#চাদর_জড়ানো_চিরকুট
#পর্বঃ- ০৬,৭
৬
লোকটা মোবাইলে কথা বলা বন্ধ করার পর হঠাৎ করে সব চুপচাপ হয়ে গেল। লতা কি করবে বুঝতে পারছে না, কিন্তু চোখ দুটো ঠিকই অনবরত পানি ঝড়াচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানিক পরে পাশের ঘরে কথা শুনতে পেল লতা৷
– ভাই আপনি এখানে?
– লতা চৌধুরী কোথায়?
– পাশের ঘরে আছে, অজ্ঞান।
– রুমের দরজা খুলে দাও। কিন্তু তাহলে তো সে নিশ্চিত হয়ে যাবে যে আপনি তাকে কিডন্যাপ করেছেন।
– কিছু করার নেই, কারণ লতার বাবা চট্টগ্রাম পুলিশের কাছে জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ এখন লতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাই এখন লুকোচুরি করে লাভ নেই। সরাসরি কাজ করতে হবে।
– রবিউল ভাই।
– হ্যাঁ বলো। কিন্তু এমন কিছু বলবা না যেটা এখন রাখতে পারবো না।
রবিউল! লতা রবিউলের কণ্ঠ শুনে চিনতে পারল কিন্তু কি লাভ চিনতে পেরে? সে কি কিছু করতে পারবে এখন?
★★
কৌতূহল নিয়ে লতার নাম্বারে কল দিলেন সাজু, কিন্তু নাম্বার বন্ধ। একটু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করার স্থান নেই। মোবাইল রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। শরীরে তাপমাত্রা ১০২°। এটা সাজুর শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা তাই এসব নিয়ে বিচলিত নয় সাজু ভাই।
আজকের সম্পর্ক ঘটনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। রাতে আবার যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখন রাত তিনটার মতো বেজে গেছে। সাজু মোবাইল বের করে ডাটা চালু করলো। একটা অপরিচিত এড্রেস থেকে মেইল এসেছে, অনেক লম্বা একটা মেইল।
সবার নিচে লেখা আছে, ” আপনি সাবরিনার কাছ থেকে লতা চৌধুরীর স্বামীকে হত্যার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আপনার ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলাম, আশা করি আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আর লতা চৌধুরী এখন আমার কাছে। ”
সাজু এবার সম্পুর্ন মেইলটা পড়তে শুরু করলো। যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে।
সাজু ভাই,
কিছু মাস আগের কথা। আমি একটা খুন করার জন্য প্রায় তিনমাস গার্মেন্টসে চাকরি করি। লোকটা অফিসে একটা গোপন ফ্ল্যাট তৈরি করে রেখেছিল। অফিস থেকে কখনো বের হতো না। তাই তাকে খুন করার জন্য গার্মেন্টসে চাকরি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
ভালো আয়রন করতে পারতাম। গার্মেন্টসে আমি আয়রনম্যান হিসেবে চাকরি নিলাম। সভ্য মানুষ কি বলে আমি জানি না, কিন্তু অফিসে সবাই তো আয়রনম্যান বলে ডাকতো।
কারখানার কাছেই একটা কলোনির মধ্যে একটা রুম ভাড়া নিলাম। কারো কাছে যেন সন্দেহের সৃষ্টি না হয় তাই একদম সহজ স্বাভাবিক জীবন। আর সেই কলোনির মধ্যে পরিচয় হয়েছে আমার এই অসুস্থ বোর তিথিদের সঙ্গে।
