চন্দ্রমহল -০৭

0
645

চন্দ্রমহল -০৭
১৭.
স্বর্ণলতা ঝোপের ভেতর ঢুকে বড় করে শ্বাস নিলেন।দমবন্ধ করে ছুটেছেন তিনি।অল্প একটু পথ ছুটে এসেছেন অথচ বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে এতেই।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেনো তার।১৬ বছর একটা কুঠুরিতে বন্দী থাকার পর আজকে তিনি পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখছেন।স্বর্ণলতার মনে হলো এ যেনো তার নতুন জীবন। যে জীবন তাকে তার মেয়ে দিয়েছে।
মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন চারপাশে।

কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে সব কিছু তার কাছে।এই যে সবুজ ঘাস,মাথার উপর মেঘলা আকাশ,আলো অন্ধকারে মাখামাখি করা বিকেল,শীতল হাওয়া এসবের রূপ,সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারে কে?
পৃথিবীর সব শব্দ ফুরিয়ে যাবে তবুও প্রকৃতির যথেষ্ট সৌন্দর্য বর্ণনা করা যাবে না। মুক্তির আনন্দে কাঁদলো স্বর্ণলতা। তারপর সেই কান্না রূপ নিলো বেদনায়।

চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সুশান্ত সেন আর সৈকত সেনের লজ্জায়,অপমানে নিচু হয়ে যাওয়া মাথা।একদল হায়েনা তার পরনের সব কাপড় খুলে নিলো,তিনি চিৎকার করে ঈশ্বরের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করছেন।

অথচ আজ তার আর লজ্জা হয় না।আজ ঈশ্বরকে বলছেন,”আমায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।এই নরপশুর পতন দেখে নিজের সকল যন্ত্রণা ভুলবো আমি।”

কান্নার মধ্যে স্বর্ণলতা দূরে কোথাও মৃদু একটা শব্দ শুনতে পেলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে গেলো তার।আর দেরি না করে পাচিলের অপর পাশে চলে গেলেন।চাবি দিয়ে ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকা খুলে বৈঠা দিয়ে নৌকা বাইতে শুরু করলেন।
মেয়ের জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার,তিনি সেসব মাথায় রাখতে চান না।নিজেকে অভয় দিয়ে বারবার বলতে লাগলেন,”আমার বনলতার জয় হবেই।”

অল্প একটু পরিশ্রমে স্বর্ণলতা হাফিয়ে গেলো।তাঁতী পাড়া আর কতোদূর কে জানে!
বুকের ব্যথায় স্বর্ণলতার মনে হলো এখনই বুঝি প্রাণ বের হয়ে যাবে।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলো নদীর পাড়ে নানা রংবেরঙের শাড়ি টাঙিয়ে রাখা।যেনো শাড়ির মেলা বসেছে।স্বর্ণলতা বুঝে গেলো এটাই তাঁতীপাড়া।নৌকা ঘাটে ভিড়িয়ে স্বর্ণলতা নামলো নিজের পুটলি নিয়ে নৌকা থেকে।রাজরানীর মতো দেখতে এই মধ্যবয়স্কা নারীকে দেখে অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।স্বর্ণলতা সবার অবাক চাহনি দেখে কিছুটা ভড়কে গেলেন।তারপর নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলেন,”রমনা মাসির ঘর কোনটা কেউ বলতে পারেন?”

একজন মহিলা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,”কে আপনি,রমনা বুড়ি আপনার কি লাগে?”

স্বর্ণলতা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো, “আমার মাসি গো উনি,আমি তার বোনঝি চন্দনা।”

সাথেসাথে যেনো সবাই চিনতে পারলো,মহিলাটি এগিয়ে এসে বললো,”হায় ভগবান! কি বলো গো তুমি! তুমি সেই চন্দনা!
বাবা গো বাবা,এতো পাষাণ মানুষ ও হয় বুঝি,বুড়ি তো তোমার নাম বলতে বলতে কানের পোকা বের করে ফেললো।সারাদিন যার সাথেই দেখা হয় তারেই বলে, আমার চন্দনা আজকে আসবেই আসবে।মাসির প্রতি এই বুঝি তোমার টান!
বুড়ির মুখে তোমার কতো যে প্রশংসা শুইনেছি আমরা।আসো আসো,আমি দেখিয়ে দেই তোমার মাসির ঘর।বুড়ি যে আজকে কি খুশি হবে তুমি চিন্তা ও করতে পারবে না।”

