#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ০৬,০৭
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
০৬
“আবেগ আর ভালোবাসা এক না। আমি ভালোবাসা হতে চাই। তোমার ভালোবাসা, তুমি যেমন স্নিগ্ধ তেমন স্নিগ্ধ ভালোবাসা হতে চাই।”
দুইদিন পার হয়ে গেছে। সায়নের সাথে সময়গুলো ভালোই কেটেছে এই দুইদিন । বিয়ের অনুষ্ঠানের ঠিক আগেরদিন অর্থাৎ হলুদেরদিন সন্ধ্যায় সে আমাদের বাড়িতে হাজির। সায়নের ছোটোবোন, বড়বোন আর দুলাভাই এসেছিলো হলুদ ছোয়ানোর জন্য। কিন্তু সন্ধ্যা বেলা সায়ন কেন আসলো বুঝলাম না।
বাবা সায়নকে দেখে বলল, “সায়ন তুমি হঠাৎ এখানে? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”
সায়ন মাথা হালকায় চুলকিয়ে বলে,”ইয়ে মানে আসলে….” কথা শেষ করতে পারেনা।
এরমধ্যে বড় আপা এসে সায়নের হাত ধরে বলে, “এসেছিস তুই! আয়, তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
বড় আপা সায়নের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো আমার ঘরের দিকে।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, ঘরে যা।” আমি তড়িৎ গতিতে ঘরে চলে আসলাম। এসে দেখলাম সায়ন আমার খাটে বসে আছে। আমাকে যেতে দেখে বড় আপা বলল, “নে সায়ন, তোর বউ চলে এসেছে। আমি গেলাম ভাই।”
আপা চলে গেলো। যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলো। আমি বললাম, “আপা দরজা বন্ধ করে গেলো কেন। যায় আমি খুলে দিয়ে আসি। বাড়িতে অনেক মানুষ, আমাদের এভাবে দেখলে খারাপ ভাববে। ”
নিজের কথায় নিজেই জ্বীভে কামড় দিলাম। স্বামী-স্ত্রীকে দেখলে নাকি খারাও ভাববে। কি যে চিন্তাভাবনা আমার!
সে বলল “চুপচাপ আমার পাশে এসে বসবি। স্বামী স্ত্রীর একান্ত সময় করে দেওয়ার জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলো, এটাও বুঝিসনা তুই? সবাই জানে, কেও এখন এখানে আসবেনা।”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। চুপচাপ গিয়ে খাটে বসলাম, যদিও তার থেকে একটু দূরে। আমাকে দূরে বসতে দেখে সে আমাকে কোমর জড়িয়ে টেনে আনলো তার কাছে। তার এমন কান্ডে লজ্জায় কুকড়ে গেলাম। সে আমাকে বলল, “তুইই তো চেয়েছিলি যাতে তোর স্বামী তোকে কোমর ধরে যেন কাছে আনে তুই যখন দূরে থাকবি! তাহলে এতো লজ্জা কিসের বলতো?”
আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকালাম। সে এসব জানে কিভাবে? বাসর রাতে লজ্জা পাবো আর সে লজ্জা কাটানোর জন্য আমাকে এভাবে কাছে টেনে নেবে। এটাইতো আমার ডায়েরিতে লিখেছিলাম।
কি মনে করে হঠাৎ আমার ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার খুললাম। বাড়িতে ফিরলেই ডায়েরিটা ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে রাখি। কিন্তু একি! ডায়েরি তো সেখানে ছিলো না। আমি অন্য কয়েক জায়গায় খোজাখুজি করলাম কিন্তু কোথাও ডায়েরি পেলাম না। আমার এমন তাড়াহুড়ো দেখে সায়নের ভিতর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না বরং সে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
এই লোকটা আমার ডায়েরি নেয়নি তো! আমি জিজ্ঞাসা করবো তার আগেই সে বলল, “কি খুজছিস সাথী? ডায়েরি নাকি?”
আমি খুব উত্তেজিত কন্ঠে বলি, “আপনি কি করে জানলেন? নিশ্চয়ই আমার ডায়েরি আপনি চুরি করেছেন!”
সে ভাব নিয়ে বলল, “তোর ডায়েরি আমি নিতে যাবো কেন। দেখ তোর বালিশের নিচে আছে।”
“আমিতো ডায়েরি কখনো বালিশের নিচে রাখিনা! তার মানে আপনি পড়েছেন সব কিছু!”