“তিথিদের” বললাম কারণ তারা দুই বোন ছিল। আপন নয় চাচাতো বোন। তিথির চাচাতো বোন ছিল বিথি। তিথির মা-বাবা মারা যাবার পর থেকে সে বিথিদের সঙ্গে থাকতো। বিথি বয়সে অনেক বড় ছিল।
তিথি আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতো। পাশাপাশি দুটো রুমের মধ্যে আমরা থাকতাম। তিথি বিথি আর বিথির মা ও ছোটভাই, চারজন একটা রুমে থাকতো। বিথির বাবা থাকতো মিরপুরে।
আমি তিনবেলা হোটেলে খাবার খেতাম। কিন্তু প্রায় সময় তিথি আমাকে খেতে দিতো। বিথির আচরণ ছিল প্রেমভাবাপন্ন, তার সকল চালচলন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। কিন্তু বিথির সঙ্গে আমার কথা হতো না। তিথি বিথি আর বিথির মা একই গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। আমি ছিলাম অন্য গার্মেন্টসে।
একদিন বিকেলের ঘটনা।
অফিসে নতুন কাজ শুরু হয়েছে তাই সেদিন ওভারটাইম না করেই পাঁচটার দিকে অফিস ছুটি হয়ে গেল। আমি প্রায় প্রতিদিনই অফিস ছুটির অনেক পরে বের হতাম। কেন দেরি করতাম সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, বুঝবেন কারণ আপনি বুদ্ধিমান মানুষ।
পাঁচটার দিকে কলোনিতে ফিরে দেখলাম বাড়ির মালিকের স্ত্রী আরো ৩/৪ জন মহিলা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে একটা মেয়েও আছে। মেয়েটারও পাঁচটার দিকে ছুটি হয়েছে তাই সে এসে মাত্র দাড়িয়েছে। আমাকে দেখে বাড়ির মালিকের স্ত্রী বললো,
– কি ব্যাপার বাবা, এতো তাড়াতাড়ি আজকে ছুটি হয়ে গেল?
– হ্যাঁ আন্টি, লাইনে নতুন কাজ শুরু হয়েছে তাই আগে আগে ছুটি দিয়ে দিল।
– তুমি এক কাজ করবা, ভালো অপারেটর দেখে তার সঙ্গে খাতির জমাবে। তারপর তার মাধ্যমে মেশিন চালানো শিখবে। অপারেটর হতে পারলে তো অনেক বেতন পাওয়া যায়।
– হ্যাঁ আন্টি সেটাই করবো।
সেই মুহূর্তে ওই মেয়েটা বলে উঠলো,
– আমাদের অফিসে হলে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে শিখিয়ে দিতে পারতাম।
ঠিক এমন সময় বিথি অফিস থেকে এসেছে। সে পিছনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে আমি জানতাম না। আমি শুধু দেখলাম রাক্ষসীর মতো আগুন জ্বলে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে গেল কিন্তু তার সেই চোখের দৃষ্টি আমি আন্দাজ করতে পারি। তার চোখের ভাসা বলে দিচ্ছিল,
” রুমের মধ্যে আসো, তোমার মেশিন চালানো আমি ভালো করে শেখাবো। ”
হাহাহা।
সাজু ভাই বিরক্ত হচ্ছেন না তো? খুন করতে গিয়ে একটা রোমান্টিক ঘটনার জন্ম হয়ে গেল। তবে সবটা বলছি কারণ নাহলে আপনি বুঝতে পারবেন না খুন কেন করলাম।
আমি আস্তে করে রুমের সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি দুটো রুমের মাঝখানে কোমড়ে হাত দিয়ে বিথি দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে আমার রুমের দরজা খুলতে গিয়ে দেখি সেখানে দুটো তালা ঝুলছে। একটা তো আমি সকালে লাগিয়ে গেছিলাম কিন্তু আরেকটা তালা কে দিল?
