#চন্দ্রপুকুর,৮ম পর্ব,০৯
-ঈপ্সিতা শিকদার
তীব্র ভীতি নিয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষের দোয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে যামিনী। প্রহরী তাকে দেখে খবর দিতে কামরার অভ্যন্তরে গমন করে।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনাকে বেগম লুৎফুন্নেসা ভিতরে প্রবেশ করতে বলেছেন।”
দোয়ার খুলে দেওয়া হয়। দুরুদুরু কম্পিত হৃদয় নিয়ে কক্ষের গহীনে প্রবেশ করে যামিনী।
কক্ষের থেকে একটি কাঠের দেয়ালের সহায়তায় পৃথককৃত পার্শ্বে নরম শিমুল তুলার গদি ও বড় চৌপায়া আসবাব বসানো বৈঠকের সুবিধার্থেই হয়তো।
সেখান থেকেই ডাক দিয়ে উঠেন বেগম লুৎফুন্নেসা,
“চন্দ্রমল্লিকা! এদিকে আসো মেয়ে।”
যামিনী ধীর পদক্ষেপে আভিজাতিকচিহ্ন বহনকারী নারীটির সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে ঝুঁকে বলে উঠে,
“আসসালামু আলাইকুম দাদীজান। আপনি ডেকেছিলেন শুনলাম।”
“হুম, ডেকেছিলাম অবশ্যই। কী করবো বলো কন্যা? তুমি আমার পৌত্রের ললাটে লেপিত কলঙ্ক, এমন কলঙ্ক যা আমার সিংহ সাদরে গ্রহণ করেছে। যতোই হোক বিবাহ তো সম্পন্ন হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতি আমি চাইলেও এই কালিমা মুছতে পারবো না।
যেহেতু আমার সিংহের স্ত্রী হয়েছো এখানে থাকবে, তার সঙ্গ দিবে, সুস্বাস্থ্যবান, উত্তম ও সুন্দর শাহাজাদি ও শাহাজাদাকে দুনিয়াতে আনবে। কিন্তু ভুলক্রমেও এই বাড়ির পুত্রবধূ কিংবা জমিদারনি হওয়ার স্বপ্ন বুনো না। অন্যথায় তোমার এই স্বপ্ন আমি আয়নার ন্যায় ভেঙে চুরমার করে দিব।”
যামিনী নীরব। নত আঁখি অশ্রুতে টইটম্বুর।
“কী বলেছি বুঝতে পেরেছো কন্যা? আমার কিন্তু তোমার থেকে কোনো সমস্যা নেই। তুমি হিন্দুত্ব সংস্কৃতিতে বড়ো হয়েছো বা কৃষ্ণ রঙা বা বংশ পরিচয় হীনা তা নিয়ে আমার কোনো রূপ প্রশ্ন নেই। তোমার একটাই ত্রুটি, তোমার মাঝে ঐ কূটনীতিক শিক্ষাদীক্ষা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও সম্ভ্রান্ততন্ত্র নেই যা শেরপুরের জমিদারনি হতে প্রয়োজন।”
এবার চোখ উঠিয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার পানে তাকায় যামিনী। হাঁটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করে উঠে,
“আমি যদি যোগ্য হয়ে উঠি দাদীজান, তবে…? তবে কি পাবো না জমিদারনির মর্যাদা?”