সায়ন বলল, “তুই আমার কাছে এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ না যে তোর ডায়েরি পড়বো আমি। যেদিন তুই অসুস্থ হয়েছিলি তখন হঠাৎ ডায়েরিটা ড্রেসিংটেবিলের উপরেই পাই আমি। তাই….”
“কি তাই? বালিশের নিচে রেখে দিয়েছেন? নিশ্চয়ই আপারা সেদিন ডায়েরি পড়ে ফেলেছে! এক মিনিট এক মিনিট, এই দুইদিন বিছানা ঠিক করার সময় তো ডায়েরি পাইনি বালিশের নিচে! আজকে কিভাবে এলো?”
সায়ন হাসলো বেশ। হাসি থামিয়ে বলল, “আজকে, এখন রেখেছি তোর ডায়েরি। এ কয়দিন আমার কাছেই ছিলো। সেদিন এখানেই পড়ছিলাম যখন তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।”
আমি রাগে নাকি লজ্জায় জানিনা তবে চুপ করে রইলাম। আমার চুপ থাকা দেখে সায়ন বলল, “শক হতে থাকবি নাকি সারাদিন! যে জন্য আসলাম তাইতো হলো না এখনো!”
আমি এবার একটু জোরালো কন্ঠে বললাম, “কারো পারসোনাল জিনিসে হাত দেওয়া আমি পছন্দ করিনা। আপনি আমার স্বামী হতে পারেন তবে ব্যাক্তিগত জিনিস একান্তই ব্যাক্তিগত, নেক্সট থেকে এই ভুল যেন না হয়।”
“ওররে, আমার কথা আমাকে ফেরত দিচ্ছিস যে! শোন, সেদিন তোকে যখন ওসব বলি তুই উত্তর দিতে পারিস নি কিন্তু আমি উত্তর দেবো।”
সেদিন কি উত্তর দিয়েছিলাম ভাবতে লাগলাম। বেশিক্ষণ ভাবনা স্থির হলো না। আমার কোমর জড়িয়ে একদম আমাকে তার গায়ের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “যেই মানুষটা আমার তার সবকিছুই আমার। তার আসবাবপত্রও আমার তার সর্দিকাশিও আমার। আর তার পারসোনাল মানেই আমার পারসোনাল, এরজন্য আমি একটুও গিলটি ফিল করছিনা।” আমি কেপে উঠলাম তার ফিসফিসিয়ে কথা বলায়। কেমন যেন কাতুকুতু লাগলো। আমি এতো রোমান্টিকতা বুঝিনা তাই এই অনুভূতি আমার কাছে কাতুকুতুর মতই।
আসলেই সে ঠিকই বলেছে। সে সম্পুর্ন মানুষটাই তো আমার। আমি কেন সেদিন এই কথাটুকু বলতে পারলাম না! বুদ্ধি কম বলে তাই! আমি এবার শতভাগ নিশ্চিত হলাম যে আমার বুদ্ধি কম।
সায়ন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রইলো। আমার একটু অভিমান হলো। লোকটা শুধু আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চায় যা আমার ডায়েরিতে লেখা ছিলো, নিজ ইচ্ছা থেকে কিছুই করেনা। এই কয়দিনের সুন্দর অনুভূতিগুলো কেমন কুয়াশার মত মিলিয়ে যাচ্ছে।
সায়ন উঠে আমার সামনে বসে আমার ডান হাত তার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “বিশ্বাস কর সাথী আমি তোর জন্য তোর সাথে এমন করছি। তোর স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চেয়েছি শুধু। আফটারঅল তুই আমার জীবন সাথী, তোকে হাসি মুখে রাখা আমার দ্বায়িত্ব হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ এমন চেহারা বানালি কেন?”
আমি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পুরুষটার সাথে কি আর আমি শক্তিতে পারি! একটু পর শান্ত হয়ে রইলাম অন্যদিকে ফিরে। সায়ন আমার মুখটা নিজের হাত দিয়ে ঘুরিয়ে তার দিকে ফেরালো। আমাকে বলল, “তোর স্বপ্নগুলো সব কিন্তু আমি পূরণ করিনি, তোর প্রতিটা ইচ্ছাকে আমি একটু অপূর্ণ রেখেছি। রাতে একসাথে জোনাকিপোকা দেখার স্বপ্ন পূরণ করিনি, কাগজে সরি লিখিনি, আজকে তোর গায়ে হলুদ ছুয়ে দেইনি। এমনকি দেবোও না। তোর সব অপূর্ন স্বপ্নের মধ্যে একটা পূর্ণতা আছে এবং সেই পূর্ণতা হলো তোর সবচেয়ে প্রিয়। জানিস সেটা কী?”
