#চিরসাথী_তুমি_আমার,১ম পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
বিয়ের অনুষ্ঠানের ঠিক চারদিন আগে জানতে পারি আমার হবু বর সায়ন আমার মেজ আপাকে ভালোবাসতো। মেজ আপার বিয়ে হয়ে গেছে গত দুইবছর হলো।
চারদিন আগে সায়ন আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলে। আমি বাবাকে বলতেই আমার ছোটো ভাই মাহফুজের সাথে আমাকে সায়নের সাথে দেখা করতে পাঠিয়ে দেয় তারা। পাঠানো বললে ভুল হবে, মূলত সে গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে এসেই উপস্থিত হয়েছিলো। আমি আর মাহফুজ গাড়ির দরজা খুলে পিছনের সীটে বসে পড়ি।
আমি কেন সামনে বসিনি সায়নের সেসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা ছিলোনা।
বেশকিছুক্ষণ গাড়ি ড্রাইভ করার পর হঠাৎ সায়ন ব্রেকে পা দিলো। গাড়ি থেমে গেলো।
এতোক্ষণ ঘুরে ফিরে আমাদের গ্রামের বাজারে এসেই গাড়ি থামিয়েছে সে।
কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে হঠাৎ পিছন ফিরে বলল, “সাথী তোর সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো। কিন্তু কিভাবে বলবো বলতো?”
বুঝতে পারলাম মাহফুজকে সাথে আনায় সে অনেকটা বিরক্ত হয়েছে। মাহফুজকে সে অপছন্দ করে এমন নয়, বরং মাহফুজ আর তার খুব ভাব। মাহফুজ প্রায় সন্ধ্যায় বাড়ি এসে বলতো, “আজকে সায়ন ভাই মালাই চা খেতে নিয়ে গেছিলো, আজকে নান রুটি খেতে নিয়ে গেছিলো।” এরকম হাজারটা কথা বলতো। তবে সায়ন আজকে মাহফুজকে দেখে বেশ বিরক্তি।
বেশকিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আমি সায়নকে বললাম, “পাশের গ্রামে নতুন পার্ক হয়েছে যাবেন নাকি? ‘মোজাম্মেল ফুড কর্নার এন্ড ফ্যামিলি পার্ক’ নাম মনে হয়।”
আমার কথা শুনে সায়ন কাওকে ফোন দিয়ে আসতে বলল।
একটু পর সায়নের বন্ধু রানা ভাইয়া আসলো। সায়নের পাশের সীটে বসে পিছন ফিরে আমাকে দেখতে পেয়ে হালচাল জিজ্ঞাসা করলো, আমিও মিষ্টি করে উত্তর দিলাম। আবার ধীরে ধীরে গাড়ি চলা শুরু করলো।
৫ মিনিটের রাস্তায় ১০ মিনিট ব্যয় করে অবশেষে আমরা পার্কে পৌছালাম। গাড়ি পার্কিং-এ রেখে ২০ টাকা জনপ্রতি টিকিট কাটলো সায়ন।
পার্কে ঢুকতেই রানা ভাইয়া মাহফুজকে বলল, “মাহফুজ চলো আমরা এক জায়গায় যাই, মাটির বিভিন্ন মূর্তি আছে ওখানে, কেও ধান ভানছে, কেও বা ঢেকিতে চাউলের আটা কুটছে।”
মাহফুজ এসব বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এসব জিনিস অহরহ দেখে তাই এই ঘটনা তার কাছে নতুন কিছু ঠেকলো না।
মাহফুজের অনাগ্রহ দেখে সায়ন তাকে বলল, “মাহফুজ তুই একটু তোর রানা ভাইয়ের সাথে থাকবি? আমি সাথীর সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
ভাই আমার ক্লাস সেভেনে পড়ে, একেতো সায়নের ভক্ত সে তার উপর দুলাভাই। সে হাসি মুখে বলল, ” তোমরা যাও আমি আর রানা ভাই বরং মাটির মূর্তিগুলো দেখি।” ভাই আমার যথেষ্ট বুদ্ধিমান তাই সায়নের বেশি ঝামেলায় পড়তে হলো না।
