চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ০৮,০৯

0
381

#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ০৮,০৯
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
০৮

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে বিদায়ের সময় কাদতে চেষ্টা করলাম তবুও কান্না পেলোনা। বড়আপা বারবার কান্না করতে বলছিলো তবুও কান্না এলো না। বিদায়ের সময় কান্না করলে নাকি সংসার সুখের হয়। আমি তো কান্না করলাম না তাহলে আমার সংসার সুখের হবেনা নাকি!

এই কথা মনে হতেই গাড়িতে বসে হাউমাউ করে কাদতে লাগলাম। সায়ন পাশেই বসে ছিলো। আমার কানে ফিসফিস করে বলল, “এই কান্নাকাটি তোর বাড়িতে করলিনা কেন? সবাই বলল মেয়েটা কেমন কান্না করেনা। বেহায়াও বলেছে তোকে অনেকে।”

আমি কান্না করেই চলেছি। কান্নার সময় হাসির কথা সবক্ষেত্রে ফল আনে না। সায়নও কান্না থামাতে ব্যার্থ হলো। আমি কেদেই চললাম। সামনের সীটে সায়নের দুলাভাই বসে ছিলো। আমার কান্না দেখে সে বলল, “সাথী মনি, বেশি কান্না ভালো না। মেকাপ আর্টিস্ট সবাই চলে গেছে। জানোই তো গ্রামে এসব পাওয়া যায়না। তাই কান্না বন্ধ করো, তাদের ডাকলেও তারা আজকে আর এসে পৌঁছাতে পারবেনা।”

সব হাসির কথা কান্না বন্ধ করেনা তবে কিছু হাসির কথা তো পারে! দুলাভাইয়ের কথা শুনে কান্না তড়িৎগতিতে বন্ধ হয়ে গেলো। চুপ হওয়া দেখে আমার অপরপাশে বসা আমার নানি বলল, “এসব কথায় কান্না বন্ধ করিস না গাধী, সংসারে সুখী হবিনা।” নানীর কথা শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। এমনকি নানীও হাসলো। সবাই মিলে মজা নেওয়া হচ্ছে! আমার সময় আসলে আমিও দেখবো, হুহ।

বাড়িতে পৌঁছাতে ৩০ মিনিট লাগিয়ে দিলো। সায়নের বক্তব্য ছিলো গ্রামে বিয়ে করেছিতো কি হয়েছে গাড়ি ভাড়া তো দেওয়া লাগবে। তাই আশেপাশের কয়েকটা গ্রাম ঘুরে শ্বশুর বাড়ি পৌছালাম।

বিয়ের শ্বশুর বাড়িতে তেমন একটা আনুষ্ঠানিকতা থাকেনা আমাদের গ্রামে। থাকে বৌভাতের দিন। বউয়ের বাড়ি থেকে লোকজন আসে, শহরে যেমন রিসিপশনের অনুষ্ঠান হয় প্রায় তেমনই।

নতুন বউ আসলে বারান্দায় বসিয়ে রাখা হয় কিছু সময় যাতে করে পাড়ার বউ-ঝি এসে বউ দেখে যেতে পারে। কিন্তু আমিতো গ্রামের মেয়ে। বউঝিরা আর কি দেখবে! কিন্তু না, মেয়ে হিসেবে আগে দেখেছে সবাই কিন্তু আজকে বউ হিসেবে দেখতে সায়নের বাড়িতে বেশ ভিড় জমেছে। অধিকাংশই মহিলারা, তাদের পুরুষগুলো হয়তো বরযাত্রী গিয়েছিলো।

ফুফু, মানে সায়নের মা আমাকে নিজের সাথে হালকা মিশিয়ে নিয়ে বাড়ির ভিতর এগিয়ে যেতে লাগলো। আমিও চলতে লাগলাম। আমার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে বলল, “কেমন আছিস মা? এই কয়দিন এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে তোর সাথে একদন্ড কথাও বলতে পারিনি।”
আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। ফুফুর কথাতে না, বরং এই বাড়িতে বউ হিসেবে এই প্রথম পা দেওয়ার জন্য। তাই ছোট্ট করে জবাব দিলাম, “ভালো আছি ফুফু।” আমার ছোট্ট কথা ফুফু ছাড়া কেও শুনতে পেলো না। আমার লজ্জা পাওয়া দেখ আর কিছু জিজ্ঞাসা করলোনা ফুফু। আমাকে নিয়ে চলতে লাগলো।