আমি বিথির দিকে তাকালাম। সে বললো,
– এই রুমে আসার দরকার নেই। যার কাছে গিয়ে মেশিন চালানো শিখবেন তার কাছে চলে যান। অফিসে তো সম্ভব না তাই বাসায় বসে নাহয় শিখে নিবেন।
আমি সামান্য হাসলাম। আপনার আমার বয়স তো প্রায় সমান, তাই না সাজু ভাই? তবে বিথিে বয়স তখন বাইশ বছর রানিং। বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেই স্বামী মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে। তিথির বয়স আনুমানিক ১৬/১৭ হবে, তবে শরীরের গঠন ভালো ছিল তাই চাকরি করতে পারতো।
যাইহোক। বিথি দেখতে অনেকটা আপনার সেই রামিশার মতো। তবে রামিশা আপুর মতো ভাগ্য তো আর সবার হয় না, তাই না? তার ভাগ্য ভালো সে পেয়েছে আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ। আর বিথির ভাগ্য খারাপ তাই সে জড়িয়ে গেছে আমার মতো একটা খুনির সঙ্গে।
সেদিন আমি হাসলাম তাই বিথি বললো,
– সারাদিন তো গার্মেন্টসে মেয়েদের মধ্যে থাকেন তাহলে বাসায় ফিরে কি না বললে হয় না?
– বললাম, কেন কি হয়েছে? তার সঙ্গে তো নিজ থেকে কথা বলতে যাইনি। পরিস্থিতিতে পরে কথা হয়ে গেছে, আমি তো উত্তর দেইনি।
– এতটুকুও বলবেন না। সোজা রুমের মধ্যে এসে ঢুকবেন আর বের হবেন না।
– ঠিক আছে তাই হবে।
আরেকদিনের ঘটনা।
পরদিন শুক্রবার তাই আমি আমার ল্যাপটপ বের করে রাত দুটোর দিকে নাটক দেখছি। বাসার কেউ জানতো না আমার ল্যাপটপ আছে। তো ল্যাপটপে একটা ইংলিশ মুভি দেখছিলাম, তারপর প্রকৃতির বেগ আসে। আমি সেভাবেই ল্যাপটপ রেখে দরজা খুলে বের হয়ে ওয়াশরুমে গেলাম।
কিন্তু সেই মুহূর্তে বিথি বের হয়েছে তার রুম থেকে। আমার দরজা সামান্য খোলা দেখে সে উঁকি দেয় রুমের মধ্যে। আর দেখতে পায় ল্যাপটপে নায়ক নায়িকার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। ইংলিশ মুভিতে এসব বিষয় একটু স্বাভাবিক ভাবে তুলে ধরে তাই অনেকে সেটাকে প/র্ণ মনে করতে পারে।
বিথি এক পলক দেখে আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি সেই মুহূর্তে ওয়াশরুম থেকে এসে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে।
বললো,
– ছিহ রাত জেগে এসব দেখতে লজ্জা করে না?
আমি থ হয়ে গেলাম, বিথি দরজা বন্ধ করে তাদের রুমের মধ্যে চলে গেল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হচ্ছিল। সকাল দশটার দিকে তিথি আমাকে ডাকাডাকি করতে লাগলো। বিথি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– সারারাত তোর ভাই যা দেখেছেন তাতে করে আজ সারাদিন ঘুম ভাঙ্গবে না। ডাকিস না।
আমি চুপচাপ সব শুনলাম। মনে মনে হাসলাম। এইতো এরকমই হাসিখুশি ভাবে সহজসরল ওই তিথি বিথির সঙ্গে পরিচয়। তিথি বোন হলেও বিথি বউ হতে চাইতো৷
দাদাজানের কথা মনে আছে সাজু ভাই?
তিনি আমাকে মারার জন্য তৎপর হয়ে গেছেন। আমার পিছনে লোক লাগানো ছিল আমি জানি। কিন্তু সেই কারণে তিথি বিথির ক্ষতি হবে আমি কোনদিনই ভাবিনি।
দাদাজান আমার সন্ধান পেয়ে গেল। ফিরোজসহ আরো তিনজনকে পাঠানো হলো আমাকে শেষ করার জন্য। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো না খারাপ জানি না তবে সেদিন আমি অফিস থেকে আর বের হলাম না। কারণ যাকে খুন করার জন্য আমি গার্মেন্টসে চাকরি নিছি তাকে সেদিনই শেষ করার টার্গেট ছিল। তাছাড়া ওইদিন রাত একটা পর্যন্ত ডিউটি করার কথা ছিল আমার। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সেদিন সারাদিন ধরে অনবরত বৃষ্টি পড়ছিল। চারিদিকে আবহাওয়া একদম ঠান্ডা।
ফিরোজ আরও তিনজনকে নিয়ে আমাদের সেই কলোনির মধ্যে গেল। আমাকে না পেয়ে পাশের রুমে তিথি বিথির উপর নজর দেয়। নেশাখোর ওই পিশাচ গুলো সারারাত তিথি বিথির সঙ্গে…..
নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, বুঝবেন কারণ আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। [ বাক্যটা দ্বিতীয়বার বললাম কারণ আপনি সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান। ]
বিথির মা আর আর ছোটভাইকে হাতপা বেঁধে অস্ত্র ধরে জিম্মি করে রাখে। আর আমার রুমের তালা ভেঙ্গে সেই রুমে ওদের দুজনকে নিয়ে ওরা নিজেদের ইচ্ছে পূরণ করে।
টিনের চালের সেই কলোনি। আলাদা আলাদা সব রুম। গ্রাম অঞ্চলের সেই স্থানে ঝড়বৃষ্টির সেই রাতে আশেপাশের কেউ জানতেই পারলো না। সারাদিন গার্মেন্টস করে সবাই বাসায় ফিরে ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনি তিথি আর বিথি।
আমি সেই রাতে গার্মেন্টসের খুনটা করি৷ এমন ভাবে করেছি যে হার্ট অ্যাটাক বলে সবাই ধারণা করে নিয়েছিল। মনের মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি ছিল কিন্তু বাসায় ফিরে আমার সব আনন্দ হারিয়ে যায়। শেষ রাতের দিকে ফিরজরা যখন চলে গেল তখনই ওরা দুজন মিলে ওই বিষাক্ত কেমিক্যাল বিষ খেয়ে ফেলে।
আমি জানি ওগুলো কোথায় ছিল। হাসপাতালে বিথি মারা গেল, তিথির চিকিৎসা চলে ঠিকই কিন্তু পেটে পচন ধরতে শুরু করে। আমি খুঁজে বের করলাম কে করেছে এই কাজ?
কারণ আমাকে মারার জন্য গেছে সেটা তো বুঝতে পেরেছিলাম সাজু ভাই। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে জানতে পারি ফিরোজদের কথা। তারপর থেকে ফিরোজকে নিয়ে পরিকল্পনা। বাকি ঘটনা আপনি অনেক কিছু জানেন।
আপনি সাবরিনার কাছ থেকে লতা চৌধুরীর স্বামীকে হত্যার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আপনার ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলাম, আশা করি আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আর লতা চৌধুরী এখন আমার কাছে।
এটা একটা দোকান থেকে মেইল করেছি তাই এটা খুঁজে সময় নষ্ট করবেন না। আমার বেশ কিছু টাকার দরকার সাজু ভাই। লতাকে ব্যবহার করে সেই টাকা আমার দরকার তাই এছাড়া আর উপায় নেই।
ইতি
রবিউল ইসলাম।
চলবে…
???????
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।
#চাদর_জড়ানো_চিরকুট।
#পর্বঃ- ০৭
রবিউল দরজা খুলে লতার রুমে প্রবেশ করলো। হাত-পা বেঁধে রাখা লতার চেহারা কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রবিউলের প্রথমে কিছুটা মায়া লাগে, তারপর সে লতার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
লতা বললো,
– আপনার কি লজ্জা করে না?
রবিউল স্বাভাবিক কণ্ঠে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– কিসের জন্য?
লতা একদলা থুতু ফেলে বললো,
– কি দোষ করেছি আমি? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। আপনি আমার স্বামীকে খুন করেছেন। আমার বাবার নামে মিথ্যা কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন।
– আর?