রানা ভাইয়ার সাথে মাহফুজ যাওয়ার পর সায়ন হঠাৎ আমার হাত ধরলো।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে তাকালাম। সায়ন মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, “তুই ভয় পাসনা আমাকে, আমি কোনো বেয়াদবি করবোনা তোর সাথে, তুই আমার হবু বউ, সরি, বউ। প্লিজ একটু স্বাভাবিক হয়ে থাক।”
আমি স্বাভাবিক হতে পারলাম না, তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম স্বাভাবিক হতে। আমার চেষ্টা দেখে সায়ন বেশ খুশিই হলো মনে হলো। আলতো হাতে আমাকে টেনে নিয়ে পার্কের দক্ষিণ দিকটায় গেলো। গোল একটা ছাতার মত কি বানানো খড় দিয়ে, গ্রামের ভাষায় খড়ের চাল বলে এটাকে, এটার নিচে চারটা চেয়ার পাতানো । আমাকে একটা চেয়ারে বসতে বললো সায়ন। হাতটা তখনও ধরে রেখেছে সে।
আমি ভাবলাম আমি বসার পর হয়তো হাতটা ছেড়ে দেবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার পাশেই চেয়ার টেনে একদম গায়ে গা লাগিয়ে বসলো। আজকের দিনটা যেন কেমন যাচ্ছে বোঝানো মুশকিল।
এমন নয় যে আমি সায়নকে ভালোবাসি। আসলে প্রত্যেকটা মেয়েই তার বরকে নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবে, আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। তাকে বিয়ে করলে ভালো তো বাসতেই হবে আজ কিনবা কাল।
সায়নের গলা ঝাড়া দেওয়ায় ভাবনা থেকে বের হলাম। সায়ন আমাকে তার দিকে তাকাতে বলল। সায়নকে ঘীরে এই প্রথম আমার জীবনে লজ্জা পেলাম।
আমি তার দিকে তাকাতে পারলাম না দেখে সে একটু হাসি দিয়ে বলা শুরু করলো, ” সাথী এখন যেটা বলবো সেটা বলা উচিৎ ছিলো অনেক আগেই। তুই আশাকরি আমাকে ভুল বুঝবিনা। আমি যখন অনার্স শেষ করি তখন তোর মেজ আপা, মানে রিয়াকে আমার সাথে বিয়ের জন্য আমার মা তোর মা-বাবার কাছে যায়। তারা বলে রিয়াকে আর একবছর ঘরে রাখবে, এর ভিতর আমি চাকরি পেলে বিয়ে দেবে। হয়তো একটা পবিত্র সম্পর্ক হবে এই ভেবে আমি রিয়াকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। বিশ্বাস কর আমি একদিনও ওর সাথে কথা বলিনি, কিংবা ওকে ডিস্টার্ব করিনি। এক বছর পার হওয়ার আগেই পুলিশের এস আই একটা ছেলের সাথে রিয়ার বিয়ে দিয়ে দিলো তোর বাবা মা।
মা সেদিন তোর বাবার কাছে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি যেতে দেইনি। এরপর আমার চাকরি হলো সেটা তো জানিস, তোর সাথে বিয়ের কথাও জানিস। আমি একটা ভয়ংকর পণ করে ফেলেছি, তোর মেজো আপা আর তোর মেজ দুলাভাইকে আমি উচিৎ শিক্ষা দেবো। কিন্তু আবার সাথে সাথেই ভাবি, তারা তো কোনো দোষ করেনি, তাদের কেন শাস্তি দেবো! এমনকি রিয়ার সাথে আমার বিয়ের কথা তোর বাবা মা ছাড়া তোরা ভাইবোনেরা কেওই জানতিস না, রিয়াও না।
বিশ্বাস কর সাথী আমি তোর বোনকে শাস্তি দিতে চাইনা, কিন্তু যখন ওকে আমার সামনে দেখি আমার হঠাৎ রাগ হয়। তুই আমাকে একটা সাহায্য করবি সাথী?”