আমাকে বারান্দায় না নিয়ে ফুফু তার ঘরে নিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই দেখলাম ফুফা বিছানায় শুয়ে আছে। আমাকে দেখেই হাসি মুখ করে হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকলো। আমি ছোট্ট পায়ে তার কাছে যেতেই সে আমাকে তার পাশে বসতে ইশারা করলো। আমি বসলাম না। আমার ভীষণ লজ্জা করছে এই বাড়ির সবকিছুতেই। সায়ন আমার পাশে ছিলো, আমাকে তার বাবার পাশে বসতে বলল,আমি বসলাম।

“তোমাদের জন্য দোয়া করা কথাটা বলাও যেন কেমন কম হয়ে যাবে। আমি সব সময় চেয়েছি সায়নের বউ হিসেবে তুমি এ বাড়িতে এসো। ভাবতেই পারছিনা আমাকে জামাই বলা ছোট্ট মেয়েটা আজ আমার বউমা। এই পরিবারকে আর আমার ছেলেকে আলোয় ভরিয়ে রেখো মা।”

আমি ফুফার দিকে তাকিয়ে বলি, “দোয়া করবেন জামাই।”
পটরপটর করে কথা বলা আমি কেমন যেন কথা হারিয়ে ফেলেছি। অন্যদিন হলে ফুফার সাথে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে যেতাম। নতুন বউ তাই হয়তো কথা কবে গেছে প্রাকৃতিকভাবেই।

ফুফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সায়নের ঘরের সামনে উপস্থিত হই কিন্তু সেখানে এক মহা বিপত্তি ঘটলো। সায়নের বড় বোন, ছোটোবোন, দুলাভাই সহ বাকি যত কাজিন ছিলো সবাই দরজার সামনে এসে দাড়ালো, উদ্দেশ্য আমাকে ঢুকতে দেওয়ার আগে তাদেরকে বকশিস দিতে হবে। আর সেটা দেবে আমার নানী। এটাই না-কি নিয়ম, নতুন বউকে বাসর ঘরে ঢোকার আগে তার সাথে আসা নানী কিংবা দাদী বর পক্ষের সবাইকে বকশিস দেবে। তা নাহলে দরজার তালা খোলা হবেনা।

সবার জোরাজোরিতে নানী তাদের হাতে তিন হাজার টাকা দিলো। সায়নের দুলাভাই বলল, “নানী তিন হাজার টাকা দিলে আপনার নাতনী আর নাতজামাই সারারাত বাসর ঘরের বাইরেই বসে থাকবে। ভালোই ভালোই দশ হাজার টাকা ফেলেন নাহলে আমরাও সারারাত ধৈর্য ধরে বসে থাকবো।”

অবশেষে প্রায় পনেরো মিনিট পর নানী সাত হাজার টাকা দিয়ে সবাইকে রাজি করিয়ে ফেলল। যদিও মা বাবা নানীর কাছে প্রায় বারো-তের হাজার টাকা দিয়েছে। ওরা জানলে সাত হাজারে শুনতো নাকি! যাক নানী আমার বাবার প্রায় পাচঁ-ছয় হাজার টাকা বাচিয়ে দিলো।

ঘর খুলে সায়নের ছোটো বোন আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলো। আমাকে সোফায় বসিয়ে সায়নকে বলল, “ভাইয়া দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নে।”
সায়ন গম্ভীর কন্ঠে বলল, “দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয় এটা ইসলামী কোনো বিধানে নেই। যাচাই করে দেখতে পারিস।”
সায়নের বড়বোন বলল, “নামাজ পড়া তো দোষের কিছু না তাইনা?”
সায়ন বলল, ” যে বিধান আমাদেরকে দেওয়া হয়নি সেটা ইবাদত হিসেবে পালন করা বিদয়াত। আর নবী(স) বলেছেন তিনি হারাম থেকেও বিদয়াতকে বেশি ভয় পান। হারামে তো জানা পাপ। চাইলেই মাফ চাওয়া যায় আল্লাহর কাছে কিন্তু বিদয়াতকে তো আমরা ভুল মানিই না।”