লতা যেন আরো অসহায় হয়ে গেল। যার স্বামী মারা গেছে দুপুরের দিকে, স্বামীর লাশ এখনো হাসপাতালে পড়ে আছে। যে নিজে এখন বাঁচবে কি মারা যাবে তার ঠিক নেই, সে আর কি বা বলতে পারে।
তবুও কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
– আপনি জানেন আমার গর্ভে সন্তান আছে। তবু কেন এমন পশুর মতো ব্যবহার করছেন? আমি আপনার যতো টাকা লাগে দেবো কিন্তু দয়া করে আমাকে মুক্তি দেন৷
– আপনার বাবার সঙ্গে আমার ছোট্ট একটা পুরনো হিসাব বাকি আছে। তাই আপনার মুক্তির বিনিময়ে টাকা নিয়ে তাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। সে এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।
– আমি আমার স্বামীর লাশ দেখতে যাবো।
– স্যরি ম্যাডাম, সেটা অসম্ভব।
– আপনি আপনার এক ছোটবোনের মিথ্যা অসুস্থ হবার গল্প বলে আমাকে ইমোশনাল করেছিলেন। আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম বলে আজ আমার এই পরিণতি।
– এটা ঠিক যে আমরা পৃথিবীতে বিশ্বাস করেই সবচেয়ে বেশি হেরে যাই। কিন্তু এটাও সত্যি যে বিশ্বাস ছাড়া কিন্তু অনেক কিছু অর্জন করা যায় না ম্যাডাম।
– আপনার কতো টাকা দরকার?
– আপাতত দশ কোটি টাকা হলেই চলবে।
– আমার বাবাকে দরকার নেই। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন, আমি ঢাকায় গিয়ে আপনার সম্পুর্ণ টাকা পরিশোধ করে দেবো। বিশ্বাস রাখতে পারেন কারণ আমি বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।
– পাগল নাকি আমি? আপনি তো নিজেই আমার কাছে বলেছিলেন যে আমাকে আপনি কোনদিনই ছাড়বেন না। ফিরোজকে হত্যা করার প্রতিশোধ আপনি যেভাবেই হোক নিবেন।
– সেটা রাগের মধ্যে বলেছি। বিশ্বাস করুন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি ফিরোজের কাছে যাবো।
– ফিরোজ সাহেব খুব জঘন্য মানুষ, তার লাশের সামনে গিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই।
– আপনিও তো জঘন্য মানুষ।
– হ্যাঁ আমিও জঘন্য। তো কি হয়েছে?
লতা তার বাধাঁ হাত দুটি জড়ো করে বললো,
– প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। সারাজীবন আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
– আপনার স্বামীকে খারাপ বলার কারণ জানতে চান আপনি?
– আচ্ছা বলেন। কিন্তু দয়া করে মিথ্যা বলবেন না, কারণ আপনি অনেক মিথ্যা বলেন।
– না মিথ্যা বলবো না। একই ঘটনা আমি সাজু ভাইকেও বলেছি। বলিনি, তবে মেইল করে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার মনে হয় সে এখন ঘুমিয়ে গেছে। নাহলে এতক্ষণে মেইল পড়ে তিনি নিশ্চয়ই কিছু করতেন।
– বলেন কেন মেরেছেন ফিরোজকে?
