#চাদর_জড়ানো_চিরকুট
#পর্বঃ- ১৯,২০
১৯
লোকটার কথা শুনে সাজুর বিশ্বাস হলো না। সাজু তখন হাসানকে বললো,
– আপনি পুলিশকে খবর দেন।
– হাসান বললো, এখানেই আসতে বলবো?
– হ্যাঁ বলেন।
হাসান সাহেব ব্যাকআপে থাকা পুলিশের কাছে কল দিয়ে মায়াজালের সামনে আসতে বললেন। কিন্তু এখন আপাতত কি করবেন সেটাই বুঝতে পারছে না। লোকটাকে আটক করে একজন যদি বসে থাকে তাহলে আরেকজন একা একা সামনে যেতে হবে।
হাসান সাহেব ওই লোকটাকে ধরে বসে আছেন। সাজু একাই পা টিপে টিপে সামনে যেতে লাগলো। চোখ সবসময় চারিদিকে ঘুরচ্ছেন। কখন কোন যায়গা থেকে আক্রমণ করে বলা মুশকিল।
সামনে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সাজু ভাই সরাসরি ভিআইপি রুমের দিকে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো ভিতরে কেউ আছে কিনা। পাশাপাশি চারটা রুম, এসবের মধ্যে কোন রুমের মধ্যে আছে বোঝা যাচ্ছে না।
ওই লোকটার কাছ থেকে জানা গেছে আরও দুজন নাকি পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তারা কোথায়?
সাজু নিজের মনের উত্তর পেয়ে গেল। মাঝখানে যে রুমটা আছে সেখান থেকে বের হচ্ছে একজন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে কাউকে কিছু বলে দিচ্ছে মনে হয়। গেইটের বাহিরে গাড়ির শব্দ হচ্ছে, মনে হয় পুলিশ এসে গেছে। সাজু আরেকটু সময় অপেক্ষা করবে কিনা সেটা সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটু থামলো।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সাজু নিজে কাউকে গুলি করতে পারবে না। যদিও হাসান সাহেব তাকে বলেছেন যে যদি গুলি করে তাহলে তিনি নিজে করেছেন বলে চালিয়ে দিবেন।
যে লোকটা রুম থেকে বের হয়েছিল সে আবার দ্রুত রুমের সামনে এলো। পুলিশের আগমন দেখে নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছে তারা।
পুলিশ চলে এসেছে। তাদের সঙ্গে হাসান সাহেব আছে। সাজু বললো,
– ওই রুমের মধ্যে দুজন আছে।
সবাই সতর্কতার সঙ্গে রুমের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিল। বৃদ্ধ এসিস্টেন্ট আব্দুর রাজ্জাক বসে আছে বিছানায়। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরো একটা লোক,
বৃদ্ধ বললো,
– কী ব্যাপার আপনারা?
– হাসান বললো, আপনাদের এখানে আমরা সার্চ করতে এসেছি। লতা চৌধুরী কোথায়?
– লতা তো ঢাকায়, সে এখানে আসবে কীভাবে?
– মিথ্যা কথা বলবেন না, আমরা চারিদিকে খুঁজে দেখতে চাই।
– ঠিক আছে দেখুন, সমস্যা নেই তো।
সবগুলো রুম খুঁজে কোথাও কাউকে পাওয়া গেল না। সাজুর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যি সত্যি লতাকে নিয়ে চলে গেছে।
একদম শেষের রুমের মধ্যে গিয়ে সাজুর একটু সন্দেহ হলো। পা দিয়ে বারবার টাইলসের উপর আঘাত করলেন। তারপর দ্রুত আব্দুর রাজ্জাকের কাছে এসে বললো,
– নিচে যে রুম আছে তার দরজা কোথায়?
বৃদ্ধ যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন,
– কিসের রুম?
