চিরসাথী_তুমি_আমার পর্ব ০২,০৩

0
562

#চিরসাথী_তুমি_আমার
পর্ব ০২,০৩
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
০২

ঘুম, যা ক্লান্তি দূর করার সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যম।
তবে আমার ঘুমটা ছিলো অসহ্যকর। ঘুম ভাঙতে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা উপলব্ধি করলাম।
চোখ খুলেই সামনে অনেককেই দেখলাম। একটু নড়তে যাবো এমন সময় বাম হাতে খচ করে উঠলো। আমি মুখ দিয়ে ‘উ’ শব্দ করে উঠলাম, যন্ত্রণায় চোখ থেকে নোনাপানি বের হয়ে গেলো।

হঠাৎ মায়ের কান্না শুনতে পেলাম। কান্নার সাথে গুনগুন করে বলছে, “আজ বাদে কাল মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো, কিন্তু এই দুর্বল দেহ নিয়ে ও চলবে কিভাবে! দুইদিন পর স্বামীর বাড়ি যাবে আর এখন স্যালাইন দেওয়া লাগছে।”

একটু পর বড় আপা একটা বাটিতে করে কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে এসে আমার সামনে বসলো, উদ্দেশ্য আমাকে মিষ্টি খাওয়ানো।

আপা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “এভাবে শরীর দুর্বল হলে কিভাবে হবে বলতো? চারদিন পর শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখবি এর-ওর গায়ে আছাড় খাচ্ছিস আর জ্ঞান হারাচ্ছি, তখন সবাই বলবে, এ কেমন অজ্ঞ মেয়ে!”

আমি ভ্রু কুচকে বড় আপার দিকে তাকালাম। জ্ঞান হারালে তাহলে অজ্ঞ বলে? না না, অজ্ঞ মানেতো যার জ্ঞান নেই কোনো একটা বিষয়ে।
হঠাৎ মনে হলো, তাহলে পার্কে আমি ঘুমাইনি। জ্ঞান হারিয়েছিলাম, কিন্তু সেই মানুষটাকে তো আসেপাশে কোথাও দেখছিনা। তার তো উচিৎ ছিলো দ্বায়িত্ববান স্বামীর মত মাথার পাশে বসে থাকা।
আচ্ছা আমার জায়গায় মেজআপা হলেও কি সে এমন গায়েব হয়ে থাকতো! হয়তো না, কারণ সে তো মেজ আপাকে ভালোবাসতো।

এসব ভাবছি তখনি সায়নের প্রবেশ ঘটলো ঘরের ভিতর। কানে ফোন নিয়ে কাওকে বলছে, ” ও তো মিষ্টি খেতে চাইনা। দেখি জোর করে খাওয়ানো যায় কিনা! তোমার এখন আসার দরকার নেই আপাতত সব ঠিক আছে।”
ওপাশ থেকে কি বললো কিছুই শুনতে পেলাম না।
“হ্যা, হু, আচ্ছা, রাখছি, খেয়ে ঘুমিয়ে যেও, আজকে এখানেই থেকে যাবো।” এসব বলে কলটা কেটে দিলো। ফোন পকেটে রেখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আচ্ছা ও যেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই দৃষ্টির নাম কি? করুণ, বাথ্যাতুর নাকি যন্ত্রণার!
তবে আর যায়হোক এই দৃষ্টিতে আমি সুখ খুজে পাইনি। মাথ্যা ব্যাথা নিয়েও ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি চলে আসলো আমার। এই লোকটা আমার অসুস্থতায় কষ্ট পাচ্ছে!
আমার জন্য তার কষ্ট পাওয়াটা যেন তার মনে আমার জন্য তৈরী হওয়া নতুন অনুভূতিকে জানান দিচ্ছে। তাহলে মেজআপার জন্য তার অনুভূতি হারিয়ে গেল মাত্র কয়দিনে? এই তার ভালোবাসা? অন্য একজনকে পেয়ে ভালোবাসা ভুলে গেলো!

