেন শুধু আমার ললাটেই দেবেন?”
যুবক তড়িৎগতিতে চোখ তুলে দেখে। তার বাচ্চা বাঘিনী দেওয়ালের সাথে পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। তার দৃষ্টি ফেলতেই সে নিজ কাজে চলে যায়।
মেহমাদ শাহ তৈরি হচ্ছে যামিনী দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। ভেজা পোশাক তার গায়ে এঁটে আছে। মানুষটা যাবে মনে পড়তেই এক দণ্ড তার হতে দৃষ্টি সরাতে হৃদয় মানছে না।
মাথার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নজর যায় যুবকের প্রেয়সীর দিকে। ভ্রু কুঁচকায় সে।
“তুমি এভাবে কী করছো, চন্দ্রমল্লিকা? যাও, পোশাক বদলে নেও।”
“আপনার যেতেই হবে?” বাচ্চাদের ন্যায় সরল অভিমান প্রকাশ যামিনীর।
মায়া বোধহয় মেহমাদ শাহের। এগিয়ে এসে তার বাচ্চা হরিণীর ছোট্ট মুখ খানা দু’হাতের মাঝে নেয়। আদুরে ভঙ্গি তার।
“আমার বাচ্চা বাঘিনী, মায়াবী হরিণী, রূপকথার রাজকন্যা এভাবে মলিন করে রেখো না মুখ খানা। তোমার হাসি মাখা মুখ খানার কথা ভেবেই তো হৃদয় শীতল করি। এভাবে মলিন মুখে বিদায় দিলে তো হৃদয় পোড়নের যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাব আমি। হেসে দাও এবার।”
অশ্রুসিক্ত চোখেই হাসে যামিনী। দু’জন জড়িয়ে ধরে একে অপরকে। দুজনেরই হৃদয়ের কামনা সময়টা যেন থমকে যায়। তবে সময় তো প্রবাহমান, কারো জন্য থামার তার সময় কোথায়?
একটু বাদেই সকলকে বিদায় জানিয়ে বের হয় মেহমাদ শাহ। যামিনী তার কক্ষে বিষণ্ণ মনে বসে। আজও তার সঙ্গী হয়েছে দিলরুবা ও মোর্শেদা খাতুন।
“চিন্তা করবে না চন্দ্রমল্লিকা। আমার শাহ খুব দ্রুতই সুস্থ ভাবে চলে আসবে এই শেরপুরে।”
“আমিন আম্মাজান। আল্লাহ আপনার পুত্রকে সুস্থ রাখুক, দ্রুত ফিরুক।”
“সুম্মা আমিন। আমার শাহ কিন্তু তোমায় বেশ ভালোবাসে। তাকে রেখো অনুরাগে। আমার পুত্রের মনটা অনেক ভালো। এই আমাকেই দেখো। এই আমার ন্যায় সামান্য সন্তানহারা নারীকে সে তার মায়ের সম্মান দেয়। ছেলেটা তোমার জন্য পুরো পরিবারের সাথে সংগ্রাম করেছে, নিজের জমিদারি ও সিংহাসন হাতছাড়া হতে পারে জেনেও একবিন্দু দ্বিধা করেনি তোমার সঙ্গ দিতে। অনেক কথা বলে ফেললাম, এখন যাই।”
চোখের জল শুভ্র হিজাবে মুছে কক্ষ ত্যাগ করে। যামিনী বিড়বিড়ায়,
“এতো ভালোবাসা আমার ঝুলিতে ছিল বলেই কি এতোটা কষ্ট পেতে হয়েছে আমার জন্মলগ্ন হতে? তবে এই সুখটা স্থায়ী করে আল্লাহ। দূরে রেখো আমায় বিপদ হতে।”
___
বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূর আগামীকালের জন্য পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত। তাদের মুখশ্রীতে বাঁকা হাসি।
আলোচনা শেষে বেগম নূর বাহার বলে উঠে,
“তোমার তেজ সব চুরমার হবে আঁধারিয়া! আর কাল ভোর থেকে তার শুরুয়াত। তবে আমার চাঁদের টুকরো, নানীজান যদি কিছু জানতে পারেন…?”
