#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১৬,১৭
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
১৬
দীর্ঘ ছয় ঘন্টা পর ঢাকা পৌছালাম। রেস্ট নেওয়ার সময় পর্যন্ত নেই। সাতটার সময় ঢাকা থেকে তেতুলিয়ার বাস ছেড়ে যাবে। আমি মনে মনে বেশ পুলকিত হচ্ছি৷ আগামী সাত-আটদিন আমার জীবন শুধু সায়নময় থাকবে। এই মুহুর্তটাকে আমি আমার সর্বোচ্চ ভালোবাসা দেখাবো সায়নকে। আমি তার কাছে শুধুমাত্র একজক স্ত্রী না বরং উৎকৃষ্ট প্রেমিকা হয়ে থাকতে চাই। কিন্তু একটু পর এসব পালটে দেওয়ার চিন্তা করতে লাগলাম।
ঢাকা টেকনিক্যাল থেকে ৭ঃ৩০ এ বাস ছেড়ে দিয়েছে। প্রায় ঘন্টা খানিক পর, আমার গা গুলিয়ে আসছিলো দেখে সায়ন আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,”এতো তাড়াতাড়ি আমি বাবা হবো! মাত্র তিন দিন আমরা ইয়ে করেছি। তাতেই খুশির খবর!”
আমি কপাট রাগ দেখিয়ে বলি, “ফাজলামো বন্ধ করেন তো। আমি জার্নি সহ্য করতে পারছিনা। মনে হচ্ছে পেটের সবকিছু বের হয়ে আসবে। চলুন না বাড়ি যায়! যাবোনা আমি সিকিম।”
সায়ন নিজের কোলের উপরে থাকা ব্যাগ থেকে একটা পাতিলেবু বের করে আমার হাতে দিয়ে বলে, “তোর জন্য তিনটা পাতিলেবু নিয়ে এসেছি বাড়ি থেকে। জানতাম এমন কিছুই ঘটাতে যাবি। এটা নাকে দিয়ে শুকতে থাক। দেখবি ভালো লাগবে। আর ওভাবে দূরে আছিস কেন! আমার কাছে সরে আয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, ভালো লাগবে।”
আমি সায়নের একটু কাছে সরে যেতেই আমার মাথাটা সে নিজের কাধে নিয়ে বলল, “চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নে। ভাববি আমার কাধে মাথা রেখে আমাদের ছাদে বসে আছিস।”
এসব চিন্তা ভাবনায় কি আর বমি আটকানো যায়! আমিও পারিনি, বাসের সুপারভাইজারের কাছ থেকে পিলিথিন নিয়ে যা করার তাই করে ফেললাম। প্রায় ১৫ মিনিট পর ক্লান্ত হয়ে সায়নের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লাম।”
ঘুমানোর আগে সে আমার মুখ পানি দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছে। একেবারে ভালোভাবে আমার মুখ মুছিয়ে দিয়েছে।এসব করতে ঘৃণা করলোনা এই লোকটার! আমি হলে তো বমির উপরে বমি করে দিতাম।
তেতুলিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল ৬টা। শরীরটা বেশ ফ্রেশ লাগছে। এদিকটায় অনেকটা শীত। মনে হচ্ছে পুরোপুরি শীতকাল চলে এসেছে। সায়নকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, ” বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিকটা হিমালয়ের অনেক কাছাকাছি থাকায় সারাবছর আবহাওয়া মোটামুটি শান্ত বলায় যায়। তবে শীতকালে হাড় কাপানো শীত পড়ে। খবরে শুনিস নি শীতে এই এলাকায় অনেকে মানুষ মারা যায়!”
মাথা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম সায়নের কথায়। গাড়ি থেকে নেমেই সোয়েটার বের করে গায়ে দিয়েছিলাম। এখন আবার সায়ন ব্যাগ থেকে একটা কাশ্মীরি শাল বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “দুই বছর আগে কাশ্মীর গিয়ে এই শালটা এনেছিলাম। খুব আরাম গায়ে দিয়ে। দেখতে পাতলা হলেও গায়ে জড়ালে বেশ আরাম লাগে।”
আমি শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। একটা বন্ধ দোকানের বেঞ্চে বসেছিলাম সায়নের গা ঘেঁষে।
একজন মাঝবয়সী একটা মহিলা এসে আমাদের সামনে দাড়ালেন। অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার অভ্যাস আমার নেই তাই চুপ করে রইলাম। সায়ন ভদ্রতা দেখিয়ে সালাম দিলো। মহিলা হাসি মুখে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,”তোমরা কি ভাই-বোন?”
