চন্দ্ররাতের_মায়া [৭]

0
242

#চন্দ্ররাতের_মায়া [৭]
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

রাবেয়া চৌধুরীর ডাক শুনে তীব্র হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামলো।নিচে নামতেই দেখলো একজন মাঝবয়সী লোক হাতে বই নিয়ে সোফায় বসে বই পড়ছে।সাথেই বসে আছে একটা মেয়ে। মেয়েটা সুন্দরী। বেশ সুন্দরী।গায়ের গড়ন, রং-বিন্যাস সবকিছু যেন প্রকৃতি তাকে ঢেলে দিয়েছে। খোলা চুল,মাথায় ফুলের গাজরা।চোখে নীল রঙ্গের চশমা।হাল্কা লাল লিপস্টিকের রং ঠোঁটে আভাস দিচ্ছে। অবশ্য এটা লিপস্টিক নাকি মেয়েটার ঠোঁটের রং ই এরকম বোঝায় উপায় নেই।তীব্র ওর পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে নিচে নামলো।রাবেয়া চৌধুরী তীব্রর হাত ধরে টেনে ওদের সামনে নিয়ে গেলেন।অতি উৎসুক কন্ঠে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন

– আরোহী,দেখ তো চিন্তে পারিস কি না,

মেয়েটা কিঞ্চিৎ হেসে উঠলো।ঠোঁটের কোনে হাসির আভা ফুটে উঠলো।বাহ্ মেয়েটকে হাসলে দারুন মানায়।হাসি হাসি কন্ঠে বললো

– তীব্র ভাইয়া না?

রাবেয়া চৌধুরী- সেই ছোট থাকতে দেখেছিলি, আমিতো ভাবলাম চিন্তেই পারবি না

আরোহী-কি যে বলো না,তীব্র ভাইয়াকে চিনবো না? তাও আবার আমি,

তীব্র-কেমন আছিস আরোহী

আরোহী-ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?

” তোরা কথা বল।আমি চা নিয়ে আসি” বলেই রাবেয়া চৌধুরী চা বানাতে চলে গেলেন।

তীব্র-হুম ভালো।তো এবার ক’দিনের ছুটি পেয়েছিস?

– পুরো এক মাস,একা বসে বসে বোর হচ্ছিলাম।তাই চলে আসলাম

– খুব ভালো করেছিস।

– ভাইয়া,নন্দিতা ভাবী কোথায়?

– ও একটু কাজে বাবার বাড়িতে গেছে।চলে আসবে কাল পরশু ( মিথ্যা বললো)

– চলো ছাঁদে যাই,এখানে ভালো লাগছে না বসে থাকতে।তোমাদের ছাঁদের পাশে ওই ছাতিম গাছটা আছে না?

– হুম আছে।ওই গাছটার কথা এখনো মনে আছে তোর?

– থাকবে না মানে,ওখানেই তো আমার… বাদ দাও চলো ঘুরে আসি।

– আঙ্কেলের সাথে একটু কথা বলতে দে

– বাবা এখন কথা বলবে না,গভীর মনোযোগে বই পড়ছে।ডিস্টার্ব করা নিষেধ।

আরোহী তীব্রর হাত ধরে টেনে ছাঁদে যেতে লাগলো।আরোহীর বাবা আহনাফ চৌধুরী বইয়ে মুখ গুজেই রইলেন।তিনি প্রচুর বই পড়েন।রিটায়ারের পর বই পড়া তার পেশা হয়ে দাড়িয়েছে।খাওয়া,ঘুম ও প্রকৃতির সাড়া দেওয়া ছাড়া বাকিটুকু সময় বই পড়ে কেটে দেন।

দুপুরের কড়া রোধ ভেঙে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে।আশেপাশে ঠান্ডা বাতাসে ছেয়ে গেলো।আরোহী ছাঁদের কার্নিশ ধরে দারিয়ে আছে।তীব্র পকেটে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে ছাতিম গাছটার দিকে।আরোহী বলে উঠলো

– তীব্র ভইয়া

– হুম

– মনে আছে এই গাছটার কথা?

– এসব কথা এখন তুলছিস কেন৷আচ্ছা তোর পড়াশোনা কেমন চলছে

– মোটামুটি চলছে

তখনি পেছন থেকে ” আরোহী, কখন আসলে তুমি” বলতে বলতে সামনে আসলো আরহা ভাবী।আরোহী জরিয়ে ধরে বললো

– এইতে ভাবী এখনি আসলাম।তুমি তো এখন আরো সুন্দরী হয়ে গেছো ভাবী,

– হাহাহা,দেখতে হবে না কার ভাবী?

নিচ থেকে রাবেয়া চৌধুরী আরোহীকে ডাকলেন।আরোহীর ইচ্ছে করছে না যেতে।তবুও বাধ্য হয়ে নিচে গেলো।আরহা তীব্রর একদম পাশাপাশি দাড়ালো।তাচ্ছিল্যর স্বরে বললো

– কি ছোট দেবর জি, বউকে আনোনি এখনো?

(তীব্র চুপ করে রইলো)

– আহারে,, তোমাকে দেখে না আমার খুব কষ্ট হয় জানো? ভালোবাসার মানুষকে তুমি কখনো ধরে রাখতে পারলে না।

তীব্র পাশ কাটিয়ে নিচে চলে গেলো।বাইকের চাবিটা নিয়ে রওনা হলো নন্দিতার রাগ ভাঙ্গানোর একটা চেষ্টা করতে। রাগ হলে সেটা ভাঙ্গা যায়,ভুল ধারনার শেখর যে অনেক গভীর, সেটা কি এতো সহজে ভাঙতে পারবে তীব্র?