সাজু এই প্রথম বয়স্ক কোনো ব্যক্তির গায়ে আঘাত করলো। একটা চড় মেরে বললেন,
– শেষের রুমের নিচে অবশ্যই গোপন ঘর আছে সেই ঘরের সিড়ি কোনদিকে তাড়াতাড়ি বল।
বৃদ্ধ চুপ করে রইল। এবার হাসান সাহেব নিজেও বৃদ্ধের জামার কলার চেপে বললেন,
– মাতলামি করো ঠিক আছে, কিন্তু সত্যি বলতে সমস্যা কি? আমরা আজকে শিকড় উপড়ে ফেলে তারপর যাবো।
অসহায় বৃদ্ধ তখন তাদের সঙ্গে গেল। একটু অদুরে রান্না ঘরের পিছনে একটা স্থান দেখিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। দুজন পুলিশ তখন সেই স্থান থেকে আবরণ সরিয়ে একটা দরজার মতো আবিষ্কার করে। সাজু হাসান সাহেব ও তিনজন পুলিশ সেখানে আস্তে আস্তে প্রবেশ করে।
অন্ধকারে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের যতো গোপন কারবার সবকিছু এখানে করার জন্য নিশ্চয়ই এটা তৈরি করা হয়েছে। একটু সামনে গিয়ে তারা একটা দরজা দেখতে পেল। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একের পর এক ধাক্কা দিয়ে দরজা ভাঙ্গা হলো।
বিশাল একটা ঘর। চারিদিকে বিভিন্ন বাক্স আছে। বাক্সের মধ্যে বিভিন্ন অস্ত্র, শেষ মাথায় একটা খাট আর সেই খাটে পরে আছে অজ্ঞান লতা চৌধুরী।
কিন্তু এখানে আর কেউ নেই।
★★★
সবকিছু পুলিশের উপর ছেড়ে দিয়ে লতাকে নিয়ে রওনা দিল সাজু। পুলিশের একটা গাড়িতে করে তারা রওনা দিয়েছে। বাইকের চাবি হাসানের কাছে দিয়ে এসেছে। পুলিশ জানিয়েছে কাছেই একটা ভালো হাসপাতাল রয়েছে। সাজু নিজেও জানে না সেই হাসপাতালে রবিউল আছে।
সাবরিনা আফরোজ যে সেই হাসপাতালের পরিচালক, সেটাও জানতেন না সাজু ভাই। রবিউলকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো সাবরিনা, আর লতাকে নিয়ে এদিকে প্রবেশ করে সাজু। সকাল হবার আগ পর্যন্ত কেউ কারো পরিচয় জানতে পারেনি।
সারারাত ধরে মায়াজালের মধ্যে ব্যস্ত ছিল ডিবি পুলিশ হাসান সাহেব। সকাল বেলা সে সাজুর কাছে কল দিলেন। সাজুকে জানালো,
– তোমার ধারণাই ঠিক হয়েছে সাজু।
সাজু বললো,
– কোন ধারণা?
– লতার বাবার সিঙ্গাপুরে কোনো গলার সমস্যা বা ক্যান্সারের অপারেশন হয়নি। ছ’মাস আগে তো দুরের কথা, দেড় বছরের মধ্যে একবারও তিনি সিঙ্গাপুর জাননি।
সাজু বললো,
– তারমানে লতার বাবাকে হয়তো মেরে ফেলা হয়েছে নয়তো কোথাও আটকে রাখা হয়েছে।
– হ্যাঁ হতে পারে।
– তাহলে যিনি লতার বাবা সেজে আছেন তিনি কি প্লাস্টিক সার্জারি করেছে?
চলবে….
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।
#চাদর_জড়ানো_চিরকুট।
#পর্বঃ- ২০
হাসান বললো,
– কী হয়েছে তা তো জানি না। কিন্তু অনেক বড়ো ধরনের গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। আর সবটাই ওই দাদাজান নামের মুখোশধারীই করেছে।
– আপনি এখন কোথায় আছেন? আমি তো সেই রাত থেকে হাসপাতালে আছি। লতার এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
– আমরা সেখানেই আছি। তুমি গতকাল বিকেলে লতার বাবার চিকিৎসার বিষয় খোঁজ নিতে বলার পরে আমি ব্যবস্থা করেছিলাম। ওরা লতার বাবার সবকিছু চেক করেছে, তিনি সিঙ্গাপুর যায়নি।
– ওই পিকনিক স্পটে আর কি কি পাওয়া গেল?
– ওহ্ তোমাকে তো বলাই হয়নি, লতার বাবার বিষয় নিয়ে এতটা আগ্রহী ছিলাম। আসল কথাটা বলতে ভুলে গেছি।
– কী সেটা?