“মামিজান, আপনি সে চিন্তা করবেন না। আমরা তো ঐ কন্যাকে এক আঘাতে হত্যা করবো না। ধীরে ধীরে একটু একটু করে অদৃশ্য বিষ মিশাবো তার অন্তরে, হৃদয়ে। তার হৃদয় অন্ধকারে ছেয়ে যাবে, সে নিজেই মরে যাবে ধরা-ছোঁয়া ছাড়া।”
#চন্দ্রপুকুর
চলবে…
#চন্দ্রপুকুর
||২২তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
সারাটা রাত যামিনীর কেটেছে নিরাপত্তাহীন, আক্রমণের ভীতি নিয়ে। সাথে তো মেহমাদ শাহের হতে বিরহের শোক তো আছেই।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা ভোর হলো এবার তো অশ্রুর পতন রোধ করুন। ক্যানো এতো বেদনা বোধ করছেন, জমিদার বাবু আপনার চৌকাঠে পা রাখবেই দিনশেষে।”
“জানি না দিলরুবা। কেন যেন বোধ হচ্ছে বাবু মশাইকে অতি শিঘ্রই হারিয়ে ফেলবো আমি। এই ভয় আমার অভ্যন্তরে গভীর ভাবে ক্ষত তৈরি করছে।”
আফসোসের সুরে শুধালো যামিনী। দিলরুবার জানা নেই কোন ভাষায় নিজের মনিবকে সান্ত্বনা দিবে সে।
এমন সময় দ্বারে জোরালো করাঘাতের শব্দ। কেঁপে উঠে উভয় নারীই। কেমন এক ভীতি যেন গ্রাস করছে তাদের।
যামিনীর ইশারা পেতেই দেওয়াল হতে তরবারি নামিয়ে দিলরুবা এগিয়ে যায়। এমন অধিক সতর্কতার জন্য দায়ী কোনো এক অজানা কারণে তাদের কক্ষ হতে প্রহরীদের সরানো হয়েছে।
ধীর হস্তে দ্বার খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করেন পরিচিত মধ্যবয়সী নারীটি। তাঁকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে যামিনী ও দিলরুবা।
“কেমন আছো চন্দ্রমল্লিকা? বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ভাবলাম ভুলে গেলে কি না আমায়, তাই মনে করিয়ে দিতে আসলাম।”
গুলবাহার খাতুনের কথা শুনে বিরক্তিমাখা চোখে তাঁর দিকে তাকালো যামিনী। নারীটি তা দেখে আলতো হাসলো।
“আহা! বিরক্ত, রাগান্বিত হচ্ছো বুঝি? যত্তসব রাগ, বিরক্তি আমার বিষয়েই, আজও অবধি নিজ শ্বশুরালয়ের জন্য বাঁদী হতে রাণী হতে পারলে না তা নিয়ে ক্রোধ নেই কোনো। বাঁদী, বাঁদী, যামিনী বাঁদী।”
“চুপ করুন! সামান্য খাতুন আপনি, আপনার স্পর্ধা কী করে হয় আমাকে এ বলে সম্বোধন করার! আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা, গোটা শেরপুরের জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের একমাত্র স্ত্রী। আমাকে বেগম বলুন। বেগম!”
খিলখিল করে হেসে দেন গুলবাহার খাতুন। যামিনী ক্রুব্ধ হওয়ার চাইতে অবাক অধিক হয়।
“হাসালে কন্যা। তোমাকে কে দিয়েছে বেগমের মর্যাদা? নিয়ম মোতাবেক প্রতিটি বেগমকে বেগম লুৎফুন্নেসার উপদেষ্টা স্বরূপ রাখার কথা অন্দরমহলের বৈঠকে বা যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে। আজ অবধি কোন বৈঠকে তুমি উপস্থিত ছিলে বা ডাকা হয়েছিল? বাস্তবতা তো এটাই তুমি সাধারণ এক বাঁদী।”
“চুপ! একদম চুপ! আর একটা শব্দও দু’ঠোঁটের ফাঁক হতে বের হলে জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”
নারীটি এগিয়ে আসে কিশোরীর দিকে। তাঁর চোখে কোনো ভয় নেই, শুধুই তাচ্ছিল্য ও ক্ষোভ মিশ্রিত চাহনি।
“এতোদিনে এও বোধ করতে পারোনি কিছুতেই ভীতি জাগে না আমার। আর আমি যে মিথ্য কিছু বলিনি তার প্রমাণ তোমার বিনা যুক্তির ক্রোধই। জিভ নাহয় আমার কাটা যাবে, সত্য তো মিথ্যে আর হবে না।”
তিনি গটগট করে বেড়িয়ে যান। মুখে তাঁর জয়ের হাসি। এই রমণীকে শব্দের আগুনে পুড়িয়ে যেন ব্যথা লাঘব হয় তাঁর।
যামিনী ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মানুষটি তো মিথ্যে বলেনি। হুট করেই তার কষ্ট ক্রোধে পরিণত হয়। যা ‘বেগম’ এর প্রাপ্য ক্ষমতা অর্জনের জন্য সকল কিছু জ্বালিয়ে ভস্ম করতেও রাজি।
চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছু ভেবেই বলে উঠে,
“দিলরুবা, আজ অন্দরমহলের ভোজনশালায় বিরাট আয়োজন করার আদেশ দাও রন্ধনশালায়। সকলকে বলো আজ আমার জন্মদিন তাদের উপস্থিত। নবাব পরিবারের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ করো।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
দিলরুবা উত্তর দিয়ে কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বের হয়। যদিও সে অনুধাবন করতে পারছে না কী চলছে যামিনীর মস্তিষ্কে।
___
বেগম নূর বাহার দিলরুবার হতে নিমন্ত্রণ পেয়ে রাগে ফুঁসছেন। অপেক্ষা করছেন শাহাজাদি মেহনূরের আগমনের।
দুশ্চিন্তায় মাথা ব্যথা বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর। তাই মাথা ও হাত-পা টেপাচ্ছেন দাসীদের দ্বারা। একটু বাদেই আগমন ঘটে শাহাজাদির।
“আসসালামু আলাইকুম মামীজান। আমাকে ডাকিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, ডাকিয়েছি। জেনেও না জানার ভান করছো? জানা নেই ক্যানো ডাকিয়েছি?”