দৃশ্যপট-২

দরজায় মিহি টোকা পড়ছে।আসমা বেগম দরজা খুলতেই নন্দিতাকে দেখে তার আনন্দের সীমা রইলো না।নিজের মেয়েকে অনেকদিন পর দেখে জরিয়ে ধরলেন।নন্দিতাও নিজের কষ্টকে কিছুটা আড়াল করে মায়ের সাথে আহ্লাদী হয়ে যায়।

– কিরে মা,হঠাৎ করে? জামাই কোথায়?

– ও আসেনি

– আসেনি মানে? কেনো?তুই একাই এসেছিস নাকি ?

– হুম

– আয় ভেতরে আয়।শরীরের কি অবস্থা করেছিস।খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস বোধহয়।হাত,মুখ ধুয়ে আয়,আজ আমি খাইয়ে দিবো।

নন্দিতা কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসতেই আসমা বেগম হাতে প্লেটে খাবার সাজিয়ে উপস্থিত হলেন।কাছে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন

– কতদিন হলো খাইয়ে দিই না।নন্দু,তোর ঠোঁট ফুলা কেন? ব্যাথা পেয়েছিস?

– ও কিছু না মা।এমনিই একটু লেগেছে।তুমি খাইয়ে দাও তো।তোমার হাতে অনেকদিন খাইনা

আসমা বেগম যত্ন করে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।নন্দিতা এই স্নেহে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।আসমা বেগম নন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর নন্দিতা নিজেকে সামলে নেয়।আসমা বেগম মিহি স্বরে বলেন

– তোকে কি ও বাড়িতে কষ্ট দেয় নন্দু?

-(নন্দিতা নিরব)

– কি হলো বল? ওরা কি তোকে কষ্ট দেয়? হঠাৎ এখানে আসলি,সাথে জামাই এলো না।ঘটনাটা কি?বলবি?

– বাবা কোথায় মা? (বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে)

– বাজারে গেছে।এখনি চলে আসবে।

বলতে বলতেই রহিম মিয়া খরচের ব্যাগটা রেখে ডাকছে,”আসমা,আসমা”।
আসমা বেগম বললেন ” ঘরে এসো গো,দেখো কে এসেছে “।” কে এসছে ” বলতে বলতে রহিম মিয়া ঘরে ঢুকতেই নন্দিতাকে দেখে চকচক চোখে বললেন

– নন্দু মা,কখন এসেছিস মা?

– এই তো এখনি আসলাম বাবা,তুমি তে ঘেমে গেছো।এখানে বসো

– জামাই আসেনি? ( বিছানায় বসতে বসতে বললো)

– না ( নন্দিতা নিরব কন্ঠে বললো)

নন্দিতা শুয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলছে,।ফোনে রিং বেজেই চলেছে।নন্দিতা ফোন তুলছে না।ফোনের স্ক্রিনে তীব্র নামটা বারবার জ্বলে উঠছে।বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে গেলো নন্দিতা।বেলকনি দারিয়ে ফোনটা রিসিভ করে নিচে রাস্তায় তাকালো।দেখলো তীব্র রাস্তায় পাশে চায়ের দোকানটায় বসে চা খাচ্ছে আর ফোন কানে রেখে বেলকনির দিকে তাকিয়ে আছে।নন্দিতা ফোন রিসিভ করে রাগি কন্ঠে বললো

– কি সমস্যা কি?ফোন দিচ্ছো কেন?

– আমার বউকে ফোন দিয়েছি,এতে সমস্যা কি?

– লজ্জা করছে না এসব বলতে?

– নন্দিতা তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না।আমায় বলতে দিলে তবেই তো বলবো তাই না?

– আমার শোনার কিছু নেই।কখনো ফোন করবা না আর,,নেভার এভার

– এই এই ফোন কাটবা না বলে দিলাম,নইলে কিন্তু

– নইলে কি?

– নইলে আমি কি করবো তাতো জানোই,এখান থেকে এসোজা একটা গাড়ির সামনে দারিয়ে যাবো

– এসব বলে আর আমায় প্রভাবিত করতে পারবে না।সব অধিকার শেষ হওয়ার দিন এসে গেছে তীব্র ।সব কিছু থেকে আপনাকে মুক্তি দিবো আমি।

বলেই ফোনটা কেটে দিলো নন্দিতা।কেটে দিয়ে ঘরে আসলো।যতবার নন্দিতা রাগ করে বাবার বাড়িতে এসেছে ততবার ই তীব্র এসে তার রাগ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে গেছে।কিন্তু এবারেরটা যে রাগ না।এটা সন্দেহ।সন্দেহ সহজে যায় না।থেকে যায়,একটু একটু করে ভাবায়,কষ্ট দেয়,শেষ করে মনের সকল অনুভূতি।একটু পর কিছু লোকের চেঁচামেচি অস্ফুট শব্দ তার কানে এলো।মনে মনে ভাবলো, তীব্র আবার কোনো পাগলামি করলো না তো? বিছানা থেকে ধরপর করে উঠে ব্যালকোনিতে দারাতেই দেখলো নিচে কিছু মানুষ গোল হয়ে দারিয়ে আছে।রাস্তার পাশ দিয়ে লাল তরল বেয়ে যাচ্ছে। রক্ত নয় তো? তীব্রর কিছু হয়ে গেলো না তো? মুহুর্তেই বুকটা ধক করে উঠলো।চারিদিকে শূন্যতা অনুভব করলো।দৌড়ে নিচে নামলো।যে দোকানটায় তীব্র বসে চা খাচ্ছিলো সেখানে যেতেই, সেখানে থাকা লোকগুলি এক এক করে সরে দারালো।নন্দিতা কাছে যেতেই দেখলো তীব্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে।মাথার পাশ দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে।নন্দিতার সারা শরীর হিম হয়ে আসলো।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here