– নিচের যে ঘরটা আছে সেটা দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে বাউন্ডারির বাহিরে বের হওয়া যায়। আমার মনে হয় গতকাল রাতে আমরা দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে ঢোকার শব্দ পেয়ে উনি পিছন থেকে পালিয়ে গেছে।
– হতে পারে, আপনি একটা কাজ করেন।
– কী কাজ?
– পুলিশের হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করেন। রবিউলকে ক্রসফায়ারের হুকুম বাতিল করার জন্য অনুরোধ করেন।
– কিন্তু রবিউল তো….
– আমিও জানি সে অপরাধী, কিন্তু তাই বলে তো এভাবে তাকে পথেঘাটে পুলিশের হাতে মরতে হবে এমনটা নয়। পুলিশ যেন তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে সেই ব্যবস্থা করতে বলেন। তাছাড়া দাদাজান নামের এই খারাপ মানুষটার সকল পাপের একটা লিস্ট তৈরি করেন।
– ঠিক আছে, আমি আমার স্যারের সঙ্গে কথা বলে রবিউলের বিষয় ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটা চেষ্টা করছি। কিন্তু রবিউল আছে কোথায়?
– জানি না কোথায় সে, কিন্তু তবুও পালিয়ে যখন আছে তখন বিপদ তো সবসময় পিছনে তার।
– দাদাজান যেহেতু পালিয়ে গেছে তাহলে লতার বাবা মানে ওই নকল বাবা আর সে কখন দেশ ছেড়ে চলে যায় সেটাও ভাবনার বিষয়।
– সমস্যা নেই পুলিশ লাগিয়ে দেবো।
– এতটা সহজ না হাসান ভাই।
– মানে?
– দাদাজানের কিন্তু আইনী লোকের সঙ্গে ভালোই পরিচয় আছে। তাকে কিন্তু আমরা পিকনিক স্পটে হাতেনাতে ধরতে পারিনি। সে যদি তার ক্ষমতার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায় যে ওই রিসোর্টে সে কাল রাতে ছিল না। এবং এতকিছু সেখানে ঘটেছে তা সে জানে না তাহলে কিন্তু ঘটনা উল্টে যাবে।
– সেটা কী সম্ভব?
– কেন সম্ভব না? উপর থেকে যদি সাপোর্ট পায় তাহলে তো সম্ভব। আপনার কী মনে হয় এসব অস্ত্রের ব্যাবসা সে সম্পুর্ণ গোপনে করেছে।
– তা ঠিক। তারমানে…
– ঠিকই ভাবছেন, এতদিন রবিউল আর লতার উপর বিপদ ছিল। আজ থেকে আপনাকে আর আমাকেও সাবধানে থাকতে হবে ভাই। আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, তার সবকিছু আমরা দুজন মিলে বের করে ফেলেছি।
– এই রিসোর্টের অনেক স্থানেই সিসি ক্যামেরা বসানো আছে। গতকাল রাতে তুমি আর আমি যখন বাহিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। তারপর বাইক লুকিয়ে রেখেছি, সবকিছু ভিডিও আছে।
– আচ্ছা আচ্ছা, সেজন্যই তাহলে আমরা ভিতরে প্রবেশ করার আগেই সে লুকিয়ে যেতে পেরেছে।
– হ্যাঁ একদম।
– আপনি এক কাজ করেন, লতার বাবাকে এখন আপাতত নজরে রাখার ব্যবস্থা করেন। দরকার হলে বাড়ির সামনে কাউকে রাখেন।
– গতকাল রাতে যে তিনজনকে আমরা গ্রেফতার করেছি। বৃদ্ধ এসিস্টেন্ট এবং বাকি যে লোক দুটো ছিল, এরা সাক্ষী দিলেও দাদাজানের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।
– স্বীকার করবে কিনা সেটাই তো বড় কথা।
– সাজু…!
– বলেন।
– তুমি কী জানো যে লতার মা মারা যাবার পর থেকে লতার বাবা আর লতা আলাদা বাড়িতে থাকতো?
– মানে এগারো বছর ধরে লতা আলাদা ছিল?