রবিউল আস্তে আস্তে সাজুর কাছে মেইলে যেটা বলেছে সেটা সম্পুর্ণ লতার কাছেও বললো। বলার সময় মিজান তার দিকে বারবার তাকিয়ে রইল। রবিউল সেদিকে নজর না দিয়ে লতার দিকে তাকিয়ে আছে।
সব শুনে লতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে আমার স্বামী ফিরোজই সেদিন গিয়েছিল।
– কলোনির মধ্যে থাকার সময় আমার দাদাজান যাকে আমার পিছনে লাগিয়েছিল তাকে আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। কিন্তু তাকে বেশি গুরুত্ব দেইনি কারণ নিজে সতর্ক হয়ে চলতাম। আর গার্মেন্টসের লোকটার সঙ্গে দাদাজানের কোনো সম্পর্ক নেই।
সেই রাতের ঘটনার পরে আমি ওই নজরদারি করা ছেলেটাকে খুঁজে বের করলাম। জীবন বাঁচাতে গিয়ে সে চারজনের নাম বলে। কারণ সেই রাতে ফিরোজ মিজান আর বাকিদের ওই লোকটাই কলোনিতে নিয়ে যায়।
– ফিরোজ সম্পর্কে এসব কথা আমি বিশ্বাস করি না রাফসান মাহমুদ।
– রাফসান মাহমুদ নামটা কি আপনার কাছে ভালো লাগে নাকি? নাহলে আমার আসল নামটা জানার পরও আপনি আমার বানিয়ে বলা নামটা ডাকলেন।
– তিথি কেমন আছে?
– সন্ধ্যা বেলা মারা গেছে।
– কিহহ।
– হ্যাঁ সেজন্য তো আমি আর ঢাকায় ফেরত যাইনি। নাহলে তো অবশ্যই যেতাম। কিন্তু মৃত্যুর পরে চিরনিদ্রায় ঘুমন্ত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করবে না আমার। সবসময় প্রতি মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি।
– তাহলে আপনার কেন অন্যে প্রিয় মানুষকে খুন করেন? আপনজন হারানোর বেদনা আপনি তো ভালো করে জানেন তাই না?
– আমি নিরপরাধ কাউকে মারি না।
– তাহলে আমি?
– আপনাকে মারবো না, টাকা পেলেই আপনাকে আমি ছেড়ে দেবো।
– বললাম তো আপনি টাকা পাবেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে আপনার বাবা টাকা নিয়ে আসুক তাহলে আপনি মুক্ত।
– আপনি যে বলেছিলেন তিন কোটি টাকার জন্য আমার স্বামী আমাকে খুন করতে চায়। তারপর আপনাকেও আমার বাবা খুনের জন্য কন্ট্রাক্ট করতে চেয়েছে। সবকিছু মিথ্যা তাই না?
– হা সবকিছুই মিথ্যা। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আপনার?
– স্টেশনের বাইরে কি আপনিই আমাকে গুলি করেছেন?
– হ্যাঁ আমিই গুলি করেছি। ভেবেছিলাম নিজেকে আড়াল করে কাজ করতে কিন্তু মুখোশ যখন খুলে গেছে তখন আর লুকিয়ে কি হবে?
– ছিহহহ,
আবারও লতার কান্না।
কোনকিছু না বলে রবিউল রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় লতার পায়ের বাঁধন খুলে দিল।
★★★
এসআই নিজাম উদ্দিন এখন চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এর কাছেই বসে আছে। সাজুর কাছ থেকে সন্ধ্যা বেলা বিদায় নিয়ে সে প্রথমে থানায় গেল। তারপর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে বসবে তার আগেই থানা থেকে কল পেল। কোনমতে খাবার খেয়ে আবারও বেরিয়ে গেল থানার উদ্দেশ্যে।
ঢাকা থেকে নাকি লতার বাবা রিপোর্ট করেছে যে তার মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে। হাসপাতাল থেকে তার বন্ধুর সাথে বের হলেও তারপর থেকে আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
টাকার ক্ষমতা অনেক বেশি। নাহলে সেই ঢাকায় বসে তিনি সম্পুর্ন চট্টগ্রামের পুলিশ সজাগ করে ফেলেছেন। যেভাবেই হোক তার মেয়েকে তিনি খুঁজে বের করতে বলেছেন।