“মামীজান।”
অস্ফুটভাবে কথাটা বলে ইশারায় উপস্থিত দাসীদের দেখায় সে। তিনি বুঝতে পেরে আদেশ করেন,
“কক্ষ খালি করা হোক। আমি শাহাজাদির সাথে একান্তে কথা বলতে চাই।”
তারা বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে গেল।
“এখন বলো আমাকে, কী হয়েছে? যেখানে ঐ কন্যার আর্তনাদ পুরো মহলে আলোড়িত হওয়ার কথা প্রভাতে, সেখানে সে আনন্দিত, দিচ্ছে জন্মদিনের দাওয়াত।”
“মামীজান, আল্লাহ নিজ হাতে ঐ ঘুঁটেকুড়ুনিকে বাঁচিয়েছে। আমার লোক তাকে আক্রমণ করতে পারেনি। গুলবাহার খাতুন উপস্থিত ছিল তার কক্ষে।”
“ধুর! এই মেয়েটা বারবার হাতে এসেও হাত হতে পিছলে যাচ্ছে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না মামীজান। আমি শাহাজাদি মেহনূর যখন এ কার্য সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছি। তা সম্পন্ন করেই ছাড়বো।”
“ইনশাআল্লাহ। আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গেই আছে আমার চাঁদের আলো।”
উভয় নারী এবার পুনরায় বারান্দায় যেয়ে আলোচনায় বসেন যামিনী নামক অধ্যায়টিকে মেটানোর।
একজন প্রহরী উচ্চ স্বরে জানায়,
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, উপস্থিত হয়েছেন।”
বেগম নূর বাহারের চোখে-মুখে কঠোরতা ছেয়ে যায়। শক্ত কণ্ঠে প্রবেশ করার অনুমতি দেন।
“আসসালামু আলাইকুম আম্মিজান। মাশাআল্লাহ অদম্য সৌন্দর্যের মালিক আপনি। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”
“হুম। কিছু বলতে এসেছো কন্যা? তাহলে আমার মূল্যবান সময় অযথা ব্যয় না করিয়ে বলে ফেলো।”
“অবশ্যই, আম্মিজান। আমার জন্মদিন উপলক্ষে করা আয়োজনে আপনাকে আসার আবেদন করতে এসেছি। আপনি এসে আমার অনুষ্ঠানকে ধন্য করুন।”
“হুম, ঠিক আছে।”
“আমি উঠছি, মামীজান। আমার নিজ কক্ষে যাওয়া লাগবে।” শাহাজাদি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নেয়।
যামিনী হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রস্তাব রাখে,
“তাহলে চলুন না শাহাজাদি একসাথেই যাওয়া যাক। বিদায় আম্মিজান।”
উভয় রমণী একসঙ্গেই কক্ষ হতে বের হয়। হাঁটার মাঝে কিশোরী শুধায়,
“উপস্থিত হবেন কিন্তু বেগম আমার ছোট্ট আয়োজনে। আমার আয়োজনে আপনার উপস্থিতি আবশ্যম, যতোই হোক আপনার ভ্রাতার একমাত্র স্ত্রী আমি।”
“ভ্রাতা? কী সব উল্টোপাল্টা কথা বলছো! শাহ আমার ভাই না। আমার মায়ের গর্ভে তার বেড়ে উঠা নয়।”
“মায়ের পেটের না হোক মামাতো ভাই তো। কারণ আপনাদের বিয়ে তো আর হচ্ছে না কোনো কালেই। আমি থাকতে কীভাবে সম্ভব তা?”