– হ্যাঁ, সেরকমই জানতে পারলাম আমি। তবে লতা যেহেতু তোমার কাছে রয়েছে সেহেতু তার কাছ থেকে এসব জানতে পারবে।
★★★
হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে সাজু ভাই বেশ ক্লান্ত হয়ে একটা সিটে বসলো। বারান্দার এই দিকটায় অনেক গুলো সিট রয়েছে। গতকাল রাতে যখন এসেছিল তখন হাসপাতালটা ভালো করে দেখা হয়নি। কিন্তু সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়তে হাসপাতালের নিচে গেল। সাজু খুব ভালো করে জানে প্রায় সব হাসপাতালের মধ্যেই নামাজের স্থান থাকে।
নামাজ পড়তে গিয়ে সাজু সাজু ভাই অবাক হয়ে গেল। হাসপাতালটি সত্যি খুব সুন্দর। এরকম এক নির্জন এলাকায় এতো চমৎকার একটা হসপিটাল রয়েছে জানাই ছিল না। কিন্তু যখনই সে জরুরি বিভাগের সামনে হাসপাতালের নাম লেখা দেখতে পেল। তখনই সঙ্গে সঙ্গে সারিনার কথা মনে পড়ে গেল, তারমানে এটাই সেই হাসপাতাল।
অযু করে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব মুনাজাতে অজ্ঞাত কারো জন্য দোয়া করে। হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন গতকাল রাত থেকে বিপদে রয়েছে। সেই লোকের জন্য দোয়া করা হলো। সাজু মাথার মধ্যে তখন সম্পুর্ণ রবিউলের চিন্তা এসে গেল। তবে রবিউল যে এই হাসপাতালে রয়েছে কল্পনা করেনি। সাজু ভাবলো যে, পুলিশের হাতে বিপদে পড়েছে সেজন্য হয়তো দোয়া করা হচ্ছে।
হঠাৎ করে তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করলো। সাজু ভাই কথা বলার জন্য এগিয়ে গেল।
সাজু তার কাছে গিয়ে বললো,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ।
– ভালো আছেন আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– আমি কি আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
– জ্বি অবশ্যই।
– আপনি এই হাসপাতালে কতদিন ধরে আছেন?
– দেড় বছর ধরে, মানে হাসপাতাল চালু হবার পর থেকে আমি এখানেই আছি।
– আমি গতকাল রাতেই এখানে প্রথম এসেছি। হাসপাতালের চাকচিক্যতা দেখে আমি মুগ্ধ। তবে চিকিৎসার বিষয় এখনো ভালো করে জানি না।
– চিকিৎসা নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। এখানে সব ভালো ভালো ডাক্তার রয়েছেন। তুলনামূলক ভালো বেতন দিয়ে তাদের রাখা হয়েছে।
– কিন্তু আমি একটা লোকের কাছে জানতে পারি যে এখানে সব ফ্রী চিকিৎসা হয়। তাহলে এতবড় হাসপাতালের এতো বেশি খরচ, তাছাড়া প্রচুর রোগীর খরচ কীভাবে চলে?
– দেশী বিদেশি অনেক ব্যবসায়ীরা এখানে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন।
– ওহ্ আচ্ছা।
সাজু তারপর সেখান থেকে উঠে গেল। আরও কিছু প্রশ্ন তার ছিল কিন্তু করতে ইচ্ছে করছে না। কারণ সে চায়না নামাজের স্থানে বসে এই লোক আর কোনো মিথ্যা বলুক।
ঘাড় ঘুরিয়ে সাজু বললো,
– আরেকটা কথা বলি?
– বলেন।
– নামাজের স্থানে বসে মিথ্যা বলবেন না। যদিও আপনার মিথ্যা বলার কারণটা আমি কিছুটা হলে ও আন্দাজ করতে পেরেছি।
ইমাম সাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
তারপর বললো,
– আপনি কি কোনো তদন্তকারী?