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে এইসব অপূর্ণতার মধ্যে একটা পূর্ণতা খুঁজে বের করতে লাগলাম।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছুই খুঁজে পেলাম না। সায়ন কিছুক্ষণ পর আবার বলল, “যেদিন জানতে পারবি সেটা কি সেদিন বুঝবি তুই আমাকে ভালোবাসিস।”
“আমার এসব কিছুই বোঝার নেই সায়ন আপনাকে তো আমি এমনিতেই ভালোবাসি।”
প্রেমিকার কাছ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনলে প্রেমিকের মন তো মোমের মত গলে যাওয়ার কথা। সায়নের এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই লক্ষ্য করলাম না। সায়ন ঠোঁট প্রসারিত করলো কিছুক্ষণ পর। হাসিটা কেমন রহস্যজনজ, ভয়ানক না শুধুই রহস্যজনক।
কিছুক্ষণ পর সে বলল, “আমার প্রতি তোর যেটা আছে সেটা সম্পুর্ন আবেগ। এই আবেগের নাম ভালোবাসা না সাথী।”
আমি বাচ্চাদের মত জেদি কন্ঠে বলি,” হ্যা এটা আবেগ আর এটাই আমার ভালোবাসা। এর আগে কারো জন্য আমার এমন হয়নি। শুধু আপনার জন্য এমন হয়। আপনার ভাবনা আমার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে এটা কিভাবে আমার ভালোবাসা না হতে পারে বলুন তো? বিশ্বাস করুন এটা আমার আবেগ এটাই আমার ভালোবাসা।” কথাগুলো বলতে বলতে কেদেই ফেললাম। জানিনা কান্নার কোনো লজিক ছিলো কিনা, তবুও কাদলাম।
সায়ন এবার আমার হাতে চুমু দিলো। সেদিনের জড়িয়ে ধরার মত আজকেও আমি অনুভূতি শূন্য। সেদিন ভয়ে জড়িয়ে ধরা উপভোগ করিনি আজকে দুঃখে চুমু উপভোগ করিনি।
সায়ন মন জুড়ানো হাসি দিলো। অন্য সময় হলে আমার মন ঠান্ডা হয়ে যেতো, এখন হলো না।
সে বলল, “কাদছিস কেন পাগলি। তোর আবেগ হোক কিংবা ভালোবাসা হোক, আমিতো তোরই থাকবো নাকি! আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি? আবার বলছি, এটা তোর আবেগ, শুধু আবেগ। প্লিজ কান্না বন্ধ কর৷ বিশ্বাস কর সাথী আবেগের পর ভালোবাসা আসে। আমিও চাই তুই আমাকে ভালোবাস, কিন্তু এই কয়দিনে কাওকে ভালোবাসা যায় বল?”
ভালোবাসায় কোনো সময় লাগেনা। হঠাৎ করেই ভালোবাসা হয়ে যায়। সায়নের জীবনে আমি জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই তো তাকে নিয়ে ভাবতে থাকি, ভালো থাকি। এটাই আমার কাছে ভালোবাসা।
আমার চুপ থাকা দেখে সায়ন বলল, “আমি চাই আমাদের বিবাহিত জীবন অন্যের মত নিরামিষ না হোক। আমরা নব্য প্রেমিক-প্রেমিকার মত থাকবো। আমরা একে অপরের প্রেমে পড়বো। দেখবি সেদিন তোর কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা পালটে যাবে।”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। কান্না করতে ভালো লাগছেনা। কালকে বিদায় নেওয়ার সময় বাকি কান্না করবো। আমার চুপ থাকা দেখে সায়ন বলল, “কান্নায় তোকে একদম মানাবে না সাথী। তুই হাসি খুশি থাকবি, আমার সাথে থাকবি। হৃদয় নিংড়ানো সুখ বুঝিস তুই! আমি আমার জীবনের সেই সুখে ভরিয়ে রাখতে চাই তোকে। তোর কান্না আমায় খুব ব্যাথা দেয় সাথী।”
আমি তার চোখের দিকে তালিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। বোঝার চেষ্টা করলাম। পারলাম না তার চোখের ভাষা পড়তে। পড়তে চাইওনা। আমি হারিয়ে যেতে পারি।
সায়ন আমাকে বসিয়ে রেখে আবার চলা শুরু করলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “ডায়েরিতে কিছু উত্তর লিখে রেখেছি।”
আমি তাড়াতাড়ি ডায়েরির পাতা খুললাম। আমার লেখাগুলোর শেষ দুই পাতা অন্য কারো লেখা, সায়নের লেখা।