নিজের উপর নিজেই বেশ বিরক্ত হচ্ছি সাথে সায়নের উপরও।
কেন সে মেজআপার গল্প আমার সাথে বলতে গেলো! তাকে নিয়ে কিছু ভাবতে গেলেই তো আমার ভাবনায় মেজআপা হানা দিচ্ছে।
সেতো আমাকে কষ্ট দেবেনা বলেছে, তাহলে আমি কেন এতো দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি!

সায়ন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকানোর পর দৃষ্টি সরিয়ে মাকে বলল, “মামী আপনি কাদবেন না। ওর কিছুই হয়নি। আমরা তো থাকবো ওর সাথে। আপনি এমন কান্নাকাটি করলে ওর মন ভালো থাকবে আপনিই বলুন?”

এতোক্ষণ আমার মা কান্না করছে সেটার প্রতি আমার খেয়াল হইনি কেন! নাকি সায়নের কথা ভাবতে গিয়ে সবকিছু ভুলে বসে আছি! না না, শুয়ে আছি।
বড় আপা আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দেওয়ার জন্য বাটি থেকে একটা মিষ্টি আমার মুখের সামনে ধরলো। আমি মিষ্টি খাবোনা তাই মাথা এদিক ওদিক নাড়াতে লাগলাম। আমার জন্য মিষ্টির গায়ে লেগে থাকা রস তো আর অপেক্ষা করবেনা! কয়েকফোটা আমার গলায় পড়লো। বিষয়টা কেও না দেখলেও সায়নের চোখে বাধলো।
বড় আপার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সায়নের বিরক্তিকর দৃষ্টি বড় আপা খেয়াল করতেই এক গাল হাসি দিয়ে বলল, “দেখ না সায়ন সাথী কেমন ছটফট করছে মিষ্টি না খাওয়ার জন্য! এমন করলে ওর সুগার তো লো হয়েই থাকবে।” এই বলে আপা গ্লাস থেকে পানি হাতের আঙ্গুলে নিয়ে আমার গলা থেকে মিষ্টির রস মুছিয়ে দিলো।

আপার কথা শুনে সায়ন ওর দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন ওকে খেয়ে ফেলবে। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার সুগার লো মানে কি? ডায়াবেটিস হয়েছে নাকি! দেহ ক্লান্ত খুব তবুও কষ্ট করে আপাকে বললাম, “আপা আমার ডায়াবেটিস হয়েছে তাহলে?”

ব্যাস! সায়নের রাগ দেখে কে!
আপাকে ধমক দিয়ে বলল, “সারাজীবন গাধামি করেই যাবি তুই? বুদ্ধি হবে কবে তোর? আজ বাদে কাল মা হবি, এখনো বুঝিস না কোথায় কি বলতে হয়?”
সায়নের আপা মুখ কালো করে ফেললো। আমার খুব কষ্ট লাগলো। আমার লাল টুকটুকে আপার মুখে আধার আমার একেবারেই পছন্দ না। পেটে বেবি আসার পর থেকে আমার ফর্সা আপাটা যেন লাল হয়ে গেছে। সৌন্দর্য তো দশগুণ বেড়ে গেছে, না না একশোগুন বেড়েছে।

আমি সায়নকে বললাম, “আমার আপাকে বকবেন না আপনি? আমার সব সহ্য হয় কিন্তু আমার আপার মলিন চেহারা আমার সহ্য হয়না।” এবার আমার ধমক খাওয়ার পালা চলে আসলো।
“চুপ কর তুই। দুই ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরেছে বুঝতে পারছিস তুই? বাড়ির সবাই কি চিন্তায় ছিলো তোর কোনো আইডিয়া আছে? আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো যেন।” এসব বলে একদম আমার মন খারাপের ঔষধ দিয়ে দিলো সায়ন।

মুখে আবার এক চিলতে হাসি চলে আসলো। আমার শরীর খারাপ তার জন্য দম বন্ধ হওয়ার সামিল। ইস! আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। মেজআপা আমার জায়গায় থাকলেও কি ওর দম বন্ধ হওয়ার মত কিছু হতো!

