#চারুলতা_ভালোবেসেছিল,পর্ব৩
গাড়ি থেকে ভাইয়া ভাবি আর বাচ্চাদের পাশাপাশি আরো একজন লোককে নামতে দেখলাম।
সম্ভবত ভাইয়ার শ্যালক। ভাইয়ার শ্যালকের সাথে আমাদের পরিচয় নেই। গত চার বছরে শুধু একবারই দেখা হয়েছে। বিয়ের পর প্রথম ঈদে ভাবির সাথে এসেছিলেন। কয়েকঘন্টা থেকে চলে যান সেবার, তাই পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাইনি।
ভাইয়া আসতেই উপস্থিত সবাই ভাইয়াকে ঘিরে ধরে, আমি আর লতা নিচে নেমে বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। আনোয়ার চাচা ভাইয়া কে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন, অথচ গত সপ্তাহে নারকেল নিয়ে ঝগড়া করে আব্বার সাথে চাচার হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। ঘটনা ছিল, আমাদের সীমানার নারকেল গাছ থেকে নারকেল ঝরে পড়ে আনোয়ার চাচার বাড়ির সীমানায়, দুই বাড়ির মাঝে বেড়া দেওয়া। সেই নারকেলের মালিকানা নিয়ে ঝগড়া আর ধস্তাধস্তি পর্যন্ত হয়ে যায় আব্বা আর চাচার মাঝে। অথচ আব্বা নারকেল খায় না, আর আনোয়ার চাচার নিজেরই নারকেল গাছের সংখ্যা দশের অধিক!
যদিও আব্বা আর আনোয়ার চাচার সম্পর্ক অম্লমধুর ছিল, কিন্তু এই সময় চাচার এই কান্না কেন জানি বেমানান লাগলো না, বরং বড় বেশি স্বাভাবিক লাগছে। হয়তো প্রতিবেশী সুলভ নানা ঝগড়া ঝামেলার মাঝেও কোন ভালো সময়ের স্মৃতি তাদের ছিল, বন্ধুত্ব ছিল।
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আমার সাথে আব্বার প্রিয় স্মৃতি কোনটা, কিন্তু মনে আসছে না। সম্ভবত স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়টা। দোকান থেকে রোজ দুপুরে বাড়ি আসতেন আব্বা, খাওয়া দাওয়া করে একটা ভাতঘুম দিয়ে বিকেলে আবার যেতেন।
মফস্বলের দোকানগুলো এমনই, শহরের মতো সবসময় জমজমাট না, দুপুরে ফাঁকাই থাকে। দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের দুইবোন কে নিয়ে আসতেন। আব্বার দোকান মাইজদী মসজিদ মার্কেটে,
আমি আর লতা পড়ালেখা করেছি নোয়াখালী সরকারি গার্লস স্কুলে। স্কুলের বাইরে বখাটে ছেলেদের আড্ডা বসতো ছুটির সময়, বেশিরভাগ মেয়ের বাবা ই এসময় চেষ্টা করতেন স্কুলে আসার। আব্বা রাগী মানুষ ছিলেন, আমি আর লতা সাহস করতাম না ফুচকা বা চটপটির আবদার করার। তবে যেদিন আব্বার মন ভালো থাকতো আমরা না চাইতে পেয়ারা মাখা, জাম মাখা, না হয় আইসক্রিম কিনে দিতেন।
আমরা দুইবোন তাতেই খুশি। লতা আর আমার বয়সের পার্থক্য চার বছর। আব্বার হোন্ডার পিছনে আমরা দুইবোন বসতাম, লতা ছোট, ও মাঝে বসতো, এরপর আমি। যখন বাতাসের বেগে আব্বা হোন্ডা চালাতেন, আমরা আব্বার শার্ট খামছে ধরে রাখতাম।
হঠাৎ মনে পরা এই স্মৃতিটা যেন বুকটা দুমড়ে মুচড়ে দিলো
সকাল থেকে কাঁদার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু চোখ যেনো শুকনো খটখটে হয়েছিল। অথচ এখন হঠাৎ দুচোখে বর্ষা নেমেছে।
‘আব্বা’ আমার আব্বা,
তিনি হয়তো আদুরে আব্বা ছিলেন না, সন্তান নিয়ে আহ্লাদ করতে পারতেন না, কিন্তু তিনি আমাদের আব্বা। বদরাগী ছিলেন,কারো মতামত শুনতে চাইতেন না, কথার আঘাতে আঘাত করতেন। কিন্তু আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন, আর্থিক নিরাপত্তা দিয়েছেন, মাথার উপর ছায়া হয়ে ছিলেন। স্বার্থপর তো আমরাও, আজ সকালে তিনি চোখ বুঝেছেন, আর দুপুর হওয়ার আগেই তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ পাব কিনা সে চিন্তা করছি। এই যে ভাইয়া, আজ মৃত্যুর পর পাঁচ ঘন্টার মধ্যে হাজির হলো। সেই ছেলে গত দুই মাস একুশ দিন কোথায় ছিল! আমার মা না হয় সৎ মা ছিলেন, কিন্তু বাবা তো তার নিজের বাবা ছিলেন।
আমাদের থেকে পাওয়া অবহেলাই হয়তো বাবাকে এতটা একাকিত্বের মুখোমুখি করেছিলেন যে তিনি মূল্য চুকিয়ে হলেও বিয়ে করতে চাইছিলেন।