কথাটা শুনে বেশ হাসি পেলো আমার। সায়ন বেশ ইতস্তত হয়ে বলল, “কেন আন্টি কি দেখে ভাইবোন মনে হলো আমাদের?”
মহিলাটা বিস্তার হেসে বললেন,”এভাবে এমন জায়গায় একটা মেয়েকে ভাই ছাড়া তো কেও তুই বলতে পারেনা। তাই বললাম আর কি! তাছাড়া তুই তুকারির সাথে যত্নটা ভাই ছাড়া কেও নিতে পারেনা। তা দুই-ভাইবোন কোথায় যাচ্ছো?”
সায়ন ভাইবোনের কথাটা মোটেও উত্তর করলোনা। অনুভুতিহীন কন্ঠে বলল, “সিকিম যাচ্ছি আন্টি আমার বোনকে নিয়ে।”
মহিলাটি ইশারায় কাওকে যেন ডাকলেন। আর্ধমিনিটের মাথায় একটা ছেলে আসলো। ছেলে বললে ভুল হবে, সায়নের সমবয়সী কিংবা ছোটো হবে। ছেলেটা মহিলার পাশে দাড়াতেই মহিলাটি বললেন, “বেশ ভালোই হলো। আমরা মা-ছেলেও সিকিমে যাচ্ছি। ছেলে নতুন চাকরি পেয়েছে সেই উপলক্ষে। হাইস্কুলের গণিত শিক্ষক আমার ছেলে। সব মিলিয়ে ছাব্বিশ হাজার টাকা মাইনে।”
এসব কেন বলছে আমি কিছুই বুঝলাম না। সায়ন কেমন একটা হাসি দিয়ে বলল, “বাহ ভালো তো! তা ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন কবে আন্টি? নাকি বিয়ে হয়ে গেছে।”
মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” না হয়নি তবে এবার দেশে এসে দিয়ে দেবো।”
কিছুক্ষণ নিরবতার পর মহিলাটি বললেন, “ভালোই হলো, একসাথে সিকিম ঘোরা যাবে। কি বলিস নাবিল?” লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন। তিনিও উত্তর দিলেন, “হ্যা মা সঙ্গী পেলে ভালোই লাগবে। বোরিং সময়টা কে’টে যাবে।”
কিছুক্ষণ পর একটা অটোরিকশা এলো। সায়ন আমাকে নিয়ে পিছনের সীটে বসে পড়লো। মহিলাটি গাড়ির ভিতর মাথা ঢুকিয়ে বললেন, “আমরা কি তোমাদের সাথে যেতে পারি?”
সায়ন বলল, “আমার বোনটা খুব বমি করে তাই রিজার্ভেই গাড়িটা নিয়েছিলাম। আপনি চাইলে আসতেই পারেন আমি কিছু মনে করবোনা।”
সায়ন গাড়ি থেকে নেমে গেলো। মহিলাকে আমার পাশে বসতে দিয়ে সায়ন আমার মুখোমুখি বসলো। মহিলাটার ছেলেটা সায়নের পাশে বসলো অর্থাৎ তার মায়ের মুখোমুখি। টুকটাক কথা বার্তায় রাস্তাটা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেলো। এরমাঝে মহিলাটি আমার আর সায়নের নাম জিজ্ঞাসা করে নিলেন। দুইজনই নাম বলার পর তিনি বললেন, “বাহ তুই ভাই বোনের নামের তো বেশ মিল, সায়ন-সাথী। কত বছরের ছোটো বড় তোমরা?