“সেটা সময় বলবে। যোগ্যতা অর্জন করা সহজ কথা নয়। এই জমিদারির সাথে অসংখ্য রহস্য মাটিচাপা পড়ে আছে। তাদের রক্ষা করতে হবে। আর রক্ষা করতে হলে জানতে হবে তোমায়, যার জন্য বিশ্বাস অর্জন করা অত্যাবশ্যক।
এখন যাও, তৈরি হয়ে নেও। আমাদের বংশের নিয়ম নব বিবাহিত বধূ গোটা গ্রামে খেজুর, নতুন চাল আর রাজকীয় বাসন নিজ হাতে বিলিয়ে দেয় গ্রামবাসীদের মাঝে। আয়েশা খাতুন, যেয়ে দেখো এসপি সাহেব হয়িতো অপেক্ষারত অন্দরমহলের প্রবেশপথে। তাকে নিয়ে আসো।”
তড়িৎগতিতে বেগম লুৎফুন্নেসার খাস বাঁদী ও অন্দরমহলের হিসাবরক্ষক আয়েশা খাতুন বেড়িয়ে যান। কয়েক মিনিট পেড়িয়ে যেতেই আয়েশা খাতুনের আগমনের জানান দেয় প্রহরী। দাসীরা কক্ষ হতে পৃথককৃত এই অংশের যতোটুকু অনাবৃতি ছিল ততোটুকুও পাতলা পর্দার দ্বারা আবৃত করে দেওয়া হয়।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম লুৎফুন্নেসা। আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করুক। নবাববাড়ির মর্যাদা আরও বাড়ুক।”
“হুম, তোমাকে ক্যানো ডাকা হয়েছে তা নিশ্চয়ই আমার চিঠির দ্বারাই বুঝতে পেরেছো। অনুষ্ঠানটি সঠিক ও সুষ্ঠুতার সাথে সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব। কোনো রূপ অঘটন ঘটলে আমি তোমাকে দায়ী মনে করবো এসপি।”
“বেগম লুৎফুন্নেসা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ভরসা করুন আপনার এই ভৃত্যের উপর, আপনাকে একদণ্ড সুযোগ দিব না হতাশ হওয়ার।”
“তুমি এখন যেতো পারো।”
এসপি সাহেব নৈশব্দে বের হয়ে যান। বেগম লুৎফুন্নেসা যামিনীকেও তৈরি হওয়ার তাগিদ দিলে, সেও বেড়িয়ে যায়।
জমকালো কাজের আলখাল্লা পরানো হয় তাকে। নিকাবের আড়ালে ঢেকে যায় তার মুখশ্রী। মাথায় পরানো জমিদার মেহমাদ শাহের দেওয়া জমিদারনির মুকুট।
নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই যেন আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাচ্ছে যামিনী। কে জানতো এই কৃষ্ণকায়া অভাবে বড়ো হওয়া রমণী জীবনের এক অধ্যায়ে এমন পর্যায়ে চলে যাবে যে সে-ই দু’হাতে দান করবে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে।
“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, কী আনন্দ দিলে তুমি আমায় আল্লাহ! সম্পূর্ণ মর্যাদা না পাই, আজ সকলের চোখে জমিদারের স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা তো পাচ্ছি, সামনে ইনশাআল্লাহ সবকিছুই পাবো।”
মনে মনে আল্লাহকে বারবার শুকরিয়া জানাচ্ছে রমণী। তবে সে আদৌ জানে তার উদ্দেশ্যে অপেক্ষারত পরিস্থিতি মঙ্গলকর না অমঙ্গলকর?