সাজু সামান্য হেসে বের হয়ে গেল।
★★★
সাজু চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম সাহেব দৌড়ে চলে গেল সাবরিনা আফরোজের কাছে। সাবরিনা সবেমাত্র ফ্রেশ হয়ে বসেছে। গতকাল রাত থেকে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে সে অপারেশন থিয়েটারে ছিল। অপারেশন থিয়েটারে সাবরিনা কখনো যায় না, কিন্তু রবিউলের জন্য গিয়েছে।
সবকিছু মোটামুটি ভালো ভাবে শেষ হয়েছে কিন্তু এখনো বিপদ কাটেনি। জ্ঞান ফেরেনি, তবে কিছু ভরসা এখনো আছে। তাই রবিউলের জন্য সে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
এমন সময় ইমাম সাহেব এসে যখন অদ্ভুত এক লোকের অদ্ভুত কথা জানালো তখন অবাক হয়ে গেল সাবরিনা। সঙ্গে সঙ্গে সে নামাজ ঘরের সামনের ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে যায়। আর সেখানে সাজুকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলে। সাজুর কিছু ছবি সে গতকালই যোগাড় করেছে। সাজুকে এখানে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি সাবরিনা।
এর রাতে ডিউটি করা জরুরি বিভাগের ডাক্তারকে ডেকে জানতে পারলো যে লতা চৌধুরী নামের একটা মেয়েকে নিয়ে এই লোকটা হাসপাতালে এসেছে।
লতা চৌধুরীর কথা শুনে আরো একবার বিস্মিত হয়ে যায় সাবরিনা। তারপর তাদের কেবিন নাম্বার জেনে নিয়ে সেদিকে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সাজুকে কথা বলতে দেখে সে থমকে দাঁড়ায়।
সাজু ভাই কথা শেষ করে যখন সিটে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছিল। তখন সাজু ভাইয়ের কাছে গিয়ে সাবরিনা বললো,
– ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। তবুও সাজু ভাই হিসেবে আপনার মতো করে বলি, মেলা মেলা ধন্যবাদ সাজু সাহেব।
– আপনি মিস সাবরিনা আফরোজ, তাই না?
– কীভাবে বুঝলেন?
– আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে মোবাইলে, কণ্ঠটা স্মরণ আছে।
– রাফসানের উপর থেকে ক্রসফায়ারের হুকুম তুলে নেবার অনুরোধ করার জন্য ধন্যবাদ দিলাম।
– তারমানে আপনি আমার কথা শুনেছেন?
– মাফ করবেন।
– রবিউলের কোনো খোঁজ জানেন? গতকাল রাতে নাকি মিরপুরের একটা বাড়ি থেকে সে পালিয়ে গেছে।
– আমি জানি না রবিউল কোথায়। আমার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ হয়নাই।
এমন সময় একটা নার্স এসে সাজুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আপনার পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনাকে সে ডাকছেন।
সাজু ও সাবরিনা দুজনেই লতা চৌধুরীর কেবিনে এগিয়ে গেল। গতকাল রাতে যে পুলিশ গাড়ি ড্রাইভ করেছেন তিনিও কেবিনের ভিতরে। সুজুকে দেখে লতা আস্তে করে বললো,
– আপনাকে আমাকে কোথায় পেয়েছেন সাজু ভাই?
– সে অনেক কথা, আগে বলেন কেমন লাগছে এখন?
– অস্থির লাগছে খুব। রাফসান মাহমুদ কোই?
– আমি জানি না।
– সে আমাকে বলেছিল আমাকে বিল্ডিং থেকে যেভাবেই হোক বের করবে। কিন্তু তার আগেই বাবার সেই এসিস্ট্যান্ট আঙ্কেল আমাকে জোর করে নিয়ে আসে। ভেবেছিলাম আমি হয়তো মরে যাবো। কিন্তু ওরা আমাকে অজ্ঞান করে ফেলে।
– তারপর?
– অজ্ঞান হবার আগ মুহূর্তে আমি মনে মনে আল্লাহর কাছে বলেছিলাম যে, এর আগেরবার যখন অজ্ঞান করেছিল তখন চোখ মেলে আমি রাফসানকে পেয়েছিলাম। তাই এবারও যেন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।
– ওহ্, তারমানে আপনার তো এরপর আর কিছু মনে নেই?
– না। একটু আগে নার্সকে যখন বললাম যে আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে। সে বললো যে, একটা ছেলে নিয়ে এসেছে। যেভাবে বর্ননা করেছে তাতে আমি পুরোপুরি রাফসান ভেবেছিলাম। যখন জিজ্ঞেস করি তার নাম কি রাফসান? সে বলে যে না তার নাম সাজু।
– আপনি চিন্তা করবেন না, আমি রবিউলের উপর থেকে ক্রসফায়ারের বিষয়টা বন্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সাবরিনা বললো,
– আপনি কি আমার সঙ্গে যেতে পারবেন?