সায়ন বলল, ” ছয় বছরের।”
“সিকিমে কি আপনার বাংলাদেশি তো এজেন্সির মাধ্যমে যাচ্ছেন নাকি নিজেরাই সব ঠিক করবেন?” লোকটা সায়নকে জিজ্ঞাসা করলেন।
সায়ন বলল, “আগেও একবার ওখানে গেছি তাই কোনো এজেন্সির হেল্প নেইনি। তাছাড়া গ্যাংটক থেকে নর্থ সিকিম কিংবা সাংগু লেকে যেতে হলে ওখানকার এজেন্সির হেল্প নিতে হয়। বিদেশি বা দেশি গ্যাংটক থেকে নর্থ সিকিমে যেতে হলে এজেন্সির মাধ্যম লাগবেই।”
মনে হচ্ছিলো বেশ গুছিয়ে কথাগুলো বলছিলো সায়ন। কিন্তু আমি কথা শুনছিলাম না বরং তার দিকে চেয়ে রইলাম। একটা বন্ধন কতটা মজবুত! যতটা মজবুত হলে অন্যকাওকে নিয়ে ভাবা যায়না। আমার ছোট্ট মনে এতো ঝড়তুফান বয়ে যাবে এটা কোনোদিনই ভাবতে পারিনি। মানুষটাকে সামনে দেখলেই অস’ভ্য অনুভুতিরা মাথার মধ্যে কিলবিল করে।
বাংলাবানন্ধা পৌছাতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লেগে গেলো। বাংলাদেশের কাস্টমে প্রায় ১ ঘন্টা এবং ভারতীয় কাস্টমে ৩০ মিনিট লাগলো সব ফরমালিটিস শেষ করতে। প্রায় দশটার দিকে হালকা নাস্তা সেরে ফুলবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা। বলাই বাহুল্য, সেই মহিলার ভ্রমণ ট্যাক্সজনিত সমস্যা থাকার কারণে তারা আমাদের একই সাথে ভারতে প্রবেশ করতে পারেননি। তার ছেলেটা অবশ্য সায়নের কাছ থেকে ফেসবুক আইডিটা নিয়ে ছিলো যাতে ভারতে এসে যোগাযোগ করতে পারে।
শিলিগুড়ি আসতেই সায়ন এসএনটি যাবে বলল। ওখান থেকে নাকি সিকিমে যাওয়ার ইনার লাইন পারমিট নেওয়া লাগে। এরপর গাড়ি ভাড়া করে সিকিম যেতে হয়। আমি ক্লান্ত কন্ঠে মুখ ছোটো করে বলি, “সায়ন প্লিজ আজকে এখানে কোনো একটা হোটেলে থেকে যায়! আমার শরীরে আর কুলাচ্ছে না। কাল সকালে সিকিমের উদ্দেশ্যে বের হলে কেমন হয়?”
সায়ন খুব আগ্রহের সাথে বলল, “আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তুই কি বলবি ভেবে কিছুই বলা হয়নি। তাছাড়া শিলিগুড়ি খুব সুন্দর জায়গা। সিকিমে যাওয়ার সৌন্দর্য এবার নিজের দুইহাত মেলে আমাদের আহবান জানাবে। আর তার শুরুটা এই শিলিগুড়ি থেকেই।”
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, “এসব শুনবোনা। কিছু দেখবোও না। আমার খুব ঘুম লাগছে সায়ন।”
পাশেই হোটেল ছিলো। ডাবল বেডের একটা রুম ভাড়া নেওয়া হলো। ভারতীয় ১৫০০ টাকা নিয়েছে তারা। ভাড়াটা একটু বেশিই মনে হয়েছিলো, মেয়ে মানুষের মন তো তাই আরকি! কিন্তু ক্লান্ত শরীরে এসব ভাবার টাইম নেই তাই সায়নের গায়ে ভর দিয়ে হোটেল রুম পর্যন্ত গিয়ে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
প্রায় ছয় ঘন্টা ঘুম দিলাম। বিকাল চারটায় ঘুম ভাঙলে দেখতে পেলাম সায়ন আমার পাশেই আধশোয়া হয়ে মোবাইল টিপছে। আমার জেগে থাকা চেহারা দেখে বলল, “খাবার তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে ছিলি বলে ডাক দিইনি। আবার অর্ডার করি!”