ইচ্ছা করছে নিজের কানের নিচে কয়েকটা থাপ্পড় লাগাই। কেন বারবার মেজআপাকে নিয়ে আসছি আমি। একদিনেই এতো কিছু কেন ভাবছি আমি। লোকটা তো বলেছে আমার সাথে ভালো থাকতে চায়, তাহলে কেন উল্টাপাল্টা ভাবি আমি!

সায়ন বড় আপাকে উঠিয়ে আমার পাশে বসে পড়লো। বড় আপা বুঝলো সায়ন আমাকে মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য আমার পাশে বসেছে তাই হাতের মিষ্টি বাটিতে রেখে সেটা সায়নের হাতে ধরিয়ে দিলো। এরপর মাকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইলো। কিন্তু মা কোনভাবেই আমাকে রেখে যাবেনা। হঠাৎ মা কি মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে বড়আপার সাথে রুমের বাইরে চলে গেলো। অন্যান্য যারা ছিলো তারাও চলে গেলো ঘর থেকে।

সবার পিছুপিছু সায়নও গেলো। কিন্তু আমাকে ফেলে সবাই চলে যাচ্ছে কেন! আমার ছোট্ট মাথার মোটা ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দরজা ভিতর থেকে ঠেলে দিয়ে ফিরতে লাগলো। আমি অবাক হয়নি একটুও। সে আমাকে এখন জোর করে মিষ্টি খাওয়াবে।
বাড়ির সবার সামনে সেটা সম্ভব না তাই বড়আপা সবাইকে নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছে।

খেয়াল করলাম সায়ন আমার পাশে বসে আছে। আমাকে হা করতে বললো। আমি বললাম, ” দেখেন, আপনি প্লিজ আমাকে মিষ্টি খেতে জোর করবেন না। মিষ্টি খেলে আমার বমি আসে।”
সায়ন কন্ঠ অনেকটা নরম করে বলল, ” এটা এখন তোমার ওষুধ, খেতেই হবে।”
এই প্রথম সায়ন আমার সাথে নরম কন্ঠে কথা বললো এমন না। কিন্তু যদি আমার সাথে কথা বলার জন্য তার সবচেয়ে নরম গলায় কথার প্রতিযোগিতা হয় তাহলে এটিই সেরা হবে।
হঠাৎ খেয়াল হলো সে-তো আমাকে ‘তুমি’ করেও বলেছে! এমনিতেই আমার লজ্জা বেশি তার উপর তার তুমি সম্মোধন লজ্জা হাজার গুনে বাড়ি দিলো।

সায়ন একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল, “এতো লজ্জা পেতে হবেনা অসুস্থ শরীর নিয়ে। হা কর, নাহলে গাল টিপে ধরে মিষ্টি খাওয়াবো বলে দিলাম।”
তার গাল টিপে মিষ্টি খাওয়ানোর ঘটনা নতুন না।
এসএসসি(মাধ্যমিক) পরীক্ষায় যখন সে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পায় তখন আমাকে আর মেজআপাকে মিষ্টি খেতে দেয় ফুফু, মানে সায়নের মা। মেজআপা মিষ্টি পছন্দ করতো তাই গপাগপ তিনটা মিষ্টি খেয়ে নেয় কিন্তু আমি চুপ করে বসেছিলাম। সায়ন তখন আমাদেরকে পড়ানোর জন্য সেখানে উপস্থিত হয়।

মিষ্টি খাচ্ছিলাম না দেখে জোর করে। পরে যখন দেখলো মিষ্টি খাবোনা তখন আমার গাল টিপে মিষ্টির ছোট্ট টুকরো করে আমার মুখের মধ্যে দিয়ে দেয়। এভাবে দুইটা মিষ্টি খাওয়ায় আমাকে।
ভয়ে ভয়ে কোনো রকমে মিষ্টি খাওয়া শেষ করি। পড়া শেষে বাড়ি ফিরে প্রচন্ড রকমের বমি করি। এরপর জীবনেও সে মিষ্টির কথা তোলেনি আমার সামনে। এমনকি এইসএসসি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পায় সে, সবাইকে মিষ্টি দিলেও আমাকে একটুও জোর করেনি। এতো বছর পর আজকে আবার আমাকে মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