___
অন্দরমহলের সদরদরজার দিকে দিলরুবার সাথে হাসাহাসি ও গল্পগুজবে মেতে এগিয়ে যাচ্ছে যামিনী। তখনই সদরদরজার সম্মুখে হাসিমাখা মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে গম্ভীর হয়ে যায় যামিনীর মুখশ্রী।
“অভিনন্দন বেগম চন্দ্রমল্লিকা। শুনলাম, আজ আমাদের বংশের রীতি পালন করতে যাচ্ছো। কী অদ্ভুৎ না যামিনী মানে বেগম? কিছু দিন আগে ছিলে সেই জন-সাধারণ চাষাদের একজন, আজ বেগম হয়ে গিয়েছো কোনো যোগ্যতার বিনাই।”
আজ আর মেহনূরের তিক্ত বাণী বিনা কোনো শব্দের উচ্চারণে গলাধঃকরণ করতে পারে না যামিনী। বরং, মিথ্যে হাসি দেয়।
“কী করবো বলেন শাহাজাদী! ভাগ্য বলেও একটা বিষয় আছে। এই যেমন আমার ক্ষেত্রেই দেখেন কোনো প্রচেষ্টা, যোগ্যতা, রূপ ছাড়াই শাহের হৃদয় এবং সম্রাজ্যের ধর্মীয়ভাবে এবং সামাজীকভাবে একমাত্র সম্রাজ্ঞী আমি। আর কেউ কেউ তো যোগ্যতা, বংশপরিচয়, শিক্ষা, শত প্রচেষ্টার পরও ব্যর্থ। তাদের হস্ত শূণ্য, হৃদয় ঈর্ষার আগুনে পরিপূর্ণ। ”
মেহনূরের তেজস্বী মুখশ্রী রাগের উত্তাপে দগ্ধিত হতে দেখা যায়, যদিও অন্তরালে রাখার যথাসম্ভব প্রচেষ্টা। যামিনী এই দৃশ্য দেখে সাহারা মরুভূমির মাঝে জমজমের জল পানের নেয় তৃপ্তি পেল।
একজন দাসী এসে উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আপনার বাহন প্রস্তুত করে হয়েছে, এখন যাত্রা করার জন্য একদম তৈরি।”
“চলো দিলরুবা, যাওয়া যাক। নবাব মহলে ফেরার পর হুজুর অথবা শিক্ষিকার নিকট যেয়ে আমার জন্য পানিতে ফুঁ দিয়ে এনো। আজকে অনেকের হৃদয় পুড়বে হিংসার অনলে, আমার না অনিষ্ট হয়ে যায়!”
দিলরুবা বুঝতে পেরে চাপা হেসে উত্তর দেয়,
“অবশ্যই বেগম। কথায় আছে, হিংসা ও প্রশান্তি কখনই একসাথে থাকতে পারে না। সুতরাং, আপনার অনিষ্ট কামনাকারী যে শতভাগ একজন অশান্তিপূর্ণ মানুষ।”
মেহনূর আর সেখানে স্থির থাকে না। অপমানের বিপরীতে হৃদয়ে পুঞ্জিভূত তীব্র আক্রোশে হনহন করে নিজের দাসীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
যামিনীর পালকি উঠে, যাত্রা শুরু হয় রহমতপুরের উদ্দেশ্যে। তার পালকি ঘেরাও করে রেখেছে পঞ্চাশের অধিক দেহরক্ষী এবং পুলিশদের গাড়ি।
অবশেষে ঘণ্টা দু’খানেকের ভ্রমণের অন্তে গন্তব্যে পৌঁছায় রমণীর পালকি। দিলরুবা ও অন্য একজন দাসী নেমে পর্দা সরিয়ে হাত এগিয়ে দেয় নামার সুবিধার্থে। যেই গ্রামে ছেলেবেলা থেকে ঘৃণ্যদৃষ্টি ও অবজ্ঞাসূচক বচনের মাঝে বেটে উঠা তার, সেই গ্রামেই আজ জমিদারনির বেশে পা রাখছে সে।
সে নিচে নামতেই প্রায় প্রতিটি গ্রামবাসী একই সুরে বলতে শুরু করে,
“জয়, বেগমের জয়! জয়, নবাববাড়ির জয়!”