স্বর্ণলতা বুঝলো বুড়ি বেশ চালাক মহিলা।আগেই সবার কাছে তার কথা বলে রেখেছে যাতে পরে কেউ সন্দেহ না করে। আমতাআমতা স্বর্ণলতা বললো,”কি করবো দিদি,স্বামী মরেছে সেই কবে,বৃদ্ধা শাশুড়ির জন্য কোথাও যেতে পারি না।এখন সেই পিছুটান ও গেলো। শাশুড়ি ও মরে গেলো।আমার এই মাসি আর একটা মেয়ে ছাড়া কিছুই রইলো না।মেয়ে আছে তার পিসির বাড়ি।”

কথা বলতে বলতে তারা রমনার কুড়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলাটি রমনাকে ডাক দিয়ে বললো,”ও জেঠিমা,দেখো তোমার বোনঝি এসেছে।তাড়াতাড়ি বের হও। ”

সাদা শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা বের হয়ে এলো ঘর থেকে।স্বর্ণলতা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করে বললো,”কেমন আছো মাসিমা?চিনতে পেরেছো?তোমার চন্দনা আমি।”

বুড়ি স্বর্ণলতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।তারপর বিলাপ করতে করতে বললো,”এতোদিনে তোর আসার সময় হলো?আমি যে তোরে শেষ দেখার জন্য বেঁচে আছি মা।আজ আমার কি যে আনন্দের দিন!আমার ঘরে মা দুগ্গা এলো গো।আয় মা আয়,ঘরে আয়।কাপড় পালটে বোসে জিরিয়ে নে।আমি তোর জন্য জলখাবার নিচ্ছি।”

চারপাশের মহিলারা যে যার কাজে চলে গেলো। সবাই চলে যেতেই রমনা খাবার নিয়ে এসে বললো,”মাফ করবেন মা,সবার সামনে আপনাকে তুই করে বলতে হচ্ছে।”

স্বর্ণলতা হেসে বললো,”আমার মা থাকলে তো এভাবেই বলতো মাসিমা।আপনি আমাকে তুই করেই বলবেন।আমি তাতেই খুশি হবো।”

রমনা চোখের জল ফেলে বললো,”আমার বুনোলতাটা না জানি কেমন আছে এখন।আপনি জানেন না মা,আপনি মেয়ে জন্ম দেন নি জন্ম দিয়েছেন মানুষরূপী একজন দেবীর।”

স্বর্ণলতা কেঁদে দিয়ে বললো,”ঈশ্বর যেনো আমার মেয়েকে রক্ষা করে। ”

১৮.
প্রলয়কে প্রভাতের চেম্বারে চেয়ারের সাথে পেছনে হাত মুঠো করে বেঁধে রেখেছে।বাহুতে ব্যান্ডেজ করা।ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে প্রভাত।ফর্সা মুখখানা রাগে লাল হয়ে আছে।কপালের একটা রগ ফুলে আছে এখনো। প্রভাত ভাইয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেসে বললো,”আমাকে কি তুই এতোই বোকা ভাবিস প্রলয়?
আমি তো শুরু থেকেই বুঝতাম ওই মেয়ের উপর তোর দুর্বলতা। যে ছেলে দাসীরা খাবার এনে দিলে খেতো না মা ছাড়া সে কি-না দাসীদের হুকুম দেয় বনলতাকে দিয়ে খাবার পাঠাতে তার কক্ষে।
বইয়ের পাতায় যে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতো সে কি-না দেখি হেঁশেলের আশেপাশে যায়।
তেলজাতিয় খাবার যে দেখতেই পারে না সে কিনা নিয়ম করে ছাদে যায় আচার খেতে,বনলতার হাতের লুচি তরকারি খায় সে!
কিন্তু তুই জানতি না আমার শকুনি দৃষ্টি তার আগেই পড়েছে ওর উপরে। ওকে ভোগ করার আশায় আমি বিভোর হয়ে থাকতাম।তোর হাত থেকে বাঁচাতেই তো আমি বাবাকে গিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে ওর কথা বলেছি।এবার তোর নিশ্চয় আর ভালোবাসা থাকবে না ওর জন্য।আর যাই হোক তোর রুচি এতোটাও নিচু না যে বাবার এঁটো খাবারে নজর দিবি।আমি আবার এসবের উর্ধ্বে। বনলতার দেহটা আমার চাই -ই-চাই।”