সেবার গাল টিপে ধরায় ভীষণ ব্যাথা পেয়েছিলাম, তাই সেই ভয়ে হা করলাম। আমার হা করা দেখে সায়ন একটু হাসি দিয়ে বলল, “তুমি জানো ভয় পেলে তোমাকে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগে। মন বলে গাল টেনে দিই।” কথাটা বলতে বলতেই মিষ্টি ভেঙে আমার মুখের ভিতর দিয়ে দেয়। আমি তড়িৎ গতিতে গিলে ফেলি সেটা। যেন ওষুধের ট্যাবলেট খেলাম। সায়ন আর জোর করলোনা।

আমি বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলাম, সায়ন আমার পাশে খাটে হেলান দিয়ে নিজের পা লম্বা করে আধশোয়া হয়ে রইলো। আমি কিছু বলতে গেলাম, কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, “আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই কেমন! দেখ একটু পর তোর ম্যাথা ব্যাথা কমে যাবে।”

প্রায় দশ মিনিট পর খেয়াল করলাম মাথা ব্যাথা একদম নেই। তার হাত বুলানোতে, মিষ্টি খেয়ে নাকি স্যালাইনের জন্য মাথাব্যাথা কমে গেলো বুঝলাম না। মাথায় এখনো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সে। ডান হাত আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বাম হাতে হয়তো মোবাইল চালাচ্ছে। মোবাইলে কি করছে সেটা আর আমি মাথা উচু করে দেখার চেষ্টা করলাম না।

হঠাৎ মনে হলো, আমি সায়নের এতো কাছে এই প্রথম এলাম। একটা বদ্ধ ঘরে আমি আর সায়ন। মনের ভিতর ভিন্ন এক অনুভূতিরা খেলা করে বেড়াচ্ছে, ভয় কিংবা লজ্জা। সায়ন মোবাইল চালাতে চালাতে বলল, “চিন্তা করিস না তুই, সুগার একটু লো হয়ে গেছে। তাই তোকে মিষ্টি খাওয়ালাম জোর করে। ডাক্তারকে বলেছিলাম তুই মিষ্টি খাসনা, যেন তোকে ঔষধ দেয়। তিনি মিষ্টি খাওয়াতে বলে। এতে নাকি ইন্সট্যান্ট কাজ হয়।”

আমি একটু সুখী স্ত্রী-স্ত্রী অনুভব করছি। মুখ ফসকে বলেই দিলাম, “আমি মিষ্টি খাইনা সেটা আপনি আজও মনে রেখেছেন?”

সে মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বলল, “সে কি জানে! আগে যেটা মনে রাখাটা শুধু একটা সাধারণ ঘটনা ছিলো এখন সেটা আমার দ্বায়িত্ব,কর্তব্য,ভালো…” বলতে গিয়েও শেষ করলোনা। আমিতো বাচ্চা না যে বুঝবোনা! সে তো ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছে।
আচ্ছা শব্দটা তো ভালোথাকাও হতে পারে! সেতো বলেছে আমার সাথে ভালো থাকতে চায়, ভালোবাসতে চায় একবারও তো বলেনি আমাকে।

সায়ন আবার বলল, “সাধারণ স্মৃতিকে ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু দ্বায়িত্বকে ভুলে যাওয়া যায়না। জীবন চলে গেলেও যায়না। আমি এই দ্বায়িত্ব থেকে বের হতে চাইনা কখনো, আজীবন, আমৃত্যু। সে যেন আমার হাতটা ধরে থাকে আজীবন, আমৃত্যু।”
,
,
চলবে..

