#চাদর_জড়ানো_চিরকুট
#পর্বঃ- ২২ [সমাপ্ত]
রবিউল লতাকে দেখে বললো, ” জেলের মধ্যে আপনি আমাকে দেখতে আসবেন এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। ”
লতার মুখ হাসিখুশি। এমনিতেই গতকাল রাতে সে প্রচুর কেঁদেছে। নিজের মা-বাবার কথা ভেবে আর কিছুদিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার কথা ভেবে খুব কেঁদেছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করে রবিউলের সঙ্গে দেখা করতে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বাসা থেকে বের হবার সময়ই সে মনে মনে ঠিক করে যে রবিউলের সামনে হাসিখুশি থাকবে। যদি কান্না আসে তবুও কাঁদবে না।
লতা বললো,
– আপনি বারবার আমার জন্য নিজেকে বিপদে ফেলেছেন। হয়তো অনেক আগেই মারা যেতাম তবুও বেঁচে আছি, সৃষ্টিকর্তা আরো বাঁচিয়ে রাখবে তাই। এখন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে যদি দেখা করতে আসি সেটা কি খুব খারাপ হবে?
– না খারাপ হবে না, সহানুভূতি হবে।
– কেন? এমনিতে আসতে পারি না রাফসান?
– কোনো কারণ ছাড়া মৃত্যু পথযাত্রী কারো সঙ্গে দেখা করার মানে হয় না। তবে যদি রাগ অভিমান শেষ করতে আসেন তাহলে ভিন্ন কথা। কারণ মৃত্যু যার সামনে নিশ্চিত তার প্রতি রাগ অভিমান জমা করে রাখতে হয় না।
– আপনি কি জানেন যে আমি আল্লাহর কাছে বারবার আপনার মুক্তি চাই?
– জানি না, এখন জানলাম। আপনার পেটের সন্তানের কী খবর? এতবড় বিভিন্ন অত্যাচারের পরে তার ক্ষতি হয়নি তো?
– আমিও ভেবেছিলাম হয়তো ক্ষতি হবে। তেমন কিছু হলে হয়তো খুব বেশি কষ্ট পেতাম না। তবে আরেকবার ভাবলাম যে এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে এই সন্তান ছাড়া কেউ নেই।
– পরশু আমার রায় ঘোষণা করা হবে, তারপর যদি ফাঁসির হুকুম হয় তাহলে কি আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন?
– আপনার ফাঁসি হবে না রাফসান মাহমুদ। আমি যেভাবেই হোক আপনার ফাঁসি আটকাবো। এতে যদি আমার সমস্ত সম্পত্তি সরকারের কাছে দিয়ে দিতে হয় তবুও রাজি।
– নিজের বাবার তিল তিল করে গড়ে তোলা এই সম্পত্তি, সামান্য একটা খুনির শাস্তি কমানোর জন্য সরকারি করে দেবেন?
– সামান্য? আপনি সামান্য?
– তাহলে কি?
– সাবরিনা আপু যে হাসপাতালের পরিচালক সেই হাসপাতালের সব টাকা কীভাবে আসে?
– আপনাকে বলতে পারি সমস্যা নেই।
– বলেন।
– সব টাকা আমিই দিতাম। তবে কোনদিন নিজের নাম করে দিতাম না। এ শহরের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছে, তাদের কাছে টাকা দিতাম তারা তাদের নিজেদের নাম করে হাসপাতালে দিতেন।
– অনেক টাকার ব্যাপার তাই না?
– আপনার সম্পত্তির মতো নয়।
– আমি গতকাল রাতে আপনাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছি।
– কিরকম?
– আপনাকে নিয়ে আমি এ দেশ ছেড়ে অনেক দুরের একটা দেশে চলে গেছি। সেই দেশে গিয়ে আমরা দুজন সংসার করছি। আমার পেটের সন্তান আপনার পরিচয়ে বড় হচ্ছে। সেখানে কেউ আমাদের চেনে না, আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ সন্তানের পরিচয় জানে না।
– অবাস্তব কল্পনা, এগুলো কেন ভাবেন?
– কেন? এমনটা কি হতে পারে না রাফসান?
– একটা কথা বলি?
– বলেন।
– না থাক, আপনি বাসায় ফিরে যান। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন।
– রাফসান….