সায়নের ছোটোবোন সুমি বলল, “ক্ষ্যামা কর ভাই ক্ষ্যামা কর। তোর নামাজ পড়তে হবেনা। তুই যা করবি কর আমরা গেলাম।”
এরপর সবাই চলে গেলো আমাকে আর সায়নকে ভিতরে আটকে দিয়ে। সায়ন আমার পাশে এসে বলল, “চল দুই রাকাত নামাজ পড়ি। আমাদের সংসার আল্লার নামে শুরু করি।”
আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম। এই লোক বিদয়াত বিদয়াত করে এতো তর্কে করে এখন নামাজ পড়বে বলছে। যায়হোক এতো তর্কের দরকার নেই। এটাচ্ড ওয়াশরুম থেকে ওজু করে আসলাম। আমার আসার পর সায়ন ওজু করে এলো। এক সাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম। সায়ন নামাজ শেষে কোনো একটা দোয়া পড়ে আমার গায়ে ফু দিয়ে দিলো পরপর তিনবার। এরপর কাছে এসে বলল, “নামাজের পর আরও একটা জিনিস সুন্নত সাথী। এখন সেটা করলে লজ্জা করবে তোর। বাইরে যাই চল পাড়ার চাচী-ভাবী সবাই আমার বউকে দেখবে।”

সায়ন আমার হাত ধরে ঘরেই বাইরে বের হয়ে এলো। ভাবীদের কয়েকজন বলল, “তোমার বউকে আমরা নিয়ে যাচ্ছিনা। এতো ভয় পেওনা দেবর সাহেব।”
সায়ন মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “বউ বাচ্চা মানুষতো। চৌকাঠে পা বেধে পড়ে যায় কিনা সেই ভয়ে হাত ধরে বাইরে আনলাম। এখন এই দেখো তোমাদের ভরসায় রেখে গেলাম।”
ধুর, কি বলে এসব আমি ২১ বছরের মেয়ে। আমাকে বাচ্চা বলে। এক-দুই বছর পর বাচ্চার মা হয়েও যেতে পারি আর এই লোক আমাকে বাচ্চা বলছে। ইস, কি ভাবছি এসব!

সায়ন আমার হাত ছেড়ে দিয়ে তার দুলাভাইয়ের সাথে কোথাও গেলো। আমাকে পুতুলের মত হয়ে বারান্দায় একটা সোফায় বসিয়ে রাখা হলো। সবাই বিভিন্নভাবে আমাকে দেখছে। এরাতো আগেও দেখেছে আমাকে। আবার মনে পড়লো, গ্রামের মেয়ে সাথীকে দেখেছে আগে, এখন গ্রামের বউ সাথীকে দেখছে।

প্রায় এগারোটার সময় আমাকে সায়নের ঘরের ফুল দিয়ে ঘেরা বিছানায় বসানো হলো। আমি মাথা ঘুরিয়ে ঘরের সব কিছু দেখতে লাগলাম। এই ঘরে এসে ছোটোবেলায় সায়নের কাছে পড়তে বসতাম। পড়া না হলে তার হাতের বেতের মা’র খেতাম। সময়ের সাথে সাথে আজ অনেক কিছু পালটে গেছে। এই ঘরটা আর সায়নের নেই এখন সায়নের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে এই ঘরের মালকিন আমি।

আমার মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখা দেখে সুমি কানে ফিসফিস করে বলল, “কি এমন দেখছো ভাবি ঘরের এদিক ওদিক? এই ঘরেই আজকে তোমার ইজ্জত চলে যাবে।”

আমার জীবনে এতো লজ্জা কোনোদিন পাইনি আমি। ইচ্ছা করছে লজ্জায় ম’রে যাই আমি। ইস, এভাবে কেও বলে! কি লাগামহীন কথা আমার ছোটো ননদের!