#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ০৩
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী

“সায়ন ভাই কেমন আছেন?” মেজআপার কথা শুনে চোখ মেলে তাকালাম। সায়ন তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বউয়ের সামনে শালীর দিকে তাকিয়ে থাকাটা বউয়ের জন্য মোটেও সুখকর না, আমার জন্যেও তাই। সে মেজআপার দিকে তাকাবে কেন! আমি কি তার থেকে কম সুন্দরী নাকি! আমার নানী তো বলে ভাইবোনের মধ্যে আমি সবচেয়ে সুন্দর, তাহলে সে মেজআপার দিকে তাকাবে কেন! সারাদিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক, আমি কি বিরক্ত হবো নাকি!

প্রায় রাত আটটার দিকে ঘরের ভিতর হন্তদন্ত করে কেও ঢোকার শব্দ পাই আমি। ঘুম পাচ্ছিলো খুব তাই চোখ মেলে তাকাইনি। সায়নকে মেজআপার হালচাল জিজ্ঞাসা করা শুনেই চোখ মেলে তাকালাম। মনে মনে এতোক্ষণ সায়নকে প্রচুর বকা দিলাম।

আমার চোখ মেলে তাকানো দেখে মেজআপা আমার বামপাশে বসলো। ততক্ষণে স্যালাইন খুলে ফেলা হয়েছে। আপা আমার হাতটা ধরে বলল, “কেমন আছিস তুই? অনেক শুকিয়ে গেছিস যে! নিজের যত্ন নিসনা কেন?”

আমি কিছু বলার আগেই আপা বলল, “সায়ন ভাই আপনি কিন্তু সাথীকে আচ্ছা রকমের শাসন করবেন যদি ও খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা করে।”
আমি হালকা কন্ঠে বললাম, “আপা এসব বাদ দে তুই। একাই এসেছিস নাকি? দুলাভাইকে তো দেখছিনা!”

আপা বলল, “তার কি ছুটি আছে নাকি। বুঝিসই তো পুলিশের এস আই-এর চাকরি, কত ব্যাস্ত থাকা লাগে সারাদিন! বিয়ের আগের দিন চলে আসবে।” সায়নকে শুনিয়ে আপাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপা তুই দুলাভাইকে কেমন ভালোবাসিস?”

আপা আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না।। আপা আমার করা প্রশ্নে খুবই বিব্রত হলো সেই মুহুর্তে। বুঝলাম সায়নের সামনে প্রশ্ন করাটা তার ভুল ছিলো।
সায়ন আমাকে বলল, “আমি একটু বাইরে যাচ্ছি সাথী। খেয়াল রাখিস নিজের। হিমাকে পাঠাবো তোর কাছে?” সায়নের কথা শুনে মেজআপা বলল, “বড়আপাকে কেন পাঠাতে বলছেন সায়ন ভাই, আমি নেই নাকি এখানে! আপনি যান আমি সাথীর কাছেই থাকছি।” সায়ন ভাই কোনো উত্তর না দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলো।

সায়ন ভাই যেতেই মেজআপা আমার একটু কাছ ঘেষে বসলো। আমার গালে হাত রেখে বলল, “সায়ন ভাই তোকে খুব কেয়ার করে তাইনা সাথী? ওনার চোখ দেখলেই বলা যায়, খুব কেয়ারফুল তোর প্রতি। আমার সবচেয়ে সুন্দর বোনটা এতো কেয়ারফুল জীবন সাথী পেয়েছে ভাবলেই আমার সব মন খারাপ দূরে চলে যায়।”

আপার কথা বলা শেষ হতে না হতেই আমি কয়েকটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম তার দিকে, “একদিনেই এতো কেয়ার দেখে ফেললি তার ভিতর? আর তোর মন খারাপ কেন থাকবে?”
আপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সুখ হলো আপেক্ষিক জিনিস সাথী। কেও সুখের জন্য সারাজীবন কাটিয়ে দেয় তবুও একটু সুখের দেখা মেলেনা, আবার কেও অসুখের পরে অনেক সুখী হয়, আবার কারো জীবন শুধুই সুখের হয়। কোনো পিড়া থাকে কাবু করতে পারেনা।”

“আপা আমি আমার কথার জবাব পাইনি।”