– জ্বি।
– জানি না কোনদিন বলা হবে কিনা, কোনদিন সেই সুযোগ পাবো কিনা। তবুও নিজের ভিতরে একটা কথা আর চেপে রাখতে পারছি না।
– বলতে হবে না, আমি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে সেটা পড়ে নিয়েছি।
– I Love You Rafsan.
– আচ্ছা।
– আপনি বিশ্বাস করেন, আমি আমার সব সম্পত্তি দিয়ে হলেও আপনার জীবন ফেরত চাইবো। এই সম্পত্তি আমাকে কোনদিন রক্ষা করতে পারবে না। আপনার মতো একটা বিশ্বস্ত মানুষ থাকলে জীবনে সুখ বলতে কিছু পাওয়া যায়।
– আপনি বাসায় চলে যান, অনুরোধ রইল। আর ভালো থাকবেন সবসময়। আপনার জন্য আর আপনার সন্তানের জন্য শুভকামনা রইল।
রবিউল এতক্ষণ পরে খেয়াল করে দেখলো যে লতার গায়ে একটা চাদর জড়ানো। রবিউল হঠাৎ করে মনে পড়লো এই চাদরে জড়িয়ে সে চিরকুট দিয়েছিল।
একটা চিরকুট। সেই চিরকুট না দিলে, রবিউল ফিরোজকে হত্যা করে চুপচাপ চলে এলে এসব অনেক কিছু ঘটতো না। চাদরটা সাজু ভাই লতাে কাছে দিয়েছে কিছুদিন আগে। লতা এটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
– চাদরটা আমাকে দিয়ে যাবেন?
– না, এটা আমার কাছে থাকবে।
– আমার ফাঁসি হয়ে গেলে তারপর নাহয় আপনি নিয়ে যাবেন। আপাতত কিছুদিন আমার কাছে থাকুক, এটা মুন্নীর দেওয়া চাদর।
লতা এবার কেঁদে উঠলো। সে চাদরটা শরীর থেকে খুলে রবিউলের কাছে দিয়ে বললো,
– বলছি না আপনার ফাঁসি হবে না, বারবার কেন এসব বলেন? একটা মেয়েকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে আপনার?
এ কথা বলেই লতা সেখান থেকে চলে গেল। রবিউল চাদরটা নিয়ে চুপচাপ ভিতরে চলে গেল।
★★★
লতা চৌধুরীর বাড়ির বিশাল ড্রইং রুমের মধ্যে বসে আছে সাজু ভাই রামিশা ও লতা চৌধুরী। লতা নিজেই এদের দুজনকে আমন্ত্রণ করেছে। লতার বাবার সেই পুরাতন এসিস্ট্যান্ট নতুন করে চাকরিতে জয়েন করেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে লতা বেশ কিছু লোককে চাকরি থেকে ছাটাই করেছে।
অনেকেই বলেছে যে এরকম করে অভিজ্ঞদের ছাটাই করলে অনেক লোকসান হবে। লতা শুধু বলেছিল ” আমার বাড়িটা থাকলেই চলবে। বাকি সব সম্পত্তি মাটির সাথে মিশে যাক তাতে কোনো আপত্তি নেই। ”
সাজুর হাতে ” এক কাপ ঠান্ডা কফি “। রবিউলের বিষয় নিয়ে তার নিজের কিছু চিন্তা হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু রবিউল সহজসরল ভাবে তার সকল অন্যায় স্বীকার করেছে। রবিউল যেসব খুন করেছে তার বেশিরভাগই কোনো প্রমাণ নেই। বাগেরহাটের হোটেলের মধ্যে সেই মাইশার বাবা ও দারোগা সাহেবকে সাজুর সামনে মেরেছিল। আর লতার সামনে মিজানদের মেরেছে। এছাড়া যাদের সে মেরেছে তার বেশিরভাগই কোনো সাক্ষী প্রমাণ নেই।
কিন্তু তবুও রবিউল সবকিছু স্বীকার করেছে। তার মনে হচ্ছিল এবার এই জীবনটার একটা সমাপ্তি দরকার।
লতা চৌধুরী বললো,
– আপনি যদি রাফসানকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে না দিতেন তাহলে ওর ফাঁসি হতো না।
সাজু ভাই বললেন,
– রবিউলকে পুলিশের কাছে তো যেতেই হতো লতা ম্যাম। আইন অনুযায়ী সে অপরাধী, তবে সেই অপরাধ বিচার করার জন্য আদালত।
– আদালত যদি তার ফাঁসির আদেশ দেয়?