চলবে ইনশাআল্লাহ

#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ০৯
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী

ননদরা আমাকে বাসর ঘরে ফুলে ঘেরা খাটে বসিয়ে রেখে বিদায় নিলো। তারা যেতেই হঠাৎ লজ্জা আমাকে মুড়িয়ে নিলো। সুমির সেই কথাটা বারবার কানে বাজছে। “কি এমন দেখছো ভাবি ঘরের এদিক ওদিক? এই ঘরেই আজকে তোমার ইজ্জ’ত যাবে।”

লজ্জা কমানোর একমাত্র মাধ্যম এই মুহুর্তে নিজেকে যতটা গুটিশুটি মেরে রাখা। আমিও তাই করলাম। চুপটি মেরে এটা ওটা ভাবছি তখনই সায়ন ঘরে এলো। আমি লজ্জায় তার দিকে ঠিকভাবে তাকাতেও পারছিনা। শুনেছি স্বামী নাকি লজ্জার চাদর হয়, তাহলে তাকে দেখে লজ্জা মিইয়ে যাচ্ছেনা কেন আমার!

খেয়াল করলাম সে আমার পাশে বসা। পাশে বললে ভুল হবে, সম্মুখে বসা। আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে সে বলল, “এতোটা জড়সড় হয়ে যাচ্ছিস কেন সাথী। ভয় কিসের আমি আছিতো!”

কি করে বলি ভয় তো তাকেই পাচ্ছি। তবে এমন ভয় না যে আজকালের গল্পের মত তোমাকে বউ হিসেবে মানিনা, আমার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।

আসলে সায়নকে যে ভয়টা পাচ্ছি এই ভয়ের কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ এমন একটা ভয় যেখানে লজ্জারা বারবার মাথানিচু করে দিচ্ছে আর সুমির মত বারবার বলছে “আজকে তোমার সর্বনা’শ হবে সায়নের হাতে।”

আমার চুপ থাকা দেখে সে আবার বলল, “ভয় পাওয়ার কিছুই নেই সাথী। এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। বিয়ে, বাসর, বাচ্চাকাচ্চা এগুলো নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”

হায় আল্লাহ এসব কি বলে এই লোক! এমনিতেই লজ্জায় ম’রি ম’রি অবস্থা তার উপর এসব কথা! বাসর রাতে নির্লজ্জ হয়ে গেলো নাকি এই লোক!
এদিকে তার কথার উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আমার এমন অবস্থা দেখে সায়ন বলল, “দেখ সাথী তুই এমন ভয় পেলে আমি এই ঘর থেকে চলে যাবো।”

তবুও আমি চুপ।

“তোর নানীকে তোর কাছে পাঠিয়ে দিতে গেলাম।”

সে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কি করে আটকাবো তাকে! হাত ধরে আটকে রাখবো! যেখানে কথা বলার ক্ষমতা নেই সেখানে তাকে হাত ধরে আটকানো বিলাসিতা। হাত ধরতে গেলে হয়তো লজ্জায় টুপ করে আমার জানটা বে’র হয়ে যাবে।

সে দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে এসে আবার আমার সামনে বসলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “স্বামী চলে যাচ্ছে বাসর ছেড়ে তাও তুই আটকাতে যাবি না? আমারই ভুল হয়েছে, তোর সাথে কোনো কথা না বলে লজ্জা ভাঙানো কাজ করা দরকার ছিলো।”

আমি লজ্জা ভাঙানোর কথা শুনে উৎসাহ নিয়ে বলে ফেললাম, “তাহলে সেটা কেন করলেন না এতোক্ষণ ধরে। লজ্জায় আমি ম’রে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি লজ্জা ভাঙানো কাজ করেন।”

সায়ন তার দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো। হাসির শব্দ বন্ধ করার চেষ্টা করছে সে। প্রায় মিনিটখানিক পর সায়ন বলল, “মুখ চেপে হাসির ঘোর বিরুদ্ধ আমি। কিন্তু তোর যা কথার শ্রী! বাড়ির লোকজন বলবে বাসর রাতে হাসাহাসি করছি কেন তাই মুখ চেপে রাখলাম।”

আমি বললাম, “আশ্চর্য তো! নিজেই বললেন লজ্জা ভাঙানো কাজ করবেন। আমিতো রাজি তাহলে হাসার কি হলো এর মধ্যে?”