বাসা থেকে থানায় যেতে যেতে এসআই ভাবছিল যে এটা হয়তো লতার বাবার নাটক হতে পারে। কারণ সাজুর কাছ থেকে যতটুকু জেনেছে তাতে মনে হচ্ছিল লতার বাবা তার মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। এখন হয়তো নিজেই অপহরণ করে মিথ্যা নাটক করছেন।
সন্ধ্যা বেলা এসআই সাহেব সাজুে নাম্বার নিজের কাছে নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সে এখন লতার অপহরণের বিষয়টি সাজুকে জানালো না। কারণ সাজু প্রথমে ব্যাপারটা নিজের কাছে গোপন করে। তাই এসআই নিজেও ব্যাপারটা গোপন করতে চায়, হালকা প্রতিশোধ।
থানায় এসে এসআই নিজাম ভালোই ধমক হজম করলেন। তারপরই দলবল নিয়ে চলে এসেছেন চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। রবিউল নামের সেই ছেলে নাকি লতার বাবার কাছে কল করেছে। তারপর তার কাছে দশ কোটি টাকা দাবি করেছে এমনকি সেই টাকা নিয়ে আসতে হবে স্বয়ং চৌধুরী সাহেব নিজে।
স্টেশনে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেই সিসি ক্যামেরা চেক করার জন্যই স্টেশনে এসেছে তারা।
সবকিছু চেক করা হলো কিন্তু কাকে যে রবিউল বলে সন্দেহ করবে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু চারজন লোককে বেশ কিছু সময় ধরে এদিক সেদিক ঘুরতে দেখা গেছে। বারবার মোবাইলে কথা বলে তারা। এদের মধ্যে কি কেউ রবিউল হতে পারে?
এসআই মনে মনে ভাবলো এই সময় সাজু ভাই থাকলে ভালো হতো। তিনি তো রবিউলকে আগে দেখেছেন। পকেট থেকে মোবাইল বের করলো এসআই নিজাম উদ্দিন। ভিডিও ফুটেজ চেক করতে করতে রাত অনেক পেরিয়ে গেছে। প্রায় চারটা বেজে গেছে।
মোবাইল বের করে দেখেন সাজুর নাম্বার থেকে আগেই কতগুলো কল এসেছে।
সঙ্গে আছে দুটো মেসেজ।
(১) স্যার লতাকে রবিউল কিডন্যাপ করেছে। তার ক্ষতি হবার আগেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। আপনি কোথায়?
(২) মোবাইল হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কলব্যাক করবেন।
এসআই মনে মনে ভাবলো, এই লোকটা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলো নাকি? সেও জেনে গেছে। নাকি রবিউলের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। তাড়াতাড়ি সাজুর কাছে কলব্যাক করলেন,
– হ্যালো সাজু সাহেব।
– স্যার আপনি কোথায়?
– আমি তো রেলস্টেশনে, আপনি কোথায়?
– আমি হোটেল থেকে বের হলাম, আপনার কাছে কল দিলাম ধরছেন না।
– ভিডিও ফুটেজ দেখার সময় মোবাইল সাইলেন্ট করেছিলাম তাই বুঝতে পারিনি।
– লতার বাবা কিছু জানিয়েছে?
– হ্যাঁ, তিনি তো চট্টগ্রামের সব পুলিশ জাগ্রত করে ফেলেছে, ভয়াবহ অবস্থা। ওই রবিউল তো ঠাণ্ডা মাথায় বাটপারি করেছে বুঝতে পারেন কিছু?
– হা বুঝতে পারছি, আমাদের এখন লতাকে খুঁজে বের করতে হবে। রবিউলের আসল উদ্দেশ্য টাকা নয় সেটা মাথায় রাখবেন। ঢাকায় ওর পুরনো এক শত্রু ছিল, তার সঙ্গে লতার বাবার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানিনা।
– আপনি রেলস্টেশনে আসেন। আমরা চারজন লোককে সন্দেহ করছি কিন্তু এরমধ্যে রবিউল কে সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি রাস্তায় বের হয়ে দেখেন দু একটা সিএনজি পাওয়া যেতে পারে।
– ঠিক আছে কিন্তু আপনারা এতো রাতে কীভাবে ফুটেজ চেক করলেন? কেউ ছিল সেখানে?
