চারুলতা_ভালোবেসেছিলো,পর্ব১

0
1185

#চারুলতা_ভালোবেসেছিলো,পর্ব১

আব্বা মারা গিয়েছেন, কাল রাতেও যিনি আমাদের দুইবোনকে তীব্র গালিগালাজ করছিলেন, আজ সকালে তিনি মৃত। ভাইয়া জানতে পেরে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছেন, কিছুক্ষণের ভিতর হয়তো পৌঁছে যাবেন। আব্বার মৃত্যুতে আমার তীব্র কষ্টে বুকটা ভেঙে আসার কথা, কিংবা চিৎকার করে কাঁদার কথা।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আমার কারো তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছে না। আমার মতো লতা আর ভাইয়ারও কী একই অনুভূতি হচ্ছে! কেননা লতাও বেশ স্বাভাবিক, আর ভাইয়ার সাথে আব্বার কখনোই খুব বেশি সখ্যতা ছিল না। আব্বার মৃত্যুর খবরে ভাইয়াও খুব একটা কষ্ট পেয়েছে বলে মনে হলো না। আমরা তিন ভাইবোন কী তবে আব্বাকে ভালোবাসতে পারিনি!! ছিঃ কি বাজে কথা! বাবার মৃত্যুতে সন্তানেরা কী ভাবে এমন ঠান্ডা থাকতে পারে, যেখানে আব্বার মৃত্যুর পর আজ আমরা পুরোপুরি এতিম হয়ে গেলাম।

আমার আম্মার মৃত্যু হয়েছে আজ থেকে দুই মাস একুশ দিন আগে। জনমদুঃখী কথাটা আম্মার সাথে খুব যায়। মামা মামীর সংসারে বড় হয়েছিলেন আম্মা।
নাহ আমার নানা নানী মৃত ছিলেন না, দুইজনই জীবিত ছিলেন। তারপরও আম্মাকে এতিমের মতো বড় হতে হয়েছিল। আমার নানা কাউকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করায় নানী রাগ করে বাবার বাড়ি চলে এসেছিলেন। কিন্তু নানা ওনার কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে তালাক দেন। দুই বছর বাবার সংসারে থাকার পর নানীর আবার বিয়ে হয়। নতুন সংসারে আম্মাকে নিয়ে যেতে পারেননি নানী।
আম্মা তাই বড় হয়েছেন তার বড় মামা মামীর সংসারে, বলা যায় অনেকটা বিনা বেতনের কাজের মেয়ের মতো।

আম্মা আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী। বড় আম্মার মৃত্যুর পর আম্মাকে বিয়ে করেন আব্বা। আব্বা আম্মার বয়সের পার্থক্য প্রায় বিশ বছর। মামার সংসারে এতিমের মতো বড় হওয়া মেয়ের বিয়ের জন্য বিনা খরচে এরচেয়ে ভালো পাত্র আর কাকে পাবে। তাও সবাই বলতো আম্মার ভাগ্য ভালো সতীনের সংসার তো করতে হচ্ছে না। ভাইয়া বড়মার ছেলে। বড়মা কে আমরা দুই বোন দেখিনি। ভাইয়ার বয়স যখন সাত বছর তখন বড় মা মারা যান। শুনেছিলাম পাঁচ দিন জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিলেন বড় মা। হতেও পারে, আম্মার মতো বড়মাও নিশ্চয়ই আব্বার কাছে শুধু অবহেলাই পেয়েছেন।

আব্বা সবসময় বদরাগী মানুষ ছিলেন। ইদানীং এই স্বভাব আরো খারাপ পর্যায়ে যায়, পান থেকে চুন খসলেই তিনি গালাগালি শুরু করতেন। ফলে পাড়া প্রতিবেশী কারো সাথে ওনার সম্পর্ক ভালো চলছিলো না। নোয়াখালীর হরিনারায়ণপুরে পুরনো আমলের দোতলা বিল্ডিং আমাদের, নীচ তলাটা গুদামঘর।
আব্বার ব্যবসার নানা সামগ্রী মজুদ করে রাখেন একপাশে, অন্য পাশটা ভাড়া দেওয়া। সেটাও গুদামঘর হিসেবেই ভাড়া দিয়েছিলেন আব্বা।

