#চন্দ্রপুকুর,৩৩তম পর্ব,৩৪
– ঈপ্সিতা শিকদার
যুবক ভাবে সত্যিই তো এ কথা ভোরে শেষদিকে বলেছিল সে। তবে কথাটি শতভাগ মিথ্যে তাও নয়। একপ্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিবাহ হয়েছিল তাদের।
তার ভাবনার মাঝে আরও শব্দ করে কেঁদে উঠে যামিনী। মেহমাদ শাহ বিচলিত হয়ে সেদিকে তাকায়। তার বাচ্চা হরিণী নয়নযুগল রক্তিম, যেন টোকা দিলেই রক্ত ঝরবে। শুভ্র রঙা হলে নির্ঘাত এতোক্ষণে গাল, নাক, কানও লালচে হয়ে পড়তো।
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, তাই তো? আমি আপনার পথের কাঁটা। তবে আল্লাহর নিকট দোয়া করি আমার মৃত্যুতে আপনি আপনার ভালোবাসা পান।”
ক্রুব্ধ হয় যুবক। গণ্ডদেশ শক্ত হাতের ছোঁয়া পড়ে যায় দ্রুতোই।
শীতল কিন্তু হুমকির সুরে শুধায়,
“সাহসটা আজকাল অধিক হয়েছে তোমার যামিনী। স্পর্ধা কী করে হয় আমার উপস্থিতিতে এরূপ বাণী মুখ হতে বের করার?”
কষ্ট হয় রমণীর। তবুও চোখজোড়া স্থির রাখে মানুষটির দিকে।
“সত্যি বৈকী মিথ্যে তো বলিনি। আপনি তো নিজ মুখে স্বীকারোক্তি দিয়ে সত্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।”
এই নারীর অভিমানী, ছলছল চাহনির সামনে কোনো এক নিয়মবিরুদ্ধ কারণে ক্রোধ ধরে রাখতে পারে না মেহমাদ শাহ। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
বস্তুত, সে রাগের মাথায় কথাটি বলে ফেলেছিল। ক্লান্ত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে যামিনী ফ্যাচফ্যাচ করে বৃথা কান্না শুনে বিরক্ত ও রাগ হওয়া ব্যতীত কোনো প্রতিক্রিয়াই সেই মুহূর্তে আসেনি।
ললাটে আদুরে স্পর্শ পায় যামিনী। খেয়াল করে পুরুষটি একেবারে শান্ত এখন।
“শোনো যামিনী যতো যাই হোক বাস্তবতা তো এটাই তোমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি। বাধ্য হয়েও বলা ঠিক হবে না। জেদ ও নিজের দম্ভ বজায়ে করেছিলাম। তবে হ্যাঁ, বিবাহের পর আমি তোমাকে পূর্ণরূপে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। দেহ, মন ও মস্তিষ্ক সবকিছুর ক্ষেত্রেই।
মেহনূরকে আমি ভালোবাসি না। বরং, তাকে আমি ফুপাতো বোন বৈকী অন্য কোনো চরিত্রে কল্পনা করিনি। এ কথাটা ছিল বিরক্তির প্রকাশ মাত্র। বাকি রইলো তাকে চন্দ্রপ্রভা ডাকার কারণ। মেহনূর অর্থ চাঁদনি বা চন্দ্রপ্রভা। ছোটোবেলায় ও জন্মের পর বোন হিসেবে এ নাম দিয়েছিলাম, এতোটুকুই।
নিজের মাথায় এ কথাগুলো পরিস্কার ভাবে এঁটে নেও। আমি বারবার তোমায় সংশোধন করব সে কল্পনা কোরো না। আর হ্যাঁ, তোমার এই আচারণে প্রচুর পরিমাণ ক্ষুব্ধ আমি। সম্পর্কে বিশ্বাস না থাকলে সম্পর্ক টিকে না।”
মেহমাদ যামিনীকে রেখে গায়ে পোশাকটা কোনোরকম পরে বেড়িয়ে যায়। রমণী এবার প্রশান্ত নিজের ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। তবুও যুবকের বলা কথায় থাকা চাপা ক্রোধের অনল তাকে ভীতিগ্রস্তও করছে।
___
যামিনী শিক্ষিকার হতে পড়ার পাঠ চুকিয়ে ফিরে আবার বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছে। তাকে অবাক করে বেগম লুৎফুন্নেসা তার সাথে যথেষ্ট পরিমাণ ভালো আচারণ করেছেন।
অবশেষে দুপুরের ভোজন শেষে কক্ষে ফিরে সে। ফিরে যার কথা তার পূর্বে মনে হয় সে হলো চাঁদনি। তার অতিপ্রিয় পোষা চন্দনা টিয়া পক্ষীটি।
“চাঁদনি! চাঁদনি! কোথায় তুমি?”
