চন্দ্রমহল -০৪

0
664

চন্দ্রমহল -০৪
১০.
প্রমিলার কক্ষে কয়েকজন দাসী দাঁড়িয়ে আছে সাজের সরঞ্জাম নিয়ে।বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আরো চার জন পেয়াদা।বনলতা কক্ষে ঢুকতেই প্রমিলা ডুকরে কেঁদে উঠলো। তারপর বনলতার হাত চেপে ধরে বললো,”আমাকে মাফ করিস না তুই কখনো। আজীবন ঈশ্বরের কাছে আমার জন্য তুই অভিশাপ দিস বনলতা। আমি তোকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আজ নিজের হাতে তোকে অসুরের হাতে তুলে দিচ্ছি।ঈশ্বর যেনো আমাকে কখনো ক্ষমা না করে। আমার ঠাঁই যেনো সবচেয়ে নিকৃষ্ট নরকে হয় এই প্রার্থনা করিস তুই।”

বনলতা কিছুই বুঝতে পারলো না। দাসীরা বনলতার পরনের শাড়ি খুলতে যেতেই বনলতা বাঁধা দিলো। কিন্তু তার বাঁধা টিকলো না।একটা গাঢ় সবুজ মসলিন শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো বনলতাকে।চুলে কাঁচা ফুলের খোপায় বনলতার রুপোর কাঠি গুঁজে দেওয়া।দুই হাত ভর্তি করে পরিয়ে দেওয়া হলো সোনা চুড়ি।কোমরে সোনার বিছা।পায়ে নুপুর।গলায় সোনার সাতনরি হার।কানে ঝুমকা। প্রমিলা অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো বনলতার দিকে।
সব কাজ সম্পন্ন হবার পর বনলতা জিজ্ঞেস করলো,”আমাকে এভাবে সাজানো হচ্ছে কেনো গিন্নিমা?”

প্রমিলা কান্নার জন্য কথা বলতে পারলো না।দাসী একজন বললো,”তোকে জমিদার বাবুর খাস কামরায় যেতে হবে,তোর কপাল ভালো এতোদিনে তুই জমিদারের সুনজরে পড়েছিস।”

আঁতকে উঠলো বনলতা। হতভম্ব হয়ে বললো,”গিন্নিমা!”

প্রমিলা কাঁদলো।তারপর বললো,”এমন কপাল পৃথিবীর কোনো নারীকে দিও না ঈশ্বর। এমন রাজকপাল যেনো আর কারো না হয়।যেই কপাল হলে স্বামীকে নিজের করে রাখার উপায় নেই,যেই কপাল হলে নিজের চোখের সামনে স্বামীর ঘরে অন্য নারীকে রাত কাটানোর জন্য যেতে দেখতে হয় সেই রাজকপাল কারো না হোক।
যেই মেয়েকে নিজের কন্যাসম ভেবেছি,কন্যা স্নেহ দিয়েছি আজ তাকেই কি-না….. ”

বনলতার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। সব গহনা টান দিয়ে ছিড়ে ফেলে চিৎকার করে বললো,”আমি কিছুতেই জমিদারের কক্ষে যাবো না গিন্নিমা।আমাকে মেরে ফেলো গলা টিপে।”

রণচণ্ডী রূপ নিলো মুহুর্তে বনলতা। ছুটে বের হয়ে যেতে চাইলো কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছয়জন পেয়াদার জন্য পারলো না।ছয়জন মিলে ধরে বনলতাকে নিয়ে গেলো জমিদারের কক্ষে।

১১.
সোফায় আরাম করে বসে রাজেন্দ্র নারায়ণ গ্লাসে মদ ঢালছেন।বনলতা মেয়েটাকে তিনি আগে কখনো দেখেন নি।মনে মনে তিনি ভাবছেন মেয়েটা দেখতে যেনো কেমন হবে।নতুন মেয়ে মানে নতুন অভিজ্ঞতা।
এই অভিজ্ঞতা রাজেন্দ্র নারায়ণের ১৫ বছর বয়স থেকেই।আজ বৃদ্ধ বয়সেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

