চন্দ্রমহল -০৬

0
630

চন্দ্রমহল -০৬
১৫.
আকাশ মেঘলা হয়ে গেছে,ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।
প্রমিলা দেবীর কক্ষের দরজা বন্ধ করে রাজেন্দ্র নারায়ণ আরেকটা চাবুক নিলেন।তারপর বিছানায় প্রমিলাকে হাত,পা,মুখ বেঁধে শুইয়ে রাখলেন।
প্রলয়ের ডাক শুনে প্রমিলা হাজার চেষ্টা করেও নিজের দুরবস্থার কথা বলতে পারলেন না।চাবুকের আঘাতে পরনের শাড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।ফর্সা শরীর কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো।
রাজেন্দ্র নারায়ণের রাগ কমলো না।হিসহিসিয়ে বললেন,”আমার খেয়ে,আমার পরে আমার ঘরেই তুই শত্রু পালন করেছিস?
আমাকে শেষ করার জন্য?
আমার বিরোধিতা করবে ওই মেয়ে?
দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিস আমাকে দংশন করার জন্য?ওই সাপের বিষদাঁত আমি কেমন করে ভেঙে দিই তুই দেখবি এবার।তবে তার আগে তোকে আমি শাস্তি দিবো। ”
মার খেতে খেতে প্রমিলার দেহের রক্তে বিছানার সাদা চাদর ভিজে গেলো।প্রমিলার উন্মুক্ত বক্ষে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলো। তারপর চাবুক ফেলে দিয়ে বিছানার একপাশে বসলো।
বিবস্ত্র প্রমিলার দেহ দেখে রাজেন্দ্র নারায়ণের ভেতরের পশু আবারও জেগে উঠলো। হাত পা বাঁধা অবস্থায় সঙ্গমে লিপ্ত হলো প্রমিলার সাথে।সারা শরীর ব্যথায় প্রমিলার মনে হলো মৃত্যু যন্ত্রণা যেনো এটাই।
চিৎকার করে কাঁদতে পারলো না প্রমিলা,মনে মনে ঈশ্বরকে বললো,”আমাকে শক্তি দাও ঈশ্বর, এতো তাড়াতাড়ি আমার মরণ দিও না।এই নরপশুর পতন দেখে আমি মরতে চাই।তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো।”

প্রমিলার জ্ঞান থাকা পর্যন্ত রাজেন্দ্র নারায়ণ ছাড়লো না তাকে।এতো ব্যথা সইতে না পেরে প্রমিলা জ্ঞান হারালো।
তারপর রাজেন্দ্র নারায়ণ উঠে প্রমিলার পাশে শুয়ে পড়লো সোজা হয়ে। মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগলো রাতের জন্য।

১৬.
রাজেন্দ্র নারায়ণের আলমারির হাতল ধরে টান দিতেই দরজা খুলে গেলো।ভেতরে শোভা পাচ্ছে কারুকার্য খচিত একটা তলোয়ার। বনলতা সেই তলোয়ার হাতে তুলে নিলো।তারপর পুরো কক্ষ খুঁজে একটা ছোট সরু তার,এক আঙুল সমান টর্চ,একটা দেশলাই নিলো,সেগুলোকে একটা ছোট ব্যাগে ঢুকিয়ে শাড়ির নিচে দিয়ে কোমরে বেঁধে নিলো।রাজেন্দ্র নারায়ণের বালিশের নিচে খুঁজতেই একটা ময়ুর খচিত ছোট ফোল্ডিং চাকু পেলো,সেটা দেখে বনলতার হাসি পেলো।কেউ না জানলেও বনলতা জানে,প্রাণের ভয়ে বালিশের নিচে এই চাকু রেখে ঘুমায় রাজেন্দ্র নারায়ণ,দুবার যেহেতু হামলা হয়েছে তাই আর ঝুঁকি সে নিবে না।সেই চাকু নিয়ে ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলো।স্বর্ণলতা তাকিয়ে দেখলো সব।তারপর শেষ বারের মতো মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
এবার আর কেউ কাঁদলো না,তবে দুজনেরই বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে লাগলো।

বাহিরে থেকে প্রলয় দরজা ধাক্কা দিয়ে চলছে।বনলতার মনে হলো এটা রাজেন্দ্র নারায়ণের কাজ।কক্ষের সব বাতি বন্ধ করে দিলো বনলতা।তলোয়ারের খাপ থেকে তলোয়ার খুলে বনলতা দরজার ছিটকিনি খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রলয় ঢুকে পড়লো।চারদিকের অন্ধকারে বনলতা বুঝতে পারলো না সামনে কে,ক্ষিপ্র গতিতে তলোয়ার চালনা করলো প্রলয়ের ঘাড় উদ্দেশ্য করে,লাফ দিয়ে প্রলয় সরে গেলো,কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।তলোয়ারের কোপ গিয়ে প্রলয়ের ডান হাতের কনুইয়ের উপরে লাগলো।প্রলয় নিচে বসে যেতেই বনলতা মা’কে টান দিয়ে বের করে পেয়াদাদের মুখোমুখি হলো,তারপর স্বর্ণলতাকে চিৎকার করে বললো পালাও মা,পালাও।