নিস্তব্ধ পরিবেশ। কোনো সাড়া নেই চাঁদনির। অথচ, যামিনী বা মেহমাদ শাহের কণ্ঠ শুনলেই সে উচ্চস্বরে ডাকে।
তবুও কিশোরী ধ্যান দেয় না তাতে। আনন্দিত মনে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে। কিন্তু এ কী মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পায় সে! খাঁচা তো বিদ্যমান, তবে পাখি দু’টো অদৃশ্য।
“দিলরুবা! দিলরুবা! আমার চাঁদনি কোথায়? কে নিয়ে গিয়েছে তাকে?”
তার অশান্ত ও উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে দিলরুবা ও মোহিনী তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় সেদিকে। সেও অবাক।
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। কিন্তু আমরা তো চাঁদনিকে দেখিনি। আপনার সাথেই তো ছিলাম আমরা।”
যামিনী ক্রুব্ধ হয় নিজের কক্ষ হতে বের হয়। চেঁচাতে শুরু করে সে।
“আমার চাঁদনিকে কে নিয়েছো? ফিরিয়ে দাও, বলছি। আমার নজরে পড়লে আল্লাহর শপথ জান নিয়ে নিব।”
সকল দাস-দাসী মাথা নত করে রাখে। তার একজন বাঁদী ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,
“বেগম আমাদের মাঝে তো কেউ নেয়নি। আর আমরা দেখিনিও ঐ পক্ষীকে।”
“তাহলে বসে বসে কী কাজ করছিলে তোমরা! ধ্যান কোথায় থাকে তোমাদের? আর প্রহরীরা কোথায়?”
ছুটে আসে তার দোয়ারের প্রহরীরা।
“ক্ষমা করুন বেগম। ক্ষমা করুন। আমরা দুপুরের আহার করতে গিয়েছিলাম।”
“আজকে আমার পোষা প্রাণীকে অপহরণ করা হয়েছে, তোমরা কেউ সাড়া অবধি পেলে না। কাল আমাকে অপহরণ করলেও তো তোমরা হাতে হাত রেখে বসে থাকবে।”
সবার আড়ালে কেউ হাসে তৃপ্তির হাসি। বিড়বিড়ায়,
“তোমার ঐ প্রিয় পক্ষীটিকেও যেমন নিজের অধীনস্থ করেছি, তেমন তোমার সবকিছুই আমার হবে।”
চেঁচামেচি শুনে বেড়িয়ে আসেন নবাব পরিবার। মেহমাদ শাহও কাছে আসে।
“কী হচ্ছে এখানে?”
যুবকের কণ্ঠ শুনে অনুভূতি পূর্ণরূপে বাঁধনহারা হয়ে পড়ে রমণী। ছুটে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অভিযোগ করে,
“দেখেন না বাবু মশাই, আমার চাঁদনিকে কে যেন অপহরণ করেছে। আমি পাচ্ছি না তাকে কোথাও। ওকে এনে দেন না।”
যামিনীর পিঠে হাত রাখে সে। দিলরুবাকে আদেশ করে,
“চন্দ্রমল্লিকাকে কক্ষে নিয়ে যাও।”
আদেশ মোতাবেক কর্ম করে দিলরুবা। মোহিনীও পিছন পিছন যায় তার।
মেহমাদ শাহ এবার মিনারকে ডাকায়।
“চাঁদনিকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করো। আর কে এই অপকর্ম করেছে তার নাম আমার চাই।”
“যথা আজ্ঞা, জমিদার বাবু।”
এদিকে যামিনী নিজের কক্ষে মন খারাপ করে বসে কামরায় বসে আছে। পোষা পক্ষীটির সাথে তার সখ্যতা গড়েছিল, গড়েছিল মায়ার এক অনড় বন্ধন। ব্যথিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলতে চাই।”
ভ্রু কুঁচকে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে। ইশারায় অনুমতি দেয়।
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তবে আমার মনে হয় এ কাজ শাহাজাদি মেহনূর ছাড়া অন্য কারো করার নয়।”
“এ কী করে সম্ভব? তিনি তো নজরবন্দী আছেন।”
“বেগম, আপনার যেমন এ অন্দরমহলে খাস বাঁদী আছে, নিজস্ব লোক আছে। তেমন তাঁরও আছে হয়তো আপনার হতেও অধিক।”
কিশোরী কিছু একটা ভাবে। অতঃপর তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠে ভয়ংকর এক হাসি, যা আগে কখনও দেখা যায়নি তার মাঝে। তবে কি ভয়ংকর কিছুই অপেক্ষা করছে শাহাজাদি মেহনূরের উদ্দেশ্যে?