সায়ন বলল, “তুই যে জন্য লজ্জা পাচ্ছিলি এসব করলেই লজ্জা ভেঙে যাবে।”

এবার মনে হয় আর রক্ষা নেই। জ্ঞান হারাবো নাকি! না না, ঠিক আছি। তবে নিজেকে অধপাগল লাগছে সায়নের এমন কথায়। ভীষণ দ’ুষ্টু তো লোকটা।

দুইজনই কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। প্রায় ২ কিংবা ৩ মিনিট পর সায়ন আমার ডান হাতটা ধরলো।

অনেক্ক্ষণ ধরে আমার হাতের তালু দেখতে লাগলো। যেন মনে হচ্ছে বিশাল মরুভূমিতে আংটি খোঁজ করা হচ্ছে। আমি বললাম, “কি দেখছেন এমন করে নিজের বেতের আ’ঘা’তের দাগ?”

বিনিময়ে সায়ন মিস্টি একটা হাসি দিলো। হৃদয় কাপানো এক ভঙ্গিতে বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা বেত দিয়ে মে’রে লাল করে দেওয়া হাতের মানুষটা আমার, একান্ত আমার। এই হাত আমার সংসার গুছিয়ে দেবে। আমার গোছানো চুল গুলো অগোছালো করে দেবে। আমার সন্তানকে পালবে, আমাদের একজন পূর্ণ পরুষ হতে সাহায্য করবে।তোর হাতে করা আঘাতের প্রতিদান দিতে ইচ্ছে করছে খুব। আচ্ছা সাথী তুই কি কখনো ভেবেছিলি সায়ন ভাই তোর স্বামী হবে?”

এই লোক আমাকে এখনো ভালোবাসতেই শুরু করেনি তাতেই এতো মন ছুয়ে দেয়। যেদিন ভালোবাসবে সেদিন আমি সইতে পারবো তো এই মানুষটার ভালোবাসা! ন্যা’কা’মি হলেও সত্যি যে আমি সইতে পারবোনা।

এভাবে চুপ থাকা ঠিক হচ্ছেনা বুঝতে পারছি কিন্তু কি করবো! আমিতো কথা বলতে পারছিনা। সায়ন বলল, “জানি জবাব দিবি না। আসলে দিতে পারছিস না। শোন একটা কথা বলি। আজকে কিন্তু আমাদের বাসর, সংসার জীবনের প্রথম রাত। আজকের এই রাত যদি নিরামিষ থেকে যায় তাহলে কেমন হয় বলতো! আমি লজ্জা দিতে চাইনা, কিন্তু এগুলো না বলেও পারছিনা। উপন্যাস বা গল্পের মত ভারীগহনা খুলে এসে শুয়ে পড়তে বলতে পারবোনা।”

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম তার দিকে। শুয়ে পড়বো না তো সারা রাত এভাবে বসে থাকবো নাকি। আমি উত্তেজিত কন্ঠে বললাম, “শুয়ে থাকবো না তো কি করবো আজব!”

সায়ন মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “যা আগে ভারি পোশাক পালটে আয় তারপরে বলছি।”

“আপনি একটু বাইরে যান নাহলে পোশাক কোথায় পাল্টাবো আমি?”

“ওয়াশরুমে পাল্টাবি, নাকি বাচ্চাদের মত ঘরে পোশাক পাল্টাস?”

আমি কথা না বলে ব্যাগ থেকে আমার সালোয়ার-কামিজ নিয়ে বাথরুমে দৌড় দিলাম। সায়ন দরজার কাছে এসে বলল, “খবরদার সালোয়ার-কামিজ পরবিনা, শাড়ি পরবি। নাহলে বাসর রাতের আমেজ চলে যাবে।”

ভারী শাড়ি পালটানোর ইচ্ছা চলে গেলো। বাইরে বের হয়ে আসলাম। আমাকে দেখে সায়ন বলল, “চলে এলি যে! পোশাক পাল্টাবি না?”