তারপর আস্তে করে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে।পেয়াদাদের বললো নজর রাখতে।

প্রভাত চলে যেতেই প্রলয় চোখ তুলে তাকালো।তারপর জিহবার নিচ থেকে ঘুমের ঔষধ বের করে থু করে ছুড়ে মারলো। এতোক্ষণ ধরে ঘুমের ভান করে ছিলো প্রলয়।তারপর মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো,”আমিও তো তোমার ভাই দাদা,কিছুক্ষণ আগে যাকে মাতাল দেখলাম সে কিভাবে তলোয়ার নিয়ে ছুটে এলো উপরে তা দেখেই তো আমি বুঝেছিলাম তোমার সব ভান ছিলো। তোমার নেশা তো সারারাতেও কাটে না।
আমার দেহে প্রাণ থাকতে বনলতার কিচ্ছু করতে পারবে না তোমরা। আর আমার বনলতা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ,ঝলসে যাবে তোমরা। ”

চেম্বারে না আসতেই প্রলয় বুঝে গেলো ভাইয়ের অভিসন্ধি। তাই প্রভাতের ঔষধের ঝুড়ির সামনে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।এবং সুযোগ বুঝে একটা ব্লেড নিয়ে ডান হাতের মুঠোয় পুরে রাখলো।
প্রলয়কে চেয়ারে বসিয়েই প্রভাত ঘুমের ঔষধ নিলো।প্রভাতের সব ঔষধ প্রলয়ের চেনা।তাই বুঝতে দেরি হলো না তার কিছু তাকে কোন ঔষধ দিবে এখন।
প্রভাত চলে যেতেই ব্লেড দিয়ে অনেক চেষ্টার পর হাতের বাঁধন খুললো প্রলয়। বাঁধন খুলতে গিয়ে হাতের অনেকখানি অংশ কেটেও গেলো।

১৯.
বাগানবাড়ির পিছনের দিকে একটা বন্দীশালা আছে।যে মেয়েদের বাগানবাড়িতে আনা হয় জমিদার ও তার বন্ধুদের মনোরঞ্জন করার জন্য তাদের মধ্যে কেউ অবাধ্যতা করলে তাকে এই বন্দীশালায় দানাপানি না দিয়ে আটকে রাখা হয়।বদ্ধ কয়েকটা ঘর,যাতে মশাল জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রঙ্গনা বনলতাকে এনে একটা কক্ষে রাখলো।
তারপর একজনকে বললো গরম পানির ব্যবস্থা কর,অন্য একজন কে বললো সুই,ব্লেড,লবন মরিচ এনে রাখ।আমি সন্ধ্যায় লবন মরিচ দিয়ে মাখবো ওর কাটা গা।
বলেই হাসতে লাগলো।

বনলতা রঙ্গনার দিকে তাকিয়ে বললো,”জমিদারের পা চাটা কুত্তী,তোর ঠাঁই নরকে ও হবে না।”

ক্রোধে মত্ত হয়ে রঙ্গনা বললো,”আমার স্বর্গ নরক নিয়ে মাথা ব্যথা নেই,এটাই আমার স্বর্গ।তবে আমার স্বর্গে তুই নরক দেখবি এবার।”

বনলতা ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,”দেখা যাক কে কাকে নরক দেখায়।”

রঙ্গনা দপদপ করে চলে গেলো। বনলতা নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য চারদিকে নজর বুলালো। তারপর মুচকি হাসলো।

চলবে?
জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here