এসপি সাহেবের পথপ্রদর্শনে দিলরুবার সঙ্গে সবার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় যামিনী। একে একে সকলে আসতে শুরু করে। মুখে তেজস্বিনী হাসি নিয়ে খাদিমদের ধরে রাখা সিন্দুক থেকে একে একে সকলকে অন্ন ও বস্ত্র তুলে দেয় যামিনী।
“আপনাকে সুখী করুক আল্লাহ বেগম। শত সূর্যের ন্যায় তেজস্বী সন্তানের জননী করুক।”
“আল্লাহ আপনাকে মেক হায়াত দান করুন বেগম। নবাবের সাথে আপনার সম্পর্ক সদা আনন্দ ও সুখে ভরে থাকুক।”
সবাই নিজেদের মতো হৃদয় শান্তিদান করার মতো দোয়া করছিল রমণীর উদ্দেশ্যে। কারো কারো কথায় তৃপ্তি পেয়ে সে তার গায়ের অলংকার খুলে দিয়ে দেয়।
কিন্তু সবার মাঝেই এমন ওড়নার আড়ালে লুকোয়িত একজন তার নিকট আসে। ত্রাণ হাতে তুলে নিয়ে শুধায়,
“চালচুলোহীন ঘুঁটেকুড়ানির ভাগ্যে রাজপুত্র মানায় না; রক্ত মানায়, মৃত্যু মানায়।”
বিপরীত কোনো শব্দ উচ্চারণের পূর্বেই তার কৃষ্ণ চামড়া ভেদ করে ঢুকে পড়ে তীক্ষ্ণ ছুড়ি। মুহূর্তেই লাল রক্তে ভেসে যায় তার অঙ্গ। হইচই পড়ে যায় জনসমুদ্রে, ভীড়ের মাঝেই হারিয়ে যায় সেই মুখোশধারী মানুষটি। তবে এ-ই কি যামিনীর অন্ত ছিল?
চলবে…
#চন্দ্রপুকুর
||৯ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যামিনী শুভ্র ঘরে শুভ্র বিছানায় শায়িত। ঘরের দ্বারে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছেন এসপি সাহেব। বেগম লুৎফুন্নেসার নিকট ইতিমধ্যে এ খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন। গর্দান না যায় তাঁর এই অসতর্কতার কারণে।
ঘটিয়ে নবাব বাড়ির বিশেষ বৈদ্যশালায় প্রবেশ করেন কালো বস্ত্রে দেহ আবৃত বেগম লুৎফুন্নেসা। তাঁকে দেখেই দিলরুবা ও এসপি সাহেব সহ বৈদ্য এবং তাঁর সহকারীরা ঝুঁকে সালাম জানায়।
কোনোরকম ‘হু’ উচ্চারণ করে ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি। যামিনীর অচেতন, পাণ্ডুর মুখখানা দেখে বুক ধ্বক করে উঠে তাঁর, সেই সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা ও ক্রোধ।
মনে মনে ভাবে,
– এবার তার সিংহকে কী জবাব দিবে সে?
“অবস্থা এখন কেমন বেগম চন্দ্রমল্লিকার?”
“চিন্তা করবেন না বেগম লুৎফুন্নেসা। জমিদার নবাব শাহের বেগম খুব দ্রুতোই সুস্থ হয়ে উঠবেন। সৌভাগ্যের বিষয় ছুড়িটা বিষ মাখানো ছিল না এবং খুব বেশি ভেদ করে অভ্যন্তরে যেতে পারেনি।”
“আলহামদুলিল্লাহ। আমার সামান্যতমও ত্রুটি চাই না আমার শাহের প্রিয় মনোরঞ্জিনীর চিকিৎসায়। খুব দ্রুতোই তার সুস্থতা চাই। আমার সিংহ এই নবাববাড়িতে চরণ ফেলার পূর্বে যেন এই ক্ষতের নাম ও চিহ্ন মিলিয়ে যায়।”
“ইনশাআল্লাহ বেগম লুৎফুন্নেসা। আমি আমার সর্বোচ্চ দিব, আপনি নিশ্চিত থাকুন। এখন বেগমকে ঔষধ দেওয়ায় ঘুমিয়ে আছেন, তবে অচিরেই উঠে যাবেন।”
আরেক দফা পর্যবেক্ষণ করে নিলেন যামিনীর প্রাণশক্তি শূণ্য হয়ে পড়ে মুখমণ্ডল। কক্ষ থেকে বের হয়েই ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এসপি সাহেবের উপর। পুরুষটির দৃষ্টি নত, লজ্জিত ভঙ্গিমা।
“সামান্য একটা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোমাকে এসপি, তাও সামলাতে পারলে না। আর তুমি কি না দায়িত্ব নিয়ে বসে আছো শেরপুরের থানার, নবাববাড়ির রহস্য রক্ষার। আজ থেকে তুমি চাকরিচ্যুত হলে, চাকরিচ্যুত!”