আপা এবার বলল, “আমি তোর দুলাভাইয়ের সাথে একটুও সুখী না। ও একটুও ভালো মানুষ না রে সাথী। আমার বাকি জীবন নিয়ে বেশ বেসামাল আমি। শুধু ভাবি কোনোদিন হয়তো আমি তাকে আমার পার্ফেক্ট জীবনসাথী হিসেবে ফিরে পাবো। কিন্তু সেটা কবে পাবো নিজেও জানিনা। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।”

আচ্ছা আপার যদি দুলাভাইয়ের সাথে ডিভোর্স হয়ে যায় তাহলে কি সায়ন ওকে মেনে নেবে! আপার তো তখন কোনো পিছুটান থাকবেনা সায়নের সাথে ঘর করতে। কিন্তু আমার কি হবে! উপরওয়ালার কাছে আমি বারবার চাচ্ছি আপার সংসার যেন না ভাঙ্গে। তবে আপার ভালোর জন্য চাচ্ছি না আমি, চাচ্ছি যে আমার থেকে সায়ন যেন আলাদা না হয়ে যায়। মানুষটা আমার জীবনের প্রেমময় অনুভূতি দেওয়া প্রথম পুরুষ। তাকে ছাড়া থাকাটা খুব কষ্টের।

আপা আমার গালে হাত দিয়ে বলল, “তোকে যে এতো কিছু বললাম এটা যেন কাওকে বলিস না। আমার কসম দিলাম তোকে।”
মেজ আপা আর কিছু পারুক কিংবা না পারুক কসম দিতে খুব ভালোই পারে।
আমি আহত কন্ঠে তাকে বললাম, “তুই ভুল করছিস আপা। সুখের অপেক্ষা করাটা ভুল। দুঃখকে ফেলে সুখের খোঁজ করা উচিৎ তোর।”

আপা একটা ব্যাথাতুর হাসি দিয়ে বলল, “জীবনটা এযুগের কোনো রোমান্টিক লেখক লেখিকার গল্প-উপন্যাস না যে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট নায়কের আমদানি ঘটবে,নায়িকার চোখে পানি পড়ার আগেই হাত দিয়ে ধরে নেবে। জীবন চলে আপন নিয়মে, বইয়ের লেখায় না। আমি এসব নিয়ে ভাবিনা যে তার থেকে চলে আসবো। শুধু ভাবি সে ভালো হয়ে যাক।”

ইশ, বড্ড মন খারাপ হয়ে গেলো। বাবা মা সায়নের মত একটা ছেলেকে ফেলে সরকারি চাকরির লোভে নিজেদের মেজ মেয়েকে একটা খারাপ লোকের সাথে বিয়ে দিলো!
সায়নকে হয়তো পাওয়া হতো না তবে আপাতো সুখী থাকতো সায়নের সাথে!
তখন কি আমার খারাপ লাগতো! না, কখনোই না। তখন সায়নের আর আমার সম্পর্কটা থাকতো ভিন্ন, আমার আর তার জীবনের গল্প এক সুতায় বাধা থাকতো না। আজকে আছে, তাই গল্পটাও এক সুতায় বাধা। যেদিন থেকে আমার নামের পাশে সায়নের নামটা যুক্ত হয়েছে আমার অজান্তেই আমার মন তাকে নিয়ে ভাবা শুরু করে দিয়েছে।

আমার কাছে একা একা বসে থাকলে মেজআপার মন খারাপ থাকবে, তাই আমি আপাকে বাইরে যেতে বললাম। আমি বেশখানিকটা সুস্থ তাই আপার সাথেই তার সাহায্যে বাইরে এলাম। বাবা-মাসহ বাকি সবাই সেখানে উপস্থিত হয়েছে। মা উঠে এসে আমাকে নিয়ে তার পাশে বসালো। মেজ আপা বড় আপার পাশে বসলো। বাবা একটু চিন্তিত হয়ে বসে আছে। আমি বাবার চিন্তিত মুখ দেখে বললাম, “আমিতো সুস্থ আছি এখন, তুমি আর মন খারাপ করে থেকোনা বাবা।”