শাহাজাদি মেহনূর হাঁটা থামিয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি না থাকলে তো সম্ভব, তাই না? নবাব শাহ নেই, তোমার কক্ষের বাহিরের প্রহরীরা নেই। ভীতি জাগছে না তোমার? জাগা উচিত।”
কিশোরীর মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে উঠলো। যুবতী বঁচন কটাক্ষ করে চলে যায় সেখান হতে। যামিনী পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে যেন চরণ দুটোতে শক্তি পাচ্ছে না আর।
___
ভোজনশালায় জমজমাট আয়োজন খাবারের। দাসীরা তো তৃপ্ত। যামিনী নিজ উদ্যোগে দাঁড়িয়ে সবার আহার করা ঠিক-ঠাক হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল রাখছে।
কিশোরীর রন্ধনশিল্পে দক্ষতার পরিচয়ে বেগম লুৎফুন্নেসাও তৃপ্ত। যদিও মুখে কিছু বলছেন না।
“ধন্যবাদ বেগম। অনেক অনেক ধন্যবাদ। বহুদিন পরে এতো ভালো ভালো খাবার পেট ভরে আহার করলাম। আপনিই আমাদের যোগ্য বেগম। আল্লাহ আপনি সুখ, শান্তি ও মর্যাদা দিক।”
প্রতিটি দাসী যাওয়ারর হওয়ার পূর্বে যামিনীর হাতে চুমু খেয়ে প্রসংশা বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। সেও খুব আদরের সহিত তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে কিছু অর্থ।
বেগম লুৎফুন্নেসা আড়চোখে তা খেয়াল করছেন, তার ঠোঁটের কোণে হাসি স্থির। শাহাজাদি নূর বাহার তা খেয়াল করে বেগম নূর বাহারকেও ইশারা করে দেখতে।
সকলে আহার শেষে মহাপরিচারিকা উঠে বেগম লুৎফুন্নেসার কাছে এসে দাঁড়ান। যেন হুট করেই জরুরি কিছু মনে পড়েছে তাঁর।
“বেগম লুৎফুন্নেসা, ক্ষমা করবেন। একটা গুরতর বিষয় আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছি আমি। অন্দরমহলের কিছু দাসীদের মাঝে দ্রোহের শুরু হয়েছে বেতনকে কেন্দ্র করে সহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে। এই বিষয়ে একটু বিচার-আলোচনার প্রয়োজন।”
“কী! এই কথা তুমি আজ জানাচ্ছো আমায়! তোমার থেকে এরূপ দায়িত্বহীনতা আশা করিনি আমি। যাকগে আগামীকালই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।”
“অবশ্যই বেগম।”
যামিনী বেগম লুৎফুন্নেসার কাছাকাছি বসায় সবই শুনতে পায়। সে বোধ করেছে দাদীজান প্রকাশ না করলেও তার উপর কিছুটা তুষ্ট আজ। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করে না সে।
“দাদীজান, আপনি অনুমতি দিলে এই আলোচনায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই। আপনাকে দেখেই তো আমি শিখবো কীভাবে যোগ্য হওয়া যায় ‘বেগম’ পদবী এর, কীভাবে সমস্যার মোকাবেলা করা যায়। তাই আপনি যদি অনুমতি দিন…”
“আচ্ছা, তুমিও এসো চন্দ্রমল্লিকা।”
মনে মনে খুশি হলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। মেয়েটা অযোগ্য হলে নিষ্ঠাবান নিজের কর্মের প্রতি।
এদিকে দু’জন নারীর এই দৃশ্য দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে ক্রোধে। উভয়েই ধৈর্য্য রাখতে না পেরে দ্রুত বিদায় জানিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
___
বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূর গভীর চিন্তায় ডুবে।
“মামীজান, নানীজান যেভাবে ধীরে ধীরে সন্তুষ্ট হচ্ছেন চন্দ্রমল্লিকার প্রতি আমার ভয় লাগছে। কারণ একবার যদি যামিনী তাঁর চোখে যোগ্য প্রমাণিত হয়, তিনি নিজেই হবে যামিনীর ঢাল।”
“সেটা তো আমারও দুঃশ্চিন্তা। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। এতো দিন যা করেছে, ভেবেছো, সব তোমার দ্বারাই। তবে এবার আমি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছি। এমন কিছু ভেবেছি যাতে ঐ মেয়ে নিজেই নিজের কাল ডেকে আনবে, আম্মিজান নিজ হস্তে ঐ মেয়েকে মেটাতে উদ্ধত হবেন।”
চলবে..