“তোর সব অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা আমি। জোনাকিপোকা পাসনি, কাগজে সরি লেখা পাসনি, আজকে তোর গায়ে আমার হাত দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হলুদ পাসনি। তবে একটা জিনিস পেয়েছিস তুই। কি জানিস? আমাকে। তোর সমস্ত ইচ্ছাতে আমি ছিলাম তোর সাথে। স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি তবে আমি পাশে ছিলাম, আগামীতেও তোর স্বপ্ন পূরণ করতে দেবোনা, তবে আমিই তোর পাশে থাকবো। আমি এমন প্রেমিক, এমনই স্বামী। তোর স্বামী, তোর আবেগ।”
আমি আনমনে একা একা বললাম, “হ্যা সায়ন আপনি আমার আবেগ, এই আবেগকে আমি ভালোবাসি। কিভাবে, কখন জানিনা শুধু জানি ভালোবাসি। আপনার সাথে আজীবন তর্ক হবে এই নিয়ে। আপনি বলবেন আবেগ আর ভালোবাসা আলাদা, আমি বলবো দুটোই এক জিনিস।”
হঠাৎ মেসেজ আসলো ফোনে।
“আবেগ আর ভালোবাসা এক না। আমি ভালোবাসা হতে চাই। তোমার ভালোবাসা, তুমি যেমন স্নিগ্ধ তেমন স্নিগ্ধ ভালোবাসা হতে চাই।”
,
,
চলবে ইনশাআল্লাহ
#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ০৭
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
“প্রেম হোক কিংবা মোহ, আমি তোমাতে বিভোর হতে চাই।” লেখাটা টাইপ করে সায়নকে পাঠাবো ভাবলাম। কিন্তু লজ্জায় আবার সম্পুর্নটা ডিলিট করে দিলাম। সারাজীবন যাকে আপনি সম্মোধন করেছি তাকে তুমি লিখে কিভাবে মেসেজ দেবো!
বড় আপা রুমে এসে আমাকে ডাক দিলো। একবার, দুই কয়েকবার ডাকার পর তার দিকে তাকালাম। ইস, কি মিষ্টি লাগছে আমার বড় আপাকে। তার সৌন্দর্য কোটিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে তার পাশে থাকা পুরুষটা। এই লোকটাকে দেখলে বোঝাই যায়না যে সে এতো বউ পাগল।
পরশুদিন এসেছে বড় দুলাভাই। সে যেন শালির বিয়েতে আসেনি, এসেছে বউয়ের লেজে লেজে ঘুরতে। আমি খোচা মেরে দুলাভাইকে বলল, “দুনিয়ায় যেন আপনার বউয়েরই একমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে! বাব্বাহ এমন বউ পাগল আমি জীবনেও দেখিনি।”
আমার কথা শুনে দুলাভাই খানিকটা হাসি দিয়ে বলল, “দেখা যাবে তোমার এমন অবস্থায় তোমার সায়ন সাহেব কি করে।”
আমার পটরপটর করে কথা বলা যেন একদম হারিয়ে গেলো।
আমার পেটে একদিন বাচ্চা আসবে। সায়নের বাচ্চা, আমার বাচ্চা, আমাদের বাচ্চা। ইস, কি লজ্জা! উচু পেট নিয়ে আমি মানুষের সামনে দাড়াবো কিভাবে! লজ্জার আভা সারাদেহে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। ইতিমধ্যেই গাল, নাক,কান লাল হয়ে গেছে। আপা বলল, “ঘরে আর কতক্ষণ বসে থাকবি। সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য। আমরা তোকে ডাকতে এলাম।”
আমি বললাম, “মেজআপা কোথায়, সে আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে কেন? হলুদেও তাকে বেশিক্ষণ কাছে পাইনি আমি।”
আমি বলতে বলতে মেজআপা আর দুলাভাই ঘরে ঢুকলো। দুলাভাই আমার বলা কথার উত্তর দিলো।
“রিয়ার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা তাই বারবার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ছিলো।”
আমি মেজ দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। এই লোকটাকে দেখে ভীষণ ভালো মনে হয়। হয়তো ভালো মানুষ, হয়তো স্বামী হিসেবেই খারাপ শুধু। আপার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ মুখ কেমন শুকনো লাগছে। দুলাভাই তাকে অত্যাচার করেনিতো! মনের ভিতর খচখচ করতে লাগলো৷ আপা কয়দিন ধরে এমনিতেই চুপচাপ তবে আজকে একদম ভিন্ন দেখাচ্ছে। আমি মেজ আপাকে বললাম, “তুই একটু আমার সাথে একা সময় দিবি আপা? আমি কিছুক্ষণ তোর সাথে কথা বলতে চাই।”
কিচ্ছুক্ষনের মধ্যে মেজ আপাকে রেখে সবাই চলে গেলো। আমি আপার হাত ধরে এনে আমার পাশে বসালাম। আপাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তোর এমন চেহারা দেখে আমার এখন বিয়ের অনুষ্ঠানকে ঝা’টা মা’রতে ইচ্ছা করছে। কি হয়েছে আমাকে বল। দুলাভাই কি তোকে কষ্ট দিয়েছে?”