আমি বারণ করে বললাম, “তার দরকার নেই। শীতে খাবার নষ্ট হয়না। আমি ঠান্ডা খেতে পারবো।”
সায়ন নির্লিপ্ত জবাবে বলল, “তুই পারলেও আমি পারবোনা।”
আমি অবাক হলাম। মানুষটা খায়নি তাহলে? আমার জন্য অপেক্ষা করেছে আর আমি পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি! ঠোঁটের কোনে আবারও মিষ্টি হাসিরা আ’ক্রম’ণ চালালো। সেদিন বলেছিলো সবাইকে দেখানোর জন্য আমার অপেক্ষা করছিলো। আজকে তো দেখানোর কেও নেই, তাহলে একা একা খেলো না কেন সে?
“আপনি খাননি কেন?”
“হোয়াট ননসেন্স, আমার বউ ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে আমার আমি খাবো তা কি করে হয়? চা খেয়েছি আমি। এখন খাবার আসলে একসাথে খেয়ে নেবো। যা তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।”
আমি আড়মোড়া ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে অয়া বাড়ালাম। দরজা খুলতে যাবো তার আগেই সায়ন বলল, “তখন তোকে আমার বোন বললেন উনি, নিজের ছেলের পরিচয় দিলেন, বেতনের খবর বললেন। কেন জানিস?”
আমিও কিছু একটা সন্দেহ করেছিলাম তবে এমন কিছুই ভাবিনি যেটা সায়ন বলল।
“মহিলা ছেলের বউ করার জন্য তোকে পছন্দ করেছে। বেচারি! জোর করে তোকে আমার বোন বানিয়ে দিয়েছ। যখন দেখবে সিকিমে গিয়ে তুই আর আমি একরুমে থাকছি তখন মা-ছেলের মুখের অবস্থা কেমন হবে ভেবেই হাসি পাচ্ছে।”
“আপনি কিভাবে সিউর হলেন যে তাদের সাথে দেখা হবে?”
দেখলিনা ফেসবুক আইডি নিলো। আলরেডি কথা হয়ে গেছে। গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে তারা বের হয়ে গেছে। ওখানে গিয়েই দেখা করবে। আমাদের জন্য নাকি দুইটা রুমও বুক দিয়ে রেখেছে। হাহা হা।”
“ধুর হাসবেন না আপনি। আপনার বউকে নিয়ে কেও এসব ভাবছে, আপনি তাদের ভুল ভাঙাবেন, তা না মজা করছেন! এগুলো আমার একদম ভালো লাগেনা সায়ন। দেখা হলেই যেন বলে দেওয়া হয় আসল কথা।”
সায়ন হাসি দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “কেও বিয়ের চিন্তা করলেই কি তা হয়ে গেলো নাকি! তুই আমার বউ, আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার জীবন সাথী। কেও কতকিছুই বলুক তোর আর আমার এই পবিত্র সম্পর্ক তো পালটে যাচ্ছেনা। তাছাড়া মা-ছেলেকে যদি এখন সব বলে দিই তাহলে তাদের সিকিম ভ্রমণটাই নষ্ট হবে। হাহা হা। ফেরার দিন বলে দিবো, কেমন?”
আমি তার বুকে রেখেই উপর নিচে দুইবার নিজের মাথা দুলাই। আমার মুখটা আদুরে হাতে উপরে তুলে আমার কলালে একটা চুমু একে দেয় সায়ন। আমি আবেশে তাকে আবার জড়িয়ে ধরি। এই লোক নাকি আমাকে ভালোবাসেনা!
,
চলবে ইনশাআল্লাহ
#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১৭
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
“স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নিয়ে কেও বিয়ে করার চিন্তা-ভাবনা করবে আর স্বামী চুপ থাকবে তা কিন্তু আমি মোটেও মেনে নেবোনা। মা-ছেলের ভ্রমণ বিন’ষ্ট হলেও আমার কিছু করার থাকবেনা বলে দিলাম।”
সায়ন আমাকে জড়িয়ে রেখেই বলল, “একটু আগেই তো মেনে নিলি ভ্রমণে তাদের ভাবনাকে আঘাত করবিনা। এখন আবার এসব কথা! সেকেন্ডে মুড পালটে যায় নাকি তোর?”