বাবার ভিতর কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। কিন্তু আমার আর মেজ আপার মন পালটে গেলো মা যেটা বলল সেটা শুনে। মা বলল, “তোরা বাবা তো তোকে নিচে ডেকে আনতে গেছিলো, আসলিনা কেন তখন?”
ব্যাস! এরমানে মেজ পাপা যা বলেছে বাবা শুনে ফেলেছে বোধহয়। বাবা তাহলে দরজার আড়াল থেকে সব শুনে ফেলেছে!
মেজ আপার দিকে তাকালাম, তার মুখটাও কেমন কাচুমাচু হয়ে আছে। মেজ আপা বাবার পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য বলল, “বাবা দাওয়াত দেওয়া কি শেষ? আর কারো বাকি থাকলে চলো আমি আর তুমি দাওয়াত দিয়ে আসি।”
বাবা একটা সরল হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো। খুশি বলতে কিছু নেই সেই হাসিতে। মেয়ে ভালো নেই তাই হয়তো সে ভালো থাকতে পারবেনা চাইলেও।

বাবা কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলল,” নারে মা, আর কারো দাওয়াত দেওয়া বাকি নেই। গ্রামের লোকজন খুব অভিমানী হয়, দাওয়াত একটু আগে আগেই শেষ করেছি। নাহলে এমন হবে যে, কেও একজন বলবে তাকে কেন বিয়ের দুইদিন আগে দাওয়াত দাওয়াত দেওয়া হলো। দুইদিন আগের দাওয়াত মানে তাকে ভুলে যাওয়া। এই অভিমানের ভিতরে আমি নেই। আর যদি একান্তই কাওকে ভুলে যাই তাহলে তাকে আর দাওয়াত দিয়ে তার হিসেব মত ছোটো করবোনা।”

অনেক্ক্ষণ আলাপ করা হলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। বড়আপা জানালো দুলাভাই আজকে রাতেই বাসে উঠেছে। কাল সকাল নাগাদ পৌঁছে যাবে। আর মেজ দুলাভাই তো বিয়ের আগের দিন আসবে মেজআপা তখন জানালোই। তবুও সবাইকে জানানোর জন্য আড্ডার মজলিশেও জানিয়ে দিলো। মোটামুটি ধারণা করা হলো কালকে থেকে বাড়িতে আত্মীয়রা আসতে থাকবে প্রায়। ফুফাতো ভাই বোনেরা কালকেই আসবে বাবা জানালো। যদিও তাদের অনেক আগেই আসার কথা ছিলো কিন্তু তাদের নাকি সবার পরীক্ষা চলছিলো তাই একটু লেট।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আমি চলে এলাম নিজের ঘরে। বিছানায় দেহ এলিয়ে দিয়ে বড় আপা আর মেজ আপাকেও নিজের ঘরে ডাকবো ভাবলাম। বিছানা থেকে উঠবো এমন সময় খেয়াল করলাম সায়নের ফোনটা বেডসাইড টেবিলে রেখে বাইরে চলে গেছে। এতোক্ষণে সায়নকে মনে পড়লো আমার! চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল, কথাটার যথার্থতা খুজে পেলাম আমি। এতোক্ষণ তার কথা ভাবিওনি। সেতো বলেছিলো আজকে এখানেই থাকবে।

আজকে এখানে থাকা মানেতো আমার ঘরে থাকবে সে। আনুষ্ঠানিকতা বাদেই সে আমার ঘরে থাকবে এটা আমার কাছে খুব একটা ভালো কিছু মনে হলো না। স্বামী হোক তবুও একসাথে থাকাটা আমার কাছে ভালো ঠেকবে না। স্বামী-স্ত্রীর এক সাথে থাকার রাত হলো তাদের বাসর রাত। আমি সেই সময়টার অনুভূতিগুলো হারাতে চাইনা। সিদ্ধান্ত নিলাম সায়ন আসলেই আমি তাকে মাহফুজের ঘরে থাকতে বলবো।