– ছিল না ভাই, ছিল না। কিন্তু বললাম যে লতা চৌধুরীর বাবা সব তোলপাড় করছেন। তাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাকে কাকে যেন কল দিয়ে ব্যবস্থা করে দিলেন৷
– আচ্ছা আমি আসছি।
★★★
রবিউল আসার আগে দুটো বিদেশি মদের বোতল নিয়ে এসেছিল। লতার পাশের রুমে বসে বসে এখন সবাই মদ খাবার আয়োজন করছে। মিজান মুখ কালো করে সারাক্ষণ বসে আছে। তার ধারণা রবিউলের কথামতো কাজ করলেও রবিউল তার বোনের জন্য ঠিকই কিছু একটা করবে।
রবিউল বললো,
– খাও মিজান, চিন্তা করো না।
– ভাই আমি আপনার কাছে বারবার কিন্তু ক্ষমা চেয়েছি। আমি ফিরোজ ভাইয়ের সঙ্গে গেছিলাম।
– আচ্ছা।
– আমার মায়ের কোনো ক্ষতি করবেন না তো?
– না করবো না। একটা কথা বলো তো, স্টেশনে বসে তুমি বেশ কয়েকবার একটা নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলছো সেটা কার নাম্বার?
– আমার একটা বন্ধু।
– বন্ধুর সাথে এতো কিসের কথা? নাকি আমার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল তখন।
– কিযে বলেন ভাই।
মিজান চমকে উঠল। তার সঙ্গের বাকি তিনজন রক্ত বমি করতে শুরু করেছে। মিজান রবিউলের দিকে তাকিয়ে দেখে তার ঠোঁটের কোনে হাসি।
রবিউল বললো,
– আমার বোন যে কেমিক্যাল খেয়ে মারা গেছে সেই কেমিক্যাল মদের বোতলে দিছিলাম। এরা সবাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে মারা যাবে, কারণ আমি এখানে দুটো কেমিক্যাল ব্যবহার করেছি।
মিজানের গলা শুকিয়ে গেছে। তার এখনো কিছু হয়নি। সে বললো,
– ভাই আমাদের অপরাধ?
– আমি বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখি না। তুমি কদিন আগে দাদাজানের হয়ে কাজ করতে, এখন করো আমার কাজ।
– সেটা কি আমার দোষ?
– না তোমার অপরাধ হচ্ছে আমার বোনের মৃত্যুর দায়ে ফিরোজের সঙ্গী তুমিও ছিলে৷ এটাই তোমার জন্য মৃত্যুর বার্তা নিয়ে এসেছে।
চোখের সামনে তিনজন কাতরাতে কাতরাতে শেষ হয়ে গেল। সাজু তার পকেট থেকে পিস্তল বের করে মিজানের কপালে ঠেকালো। মিজান নিজের কোমড়ে হাত দিতে গিয়ে সেখানে পিস্তল পেল না। রবিউল তার সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল দিয়ে দুটো গুলি করলো। একটা ছোট্ট চিৎকার দিয়ে মিজান লুটিয়ে পড়লো।
লতা চিৎকার শুনে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো। রবিউল দরজা খুলে দিলে লতা পরপর চারটা লাশ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কঠোর ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থাকে।
– ওদের কেন মারলেন?
– টাকার ভাগ দিতে হবে না তাই।
লতা কাঁদতে লাগলো। রবিউল তাকে বললো,
– আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে যেতে হবে। আপনার বাবার কারণে এ শহরে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। শহর থেকে বের হবার আগে আপনার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করতে হবে।
লতা আৎকে উঠলো।
– আমার সন্তানের দিকে নজর দিচ্ছেন কেন?
– কারণ এটা ফিরোজের রক্ত, আর ফিরোজের সন্তান পৃথিবীতে আসুক সেটা আমি চাই না।
চলবে…
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।