এতোক্ষণে আমার চোখে পানি টলমল করছে। এতোক্ষণ বলা তার কথাগুলো কান্না করার মত কিনা জানিনা তবে আমার কান্না লাগছে। যাকে আজ বাদে কাল বিয়ে করবো সে নাকি আমার বোনের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এসেছে। আমার তার দিকে তাকাতেই সে মাথাটা নিচু করে নিলো। হয়তো আমার চোখের পানির জন্য সে অনুতপ্ত।
আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে রইলাম। সে আবার বলল,” আমি তোর সাথে স্বাভাবিক হতে চাই সাথী। তুই আমার স্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে আমার একান্ত মানুষ, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবি। আমি জানি এই কথাগুলো না বললে তুই কোনোদিন কিছুই জানতে পারতিস না।
কিন্তু আমি সুখী হতাম না কোনোভাবে।
আমার স্ত্রী কিংবা হবু স্ত্রীর আমার বিষয়ে জানা উচিৎ। সে জন্য তোকে সব জানালাম। বিশ্বাস কর, রিয়ার প্রতি আমার যে অনুভূতিই থাকুক না কেন, তার জন্য তোকে একটুও কষ্ট দেবোনা।”
এরপর তার অন্য হাতটা এগিয়ে আনলো, আমার হাতকে তার দুই হাতের মুঠোয় নিলো। এই প্রথম একটা স্পর্শ আমাকে জানান দিচ্ছে এই মানুষটা একান্তই আমার, তার সুখ তার দুঃখের সঙ্গী আমি।
এই পুরুষটাকে নিয়ে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি আছে, যা বলে শেষ করা যাবেনা। ছাত্র জীবনে সে আমাদের প্রাইভেট পড়াতো, ক্লাস টু থেকে সিক্স পর্যন্ত তার কাছে পড়েছি আমি আর মেজ আপা। মেজে আপা এইটে পড়তো। এরপর সে পড়াশোনার জন্য শহরে চলে যায়। আমাদের জীবন আবার চলতে থাকে। অন্য এক টিচারের কাছে পড়তাম। নতুন টিচার মোটেই আমাদের মারতোনা।
সায়ন আমাদের দুই বোনকে শাস্তি দিতো খুব, বেত দিয়ে হাতের তালুতে এমন আঘাত করতো যে কেদে দিতাম আমরা।
আজ সেই হাতর তালু সে পরম আদরে ধরে রেখেছে। হয়তো কোনো বিশ্বাসের চাদরে মুড়িয়ে দিতে চায় এই স্পর্শ।
তবে মনের ভিতর একটা ভয় হচ্ছে, লোকটা মেজ আপার কোনো ক্ষতি করবেনা তো?
আমি এটা নিয়ে ভাবতে চাইনা। যা হবে আমি দেখবো, কিন্তু এই লোকটাকে ছাড়তে পারবোনা। আমি চাইলেও পারবোনা।
কারণ বিয়ে তো একবারই হয় সেটাতো তিনদিন আগেই হয়ে গেছে। শুধু অনুষ্ঠান করাটাই বাকি আছে। এই স্পর্শ আমার স্বামীর, আমার একান্ত প্রিয়জন। আমি তাকে ভালোবাসবো কাল হোক কিংবা পরশু। স্ত্রী স্বামীর প্রেমে পড়বে এটা প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। আমার হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে খেয়াল করলাম। এর নাম কি সুখ নাকি দুঃখ!
মেজ আপার কোনো ঝামেলা হবেনাতো! সময় বলে দেবে। জ্ঞান হারাচ্ছি নাকি ঘুমাচ্ছি জানিনা তবে এরপর বেশকিছুক্ষণের স্মৃতি আমার কাছে নেই।
চলবে..