“বেগম…!”
“চুপ! একদম চুপ! আমি তোমার মুখ থেকে একটা শব্দও শ্রবণ করতে চাই না। আয়েশা খাতুন চলো।”
এসপি সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না কী করবেন তিনি। এই চাকরি তাঁর কাছে সোনার ডিম পাড়া মুরগি বৈকী কিছুই নয়, এই যোগ্যতায় মাসিক বেতনই তিন লক্ষ মুদ্রা। যেহেতু বেগম লুৎফুন্নেদার মুখমণ্ড থেকে যেহেতু এ বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তাই আর চাকরি বাঁচানোর সম্ভাবনা শূণ্যের কোঠায়। তবুও শেষবার একটা সুযোগ নিতে চান তিনি, তাই সকলের আড়ালে যেয়ে পকেট থেকে বের করেন জাদুকরী বাক্সটি।
___
“শাহাজাদি! শাহাজাদি মেহনূর! শুনেছেন জমিদার বাড়িতে চলমান গুঞ্জন?”
শাহাজাদি মেহনূরের বিশেষ দাসী রত্না আনন্দ ও উত্তেজনাপূর্ণ মন নিয়ে কক্ষে ঢুকে। সে তখন নিজের প্রিয় হরিণের গোশত খেতে ব্যস্ত।
“ওহহো রত্না! এতো কী খুশির খবর জেনেছো যে এমন ভাবে উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একটু সবুর করো, শান্ত হও, তারপর জানাও।”
“আরে শাহাজাদি সংবাদই এমন। আপনিও প্রাণোচ্ছল, সতেজ হয়ে পড়বেন। ঐ চন্দ্রমল্লিকাত উপর হামলা হয়েছে অনুষ্ঠানে, বৈদ্যশালায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে এখন। একদম ঠিক হয়েছে, খুব সখ ছিল বাঁদী থেকে বেগম হওয়ার! হুহ!”
তড়িৎগতিতে শাহাজাদি মেহনূর আহার করা থামিয়ে দেয়। স্তব্দ তার চাহনি, ভঙ্গিমা।
“কী বললে রত্না? আবার বলো তো মেয়ে। আমি কি ভুল শুনলাম?”
“না আমার শাহাজাদি, আপনি একদম সঠিক শুনেছেন। নবাবের কর্ণ ও আঁখিতে পর্দা লাগানো নারীর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত!”
“তাহলে আমি এখানে কী করছি? আমার নারীটিকে দেখতে যেতে হবে। না, না, সবকিছুর পূর্বে নানীজানের কামরায় যাওয়া লাগবে।”
কথাগুলো বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ায় মেহনূর। রত্না চমকিত হয়। অপ্রিয় রমণীর প্রতি এতো কীসের দরদ বোধগম্য হচ্ছে না।
প্রশ্ন করার সুযোগও পায় না সে। তার পূর্বেই উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে কক্ষের দোয়ার খুলে বেরিয়ে যায় শাহাজাদি। পিছন পিছন সেও যায়।
বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষের সদরদরজায় পৌঁছালে সাক্ষাৎ হয় বেগম নুর বাহারের সঙ্গে। সালাম জানায় সে। দু’জনই প্রবেশ করে কক্ষ।
বয়োজ্যেষ্ঠ নারীটি চিন্তিত ও দুঃখিত বেশে নরম গদির উপর বসে।
“আসসালামু আলাইকুম সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বেগম। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”
“আমিন। ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমরা এ ওয়াক্তে…?”
