চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১০,১১

0
403

#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১০,১১
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
১০

“ভাবীইইইই বাসর রাত কেমন হয়েছে? ফরজ গোসলও দেখছি করে ফেলেছে, হুম!”
কথাটা শোনার থেকে কেউ যদি বা’শ দিয়ে আমার মাথা ফা’টিয়ে দিতো তবুও কিছু মনে করতাম না। ভাবীকে কেউ এতো নি’র্লজ্জ-এর মত প্রশ্ন করে!

সকালে ঘর থেকে বের হয়েই এমন কথার মুখোমুখি হতে হলো। কে বলেছে সেটা নিশ্চয় না বললেও চলবে। কানের কাছে কথাটা বলে আমাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসালো মেয়েটা।

ওদিকে পেয়াজ রসুন কা’টাকু’টির কাজ চলছে। গেস্টদের জন্য রান্না হবে সাদা ভাত, ডাউল আর আলুঘাটি বা আলুঘন্ট যেটাই বলুন।
আমার কাছে আপাতত সুমিকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমার কি উচিৎ ওখানে কি কা’টাকু’টিতে হেল্প করা! আমি আস্তে করে সুমিকে বললাম, “চলো ওখানে যাই। আমরাও কাজে সাহায্য করি।”
সুমিকে যেন ভীষণ অ’ন্যায় কিছু বলে ফেলেছি। একটা ভাব নিয়ে বলল, “পাগল হয়েছো নাকি ভাবী? তুমি নতুন বউ হয়ে তরকারি কু’টতে যাবা! এখানে চুপচাপ বসে থাকো। দেখছোনা মাঝে মাঝে লোকজন আসছে নতুন বউকে দেখার জন্য!”

আমি আর কিছু বললাম না। চুপ করে বসে রইলাম। সায়নকে আশেপাশে দেখছিনা। ভোরের নামাজ পড়ে এসে পাঞ্জাবি পালটে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে, এরপর থেকে তার খোঁজ নেই কোনো। আমি সুমিকে বললাম, “তোমার ভাইয়া কোথায়? তাকে সেই ভোর থেকে দেখছিনা।”

“বাব্বাহ একদিনেই এই অবস্থা! স্বামীকে কি চোখে চোখে ছাড়া থাকবেনা নাকি তুমি! ভাইয়া যখন চলে যাবে তখন কিভাবে থাকবে?”

আমি বললাম, “চলে যাবে মানে, কোথায় চলে যাবে?”

সুমি বলল, “জানো না মনে হচ্ছে! চাকরিতে ফিরবে না পনেরোদিন পর?”

এই নিয়ে আমি মন খারাপ করতে চাইনা। সে তার চাকরিতে যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। এমনও তো হতেপারে আমাকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ করবোই না আমি।

“ভাবী কালকে কেমন এনজয় করলে?” সুমিও চোখ মেরে বলল।

“আমারও দিন আসবে সুমি। সেদিন এমন জ্বালাবো যে কা’ন্না করেও কুল পাবেনা বলে দিলাম। নির্ল’জ্জ মেয়ে।”

“নির্ল’জ্জ না হলে প্রেমে পড়া যায় নাকি!”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “এই এই তুমি প্রেম করো নাকি?”

“আরে কখন বললাম প্রেম করি। বললাম প্রেমে পড়েছি। তাকে তো আমার মনের কথা বলায় হয়নি। এমনকি সে আমাকে চেনেও না ঠিক মত। ভার্সিটির সিনিয়র সে, আর আমি তো কেবল চান্স পেলাম।”

“সাবধানে থেকো সুমি। এই ছেলেরা খুব একটা সুবিধার হয়না। দেখবা দিনশেষে একা খালি হাতে দাঁড়িয়ে আছো”
সুমি আর কিছু বলল না। আমি আবারও বাইরের কাজ দেখতে লাগলাম।