বাড়ির পিছনে বড় একটা পুকুর ছিল, আর বাড়ির সামনে এক চিলতে উঠোন। পেছনের পুকুরটা আব্বা ভরাট করে ফেলেছিলেন, প্রায় দেড়বছর আগে। আব্বার ইচ্ছে ছিলো পুকুরের জায়গা ভরাট করা শেষে বড় করে নতুন বিল্ডিং ওঠাবেন, আর পুরনো বিল্ডিং ভেঙে সামনে দোকানঘর করবেন, সেগুলো ভাড়া হবে।

কিন্তু হঠাৎ করোনার ভয়াল থাবায় সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়। ব্যবসা আর আগের মতো থাকে না, যার প্রভাব আব্বার মন মেজাজের উপরও এসেছিল। ইদানীং তিনি কাউকে সহ্য করতে পারছিলেন না। সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন।
আম্মা সারাক্ষণ আব্বার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। আর
আমি তো নিজের দুঃখেই নিরব হয়ে গিয়েছিলাম, বিয়ের মাত্র এগারো মাস না যেতেই বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে এসেছি। স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে শ্বশুর বাড়িও আমার জন্য পর হয়ে যায়। নাতি নাতনি নেই, কমবয়সী বিধবা ছেলের বৌ কে তারা রাখতে চায় না। বড় জা ভয় পেত ভাসুরের নজর যায় নাকি আমার উপর, শাশুড়ি আম্মা চিন্তা করতেন দেবরকে নিয়ে।
অপয়া বিধবা ভাইয়ের বৌ এর প্রতি দেবরের আকর্ষণ তৈরি হোক এটা তিনি চাইতেন না।

যতই নিজেকে আড়ালে রেখে ঐ বাড়িতে পরে থাকতে চাইতাম, লাভ হয়নি। আসলে আমি বাবার বাড়ি ফিরে আসতে চাইনি, জানতাম এখানে আমাকে সাদরে গ্রহণ করা হবে না। কিন্তু একরকম জোর করেই শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। কী কদর্য ছিল সেই দিন, আব্বা ব্যাপক চিৎকার চেঁচামেচি করলেন ওনাদের সাথে, বিয়ে দিয়েছেন এখন আমি ঐ বাড়ির বৌ, ওনাদের দ্বায়িত্ব। ওনারাও ঠিক করে এসেছেন আমাকে দিয়ে যাবেন।

ছিঃ এক ফেলনা জিনিস যেন, এ বলছে তুমি রাখো, ও বলছে তুমি। বরাবরের মতো আম্মা নিরব দর্শক, একপাশে শুধু আঁচল চাপা দিয়ে কান্না করে গিয়েছেন।
পাড়া প্রতিবেশীরা মজা দেখতে ভীড় করেছিলো। শেষে একলাখ টাকা, আর আমার বিয়ের গয়না গুলো ফেরত দিয়ে আমাকে রেখে যেতে পারেন শ্বশুর শাশুড়ি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন তারা।

কমবয়সী বিধবা ছেলের বৌ তারা রাখতে চায় না, বিধবা মেয়ের বোঝা আব্বা আর নিতে চায় না।
তবু অনিচ্ছা সত্ত্বে আমাকে রাখতে অবশেষে বাধ্য হন। তবে আমি চোখের সামনে পড়লেই আব্বা খিটমিট করতেন। কথার আঘাতে এত জর্জরিত হয়েছি, যে মাঝেমাঝে মনে হতো আত্মহত্যা করি। আম্মার কান্না আমাকে একসময় আর স্পর্শ করতো না। নিরব থেকে সারাজীবন সন্তানের সাথে অন্যায় হতে দিয়েছেন বলে আম্মার উপর তীব্র অভিমান হতো। মা পাখি ও তো ঝড় ঝাপটা থেকে বাচ্চা কে বুকে আগলে রেখে উদ্ধার কে, অথচ আম্মা মানুষ হয়েও কোনদিন ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

একসময় আম্মার সমব্যথী ছিলাম, বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতম, সেই আমি তীব্র অভিমানে নিজেকে আম্মার কাছ থেকে এতটাই গুটিয়ে নিলাম যে আম্মার শরীর ভালো নেই তা শুরুতে চোখে পরেনি।
আম্মা ছোটবোন লতার হাতে বুকে সরিষার তেলে রসুন পুড়ে মালিশ করাতেন। খুব ব্যথা পেতেন বুকে।