দরজায় নক হতে রাজেন্দ্র নারায়ণ দরজা খুলে দিলেন।দরজার সামনে ছয়জন মিলে একজন রণচণ্ডীকে ধরে আছে।রাজেন্দ্র নারায়ণ মুগ্ধ হয়ে তাকালেন।
শেষ কবে এতো রূপবতী মেয়ে দেখেছেন তার মনে নেই।
বনলতা ভিতরে ঢুকতেই রাজেন্দ্র নারায়ণ কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিলেন।তারপর বনলতার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আমার মহলে স্বর্গের অপ্সরা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ আমি জানতামই না।কতো বড় ব্যর্থতা এটা আমার জন্য বুঝো তুমি বনলতা? ”

বনলতা চুপ করে রইলো।বনলতার বাম হাতে রাজেন্দ্র নারায়ণ আলতো করে চুমু খেলেন।ঘৃণায় শিউরে উঠলো বনলতা।
কক্ষের সব বাতি নিভিয়ে হালকা নীল আলোর বাতি জ্বালিয়ে দিলেন রাজেন্দ্র নারায়ণ।
তারপর বনলতার শাড়ির আঁচল ধরতেই লাফিয়ে উঠে থুতু মারলো বনলতা রাজেন্দ্র নারায়ণের মুখে।

রাগে ফুঁসতে লাগলো রাজেন্দ্র নারায়ণ।দেয়াল থেকে চাবুক টান দিয়ে নিয়ে তেড়ে গেলেন বনলতার দিকে।কোমর থেকে বিছা খুলে নিলো বনলতা,রাজেন্দ্র নারায়ণ বনলতার দিকে চাবুক ছুঁড়ে মারতেই বনলতা বিছা চাবুকের মতো ছুঁড়ে মারলো।চাবুকের সাথে পেঁচিয়ে গেলো কোমরের রূপোর বিছা। বিছায় হ্যাঁচকা টান দিতেই রাজেন্দ্র নারায়ণের হাত থেকে চাবুক ছুটে এলো বনলতার হাতে।চাবুক হাতে নিয়েই কষে আঘাত করলো বনলতা জমিদারের পিঠে।
আর্তনাদ করে উঠলো জমিদার। বনলতাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করার সুযোগ না দিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ কক্ষের দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন।তারপর বাহিরে থেকে কক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো।

কক্ষের বাহিরে গিয়ে পেয়াদাদের বললেন,”তোমরা সবাই চব্বিশ ঘণ্টা এই দরজায় নজর রাখবে।কোনোমতে যেনো এই মেয়ে পালাতে না পারে।আমি আবার আসবো রাতে।”

তারপর প্রমিলার কক্ষে গেলেন।প্রমিলা নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন।রাজেন্দ্র নারায়ণ কক্ষে ঢুকেই প্রমিলার গালে কষে চড় মারলেন।

হতভম্ব প্রমিলা কাঁদতে ভুলে গেলো। রাজেন্দ্র নারায়ণ প্রমিলার চুলের মুঠি চেপে ধরে বললেন,”এই মেয়ে কে?তোর কেমন আত্মীয়?
এ তো জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। আমাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করেছে এই মেয়ে।আমি ওকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দিবো তুই দেখিস।”

নিজের কষ্ট ভুলে প্রমিলা হাসলো।তারপর বললো,”আমার ৩৫ বছরের সংসার জীবনের কষ্ট আজ সার্থক হলো।তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ বনলতা। ”