আমি বললাম, “শাড়ী পাল্টাবো না। গহনাগাঁটি খুলবো শুধু।”
সায়ন আর কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলো। আমি ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলে বসে একে একে গহনা খুলতে লাগলাম।

সায়ন পিছন থেকে বলল, “জানিসই তো আমার ঘরে ড্রেসিংটেবিল ছিলোনা! এটা বানিয়েছি ছয়দিন হলো। রোমান্টিক স্বামীর মত আমার খুব ইচ্ছা যে, বউ সাজবে আর আমি এভাবে আধশোয়া হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকবো অপলক। দেখনা তোর সাজ খুলে ফেলছিস তাও তোর দিকে তাকিয়ে আছি আমি, অপলক। সাথী তুই এতো মায়াবী কেন বলতো!”

আমি তাড়াতাড়ি গহনাগাঁটি খুলে। তার পাশে গিয়ে দাড়াই। লজ্জাটা আস্তে আস্তে উবে গেছে, ভয়টাও। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে বলি, “আপনি তো আমার প্রেমিক না তবে এতো প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে কেন বলেন তো! আপনি তো আমাকে ভালোইবাসেন না তবুও কেন এতো কাছে থাকতে ইচ্ছা করে বলেন তো!”

সায়ন বলল, “আমার উত্তর পাইনি।”
এরপর আমার হাত ধরে টান দিতেই আমি গিয়ে তার বুকের উপর পড়ি। আমাকে ধরে ঘুরিয়ে তার ডান দিকে শুইয়ে দেয় সে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “কারণ আমি তোমার পূর্ণতা। এমন পূর্ণতা যাকে তুমি সব অপূর্ণতার মাঝেও খুজে বেড়াবে।”

আমি চোখ নামিয়ে নিই। ভেজা ভেজা কন্ঠে বলি, “আপনি আমার অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা নন সায়ন, আপনার সাথে থাকলে অপূর্ণতাতেও আমি পূর্ণতা দেখি।”

সায়ন একটু এগিয়ে এসে আমার গলায় মুখ নামিয়ে দেয়। আমি যেন দম নিতে ভুলে গেলাম সেই মুহুর্তে। হঠাৎ এমন কান্ড করবে আমি সাত জনমের ভাবতে পারিনি।

আমার সেই কঠিন অবস্থায় সায়ন বলল, ” অনেকদিন তো বিয়ে করা কনে হিসেবে ছিলে আজকে বউ হবে?”

এরপর আবার সেই একই কাজ করলো।
আমি কি বলবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ভয়ে, লজ্জায় মুঠি করে তার চুল ধরে রাখি। আজকে প্রথম সে আমার লজ্জাকে জিততে চায়,আমি বারণ করলে কি শুনবে? বারণ করবো কেন, স্বামী যে আমার!

একটু ঘুমানোর পরেই আবার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো সায়ন। আমার মাথা ঠিকঠাক ভাবে বালিশে দিতে দিতে বলল, “ফজরে আজান হয়ে গেছে, নামাজের সময় হয়েছে। তাড়াতাড়ি গোসল করে নে। এরপর আমিও গোসল করে নামাজে যাবো।”

আমি মিনমিনিয়ে বলি, “আমি গোসল করবো না। ভেজা চুল নিয়ে আমি সবার সামনে যেতে পারবোনা। লজ্জা করবে আমার।”

সায়ন আমাকে আলতোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “এই দিনে গোসল করাটা স্বাভাবিক বিষয়। যদি কেও গোসল না করে তাহলেই তো অস্বাভাবিক ঘটনা হবে। সবাই ভাববে কোনো ঝামেলা হয়েছে।”

আমি উঠে পড়ি কোনোরকমে। তার কথামতো গোসল করতে যাবো কিন্তু সবার সামনে যেতে লজ্জা আমার করবেই বিশেষ করে সুমি, সে যে কি বলবে সেই ভয়ে আছি।

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here