___
মেহমাদ শাহ বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে বসে আছে। উদ্দেশ্য তার দাদার মরহুম নবাবের উদ্দেশ্যে মিলাদ ও দান করার কথাবার্তা বলা।
যদিও এতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। নিজের দাদীজানের আদেশ পালনে উপস্থিত হয়েছে শুধু।
“ভাবছিলাম পনেরোটা গরু কুরবানি দিব গোটা শেরপুর বাসীকে আহার করাতে। আর পাঁচটা ছাগল মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করে দিব। এগুলো তো যথেষ্ট হবে, তাই না আমার সিংহ?”
“হ্যাঁ, দাদীজান।”
“আর গরীব-মিসকিনদের মাঝে কতো পরিমাণ অর্থ বিলিয়ে দেওয়া যায় না কি কাপড়-চোপড় বা অন্ন দিব? এ নিয়ে বড়োই বিড়ম্বনায় ভুগছি।”
“জী, বেগম।”
বিরক্ত হন বেগম লুৎফুন্নেসা। ধমক দিয়ে বলে উঠেন,
“এমন হ্যাঁ, জী করছো ক্যানো মেহমাদ? তোমাকে আলোচনা ও নিজের মতামত দিতে ডাকানো হয়েছে, আমার সাথে সায় দিতে নয়।”
এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না মেহমাদ শাহ, উঠে দাঁড়ায় নরম গদি হতে। চোখজোড়া হতে উপচে বিরক্তি, তিক্ততা, ক্রোধ।
“আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই দাদীজান, এমন একজন নির্দয় মানুষের কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার। যা ইচ্ছে করুন আপনি।”
“মেহমাদ! তোমার দাদাজান হন তিনি! এরূপ তাঁর উদ্দেশ্য অসম্মানজনক বাণী উচ্চারণ কীভাবে করো তুমি? আজও গ্রামবাসীর মুখে মুখে আমাদের বংশ ও তোমাদের দাদাজানের প্রশংসাবাণী থাকে।”
“এই নবাব বাড়ির বাস্তবতা জানলে এই গ্রামবাসী থুঁথু ছিটাতে আসবে। আর তিনি হয়তো শাসক হিসেবে খুব মন্দ কেউ ছিলেন না তার লোকদের নিকট। তবে তার বাস্তবতা আমার দেখেছি। কতোটা নির্দয় ছিল আমি নিজ চোখে দেখেছি।
যে নিজের পুত্রকে খুন করে তা মাটি চাপা দিতে পারে তার চাইতে জঘন্য ব্যক্তি আর হয় না। আর কোনো না কোনো ভাবে না বুঝে আমিও এই অপরাধে অংশীদার হয়েছি।”
অপেক্ষা করে না যুবক। দ্রুতো পদচারণায় বেড়িয়ে যায়। তার অপছন্দের যদি তালিকা করা হয়, তবে প্রথম নামটি তার দাদাজানেরই হবে।
বেগম লুৎফুন্নেসা স্তব্ধ হয়ে আছেন। তাঁর আঁখিজল ভিজিয়ে দেয় গণ্ডদেশ। যে সত্য সে ভুলে থাকতে চায় তা আবার ক্যানো মনে করিয়ে দিলো মেহমাদ?
পুত্রের কথা মনে করে গা কাঁপিয়ে কেঁদে উঠেন। শেষবারের জন্য ছেলেকে ছুঁয়েও দেখতে পারেননি। স্বামী নামক মানুষটি সেই সময় টুকুই দেননি। এতোটাই অভাগী তিনি যে স্বীয় পুত্রের কবর কোথায় তাও জানা নেই। শুধু জানে জঙ্গলের কোনো এক প্রান্তে মাটির তলে নিদ্রারত তাঁর মানিক রতন।
“লুকমান! আমার লুকমান! আমার রত্ন!”