১২.
কক্ষের বাতি জ্বালিয়ে দিলো বনলতা। তারপর ভিতরের দিক থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।দুই চোখ রক্তজবার মতো হয়ে আছে।মাথায় আজ খুন চেপেছে বনলতার। এখান থেকে পালাবার পথ খুঁজছে।
চন্দ্রমহলের সব কক্ষে ঢুকলেও বনলতা এই কক্ষে এসেছে আজ প্রথম বার।হঠাৎ করে বনলতার মনে হলো এই কক্ষটি ভালো করে খুঁজে দেখা দরকার।আর হয়তো সুযোগ পাবে না প্রকাশ্যে এই মহলে ঘুরে বেয়ারানোর।

এবার আর চুপ থাকতে পারবে না সে,এবার তাকে জমিদারের মুখোমুখি হতে হবে।
ভালো করে তাকালো বনলতা ঘরের দিকে।সুসজ্জিত একটা রুপোর বিছানা, দেয়ালে বড় বড় তৈলচিত্র। একপাশে সুগন্ধি ধুপ জ্বলছে। একপাশে সেগুন কাঠের বড় একটা আলমারি। অন্য দিকে একটা বড় আয়না।
খাটের পাশে একটা সোফা।বাহিরের দিকে একটা শৌচাগার। ঘরের চার দেয়াল ঠুকে দেখলো ফাঁপা আছে কি-না কোনো দেয়াল।তারপর একে একে সবগুলো তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়ালো বনলতা। একে একে সবগুলো তৈলচিত্র দেয়াল থেকে সরালো।কোনো দরজা খুঁজে পেলো না।
নিজেকে কেমন ব্যর্থ মনে হলো বনলতার। একই প্রাসাদে মা মেয়ে ১৬ বছর ধরে আছে,অথচ মা’কে সে খুঁজে পাচ্ছে না।এর চাইতে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে!

চোখ বন্ধ করে ফ্লোরে বসলো বনলতা। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পরে উঠে দাঁড়ালো। আয়নার সামনে গিয়ে তাকালো নিজের দিকে।আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিজে বললো,”আমি ভয় পাবো না।কিছুতেই না।আমি এক সাহসী জমিদারের কন্যা। সাহসিকতা আমার রক্তে বইছে।কেনো আমি হেরে যাবো আজ?”

পুরো কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখলো বনলতা। হঠাৎ করেই আবার আয়নায় চোখ গেলো।দ্রুত পায়ে আয়নার সামনে এসে দাড়িয়ে আয়নার কাঠের ফ্রেমে হাত দিলো।তারপর আলতো হাতে ধাক্কা দিতেই সরে গেলো আয়না।বনলতার নজরে এলো একটা দরজা।
এই সেই কাঙ্ক্ষিত দরজা যা সে এতোগুলা বছর ধরে খুঁজে চলেছে।
দরজার ছিটকিনি খুলতেই দেখতে পেলো নীল শাড়ি পরনে এক মহিলা ফ্লোরে বসে আছে,দুই হাত সামনে এনে বাঁধা,মুখ বাঁধা অবস্থায়।
কাউকে বলে দিতে হয় নি,তবুও বনলতা জানে এই তার মা স্বর্ণলতা।

১৬ বছর ধরে যাকে মা বলে ডাকার প্রবল আকুতি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বনলতা এই সেই মানুষ। বনলতা এগিয়ে গিয়ে স্বর্ণলতার হাত,মুখের বাঁধন খুলে দিলো।তারপর কোমল সুরে বললো,”মা,মা গো… আমার মা,১৬ বছর ধরে যাকে আমি খুঁজে চলেছি তুমি আমার সেই মা।যাকে একবার দেখার জন্য রাতের পর রাত আমি না ঘুমিয়ে চন্দ্রমহলের প্রতিটি ইট সরিয়ে দেখেছি তুমি আমার সেই মা।যাকে খুঁজে পাবার জন্য আমি পুরো জমিদারি চষে বেড়িয়েছি তুমি আমার সেই মা।
আমি তোমারই বনলতা মা।”

চলবে….

জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here