পাড়ায় মহিলারাও সাহায্য করছে আর আমি বাড়ির একমাত্র বউ হয়েও কিছু করছিনা এটা কেমন দেখায়। ওখানে যাওয়ার পর কাজ করতে নিষেধ করতে বললে তখন না হয় চলে আসবো কিন্তু এখন যাওয়া উচিৎ।
সুমির হাত ধরে বললাম, “চলো আমার সাথে। সবাই কাজ করছে আমরা বসে আছি, এটা দেখতে একটুও ভালো লাগছেনা।”
এক প্রকার জোর করেই সুমিকে দাড় করালাম। এরপর হাত ছেড়ে দিলাম। নতুন বউ জোরাজোরি করছে দেখতে ভালো দেখায়না তাই এমন করলাম।

বাইরে বের হয়েই দেখলাম। একটা বোটি ফাকা আছে। সেখানে গিয়ে বসে গেলাম উদ্দেশ্য পেয়াজ কু’টবো। একটা পেয়াজ হাতে নিয়েছি ওমনি কেও এসে ছো মেরে হাত থেকে পেয়াজ কেড়ে নিয়ে আমাকে দাড় করিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখলাম আমার একমাত্র শাশুড়ী রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমাকে বলল, “নতুন বউ হয়েও তুই এসব করার সাহস পেলি কিভাবে? নিশ্চয় সুমি বলেছে তাইনা?”

আমি বললাম, “না না ফুফু ও কেন বলবে! আমিই তো ওকে নিয়ে আসলাম।”

ফুফু আমার হাত ধরে একটু সরিয়ে আনলো। কড়া গলায় বলল, “কালকে একবার ফুফু বলেছিস কিছু বলিনি, আজকে কিন্তু ছাড় পাবিনা। মা না ডাকলে কথা বলবিনা আমার সাথে।”

আমি একটু লজ্জা পেলাম বটে। আমার তো তাকে ফুফু বলা ঠিক হচ্ছেনা। স্বামীর মাকে কিভাবে ফুফু বলা যায়! নিজের শব্দ শুধরে বললাম, “আচ্ছা মা, আর ফুফু ডাকবোনা। তুমি বকো না আর কেমন!”

আমার সুন্দর শাশুড়ী একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলল, “বকবো অবশ্য বকবো। অন্য শাশুড়ীর মত সারাদিন তোকে জ্বালাবো না আবার দোষ করলেও চুপ করে বসে থাকবোনা। আমি আদর্শ শাশুড়ী হতে পারবোনা বাপু।”

কেও একজন পিছন থেকে বলল, “তুমি আদর্শ মা হয়ে থেকো আজীবন। পিচ্চিটাকে তোমার শাশুড়ীর রূপ দেখিও না, মায়ের রূপই সবচেয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর হয়।”

বাব্বাহ প্রায় ৩ ঘন্টা পর দেখা হলো মহাশয়ের সাথে। আর এসেই এমন সাহিত্যিক মার্কা কথার ফুলঝুরি। সুমি একটু সরে এসে সায়নকে বলল, “ভাইয়া, ভাবী তোকে না দেখয়ে পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো। যাক তুই এসেছিস তাও ভালো, ভাবী এবার শান্তিমত নিশ্বাস নিতে পারবে।”

সায়ন সুমির মাথায় আস্তে করে চড় দিয়ে মাকে বলে বলে, “মা তোমার মেয়ে বড্ড পেঁকে যাচ্ছে, ওকে বিয়ে দিতে হবে যে!”
মায়ের ডাক পড়লো রান্নাঘর থেকে তাই কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। সুমিও তার ভাইয়ের উপর মিথ্যা রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। সায়ন আমায় ধীরকন্ঠে বলল, “আসলেই কি তুই আমাকে মিস করছিলি সাথী?”

আমি না বলতে যাবো তার আগেই পাড়ার এক দাদী বলল, “সায়ন, এতো বউয়ের পেছনে ঘুরলে হবে নাকি? লোকে তো বউ পাগলা বলবে!”