– আপনি তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করবেন। রবিউলকে ক্ষমা চাইতে বলবেন। মৃত্যুর পরিবর্তে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক আমিও সেটাই চাই।
– তিথি বিথির মৃত্যুর রহস্য পাওয়া গেছে?
রামিশা বললো,
– হ্যাঁ মোটামুটি পাওয়া গেছে।
– কি?
– রবিউলের কথা ঠিক ছিল। তিথি বিথি দুজনেই মারা গেছে। তবে বিথি আগে মারা গেছে, আর তিথি মারা গেছে আপনি যেদিন চট্টগ্রামে গেছেন সেদিন। বিথির মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন। হাসান ভাই যেদিন তাদের বাসায় যায় সেদিন রবিউলের কথা শুনে তিনি হাসান ভাইকে বের করে দেয়। আবার তিথি বিথির কথা বলেন যে তারা গ্রামের বাড়িতে।
কিন্তু সেদিন আমি বিথির বাবার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি সবকিছু। তিথি বিথির মৃত্যুর পর থেকে বিথির মা এরকম হয়ে গেছে। মিরপুরের ওই বাসাতে থাকার ব্যবস্থা রবিউল করে দিয়েছেন।
– এগুলো আপনি জেনেছেন তাই না?
– হা।
– তাহলে আপনি কি সাজু ভাইয়ের এসিস্ট্যান্ট?
– হাহাহা।
– হাসছেন কেন? আমি সেদিন চট্টগ্রামে থেকেই লক্ষ্য করেছি আপনারা দুজন একসঙ্গে। তারপর তো নিজেই নিজের খবর জানি না। আপনাদের কথা আর জানবো কীভাবে তাই না।
– এসিস্ট্যান্ট বলতে পারেন, সেটা শুধু মামলার জন্য নয়। পুরো জীবনের জন্য।
★★★
আদালতে প্রায় সবাই এসেছে। কি ধরনের রায় হবে সে বিষয় সকলেই নিশ্চিত। যেখানে খু নি নিজের মুখে ৫৬ খু নে র কথা স্বীকার করেছে সেখানে আর কি বাকি থাকবে।
সময় শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে বিচারক রবিউলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোমার কেমন শাস্তি হবে সেই বিষয় নিশ্চয়ই ধারণা আছে।
– জ্বি।
– আমি তোমার জন্য ফাঁসির আদেশ দেবো। এই বিষয় তোমার কি কিছু বলার আছে?
– না নেই।
– তোমার মনে হয় না যে আমি তো সবগুলো অপরাধীকে মেরেছি। তাহলে আমাকে আদালত কেন ছাড় দেবে না, একটু সহানুভূতি করবে না।
– না মনে হয় না। আমি মাইশা নামের একটা মেয়ে বিনা কারণে মেরেছি। আমার যখন ফাঁসি হবে তখন আমি ভেবে নেবো যে মাইশাকে মারার জন্য আমার ফাঁসি হচ্ছে। রাস্তার কুকুর মারার জন্য কোনো বিচার হচ্ছে না। তাছাড়া সেই সময় আমি সাজু ভাইকেও মারতে চেয়েছিলাম। তাকে সেই মামলায় ফাসানোর চেষ্টা করেছিলাম।
– তোমার অপরাধ জীবন খুব ছোট কিন্তু সামান্য সময়ের মধ্যে তুমি অনেক মানুষ মেরেছ।
– হ্যাঁ জানি।
– আমি এখন রায় ঘোষণা করবো, তোমার কিছু বলার আছে?