তাঁর ক্রন্দন গ্রাস করে নীরবতাকে। এ আর্তনাদ শুধু চার দেওয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ। তবে কী এমন পাপ করেছিলেন লুকমান, যার জন্য এতো বড়ো শাস্তি পেতে হলো তাঁকে?
চলবে…
#চন্দ্রপুকুর
||৩৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আধো আলো আসছে। অন্ধকারচ্ছন্ন কামরা। ঠিক কামরা নয়, চিলেকোঠা মনে হচ্ছে। কাল রাত হতে আহার করেনি রত্না।
দেহ ঝিমঝিম করছে তার। প্রায় দুইদিন পেড়িয়ে গিয়েছে এই বন্দীদশায়। পেটে এক বিন্দু অন্ন তো দূরে থাকুক জলও পড়েনি।
“হে আল্লাহ! কী অপরাধে আমায় এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করালে আমি জানি না। তবে আমি আর সইতে পারছি না। আমাকে ক্ষম করো, মুক্তি দাও।”
আল্লাহ তায়ালা হয়তো তার দোয়া শ্রবণ করলেন। কারণ এক মুহূর্তে পেড়িয়ে যেতে না যেতেই বন্ধ দোয়ার খুলে যায়। এক ঝাঁক আলোর প্রবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে যুবতী।
পিটপিট করে চোখ খুলে রত্না। সামনে বাঁকা হাসি সমেত দাঁড়িয়ে আছে যামিনী, মোহিনী ও দিলরুবা।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা?”
“হুম, আমি। অন্যকাউকে অবশ্যই আশা করা উচিত হয়নি।”
“আমাকে মুক্তি দিন বেগম। কোন ত্রুটির জন্য আমাকে এমন ভাবে আটক করেছেন?”
“জানো না তুমি? তোমার ভুল তো গণনা করে সমাপ্ত করা যাবে না। সবচেয়ে বড়ো ভুল তো করেছিলে আমায় হত্যা করার পরিকল্পনায় নিজের মনিবের সাথে হাত মিলিয়ে। আমার চাঁদনি, কোথায় সে?”
হচকচিয়ে গেল যেন যুবতী দাসী। ঘাবড়েও গেল বটে।
“ক্ষমা করবেন বেগম। আমি এ বিষয়ে কিচ্ছু জানি না। সত্যিই জানি না।”
“নিজের মনিবকে বাঁচানোর জন্য এসব বলছো? হাস্যকর! তোমার মনিবের বাস্তবতা তো দেখে নেও।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকায় নারী। যামীণী মোহিনীকে ইশারা করে রত্নার হাতের বাঁধন খুলতে। দিলরুবার হতে চিঠিটি হাতে নিয়ে রত্নার হাতে ধরায় সে।
“তোমার মনিবকে বেনামী চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে বন্দী করা হয়েছিল জানিয়ে। মূলত তোমার বিপরীত আমার চাঁদনিকে ফেরত চেয়েছিলাম।
তিনি পরিস্কার ভাবে চিঠিতে জানিয়েছেন, তুমি তাঁর নিকট নিছকই মূল্যহীক এক গোলাম। তুমি বাঁচো আর মরো তাঁর কিছুই যায় আসে না। অদ্ভুৎ না ব্যাপার খানা!”
যামিনী একের পর এক শব্দের তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে। তাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রত্না। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারলো না কৈশোর বয়স হতে সেবা করছে যার, তিনি এমন মনোভাব পোষণ করতে পারেন তাঁর বিষয়ে। বারবার চিঠিটা দেখছে, যদি একখান প্রমাণ পায় এই চিঠির মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার।
তা হয়তো কিছুটা অনুধাবণ করতে পারে যামিনী।
“সন্দেহ হলো শাহাজাদির সিলমোহর খানা দেখে নিয়ো। নিজের মালিকের সিলমোহর তো চিনতে তোমার ভুল হওয়ার কথা না। এখন বলো এমন কাউকে বাঁচাতে নিজে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে চাও না কি নিজের প্রাণ রক্ষা করতে চাও?”