আপা কষ্ট করে হাসি টেনে বলল, ” না রে তুই এমন ভাবিস না। আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা একদম। আমি চাইলেও একদন্ড শান্তি খুজে পাচ্ছিনা। না বসে শান্তি পাচ্ছি, না দাঁড়িয়ে, না শুয়ে। এমন আমার কোনোদিন হয়নি। দেখলিনা তোর দুলাভাইও কেমন একটা খাপছাড়া হয়ে আছে! আমার জন্য চিন্তা করছে যে মানুষটা। জানিস আমার অসুস্থতার চেয়েও ওর চিন্তা করাটা আমার জন্য শান্তি এনে দিচ্ছে। দিনশেষে আমি তার স্ত্রী, আমার জন্য সে চিন্তিত এটাই আমার কাছে অনেক কিছু।”
আমার আপা কি সুন্দর করে ভালোবাসতে পারে। প্রিয়জনের অবহেলা সে চুপ করে সহ্য করে চলেছে, তার চিন্তিত মুখ দেখে ভালোবাসা খুজে চলেছে। আমি মেজ আপাকে বড়আপার মত করে বললাম, “এভাবেও কি ভালোবাসা হয় আপা। যে কোনো কেয়ার করেনা, তোর জন্য তার করা চিন্তাটাও তোর কাছে ভালোবাসা? এতো অল্পতেই কেন সুখী হওয়ার চেষ্টা করিস তুই? এভাবে জীবন চলে আপা?”
আপাও এবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো তারপর বলল, “মরুভূমিতে একফোঁটা পানির মূল্য পিপাসুরা জানে। এক ফোটা পানি তাদের কাছে এক সমুদ্র পানির মত। আমারও কাছে তার ছোট্ট চিন্তা মরুভূমিতে পাওয়া পানির মত। সুখ যেখানে নেই সেখানে মেঘমুক্ত আকাশ দেখেও হাসতে হয়।”
আমার চোখ ভিজে এলো। আমি বললাম, “যদি আমার সুখ তোকে দিতে পারতাম তো দিয়েই দিতাম। আমার জীবনে এতো সুখ, আমার আপা এতো কষ্টে থাকে কেন! আল্লাহ আমার সুখ তোকে দিয়ে দিক। আমিন।”
আপার আমার কথা শুনে আমার মাথায় চুমু একে দিয়ে বলল, “কারো জন্য সুখ চাইতেই পারিস, নিজের সুখ হারানোর আশা করবিনা। তুই স্নিগ্ধ, সবচেয়ে স্নিগ্ধ, একদম ফুলের মত পবিত্র। আমার কলিজার টুকরা তুই। তোর সুখও যে আমার সুখ।”
আমি আপার চোখ মুছে দিয়ে বলি, “একদিন তুই এতো সুখী হবি যে তোর মনে হবে তুই স্বপ্ন দেখছিস। এটা দোয়া না আপা, এটা আমার বিশ্বাস। উপরওয়ালার প্রতি বিশ্বাস। মিলিয়ে নিস তুই।”
আপাও আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, “তাই যেন হয়। আর শোন, কালকে বাকি কান্না করিস। এখন কাদলে কালকের কান্নার মোমেন্টাম হারিয়ে যাবে।”
আপার কথা শুনে ফিক করে হাসি দিয়ে ফেললাম।
আমার আপা এতো ভালো কেন। নিজে কষ্টে থেকেও ছোটোবোনকে হাসি মুখে রাখতে চায়। আপা আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আর ঘরে থাকিস না। সবাই মন খারাপ করবে। বলবে কনে ঘরে বসে আছে।”
আমি রাগি একটা ভাব নিয়ে বলি, “আমি কিন্তু কনে না আপা। আমি বউ, আমার সায়নের বউ।”