– আমার কবরটা যেন আমার মা-বাবার কবরের কাছে দেওয়া হয়। সকলের সামনে আমার এটাই শুধু বলার আছে। অপরাধ জগতে এসে আমি কোনদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। এবার অন্তত কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবো। সেখানে সকাল সন্ধ্যা রাত বলতে কিছু নেই, আছে শুধু অন্ধকার।
বিচারক রবিউলের ফাঁসির আদেশ দিলেন। তারিখ অনুযায়ী সেটা রায় ঘোষণার পর থেকে সতেরো দিন পরে কার্যকর করা হবে। তবে সেই তারিখ পরিবর্তন হতে পারে।
★★★
তিনদিন পর রবিউলের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাবরিনা এসেছিল। চলে যাবার সময় তার হাতে সেই চাদরটা দিল রবিউল। চাদের আরেকটা চিরকুট জড়ানো আছে।
সাবরিনা নিজেও একটা ছোট্ট চিরকুটে রবিউলের জন্য কিছু লাইন লিখে এনেছিল। রবিউল সেটা পড়ে দেখেছিল,
প্রিয় রবিউল ইসলাম,
তুমি তিক্ততার শেষ সীমান্তে,
আমি দাঁড়িয়ে আছি তার প্রান্তে।
পাড়ি দিতে হবে বহুদূর একসাথে,
যেতে চাই রেখে হাতটা হাতে।
তোমার যত গোপন সংগ্রাম আমার কাছে জমা
আমি চাই সেই দোষগুলো হয়ে যাক ক্ষমা।
ইতি,
তোমারই
সাবরিনা আফরোজ।
[ কবিতাটা সত্যি সত্যি সাবরিনার লেখা ]
|
|
সাবরিনা র কাছ থেকে চিরকুট গ্রহণ করলেন সাজু ভাই। আবারও সেই চাদর জড়ানো চিরকুট।
সাজু ভাই পড়তে লাগলেন,
সাজু ভাই,
কিছু কিছু মানুষকে আমাদের হঠাৎ করে ভালো লেগে যায়। কেন ভালো লাগে সেই উত্তর আমরা জানি না কিন্তু ভালো লাগে। সম্মান করতে ইচ্ছে করে এমন কেউ জীবনে থাকে।
আপনি আমার জীবনে সেরকমই একজন। আমি সবসময় আপনাকে সম্মান করি।
গতকাল “দাদাজান” আমার সঙ্গে দেখা করতে জেলের মধ্যে এসেছিলেন।
অবাক হচ্ছেন? হবেন ই তো।
তার নিকনেম “দাদাজান”, প্রচুর ক্ষমতা নিয়ে চলেন ঠিকই কিন্তু সহজে কারো সঙ্গে দেখা করে না। আমার মতো রবিউল তিনি তৈরি করেছেন। সুতরাং আমি যদি এতটুকু চালাক হয় তাহলে ওই দাদাজান কতটুকু চালাক হিসাব করেন।
নাম পরিবর্তন, চেহারা পরিবর্তন, আরো অনেক কিছু আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। আপনারা যাকে মেরেছেন তিনি দাদাজান নয়।
তিনি বেঁচে আছেন, তবে আমার মনে হয় আপাতত সে খারাপ কিছু করবে না। তবে একটা সময় করবে এটা নিশ্চিত।
ভালো থাকবেন।
রবিউল ইসলাম রাব্বি।
★★
২০২২ সালে লেখা আমার সর্বপ্রথম গল্প এই “চাদর জড়ানো চিরকুট”। বছরের প্রথম গল্পটা পাঠক পাঠিকার কাছে এতটা ভালোবাসা পাবে আমি কখনো কল্পনা করিনি। এতদিন ধরে এই গল্পটা ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও মোবারকবাদ।
গল্পটা আমি হঠাৎই শুরু করেছিলাম। একজন মানুষ আছে যার কাছে সাজু ভাই সিরিজ সবচেয়ে বেশি প্রিয়। সে আমার সাজু ভাই সিরিজের গল্প ছাড়া আর কোনো গল্প পড়ে না। বছরের শেষ দিনে সে বলেছিল ” সাজু ভাই সিরিজের কোনো রহস্যময় গল্প পাচ্ছি না, আফসোস সাজু সাহেব। ”
তারপরই আমি ০২ জানুয়ারি এই গল্পটা শুরু করেছিলাম। আর পাঠক পাঠিকার ভালোবাসা নিয়ে গল্পটা ২২ পর্বে সমাপ্ত হয়ে গেল।
যেখানে সমাপ্তি হয়েছে সেখানে অনেক গুলো প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল। দাদাজান যদি সত্যিই বেঁচে থাকে তাহলে তো রবিউলের বাঁচা দরকার।
ভাবতে থাকি নতুন কিছু।
সবাই ভালো থাকবেন, দোয়া করবেন।
—– সমাপ্ত —–
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম।
Really nice.thanks for your excellent creation.