সায়নের ফোনটা হাতে নিলাম। পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই আলো জ্বলে উঠলো। খেয়াল করলাম ফোনে কোনো পাসওয়ার্ড দেওয়া নেই। নরমাল লকটা খুলতেই এক চিলতে, না না অমোঘ এক হাসি চলে আসলো আমার ঠোঁটের কোনে। হোমস্ক্রিনে বিয়ে পড়ানোর দিনের ছবি উঠে আছে। সায়ন আমার হাত ধরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিলো আমি লজ্জায় মাথা উঁচু করতে পারিনি। তাই মাথা নিচু করেই বসেছিলাম। বড় আপা তার ফোন দিয়ে টুপ করে ছবিটা তুলে নেয়।

আচ্ছা ছবিটা সায়ন পেল কিভাবে! আবার একটা গাধার মত চিন্তা করলাম। সায়ন আর বড় আপা ক্লাসমেট, মামাতো ফুফাতো বোন আর ভাই, যদিও একটু দূর সম্পর্কের। ছবিতো সে আপার কাছ থেকে নিতেই পারে।

হঠাৎ মনে একটা ভুত চেপে বসলো। মেসেঞ্জারে ঢুকে তার মেসেজ চেক করবো ঠিক করলাম। মেসেঞ্জার আইকনে টাচ করার সাথে সাথেই দেখলাম কেও ঘরে প্রবেশ করলো। সায়ন এসেছে এই ঘরে থাকতে। কিন্তু এতোক্ষণ সে কোথায় ছিলো! খেয়েছে কি সে! আমি জিজ্ঞাসা করার আগেই ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিলো। ধমক দিয়ে বলল, “বউ হয়েছিস বলে আমার পারসোনাল জিনিসে হাত দিবি সেটা আমি মোটেও এক্সেপ্ট করবোনা সাথী। তোর কোনো ব্যাক্তিগত জিনিসে আমি কখনো নাক গলাবো না, আশাকরি আমিও তোর থেকে সেম জিনিস পাবো।” আমি হঠাৎ রেগে গেলাম মাথামোটার মত, তেজি কন্ঠে বললাম, “আমি হাত দিলেই আপনার জ্বলবে। মেজ আপার সাথে বিয়ে হলেও কি এটাই বলতেন?”

সায়ন ভাই ঠান্ডা গলায় বলল, “ভেবেছিলাম তোকে রিয়ার কথাটা বলা ঠিক হবেনা তবুও বলেছিলাম, ভেবেছিলাম তুই আমাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করবি। কিন্তু না, তুই বিষয়টা জটিল বানিয়ে দিচ্ছিস। আমি তোর থেকে এই কথাটা মোটেও আশা করিনি সাথী।”

আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। মেজআপা আর সায়নকে জড়িয়ে বলার জন্য না বরং সায়নকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমি কিছু বলবো তার আগেই সায়ন বলল, “ভেবেছিলাম আজকে এই বাড়ি থাকবো, তবে আর সম্ভব না। আমি গেলাম, তোর এসব ইডিয়েট মার্কা কথা শুনে আমার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়িস, আমি গেলাম।”

সায়ন হনহন করে ঘর ছেড়ে চলে গেলো। আমার কথার কোনো লাগাম নেই। গাধী একটা আমি। কেন বলতে গেলাম এটা! ঠিকই তো, তার পারসোনাল জিনিস কেন আমি ঘাটবো, আর ঘাটলেও মেজ আপাকে নিয়ে কেন কথা বলবো! প্রায় সাত-আট মিনিট পর আমার ফোনে মেসেজ আসলো। মেসেজটা ওপেন করে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে, “তুমি স্নিগ্ধতায় ভরা আকাশের মত, সেই আকাশে আমি মেঘ জমতে দিতে পারিনা। আমার কথায় কষ্ট পেলে হাজারবার সরি বলতে রাজি আছি, তবুও আকাশে মেঘ যেন না জমে। Have a Sweet Dream। বিয়ের দিন দেখা হবে, বাই।”

চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here