স্বর্ণলতার মনে হলো দুই পা যেনো পাথরের ন্যায় হয়ে আছে,মেয়েকে এই বিপদের মধ্যে রেখে নিজের প্রাণ নিয়ে পালাতে ভেতর থেকে মন সায় দিলো না।
বনলতা জানতো এরকম করবে স্বর্ণলতা,তাই বললো,”আমার বাবার শপথ লাগে মা,পালাও।আমাকে জীবিত দেখতে চাইলে পালাও তুমি।”
এরপর আর স্বর্ণলতা দেরি করলো না।ছুটতে লাগলো।দীর্ঘদিন বদ্ধ ঘরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় থাকায় ভালো করে ছুটতে পারলো না স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতাকে পালাতে দেখে একজন পেয়াদা ছুটে গেলো তাকে ধরতে,বনলতা তলোয়ারের এক কোপে তার মুন্ডু নামিয়ে নিলো।ভয় পেয়ে একজন পেয়াদা তিনতলার শেষ মাথায় থাকা ঘন্টায় বাড়ি দিলো।
জরুরি ঘন্টা শুনে চারদিক থেকে পেয়াদারা ছুটে আসতে লাগলো উপরের দিকে।রাজেন্দ্র নারায়ণ চমকে উঠলেন শোয়া থেকে।তারপর নিজের পোশাক পরে বের হয়ে এলেন প্রমিলার কক্ষ থেকে।
প্রলয় বাম হাতে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে এলো বনলতাকে রক্ষা করতে।

সিড়িতে দুপদাপ পায়ের শব্দ পেয়ে স্বর্ণলতা বুঝতে পারলো পেয়াদারা আসছে,তাই স্বর্ণলতা দুতলার করিডরে এসে দৌড় বন্ধ করে ধীরপায়ে হাটতে লাগলো। করিডোরের রশিতে থাকা শুকনো কাপড় তুলে নিয়ে নিজের ব্যাগ আড়াল করে এমন ভাবে যেতে লাগলো যেনো শুকনো কাপড় নিতেই এসেছে সে।
পেয়াদারা হাতে তলোয়ার নিয়ে ছুটতে লাগলো উপরের দিকে,স্বর্ণলতাকে পাশ কাটিয়ে সবাই যেতেই স্বর্ণলতা আবারও ছুটতে লাগলো।

পেয়াদাদের এভাবে ছুটতে দেখে প্রভাত বুঝলো কোনো সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়,নিজের তলোয়ার নিয়ে নিজেও ছুটে এলো তাই এতোক্ষণে তার নেশার ঘোর কেটেছে।

চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো সবাই বনলতাকে,বনলতা থেমে রইলো না।”জয় মা কালী” বলে ঝাপিয়ে পড়লো,চারদিক থেকে সবাই যখন বনলতার গর্দান লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো একসাথে,বনলতা তখন মাটিতে বসে গিয়ে এক ঘূর্ণন দিয়ে সবার পায়ে তলোয়ার চালালো।চোখের পলকে সবাই ফ্লোরে পড়ে গেলো। চাবুক হাতে নিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ পেছন থেকে বনলতার তলোয়ার লক্ষ্য করে প্যাচ দিয়ে টান দিতে যেতেই প্রলয় এসে বাবার সামনে দাঁড়ালো। আধো আলো,আধো অন্ধকারে রাজেন্দ্র নারায়ণ দেখলো ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে প্রলয় তাকিয়ে আছে তার দিকে।সেই তেজি চাহনি,সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, যে চাহনির সামনে রাজেন্দ্র নারায়ণ থরথর করে কাঁপতো।
হঠাৎ করেই রাজেন্দ্র নারায়ণের মনে হলো তিনি চিনতে পেরেছেন এতো দিন পরে এই চাহনি কার ছিলো।অস্ফুটস্বরে বললেন,”বাবা!”