সায়ন স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “পেছনে কই ঘুরছি দাদী! বউকে সাথে নিয়ে চলছি। দেখছোই তো আমার বউটা কেমন বাচ্চা বাচ্চা।”

এই লোক আমাকে বাচ্চা বলে কেন বারবার! যেখানে মানুষের আঠারো পার হলেই এডাল্ট হয়ে যায় সেখানে একুশে পা দিয়েও কি বাচ্চা হয়ে থাকবো নাকি আমি! আমি সেখানে আর দাড়ালাম না। বারান্দায় এসে আবার যথাস্থানে বসে পড়লাম। দেখলাম সে দাদীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘরে ঘরে গেলো। সাথে আট দশ বছরের তিন চারজন ছেলে। একটু পর কারণ বুঝলাম যখন দেখলাম ফুল গুলো একএক জন পাজা করে নিয়ে যাচ্ছে। ফুল তার পছন্দ না আগেই জানতাম। তাই সকাল সকাল ফুলের শ্রাদ্ধ করে ফেলছে, ফুল আমার প্রিয় বলে একটারাত সব সহ্য করেছে বেচারা, আহারে!
,
,
দুপুরে বিশাল আয়োজন হলো বউভাতের। প্রায় চারশোজনের দাওয়াত দেওয়া ছিলো। কিন্তু আয়োজন করেছে পঁাচশোজনের। দাওয়াতের থেকে বেশি মানুষ আসবে এটাই স্বাভাবিক, হলোও তাই।

সন্ধ্যা নাগাদ সবাই বিদায় নিলো। আমাদের বাড়ির ওদিক থেকেও প্রায় ষাটজন এসেছিলো পয়তাল্লিশ জনের দাওয়াতে৷ বাড়ি প্রায় ফাকা ফাকা হয়ে আছে। সায়নের বড়বোন, দুলাভাই ছাড়া আর সব আত্মীয় চলে গেছে। প্রতিবেশীরা এখনো আছে, তাদের আনাগোনা আগামী কয়দিন থাকবে। নতুন বিয়ে বাড়ি বলে কথা, না আসলে কেমন দেখায়!

সুমি আর আমি ঘরে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ সায়ন ঘরে এলো। সুমি বিদায় নিয়ে যেতেই সায়ন আমার পাশে বসে বলল, “সারাদিন কি ব্যাস্ত ছিলাম দেখলিই তো। তোর খোঁজটাও একবার নিতে পারিনি। মন খারাপ হয়েছিলো নাকি একবারও?”

“উহুম, এটা আমার গ্রাম। মন খারাপ কেন হবে শুনি? আমি খুব মজা করেছি। তাছাড়া আপনি তো ব্যাস্ত ছিলেন আমি দেখেছি তাই এই নিয়ে কিছুই ভেবে ওঠা হয়নি।”

সায়ন মিষ্টি করে বলল, “বাহ, ভেবেছিলাম বউ বাচ্চা আছে এখনো। কিন্তু এখন দেখছি বাচ্চার মা হওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত।”

আমি কপাট রাগ দেখিয়ে বললাম, “বারবার সব কথায় আমাকে বাচ্চা বলবেন না তো, রাগ হয় আমার।”

সায়ন কোনো জবাব না দিয়ে খাটে আড়াআড়িভাবে শুয়ে পড়লো। পকেট থেকে ফোন বের করে আমার হাতে দিলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম না কিছুই। ফোনটা হাতে নিতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে দুটো টিকিট, প্লেনের টিকিট।
ভারতে যাবো আমরা! ইশ আরও একটা স্বপ্ন পূরণ হবে, লাচুংয়ের জিরো পয়েন্ট, বরফের চাদর এগুলো শুধু ইউটিউবেই দেখছি। এই স্বপ্নটাও পূরণ করবে সায়ন! লোকটা এতো মন ছুয়ে দেয় কেন! এখন ইচ্ছা করছে তার বুকে মাথা রেখে বলি,
“এভাবে আর কত স্বপ্ন পূরণ করবেন আপনি। আপনি আমার সাথে আছেন এই সুখটাই যে আমার জীবনের সেরা সুখ। বেশি সুখ সহ্য হবেতো আমার! সব স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে যেন কেও ঘুমটা ভাঙিয়ে দেবে।”

মনের কথাটা সায়৷ শুনে ফেলল নাকি এমনিতেই বলল বুঝলাম না। তবে মনে হলো কথাটা আমার মনের কথার নিখুঁত উত্তর।

সায়ন মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
“তোমার স্বপ্নগুলোকে পূরণ করতে ভালোবাসি।”

“আর আমাকে?”