“দাদীজান, শুনলাম বেগম চন্দ্রমল্লিকার উপর না কি হামলা হয়েছে। বেশ লাগলো হৃদয়ে। আহারে এটুকু মেয়েটা…! তাই খবর নিতে চলে আসলাম। কেমন আছে সে?”
“সুসংবাদই, চন্দ্রমল্লিকা ঝুঁকি ও বিপদ মুক্তো। তবে কন্যার মুখশ্রী একদম ফ্যাঁকাসে হয়ে গিয়েছে। ইশ!”
বেগম নূর বাহারের ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ। নিজের অমত ও রাগ টুকু অন্তরালে রেখে শুধায়,
“আম্মিজান, আপনি ঐ অমাবস্যার যামিনীকে নিয়ে এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না। ও মরলে মরুক, বাঁচলে বাঁচুক, আমাদের কী? আর মেহনূর তোমার হৃদয় শিশিরের ন্যায় অমলিন আমি জ্ঞাত এ সম্পর্কে। তবে মনে রেখো শত্রুকে দয়া তো দূরে থাকুক সহানুভূতিও দেখাতে নেই।”
বেগম লুৎফুন্নেসা নিজের অধর ভেজায়। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিমায় তাকায় পুত্রবধূর পানে।
“তোমার এতো বড়ো স্পর্ধা তুমি আমাকে প্রশ্ন করো! এই ক্ষণে তোমায় তোমার ঐ দু’পয়সার পিতার নিকট ফেলে আসার ক্ষমতা রাখি আমি তা কি ভুলে বসেছো?”
“না, না, আম্মিজান। আপনি মনে কষ্ট নিবেন না। আমি দুঃখিত, আমার ভুল হয়েছে। আমি শুধু কৌতূহলী হয়ে…”
“আমার চেয়ে অধিক বুঝতে এসো না, অনেক বেশি আঘাত পাবে। চন্দ্রমল্লিকা আর যা-ই হোক, তবে আমার সিংহের অতিপ্রিয়। তার উপর একটা আঘাত পড়বে, আমাদের উপর দশটা প্রশ্ন মেহমাদের, হ্রাস পাবে বিশ্বাস। কারণ শুধু মেহমাদ নয়, এই নবাববাড়ির প্রতিটি মানব জ্ঞাত আমাদের চন্দ্রমল্লিকাকে না মেনে নেওয়া সম্পর্কে।”
“দুঃখিত আম্মিজান। আমি প্রকৃতপক্ষেই এভাবে বুঝাইনি।”
“মুখ বন্ধ করে বিদায় হও আমার নজরের সামনে থেকে! আমি একা থাকতে চাই।”
শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহার নিয়মানুযায়ী বিদায় জানায়। কক্ষ ত্যাগ করতেই ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা।
বিড়বিড়ান,
“তোমরা বুঝবে না ঐ কন্যার মাঝে কী আছে, বুঝবে না।”
___
যামিনীর চোখের সম্মুখে ধীরে ধীরে আলোর উন্মেচন ঘটে। সর্বপ্রথম যে মুখশ্রীটি দেখতে পায় তা হলো দিলরুবার।
“বেগম আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু লাগবে আপনার?”
“আমি বেঁচে আছি তবে…? ফিরতে পেরেছি আমার বাবু মশাইয়ের দুনিয়াতে।”
“হ্যাঁ, পেরেছো আমার সোনামুখী রাণী। আমার চন্দ্রমল্লিকা, যার খুশবুতে আমার প্রাণের বাস, সে ফিরে না এসে থাকতে পারে?”
হুট করে মেহমাদ শাহের কণ্ঠ শুনে বহু কষ্টে আশেপাশে তাকায় সে। কিন্তু কোথাও নেই প্রিয় মানুষটি। তখনই নজর স্থির হয় তার কানের নিকটে বিদ্যমান যন্ত্রটির দিকে। বিস্মিত নয়তে তাকিয়ে থাকে শুধু।
চলবে…