প্রলয় বাবার সামনে এসে বললো,”আমি বেঁচে থাকতে বনলতার একটু ক্ষতি ও আপনাকে করতে দিবো না আমি।”

প্রায় ১৪-১৫ জন পেয়াদা বনলতার তলোয়ারের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে আছে। হঠাৎ করে তলোয়ারের উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করে প্রভাত বনলতার তলোয়ার ফেলে দিলো,তারপর কয়েকজন মিলে বেঁধে ফেললো রশি দিয়ে বনলতাকে আষ্টেপৃষ্টে।

প্রলয় এগিয়ে এলো বনলতাকে বাঁচাতে তার আগেই বনলতা বললো,”না,ছোঁবেন না আমাকে।আপনার দেহে এই জমিদারের রক্ত বইছে,আমার গায়ে আপনার হাত লাগলে আপনার সেই হাত আমি দেহ থেকে আলাদা করে ফেলবো।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”এবার নিশ্চয় তোমার কিছু বলার নেই বাছা,এই মেয়ে আমাদের শত্রু।শত্রুকে কখনো ভালোবাসা যায় না,শত্রুকে শুধু ভোগ করতে হয়।”

একজন পেয়াদা রাজেন্দ্র নারায়ণের দিকে তাকিয়ে বললো,”অপরাধ নেবেন না হুজুর,এই মেয়ের সাথে আরেকজন মহিলা ছিলো এই কক্ষে,মেয়েটা ওই মহিলাকে মা বলে ডেকেছে এবং ওই মহিলাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে।”

মুহুর্তে রাজেন্দ্র নারায়ণের মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেলো,এগিয়ে গেলো বনলতার দিকে।প্রলয় বাঁধা দেওয়ার জন্য সামনে এগুতে যেতেই প্রভাত সহ কয়েকজন মিলে প্রলয়কেও আটকে ফেললো।প্রলয়ের ডান হাতে একটা গভীর ক্ষত হলো,তা দেখে প্রভাতের ভীষণ মায়া হলো। সেপাহীদের বললো,”ওকে আমার চেম্বারে নিয়ে চলো,ওর হাতে ইনফেকশন হতে পারে।জলদি চিকিৎসা করতে হবে।”

প্রলয় চিৎকার করে বললো,”আমি যাবো না দাদা,আমার বনলতাকে ছেড়ে আমি যাবো না।আমার বনলতার কোনো ক্ষতি হলে আমি সব শেষ করে দিবো।”

প্রলয়ের চিৎকার কেউ আমলে না নিয়ে নিয়ে চললো দুতলায় প্রভাতের চেম্বারে।

প্রলয় যেতে রাজেন্দ্র নারায়ণ বনলতার চোয়াল চেপে ধরে বললো,”আচ্ছা,এবার বুঝতে পেরেছি আমি।তুমি স্বর্ণলতার মেয়ে,জমিদার সুশান্ত সেনের মেয়ে বনলতা সেন তুমি! এজন্যই তো বলি,এতো রূপবতী আর তেজী মেয়ে কিভাবে হয়?”

বনলতা আবারও থুতু মারলো সোজা রাজেন্দ্র নারায়ণের মুখে,তারপর বললো,”নর্দমার কীটকে এভাবেই থুতু মারতে হয়,তোর দিন শেষ। পাপের ভান্ডার পূর্ণ হয়ে গেছে তোর।এবার তোর সাজা পাবার দিন এগিয়ে এসেছে।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ হাসলো,বড় বিকৃতভাবে হাসলো।তারপর বললো,”তোর মাকে ১৬ বছর ধরে বন্দী রেখে আমি ধর্ষণ করেছি,তোর মা ৬-৭ বার আমার সন্তান পেটে নিয়ে পেট বাঁধিয়েছে।সেসব আমি অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিয়েছ ঔষধ দিয়ে।তবে তোকে আমি ছাড়বো না।তোর জন্ম হয়েছে জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণের রক্ষিতা হয়ে থাকার জন্য।তোকে আমি আমার বাগান বাড়িতে রাখবো।খাস রক্ষিতা করে,দুই-তিনজন মিলে যখন তোর যৌবন নদীতে এক সাথে সাতার কাটবে তখন তুই বুঝবি জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণের সাথে বেয়াদবি করার,তাকে থুতু মারার শাস্তি কতো ভয়াবহ হতে পারে।তখন তুই আফসোস করবি কিন্তু লাভ হবে না।চিন্তা করিস না,তোর গর্ভের সন্তান আমি মারবো না।”

বনলতা রাজেন্দ্র নারায়ণের বাম পায়ের হাটু বরাবর লাথি দিয়ে বললো,”পাগলের সুখ মনে মনে, আমার একটা চুল ছেঁড়ার ক্ষমতা ও নেই তোর।আমি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি,পুরো জমিদারের বংশকে জ্বালিয়ে দিতে আমার জন্ম।”

রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ পেয়াদাদের বললো,”এই মেয়েকে আমার বাগানবাড়িতে নিয়ে রঙ্গনার হাতে তুলে দিয়ে বলবে,একে বিশেষ হেফাজতে রাখতে বলেছেন জমিদার বাবু।যাতে পালাতে না পারে,কড়া নজর রাখতে।”

চলবে….

জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here