“সেটাও একদিন হয়ে যাবে চলতে চলতে।” সায়নের নির্লিপ্ত জবাব।

আমি বলেই ফেলি,”আমার জায়গায় মেজ আপা থাকলে কেমন হতো সায়ন?”

সায়ন রেগে গেলো না বরং শান্ত গলায় বলল, “আমি আমার স্ত্রীর জন্য করছি সব। যে কেও আমার স্ত্রী হলেও আমি তার স্বপ্ন পূরণ করতাম। বারবার তোর মেজ আপার নামটা নিবিনা, ভাল্লাগে না এটা শুনতে।”

“সায়ন আমাকে বাচ্চা দেবেন একটা, আপনার বাচ্চা? বিশ্বাস করেন সায়ন আমি খুব ভীতু। শুধু মনে হয় আপনার সাথে আমার শেষটা ভালো হবেনা। প্লিজ একটা বাচ্চা দেন আমায়। বাচ্চা হলে নাকি স্বামী বন্দী হয়ে যায়। আমিও চাই আপনাকে না হারাতে। এই চাওয়াটুকুতে দয়া করে কৃপণতা করবেন না।”

বিয়ের পরদিন এমন ঠোঁটকাটার মত কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় ছিলোনা আমার কাছে। সিনেমার মত “তোমাকে ছাড়া বাচবোনা” এটা মিথ্যা। কিন্তু তোমাকে ছাড়া বেচে থাকাটা কি আদৌও বেচে থাকা হয়!

সায়ন উঠে বসে আমার মাথাটা তার বুকে চেপে ধরে বলে, “আমি কখনো ভাবিনি এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেবো। এখন ভাবছি নেবো। কেন জানিস? শুধু তোর জন্য, আমি তোর পাশে আছি এই বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য।”

লোকটা এমন কেন কেও বলতে পারবেন? সব করবে আমার জন্য তবুও ভালোবাসি বলবেনা। আচ্ছা এতো কিছুর পরেও কি ভালোবাসি বলার বা শোনার দরকার আছে কভু?

,
চলবে ইনশাআল্লাহ

#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১১
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী

কেও হাজারবার ভালোবাসি বললেও হয়তো আপনি সেখানে ভালোবাসা খুঁজে পাবেন না। আবার এমন কিছু মানুষ আছে যারা সারাজীবনে একবারও ভালোবাসার কথা বলবেনা। তবে তার প্রতিটা গল্পই হবে ভালোবাসাময়। জীবন চলার পথে ভালোবাসি শোনার চেয়ে ভালোবাসাময় মানুষকে পাওয়া বেশি ভাগ্যের, সর্বোচ্চ ভাগ্যের।

একমুহূর্তে সায়নের বুক থেকে মাথা তুলতেই ইচ্ছা করছেনা। সায়নও বেশ কিছুক্ষণ আমাকে তার সাথে জড়িয়ে রাখলো। ভয়ে কিংবা লজ্জায় আমি সায়নে জড়িয়ে ধরতে পারিনি, নিজের হাত আমার বুকের সাথে গুটিকরে রেখে দিয়েছি।

সায়ন ফিসফিস করে কানে বলল, “তুই এতো সুন্দর কেন সাথী? তুই আমার আশেপাশে থাকলে মনে হয় আমার জীবনে অন্ধকারের অস্তিত্ব নেই। তুই এমন আলোকিত কেন সাথী?”

আমি হাতদুটোকে বের করে দুইপাশ থেকে তার পিঠে রাখি। ইচ্ছে করছিলো প্রচন্ড শক্তিতে জড়িয়ে রাখি, কিন্তু সে ক্ষমতা নেই তাই আলতোভাবে পিঠ ছুয়ে রাখি।

সায়ন আবার বলে, “আমি মিথ্যা বলিনা সাথী, এখনো বলছিনা। মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী, তুইও আমিও। ভেবে দেখতো আমি সুন্দর না হলে আমার প্রতি কি তোর এতো আবেগ, এতো অনুভূতি থাকতো? তুই সুন্দর না হলে কি তোকে বারবার কাছে আনার, নিজের কাছে জড়িয়ে রাখার চাহিদা থাকতো?”

আমি তার বুকে মুখ রেখে বলি, “সৌন্দর্যকে ভালোবাসা খারাপ কিছুনা সায়ন। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ সুন্দর। সবার দেখার ভঙ্গি তো এক না। আমার থেকে কতই সুন্দর মানুষ আছে পৃথিবীতে কই তাদেরকে তো আপনি নিজের কাছে রাখছেন না! ভালোবাসা সৌন্দর্য দিয়ে শুরু হয় সায়ন কিন্তু এর পরিণতি মনে গিয়ে শেষ হয়।”

সায়ন আমাকে টাইট করে জড়িয়ে ধরে বলে, “তোকে কখনো বলেছি, আমি তোকে ভালোবাসি?”

আমিও এবার নিজের হাত দিয়ে টাইট করে সায়নের পিঠ আঁকড়ে ধরে বলি,”আমিও কি বলেছি নাকি আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি তো আমার সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। এর পরিণতি তো মন পর্যন্ত গড়াবে। আমি ততদিন অপেক্ষা করবো।”

সায়ন আমার মাথায় একটা স্নিগ্ধ কোমল উষ্ণতা দিয়ে দেয়। এই ছোয়াই কোনো কামুকতা নেই,লোভ নেই লালসা নেই, আছে এক পৃথিবী মুগ্ধতা।

সায়ন আমাকে জড়িয়ে রেখেই বলল, “তোকে এতো কাছে পেয়েছি মাত্র একদিন হলো। একদিনেই এতো নেশাময় হয়ে উঠলি কেন তুই বলতো? কি আছে তোর মধ্যে?”

আমি তার বুকে মুখ লাগিয়ে বলি, “আপনার দৃষ্টিতে আমার সুন্দর চেহারা আছে। আমার ব্যক্তবে আমার প্রতি আপনার স্নিগ্ধ ভালোবাসা আছে।”

সায়ন আস্তে-ধীরে হাসতে থাকে। আমি তার স্নিগ্ধ সেই হাসি তার বুকে মাথা রেখেই উপলব্ধি করতে পারি।সারাজীবন উপলব্ধি করতে চাই। আমার সৌন্দর্যে ভরা জীবনে আরো সৌন্দর্য,স্নিগ্ধতা উপলব্ধি করতে চাই, সায়নকে সাথে নিয়ে চাই।

সায়ন আমার চুলের ভিতর মুখ নামিয়ে বলে, “উপন্যাসে পড়েছি স্বামী বউয়ের চুলের ঘ্রাণ পেলে সব ক্লান্তি ভুলে যায়। আমার তো এমন কিছুই হচ্ছে-না সাথী! তাছাড়া তোর চুলের তো ঘ্রাণ নেই। যেটা আছে সবটাই শ্যাম্পুর ঘ্রাণ।”

আমি মুচকি হাসি দিয়ে যথাস্থানে নিজের মাথাকে চেপেচুপে রেখে বলি, “উপন্যাসে কিছু কথা উপমা হিসেবে লেখা হয়। উপন্যাসের সেই স্বামীরাও বউয়ের চুলে কোনো না কোনো ব্রান্ডের শ্যাম্পুর ঘ্রাণই পায়। অত্যান্ত রোমান্টিকতায় তারা সেই শ্যাম্পুর ঘ্রাণকে বউয়ের চুলে ঘ্রাণ হিসেবে ধরে নেয়। আপনিও যেই ঘ্রাণ পাচ্ছেন ওটা শ্যাম্পুর ঘ্রাণ না ভেবে আমার চুলের ঘ্রাণ ভাবুন তাহলেই হয়ে যাবে।” বলে অজান্তেই তার বুকে ঠোঁট ছুয়ে দিই ছোট্ট করে। সে হয়তো বুঝতেও পারেনি। আমার কান্ডে আমিই অবাক হই ভীষণ। এতো দুঃসাহস হলো কিভাবে আমার!

সায়ন স্বাভাবিক গলায় বলল, “পারবোনা শ্যাম্পুর ঘ্রাণ
কারো চুলের ঘ্রাণ হিসেবে ধরে নিতে। তুই আজকে থেকে মাথায় শ্যাম্পু দিবিনা। আমি তোর চুলের আসল ঘ্রাণ পেতে চাই।”
হে আল্লাহ এ কেমন স্বামী দিলে আমায়। চুলে শ্যাম্পু না দিয়ে থাকবো কীভাবে! শ্যাম্পু না করলে আমার মাথা যন্ত্রণা করে। এতো বড়বড় চুল ঠিক রাখা যায় নাকি!

আমি সায়নের বুকে থেকে উঠে আসার চেষ্টা করি কিন্তু সায়ন আমাকে আকড়ে ধরে রাখে। আমি মোচড়ামুচড়ি করে আবার তার বুকে গুটিয়ে যাই। বলি, “আমার চুল কত বড় দেখেছেন আপনি? চুলে শ্যাম্পু না করলে মাথা ব্যাথা করে আমার। কেমন আনরোমান্টিক লোক আপনি এইটুকু ভাবতে পারেন!”

“এই তুই রোমান্টিকতার কি বুঝিস রে? প্রেম ট্রেম করেছিলি নাকি ভার্সিটিতে?”

“ভার্সিটির প্রথম জীবনে সবাই প্রেম করে।”

সায়ন দুই হাতে আমার মাথা ধরে উচু করে তার মুখোমুখি ধরে বলে, “তুই কোনো প্রেম করতে পারবিনা সাথী। আমি তোর জীবনের প্রথম পুরুষ। আমি বিশ্বাসই করিনা তুই কোনোদিন প্রেম করেছিলি।”
প্রেম আমি কোনোদিন করিনি। সায়ন আমার অনুভুতির প্রথম পুরুষ। পুরুষটাকে জ্বালাতে ভালোই লাগে তাই এই কথাটা বলেছিলাম। দেখলামও তার জ্বালাময় চেহারা, হিহি হিহি।

এরপর সায়ন আমার মাথাটা তার বুকে নিয়ে আবার সেইভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি খুব হিংসুটে স্বামী। বউয়ের মনের আনাচে-কানাচেতে শুধু আমার বিচরণ চাই আমি।”

আমি আর কিছু বলি না। কথায় কথা বাড়ে তার থেকে বরং পরম শান্তিটা উপভোগ করি। তার বুকে মাথা রাখার প্রথম অনুভূতি। আগে কোনো অনুভূতি হয়নি পরিবেশের জন্য। আজকে হচ্ছে, এক প্রবল অনুভূতি।

ওভাবে অনেকটা সময় পার করেছি।
ডায়েরিতে এখানে-ওখানে প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানোর কথা লিখেছি বারবার। কিন্তু মোটেই ভাবিনি ঘরেও এতো সুন্দর সময় কাটে। সত্যি, সায়ন তাকে আমার পাশে রাখতে চেয়েছে আমার পূর্ণতা হিসেবে, পেরেছেও।

রাতের খাওয়াটা করলাম না। দুপুরে মাংসের সাথে ঝোল বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়েও জ্বা’লাপো’ড়া কমছে না গলার,পেটের।
রাতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিলাম এমন সময় সায়ন হাতে করে মুড়ির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। মুড়ির প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো মুড়ি নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে বলল, “রাতে তুই কিছু না খেলে আমি শান্তি পাবোনা। ক্ষুধা পেটে তোর ঘুম আসেনা তুই জানিস না? হা কর, মুড়ি খেয়েনে কয়েকমুঠো মাত্র। মুড়িতে গ্যাসও কমে যায়, গলায় জ্বা’লাপো’ড়াও কমে যাবে।”

আমি ছোট্ট করে হা করি। মুখের ভিতর অর্ধেকেরও কম মুড়ি যায় আর বাকিটা গলা বেয়ে বিছানায় পড়ে, কিছু মুড়ি ব্লাউজের ভিতর ঢুকে পড়ে। সায়ন বিরক্ত চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,”গালে তুলে দিচ্ছি তাও ঠিকভাবে হা করবিনা তুই? বাচ্চাদের মত মুড়ি ছড়ানো লাগলো।”

আমি কপাট রাগ দেখিয়ে বললাম, “আপনার একবালতি হাতের মুড়ি আমার ছোট্ট মুখে ধরবে কিভাবে শুনি?”

সায়ন আর কিছু বললো না। অল্প অল্প করে মুড়ি আমার মুখে দিতে লাগলো। আমি বাচ্চাদের মত করে খেতে লাগলাম। কয়েকমুঠো মুড়ি খাওয়ার পর সায়ন বলল, “তোর এমন বাচ্চা বাচ্চা মুখ দেখে আমার একটা কাজ করতে ইচ্ছা করছে সাথী। দয়া করে আটকাবি না, লজ্জাও পাবিনা।”

আমি ‘কি’ বলার আগেই সায়ন আমার মুখের কাছে ঝুকে এসে আমার গালে আদুরে একটা চুমু খেলো। বেশ অনেক্ক্ষণ ধরে আমার বাম গালে চুমুটা খেলো। হঠাৎ এমন কান্ডে আমি লজ্জার থেকে অবাকই বেশি হলাম। আদুরে চুমু খাওয়া শেষে সায়ন আমার কপালে তার কপাল ঠেকিয়ে বলল, “এমন বাচ্চাদের মত করবিনা সাথী। এমন করলে কিন্তু আমি আদর না দিয়ে থাকতে পারবোনা।”

তার করা কাজে এতোটা লজ্জা পাইনি যতটা তার কথায় লজ্জা পেলাম। চোখ খিচে বন্ধ করে রাখলাম। একই বাক্য মনের ভিতর কথা বলে, “ভালোবাসে না বলে তবুও প্রতিটা কাজ ভালোবাসাময়।”

আমার খিচে চোখ বন্ধ করা দেখে সায়ন বলে, “এমন চেহারা বানিয়ে না রেখে ওয়াসরুমে দৌড়া। তোর কাপড়ের ভিতরের মুড়িগুলো ঝেড়ে আয়, আমি ততক্ষণে বিছানার উপরে পড়ে থাকা মুড়িগুলো ঝেড়ে ফেলি।”

সায়ন আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আমিও ওয়াসরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এসে দেখি সায়ন বিছানা পরিষ্কার করে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আমি বিছানার কাছে যেতেই। সায়ন উঠে বসে আমাকে তার সামনে বসায়। আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। আমার চোখে পানি চলে আসে, একটু আগেই তো বলল বাচ্চা নেবে তাহলে এটা কেন!

সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমিও চাই সাথী কিন্তু তুই সুস্থ না। তখন আবেগের বসে বলে ফেলেছি কিন্তু এখন বুঝতে পারছি বাচ্চা নেওয়াটা তোর জন্য অনেক বি’প’দজনক। তুই ডায়াবেটিসের রোগী, বাচ্চা নেওয়াটা তোর জন্য ভালো হবে না।”

আমি রাগে কেদে ফেলি। হাতের প্যাকেটটা দূরে ছুড়ে ফেলে বলি, “খাবো না আমি এটা। বাচ্চা লাগবে আমার বাচ্চা। আপনার বাচ্চা,আমাদের বাচ্চা।”

“আমি কি বলেছি বাচ্চা নেবোনা! নেবো তো একটু অপেক্ষা কর। কাদিস না প্লিজ। সব সহ্য হয়, তোর কান্না সহ্য হয়না আমার। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর। তাছাড়া বাচ্চা বিয়ের একদুই বছর পর নেওয়া ভালো। নিজেদের সময় দিই আগে!”

আমার কান্নার মাত্রা বাড়তে থাকে। নতুন বউ বলে শব্দ করে কান্না করতে পারছিনা। বারবার দেহ কেপেকেপে উঠছে। সেদিনের পার্কের মত ঘুম পাচ্ছে আবার। না না, ঘুম না। জ্ঞান হারাচ্ছি, সেদিন তো জামতাম না আমার সুগার লো, এখন জানি।

সায়ন আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলতে থাকে, “সাথী তুই কাদিস না প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবেতো, এরপর বাচ্চা নেবো তো। একবার আমাকে বিশ্বাস কর।”

আরও অনেক কথা বলল সায়ন। কিন্তু মনে হলো কথার দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আমি সব কথা শুনতে পেলাম না। তার বুকেই নেতিয়ে পড়লাম।

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here