নিজেকে ভীষণ ছোট লাগছে। আব্বা কোনদিন আদর করে পাশে বসিয়ে দুটো কথা বলেনি, সেই অভিমান করেছি। কিন্তু নিজে কয়দিন আব্বার জন্য তার প্রিয় মুড়িমাখা করে দিয়েছি, নিজ থেকে আব্বার পাশে বসে দুটো কথা বলেছি! শুধু ভয় করে গেলাম, কিন্তু আমার আর আব্বার মাঝে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা অদৃশ্য দেয়াল ভাঙার কোন চেষ্টাও করিনি। জানতাম বিকেলে আব্বা মুড়িমাখা দিয়ে চা খান। কিন্তু আম্মার মৃত্যুর পর একদিনও আমি বা লতা নিজ থেকে মুড়ি মাখাইনি।
আব্বা রেগে নাস্তা চাইলে বিরক্ত হয়েছি। আব্বা ভালো বাবা যদি না হয়, আমরা ও কি সুসন্তান ছিলাম।
এই যে আম্মার মৃত্যুর জন্য আব্বাকে দায়ী করি,
বলি আব্বা অবহেলা করেছেন। কিন্তু আমি বা লতা পাশে থেকেও কি কোনদিন বুঝতে চেয়েছি যে আম্মার ঠিক কতটা ব্যথা হচ্ছে, শুধু কী গ্যাসের সমস্যা না অন্য কিছু। অবহেলা তো আমরাও করেছি। লতা সবসময়ই আত্মকেন্দ্রিক, সাজতে ভালোবাসে, নিজের জগতে থাকে। আর আমি! অসময়ে বিয়ে,আর অকালে বিধবা হওয়ার কষ্ট আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার উপর শ্বশুর বাড়ি ও বাবার বাড়ি দুই বাড়িতে ব্রাত্য হয়ে পড়ায় মনে বিশাল অভিমান বাসা বাধে। না আম্ম, না আব্বা কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যত্ন, ভালোবাসা দেখাতাম না। আববা আমাকে দেখলে খিটমিট করতো, তাই আব্বার সামনে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম। স্ত্রীর মৃত্যুর পর লোকটা সময় মতো খাচ্ছে কিনা,ঔষধ নিচ্ছে কিনা খেয়াল করা কি মেয়ে হিসেবে আমারো দ্বায়িত্ব ছিল না।
আব্বা যদি ভালো বাবা না হোন, আমিও তো ভালো মেয়ে না। না ভালো স্ত্রী হয়েছি। মুবিন আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড় ছিল, লেখাপড়া বেশিদূর করেনি, কিন্তু লোকটা খারাপ ছিল না, আমার উপর কখনো স্বামিত্ব ফলায় নি, জোর করেনি। সেই লোকটা যখন জীবিত ছিল, কী অনিহাই না দেখাতাম। অথচ তার মৃত্যুর পর এত শোক কোথা থেকে আসলো! আমিও কি তাহলে অভিনয় করছি না! জীবিত যে লোকটা কে একটা ফুল কখনো দেই নি, তার কবরে আজ মালা দিতে চাওয়াটা তো উপহাসই।
হঠাৎ একটা পর্দা চোখের সামনে উন্মোচন হয়ে গেল যেন, ভালো মেয়ে হইনি, ভালো স্ত্রী হইনি। তবে ভালো বোন তো হতেই পারি। সম্পর্কের এই ঢিলে হয়ে আসা সুতো কি আমি পারবো শক্ত বাঁধনে বাঁধতে। ভাইয়ার সাথে শত্রুতায় যেতে চাই না, আবার নিজেদের অধিকার ও ছেড়ে দেব না। ভালো বোন হওয়ার একটা চেষ্টা লতার জন্য হলেও করবো।
“আনু চাচা ভিতরে যাই চলেন,আব্বার গোসল দেব।”
আনোয়ার চাচার সাথে আরো কয়েকজন কেঁদে উঠেছিলেন, কিন্তু ভাইয়ার নির্লিপ্তততায় সবাই একটু থতমত খেয়ে যায়।
“তাতো অবশ্যই বাবা, তোমার জন্য ই অপেক্ষা করছিলাম। না হলে লাশ তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করাই উত্তম। ”
আনোয়ার চাচা নিজেকে সামলে নেন।
বাদ যোহর আব্বার লাশ সমাহিত হবে, বাড়ির পিছনে, মুরুব্বি রা এটাই ঠিক করেছিলেন।
“আব্বার লাশ মসজিদের কবরস্থানে দাফন করবো।”
ভাইয়ার কথায় একটু চমকালেও, অবাক হইনি। কেন জানি মনে হচ্ছিল ভাইয়া বাড়িতে দাফন করতে না করবেন।
“কেনো হিল্লোল বাবা , বাড়িতেই তো ভালো, জায়গা তো আছে। তোমরাও যখন তখন কবর জিয়ারত করতে পারব।”
“চাচা সেটাতো মসজিদের কবরস্থানেও পারব। বাড়িতে থাকে মেয়েরা, তারা তো আর কবর জিয়ারত করতে পারবে না। আমি ঢাকা থেকে আসবো যখন, তখন সেখানেই জিয়ারত করবো।”
“আব্বার দাফন বাড়িতেই হবে ভাইয়া, তোমার অংশে না করলে আমার আর লতার অংশে করবো।”
ভাইয়া যেন কেঁপে উঠলেন আমার কথায়।
কাঁপুক, সারাজীবন কথা বলিনি, তাতে লাভ কিছু হয়নি। এখন বলে যদি হয়, তবে তাই হোক।
Rukshat Jahan