কথাটা বলেই জ্বীভে কামড় দিলাম। আপা মজা নিলোনা বরং বলল, “তুই তোর সায়নের সাথে সুখী থাক।”
আপার সাথে কাজিনদের সঙ্গে আড্ডাদিতে গেলাম। বড় আপা, বড় দুলাভাই, মেজ দুলাভাই সবাই দেখানে ছিলো। আমাদের যেতে দেখে বড় আপা আমাকে নিয়ে নিজের পাশে বসালো। মেজ দুলাভাই মেজ আপার হাত ধরে বলল, “রিয়া এসো।” খুব আলতো করে মেজ আপাকে নিজের পাশে বসালো। আস্তে করে মেজ আপাকে কিছু একটা বলল। মেজ আপা না সূচক মাথা নাড়ালো। কেও দেখলে বলতে এরা কিউট কাপল। মন থেকেও কিউট হোক তারা, এটাই চাই আমি।
প্রায় তিন ঘন্টা ধরে আড্ডা চললো। যাদের হাতে মেহেদী দেওয়া বাকি ছিলো তারা সবাই একে একে বড় আপার কাছে আর মেজ আপার কাছে গিয়ে সিরিয়াল দিলো।
বড় আপা সবাইকে মেহেদী দিতে লাগলো, ওদিকে মেজ দুলাভাই বলল মেজআপা মেহেদী দিয়ে দিতে পারবেনা তাই চাপ পড়লো বড় আপার কাছে। বেশ কিচ্ছুক্ষণ বসে থাকার পর মেজ আপা আর দুলাভাই তাদের ঘরে চলে গেলো।
আমার একটু আড়ি পাততে ইচ্ছা করলো। কোনো রকম সবাইকে কিছু একটা বুঝিয়ে মেজ আপার ঘরের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন দেখায় তাই বসে পড়লাম, পায়ের নুপুর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম যাতে কেও এখানে কেন আছি জানতে চাইলে বলতে পারি নুপুর ঠিক করছি। বাহ সাথী বাহ, কি বুদ্ধি তোর!
প্রায় অর্ধমিনিট পর মৃদুস্বরের কথা শুনলাম। মেজ দুলাভাই বলছে, “রিয়া তুমি কিন্তু একটু বেশি করছো। যায় ওষুধ খাওয়া বন্ধ করেছো কেন? আমার সন্তানের কিছু হলে কিন্তু তোমার বিপ’দ আছে।”
মেজ আপা বলল, “আমি খাবোনা ওষুধ। আপনার সন্তানের কিছু হলে আমার কি!”
আমি যেন চিন্তা শূন্য হয়ে গেলাম। মেজ আপা প্রেগন্যান্ট? আমরা জানলামও না। পেটও তো তেমন উঁচু হয়নি এখনো।
মেজ দুলাভাই বলল, “তুমি আপনি বলে কথা বলছো কেন রিয়া? আর আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ওটা, আমাদের সন্তান। তাকে কেন কষ্ট দিবে? মা হয়ে এটা কিভাবে করতে পারছো তুমি?”
মেজ আপা বলল, “ভালোবাসা? কার সাথে কার ভালোবাসা! ওটা শুধু সংসার, নাটকের সংসার। কোনো ভালোবাসা নেই ওখানে।”
আমার কাছে মেজ দুলাভাইয়ের আচার-আচরণ একদম স্বাভাবিক লেগেছে সারাক্ষণ। এমনকি সব সময় দেখেছি সে আপাকে খুব কেয়ার করছে।তাহলে কি মেজ আপা দোষী নাকি! না আপা দোষী না আমি শতভাগ নিশ্চিত। এদের সমস্যা আমি ঠিক করবোই। এদের নিজেদের জন্য আমার পুচকুর খবর জানতেই পারলাম। দেখাচ্ছি মজা এদের।
,
চলবে ইনশাআল্লাহ