অভিমান আর ধরে রাখতে পারিনি। আব্বাকে অনুরোধ করেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। ব্যবসায় মন্দা, আমার বিধবা হয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া, আব্বাকে এতটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল যে আম্মার বুকে ব্যথাটা একটা উটকো ঝামেলা ছিলো তার জন্য।
তবে আম্মা বেশি জ্বালাননি, দুম করে ঘুমের ভিতর হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। ভয় পেতে পেতে আম্মার হার্ট বোধহয় একদম দূর্বল হয়ে পরেছিলো, অথবা দীর্ঘদিন ধরেই হয়তো অসুখ চেপে রেখেছিলেন তিনি।তাই শেষের দিকে আর সময় দেয়নি।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সারাজীবন যে আম্মাকে আব্বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, সেই আম্মার মৃত্যুতে আব্বা যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পরেছিলেন।
আম্মার জন্য আব্বার শোকের বহিঃপ্রকাশ আমার কাছে উপহাস লাগতো। কারণ জানতাম খুব তাড়াতাড়ি স্বরূপে ফিরে আসবেন। হয়েও ছিলো তাই। একমাসের মধ্যে আব্বা তৃতীয় বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। নাহ সামাজিক বা ধর্মীয় কোনভাবেই আব্বার বিয়ে করতে চাওয়াটা অবৈধ নাহ। আমার আর লতার আব্বাকে আটকানোর কোন ক্ষমতা ও ছিলো না।
তা-ও আমি বিরোধিতা করেছিলাম, কেননা কমবয়সী তরু খালাকে বিয়ে করার জন্য আব্বা দোকানঘর পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চলেছিলেন।

তরু খালার ভাই তার বোনকে এত বয়সী একজনের লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল না। যদিও তরু খালার ও এটা প্রথম বিয়ে নয়, তবুও সুন্দরী খালার জন্য তার দাবী ছিলো পনেরো লাখ টাকার কাবিন।আর তা হাতে হাতে উসুল হবে। আব্বা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন, একাকিত্ব তাকে এতটাই নাকি কুড়ে খাচ্ছিল যে এর হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি সম্পদও বিক্রি করতে রাজি। এই নিয়ে ঘরে অশান্তি শুরু হয়। চিরকাল আমাদের ভালোমন্দ থেকে দূরে থাকা ভাইয়াও এবার বিরোধিতা করেন। প্রথমে ফোনে ভাইয়া, তারপর বাড়িতে আমি আর তরু দোকানঘর বিক্রি না করতে অনুরোধ করায় আব্বার মাথা গরম হয়ে যায়, তীব্র গালিগালাজ করেন আমাদের।

আম্মা আর আমরা দুইবোন নাকি অপয়া, জোঁকের মতো শুধু ওনার রক্ত শুষে গিয়েছি। বিয়ে দিয়েও শান্তি পাননি, একবছর হতে না হতে আবার কাঁধে এসে উঠেছি। অথচ পড়ার মাঝপথে বিয়ে না দিতে আব্বাকে কত অনুরোধ করেছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি, আব্বা যেনো সব ভুলে গেলেন। রাতে যে লোক সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে শুতে গেলেন, আজ একটু পর তিনি ই এ-ই বাড়ি থেকে চিরবিদায় নেবেন। খাটিয়া এনে রাখা হয়েছে, ভাইয়া এলে আব্বাকে শেষ গোসল দেওয়া হবে।

আম্মার মৃত্যুর পর ও ভাইয়াকে খবর দেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু সৎ মায়ের জন্য ভাইয়া সেবার আসেনি। এবার আব্বার মৃত্যুতে আসছেন,
কেন আসছেন জানি। তবে এবার আমি চারু আর চারাগাছের মতো নুয়ে পরব না, চারু এবার মহিরুহ হবে। লতা আর আমার জন্য এবার আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ভাইয়া যে মহত উদ্দেশ্যে আসছেন না আমরা দুবোন জানি। তবে আমরাও এবার লড়াইয়ে প্রস্তুত। দেয়ালে যে পিঠ ঠেকেছে, ঘুরে তো দাঁড়াতেই হবে।

Rukshat Jahan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here