অনেকটা সময় নৈশব্দে বসে থাকে সামনের নারীটির। সে পরিকল্পনা করছে না কি বিচার-বিশ্লেষণ না কি নিজেকে সামলাচ্ছে বোধগম্য হয় না কিশোরীর।
“আমি আমার প্রাণ বাঁচাতে চাই বেগম। আমাকে মুক্তি দিন। বিপরীতে যা বলবেন তা-ই করব।”
আকস্মাৎ পা জড়িয়ে ধরে মিনতি করে রত্না। যামিনী বিজয়ীর হাসি দেয়।
___
মেহমাদ শাহ নিজের কামরায় বসে কাগজপত্রে ডুবেছিল। বহুদিন ধরে ধান বিক্রির হিসেবটা ধরা হয় না, আজ ধরে দেখলে কেমন যেন গড়মিল মনে হচ্ছে তার।
তার ব্যস্ততার মাঝে কামরার দোয়ার খুলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ছুটে আসে যামিনী। আঁকড়ে ধরে তার বক্ষে অশ্রু বিসর্জন দিতে শুরু করে।
“কী হয়েছে আমার চাঁদের মল্লিকার? আমার সোনালি হরিণ এভাবে কাঁদছো ক্যানো?”
“বাবু মশাই আমার চাঁদনি… আমার চাঁদনি…” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে যামিনী।
আদুরে ভঙ্গিতে পিঠে হাত বুলায় যুবক। যেন একটু শক্ত স্পর্শ পেলেই আঘাত পাবে তার প্রেয়সী।
“আমি মিনারকে আদেশ করেছি তো আমার চন্দ্রমল্লিকা। খুব শিঘ্রই তাকে ফিরে পাবে তুমি।”
“চাঁদনি আর নেই বাবু মশাই। কী করে আমি ফিরে পাব তাকে? মানুষ এতোটা নির্দয় কী করে হতে পারে! প্রতিশোধের নেশায় একটা মাসুম জীবকে…!”
আবারও ক্রন্দনধ্বনি শোনা যায়। মেহমাদ শাহ স্তম্ভিত।
“মানে? কী বলতে চাচ্ছো তুমি? কী হয়েছে সোজাসুজি বলো চন্দ্রমল্লিকা।”
“বাবু মশাই আমি দিলরুবা আর মোহিনীর সাথে মহল ঘুরে দেখতে বের হয়েছিলাম। মহলের পিছন ভাগে জঙ্গলের দিকটায় যেয়ে দেখতে পাই চাঁদনিকে ছুড়ি দিয়ে হত্যা করছে কেউ।”
আরও জোরে শব্দ করে ক্রন্দনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় রমণী। যুবক উত্তেজিত।
“কার এতো দুঃসাহস জানাও আমাকে! কাকে দেখেছো তুমি? আর সে এখন কোথায়?”
যামিনী কান্না মৃদু হয়। কোনোরকম দরজার দিকে ঘুরে সে। সেখানে দাঁড়ানো দিলরুবা তার ইশারা পেলেই মোহিনীর সাথে রত্নাকে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করে।
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার বাবু। শাহাজাদি মেহনূরের খাঁস দাসীকেই আমরা পেয়েছিলাম জঙ্গলের দিকে, অনেক কষ্টে পেয়েছি।”
রত্না চরণ জড়িয়ে ধরে জমিদারের। ক্ষমার আকুতি করতে শুরু করে,
“আমার কোনো দোষ নেই, জমিদার বাবু। আমাকে শাহাজাদি বাধ্য করেছিল এ কাজ করতে। ক্ষমা করুন আমায়। ক্ষমা ভিক্ষে দিন।”
মেহমাদ শাহের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। চিৎকার করে উঠে,
“মিনার! মিনার! এই মেয়ে সহ মেহনূরকে এখনই মহল হতে বহিষ্কার করো। আর এই মুহূর্ত মেহনূরকে পাঠিয়ে দাও তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।”
হনহন করে চলে যায় যুবক। হয়তো বেগম লুৎফুন্নেসার কামরাই তার গন্তব্য।
তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয় যামিনী। এই অবধি যতোটুকু হৃদয় পুড়ছিল নিজের অপকর্মের উদ্দেশ্যে।
এখন ততোটাই শান্তি বোধ করছে। জয় আর ক্ষমতা পাওয়ার মাঝে যে তৃপ্তি ও শান্তি তা এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার পর বোধগম্য হচ্ছে তার।
অতীত,
যামিনীর কথায় রাজি হওয়ার পর রত্নাকে দাঁড় করায়। প্রশ্ন করে,