– লতা বললো, আপনি কে?
– সাজু বললো, উনি রবিউলের বন্ধু।
– লতা বললো, কোথায় যেতে হবে?
– রবিউলের কাছে, রবিউল এই হাসপাতালেই আছে। গতকাল রাতে মিরপুর থেকে পালানোর সময় দুটো গুলি লেগেছে। আমরা অপারেশন করেছি তবে এখনো কিছু বুঝতে পারছি না।
সাজু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। লতা কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। সাবরিনা সাজুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– সরি সাজু ভাই, আপনাকে মিথ্যা বলেছি। রবিউল এখানেই আছে, আইসিইউতে। আপনার কাছে বিশেষ অনুরোধ, আপনি পুলিশের কাছে কিছু জানাবেন না। রবিউল আগে সুস্থ হোক তারপর নাহয় যা করার করবেন।
লতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– রবিউল সুস্থ হবে তো আপা?
★★★
তিথি বিথির যে ঠিকানায় হাসান সাহেব গতকাল সকালে দেখা করেছিলেন সেই বাসার সামনে আবার এসেছে রামিশা। রাত চারটার দিকে তার যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখন সে সাজু কল করে। সাজু তখন টুকটাক কথা বলার পরে রামিশাকে বলেছিল যে সকালে উঠে যেন ওই বাসায় গিয়ে কথা বলে রামিশা।
দরজা খুলে বিথির মা রামিশাকে দেখে আনন্দিত গলায় হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। বলে,
– বিথি, তুই এসেছিস মা?
রামিশা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তখনই যেন ভিতর থেকে একটা লোক আসেন। তিনি মহিলাকে ছাড়িয়ে ভিতরে নিয়ে যায়। তারপর সম্ভবত তাকে রুমে রেখে দরজা লাগিয়ে দেয়। পুনরায় সদর দরজার সামনে এসে রামিশার দিকে তাকিয়ে বলেন,
– কার কাছে এসেছেন?
– আমি তিথি বিথির সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
– আপনার পরিচয়?
– রবিউল সম্প্রতি অনেক গুলো খুন করেছে। তার সেই মামলার জন্য কিছুটা তথ্যের দরকার ছিল। তবে সেক্ষেত্রে রবিউলের কিছু হবে না। আপনার ঠিকানা রবিউল আমাদের দিয়েছে।
– গতকাল কি আপনাদের মধ্যে কেউ এসেছিলেন।
– হ্যাঁ হাসান ভাই, ডিবি পুলিশ।
– তিথি বিথির সম্পর্কে রবিউল কিছু বলেনি?
– হ্যাঁ বলেছে। একবার বলেছে তারপর আবার সে নিজে বলে সেগুলো মিথ্যা ছিল। এরপর গতকাল আবার আপনাদের ঠিকানা দেয়। সেজন্য আমরা রবিউলকে বিশ্বাস করতে পারি না।
– আপনি একটু বসেন, আমি ভিতর থেকে আসি।
★★★
লতাকে নিয়ে সাবরিনা আর সাজু ভাই চলে গেল রবিউলকে দেখানোর জন্য। গতকাল রাতে যে পুলিশ সাজুর সঙ্গে এসেছিল সে সবকিছুই শুনে গেল। ওরা তিনজন কেবিন থেকে বের হবার পরে উনিও বের হয়ে যায়। হাসপাতালের এক কর্নারে গিয়ে মোবাইল বের করে একটা নাম্বারে কল দেয়,
– হ্যালো দাদাজান, আপনার জন্য একসঙ্গে দুটো ভালো খবর আছে।
– কি খবর?
– লতাকে যে এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি সেটা বলেছি আপনাকে। কিন্তু একটু আগে জানতে পারলাম যে আপনার সেই রবিউলও নাকি রাতে আহত অবস্থায় এখানে ভর্তি হয়েছে।
– বলেন কি?
– হ্যাঁ, এরা বিষয়টা গোপন করতে চায় সুতরাং পুলিশ এখানে আসবে না।
– ঠিক আছে, এরকম একটা খবরের অপেক্ষা করছি আমি। আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার মতো রবিউল ছাড়া কেউ নেই। ওকে যেভাবেই হোক সরাতে হবে, নাহলে আমি শেষ।
চলবে….
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম।