#চন্দ্রপুকুর,২৮তম পর্ব
– ঈপ্সিতা শিকদার
গোলাপজলে স্নান নিয়েছে যামিনী। মিষ্টি ঘ্রাণে দেহের সকল ক্লান্তি যেন নেমে গিয়েছে। গা মালিশ করে দিচ্ছে দু’জন দাসী।
দর্পনে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে কিশোরী। মালিশ করার সুবিধার্থে পরা উত্তরীয়তে তার দেহের বেশ কিছু অনাবৃত। যাতে চিহ্ন মেলে মেহমাদ শাহের ভালোবাসার।
সে খেয়াল করে দু’জন দাসী সেসব একে অপরকে ইশারা করে হাসছে। তবে দিলরুবা কেমন যেন নিঃশ্চুপ।
“দিলরুবা কোনো সমস্যা? এমন নীরব কেন তুমি?”
“বেগম আমি…”
যামিনী বুঝতে পারে তার খাঁস ভৃত্যের সংকোচ। তাই বাকি দুই দাসীর উদ্দেশ্যে আদেশ করে,
“তোমরা আমার জন্য তুলসি চা করে নিয়ে আসো। আর বৈদ্যশালা হতে পুদিনার তৈলও। মাথা ব্যথা করছে ভীষণ।”
“যথা আজ্ঞা বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”
তারা আদেশ পালনে গমন করে। রমণী এবার জিজ্ঞেসু চাহনিতে তাকায় দিলরুবার দিকে।
“আসলে বেগম আমি… আমি গতকালের আপনার সিদ্ধান্তের বিষয়টা ভাবছিলাম। আপনাকে এতোটা বাজেভাবে অত্যাচার করার পর কি এতো টুকুতেই ক্ষমা করে দেওয়া উচিত ছিল? আরও ভয়ংকর শাস্তি দিতে পারতেন কিংবা ক্ষমার বিনিময়ে অন্দরমহলের শাসন ভারও তো চাইতে পারতেন।”
যামিনী মৃদু হাসলো। শিমুল তুলোর নরম পালঙ্ক হতে উঠে দাঁড়ায়।
“আমার বস্ত্র বের করো, হালকা গোলাপি বর্ণের সিল্ক কাপড়েরটা। আমি তৈরি হব। আজ বাগানে ভোজন করব বাবু মশাইয়ের সাথে। বাগানে চলো।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
দিলরুবার সহায়তায় তৈরি হয় কিশোরী। তৈরি হয়ে মুকুটটা পরে নেয় সে। এই তাজ তার মর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতীক স্বরূপ।
বাগানে হাঁটছে যামিনী ও দিলরুবা। ফাঁকে ফাঁকে খেয়াল করছে ভোজন করার ব্যবস্থা ঠিক-ঠাক হচ্ছে কি না…
“কী বলছিলে তুমি দিলরুবা? আমি এ সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যানো এটাই তোমার প্রশ্ন, তাই তো?”
“জী, বেগম।”
“শোনো আমি তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দিলে কোনো লাভ হতো না। তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছে আমি বাবু মশাইয়ের ভালোবাসা হলে, আম্মিজান তাঁর মাতা। ঝোঁকের বশে বা ভীতি তৈরি করতে তখন দাদীজানের কামরায় ঐ রকম বাণী উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। তবে এতো বড়ো শাস্তি দিতেন না, ঠিকই ক্ষমা করে দিতেন।
আবার আমি যদি এমন রূপ শাস্তি বলতাম তবে আমার উপর হতাশ বা অসন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকতে পারতো। সবচেয়ে বড়ো বিষয় বেগমদের বড়ো শাস্তি দেওয়া এতো সহজ নয়। খুব অধিক হলে পুরনো মহলে পাঠানো হতো, তাও পরে কোনো এক ব্যবস্থা করে ফিরে আসতেন তাঁরা।”
“তা ঠিক বলেছেন বেগম চন্দ্রমল্লিকা। তবে বেগম লুৎফুন্নেসার নিকট ক্ষমার বিপরীতে রাজত্ব চাইলেন না ক্যানো?”
“জমিদারের পুত্র হলেই জমিদারি পাওয়া যায়, তবে জমিদারের স্ত্রী হলে রাজত্ব পেতে লড়তে হয়। দাদীজান আমার কথা মান্য করে হয়তো অক্ষম স্বীকার করে শাসনভার আমার হাতে তুলে দিতে চাইতেন। তাহলে তাঁর প্রতিই সহানুভূতি তৈরি হতো, লোকচক্ষু ভাবতো মানুষটা প্রকৃতপক্ষেই অনুতপ্ত এবং প্রায়শ্চিত্ত করতে তৎপর। আমি নামক দুই দিন ধরে আসা বেগমকে এতো বড়ো দায়িত্ব কখনো দেওয়া হতো না।
তবে আমি তাঁকে ক্ষমা করে প্রশ্ন করে যে বেগম হয়ে আমি তাঁর নিকট না ন্যায় পেলে সাধারণ জনতা কি পাবে, তাঁর বিচারকার্যে সূক্ষ্ম সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছি সকলের মস্তিষ্কে। সেই সাথে আমার চিত্র উজ্জ্বল হয়েছে লোকচক্ষুর সম্মুখে। আমাকে সবাই দয়াশীল, বিচক্ষণ ভাবছে। প্রজার সঙ্গ খুব প্রয়োজন ক্ষমতা পেতে এবং ধরে রাখতে।
তাছাড়া আরেকটি বিষয়ও আছে…।”
“তা কী বেগম?”
“বলো তো, এই অন্দরমহলের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষগুলো কে কে বাবু মশাইয়ের পরে?”
দিলরুবা খাণিকটা ভেবে উত্তর দেয়,
“বেগম লুৎফুন্নেসা, তারপর নূর বাহার, আপনি এবং শাহাজাদি মেহনূর।”
“হুম, এখন এরা তিনজন নত হয়েছে আমার সম্মুখে, তাও আবার ভরা মাহফিলে। সবাই এবার টের পেয়েছে আমার ক্ষমতার ঝাঁঝ। এই মহলের অনেকে যেমন আমায় অপছন্দ করে, তেমন অনেকে তাঁদেরও করে। ভীতিতে আমাকে পূর্ণরূপে সমর্থন দিতে পারছিল না।
এবার সেই সাহস পাবে, কারণ তারা জ্ঞাত আমি তাদের রক্ষা করতে সক্ষম। যে দাদীজানের মতোন ক্ষমতাধারী নারীকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে পারে, সে নিশ্চয়ই বহু কিছু করতেই সক্ষম। দ্বিতীয়ত, আমি তাঁদের দম্ভ তাঁদের হস্ত দ্বারাই আয়নার ন্যায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছি। আমার হৃদয় শীতল করেছি।”
“বেগম, আপনার কথামতো সব কাজ হয়ে গিয়েছে। আপনি একদফা পরিদর্শন করে নিন, আর কিছু লাগবে কি না।”
___
আহার করা শেষে মেহমাদ শাহকে বিদায় জানিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করে যামিনী। আঙিনায় দেখতে পায় শাহাজাদি মেহনূর এক কন্যার গালে চড় দিয়ে চলে যাচ্ছে। যদিও কী বলল বুঝতে পারেনি। তবে কন্যাটির মাথা পিলারে লেগে রক্তারক্তি অবস্থা।
“সাবধান! বেগম চন্দ্রমল্লিকা প্রবেশ করছেন!”
“মালিহা খাতুন, এখানে এতো ভীড় ক্যানো? কী হয়েছে? আর এই ক্রন্দনরত কন্যা কে? আগে তো কখনও দেখিনি অন্দরমহলে।”
“বেগম, এই মেয়ে নতুন দাসী। ভুল বশত শাহাজাদি মেহনূরের সাথে ধাক্কা লেগেছিল তাই তিনি রেগে…”
“থাক, বুঝতে পেরেছি। নাম কী তোমার?”
মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায় যামিনী। শ্যাম বর্ণের যুবতী কন্যা, খুব বেশি হলে বছর তিনেকের বড় হবে তার হতে।
“মোহিনী।”
বেশ উচ্চস্বরেই শুধায়,
“আহারে খুব লেগেছে বুঝি? এরা যে এতো অমানবিক! দাদীজানও নাতনির মোহে অন্ধ হয়েছেন, তা-ই তো অন্যায়েও চুপ থাকছেন। তবে আমার হেফাজতে থাকলে আমি তোমায় রক্ষা নিশ্চয়ই করতাম। মালিহা খাতুন, এই কন্যাকে বৈদ্যশালায় পাঠান।”
দিলরুবা সমেত কিশোরী নিজ কক্ষে চলে আসে। তার মাথায় চলছে অন্য এক পরিকল্পনা।
“দিলরুবা, মহলে হয়তো নতুন দাসীরা এসে পড়েছে বা খুব শিঘ্রই এসে পড়বে। আমিই সবার আগে সেখান হতে চয়ন করতে চাই। আর মোহিনী নামক কন্যাটিকে আমার সেবায় চাই। অবশ্য আমি চাই মেয়েটা নিজেই আমার নিকট আসুক।”
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। কিন্তু আপনি ইচ্ছে করলে তো অভিজ্ঞ বাঁদীই নিতে পারেন।”
“তারা যে দাদীজানের বা আম্মিজানের বা শাহাজাদির পক্ষের লোক হবে না কি নিশ্চয়তা আছে? শোনো এই মহলে সবার মাঝে নিজের প্রতি একটা সমর্থন তৈরি করার দরকার ছিল। সেই পথে ইতিমধ্যে চলছি আমি।
এখন দরকার নিজের বিশেষ, অনুগত ও বিশ্বাসযোগ্য লোক তৈরি করা। যারা মহলের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকবে, আমায় তথ্য দিবে। আর দাদীজানের রাজত্বকালের ইতি ঘটবে দ্রুতোই।”
“তা কীভাবে বেগম?”
“তাঁর শাসনকার্যের প্রতি জনসাধারণের সন্দেহ তো তৈরি করেই ফেলেছি। এখন শুধু তাঁর আরেক বার বিরাটকার ত্রুটি করতে বাকি।”
“তাতেও কি লাভ হবে বেগম? তাঁর পর তো উত্তরাধিকার স্বরূপ থাকছেন বেগম নূর বাহার।”
“একজন অপরাধীর হাতে নিশ্চয়ই কেউ শাসনভার দিবেন না। সেসব করতে এখনও বেশ খাণিক পথ বাকি। তবে সবকিছুর পূর্বে শাহাজাদি মেহনূরকে বিদায় করার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি এখন যেয়ে আসা নতুন বাঁদীদের আমার কক্ষে নিয়ে আসো।”
___
বেগম লুৎফুন্নেসা খুব বেশিই অসুস্থ বোধ করছেন। সবার আড়ালে বৈদ্যশালা হতে ঔষধ আনিয়ে সেবন করছেন। এতো বছর ধরে এই জমিদারি সামলাচ্ছেন তিনি। বিন্দ পরিমাণ মলিনতাও কখনও দেহে লাগেনি তাঁর, অথচ এতো বড়ো কালিমা লেপণ হলো এখন।
আয়েশা খাতুন কামরায় প্রবেশ করেন। তাঁর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা।
“আসসালামু আলাইকুম বেগম। এখন কেমন বোধ করছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে আয়েশা। নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছো। ভয় কোরো না বলে ফেলে, আমি ঠিকই গলাধঃকরণ করে নিব।”
নরম, নিস্তেজ কণ্ঠ তাঁর। আয়েশা খাতুনের প্রচণ্ড মায়া হয় নিজের মনিবের জন্য। কে বলবে এই নারীটিই দু’দিন আগ অবধিও নিজের তেজস্বিনী রূপে গোটা অন্দরমহল কাঁপিয়ে রাখতো?
“বেগম… আসলে আরমান বাবু পত্র পাঠিয়েছেন।”
“আরমান?” বিড়বিড়ায় বেগম লুৎফুন্নেসা। এতো বছর পর এই নাম আবার তাঁর কর্ণগোচর হতেই অশ্রুর বর্ষণ হয় নয়নযুগল হতে। এই ভালোবাসাকে তো কতো বছর পূর্বেই নিজের হৃদয়ে সমাধিস্থ করেছেন তিনি।
চিঠিটি নিয়ে পড়তে শুরু করেন। স্তব্ধ, মূর্তিমান তিনি। তাঁর গোটা দেহ হিম শীতল হয়ে গিয়েছে ভীতিতে।”
চলবে…