“আমার চাঁদনিকে কোথায় রাখা হয়েছে? আমাকে তার নিকট নিয়ে যাও।”
“টিয়া পাখিটি মহলের পিছনের দিকে রাখা হয়েছে এক ভৃত্যের অধীনে।”
“ঠিক আছে, তুমি তাদের থেকে পক্ষীটি নিয়ে আসবে। মোটেও ধূর্ততা দেখিয়ে কিছু জানতে দিবে না তাদের। আমার লোকের দৃষ্টি তোমার উপর থাকবে, মনে রেখো।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
দিলরুবা ও মোহিনী সহ কয়েকজন প্রহরী রত্নার চোখে কাপড় বেঁধে তাকে নিয়ে বের হয়। যামিনী সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। একটু বাদেই চাঁদনি সহ সেই অন্ধকার কামরায় প্রবেশ করে রত্না, মোহিনী ও দিলরুবা।
“আমার চাঁদনি, কেমন আছো তুমি?” আদুরে গলায় রমণী দু’হাতে আগলে নেয় টিয়া পাখিটিকে। তারপর রত্নার দিকে দৃষ্টিপাত করে।
“তুমি যেয়ে জমিদার বাবুকে সব স্বীকার করবে। আর ভুলেও দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে যেন আমার নাম না বের হয়।”
মোহিনী বলে উঠে,
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তবে জমিদার বাবুকে বলে খুব বেশি কিছুই হবে না। বেগম লুৎফুন্নেসার সাথে আলোচনা করে আগের মতোই অপেক্ষা করবেন শাহাজাদির ভ্রাতার আগমনের। তবে শাহাজাদি মেহনূরকে এভাবে এখানে রাখা ভীষণ বিপদজনক।
তাকে দ্রুতো বের করতে হবে। যে আপনার কক্ষে ঢুকে চাঁদনিকে চুরি করতে পারে, সে বড়ো কোনো ধরনের ক্ষতিসাধনও করতে পারে। ছিনিয়ে নিতে পারে আপনার হতে আরও অনেক কিছু। এমন কী জমিদার বাবুকেও!”
যামিনী ভাবে, খুব করে ভাবে। অতঃপর ঐ কামরা হতে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে যায়। কোমরে গুঁজে রাখা ছোটো ছুড়িটা দিয়ে এক আঘাতে হত্যা করে চাঁদনিকে। রক্তে ছিটকে পড়ে মাটিতে, সাথে পড়ে যায় চাঁদনিও হাত ফসকে। মাটিতে বসে ঝরঝরিয়ে কেঁদেও দেয় সে। কী পাপ না করতে হচ্ছে তাকে জীবনের এ পর্যায়ে এসে!
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। রত্নার বাহু ধরে কঠোরভাবে আদেশ করে,
“বাবু মশাইকে বলবে তুমি হত্যা করেছো চাঁদনিকে শাহাজাদির আদেশে, মনে থাকে যেন। আর চিন্তা কোরো না এর বিপরীতে মোটা অংকের অর্থও পেয়ে যাবে।”
“জী, বেগম। শুধু আমার জীবন খানা ভিক্ষে দিয়েন। বাড়িতে আমার এতিম এক পুত্রও আছে।”
___
শাহাজাদি মেহনূর শেষবার নবাববাড়িকে দেখে নিচ্ছে গাড়িতে উঠার পূর্বে। কী এক নির্মম পড়িহাস ভাগ্যের! যখন সে এসেছিল তখন তাকে স্বাগাতম জানাতে এগিয়ে এসেছিল গোটা নবাবপরিবার। অথচ, আজ কেউ নেই।
অনেকটা অপরাধীর বেশেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে। সে পাপের শাস্তিও পাচ্ছে যে পাপ সে করেনি কখনও। যুবতী অজ্ঞাত নয় যামিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে।
তবুও তার হস্তে কিছু নেই। নানীজানও তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই নৈশব্দে সহ্য করে নিল এই পাপের কালিমা লেপণ। মনে প্রতিশোধের আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলছে তার।
চোখের জল মুছে গাড়িতে উঠে বসে শাহাজাদি। শক্ত মুখে বিড়বিড়ায়,
“আমি চলে যাচ্ছি যামিনী। তবে ফিরে আসবো প্রলয় হয়ে। ধ্বংস হবে তোমার জীবনের সুখের পাতার অস্তিত্ব আমার হাত আঁকড়ে ধরে।”
চলবে…