এতো রাগ হচ্ছিলো সেই মুহুর্তে, ইচ্ছা করছিলো সায়নের চুল ছি’ড়ে ফেলি। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো, দিলাম এক ইয়া বড় কাম’ড়। সায়ন ‘উউউহ’ করে উঠে আমাকে ছেড়ে দিলো। আমি সেই সুযোগে ওয়াশরুমে চলে এসে দরজা আটকে দিলাম। সায়ন রাগি কন্ঠে বলল, “তুই আজকে যেন ওয়াশরুম থেকে বের হবিনা! বের হলেই তোর কপালে ব্যাঙ ডাকাবো আমি।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,”বউয়ের সব কথা না শুনলে এমন উদ্ভট আচরণের শিকার হবেন বারংবার। এমন এমন জায়গায় কামড়াবো যে মানুষের সামনে যেতে পারবেন না।”
কথাটা যথেষ্ট ভুল বলে ফেলেছি সেটা ওপাশথেকে বুঝিয়ে দিলো।
“ঠিক আছে, আমিও দেখে নেবো। তোর গালে কাম’ড়াবো, নাকে কাম’ড়াবো। মানুষের সামনে মুখ কিভাবে দেখাস আমিও দেখবো।”
ব্যাস! হয়ে গেলো আমার পটরপটর করে কথা বলা। চুপ করে হাত মুখ ধুতে লাগলাম। শরীরটা খারাপ লাগছিলো, ভাবলাম গোসল সেরে নেওয়া ভালো হবে। ওড়না হ্যাংগারে রেগে সাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম। পোশাক নিয়ে আশা হয়নি খেয়াল হতেই সায়নকে বললাম আমার পোশাক দিতে আর একটা টাওয়াল দিতে।
একটু পর ওপাশ থেকে দরজা খুলতে বলা হলো। আমি দরজাটা কিঞ্চিৎ ফাকা করে ডান হাত বের করলাম, কিন্তু আমার হাতে পোশাক না দিয়ে আমার হাতটা হেচকাটান দিয়ে আমাকে বাইরে বের করে নিলো। এতক্ষণ সাওয়ারের নিচে থাকা আমি এখন ভিজে একাকার। সায়নও হয়তো ভাবেনি আমি ভিজে গেছি। আরেকটা মোক্ষম ঘটনা ঘটেছে, সাওয়ার ছাড়ার সময় যে উড়নাটা আমি হ্যাংগারে রেখে দিয়েছিলাম সেটা ওখানেই রয়ে গেছে, সায়নের মুচকি হাসি দেখে সেটা খেয়াল হলো। এদিকে সে আমার হাত ছাড়ছেনা, লজ্জা ঢাকার উপায় না পেয়ে ভিজে গায়ে তাকেই জড়িয়ে ধরলাম। সায়ন এক হাত মেলে আমার শুকনা পোশাক ধরে রেখেছে আরেক হাত আমার পিঠে রাখলো।
হাসতে হাসতে বলল, “এটা কি করলি তুই? আমার পোশাক ভিজিয়ে দিলি? ইস! ওড়না ছাড়া তোকে যা লাগছিলো না!”
আমি কোনো কথা বললাম না। কি বলবো আমি, লজ্জায় আমার গলায় কথা আটকে গেছে। লোকটা অস’ভ্য হয়ে গেছে যে একদম। উড়না ছাড়া কেমন দেখাচ্ছে সে কথা বলার কি দরকার ছিলো!
“আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছিস আবার লজ্জা ঢাকার জন্য আমাকেই জড়িয়ে ধরেছিস? এ কেমন চিন্তা ভাই!”
আমি তবুই চুপ করে রইলাম। চিন্তাশূন্য হয়ে আছি। এই পরিস্থিতিতে আমি কখনোই পড়িনি। সায়ন এবার সিরিয়াস হয়ে আমাকে বলল, “আজব সাথী! আমার সামনে তুই লজ্জা পাচ্ছিস? এটা আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর লাগছে। লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই। আমাদের ভিতর তো সব কিছুই হয়ে গেছে। এখন কিসের লজ্জা বলতো?”
আমি মিনমিন করে বলি,”সম্পর্কটা এমনই সায়ন। যে স্ত্রী সারারাত আপনার ভালোবাসায় বিভর হয়ে ছিলো সে দিনের বেলায় আপনার সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়লে লজ্জা পাবে। নিজের লজ্জা ঢাকতে আপনাকেই জড়িয়ে ধরাটা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর সমাধান মনে হয়েছে।”
“এখন আর কি করার ভিজে যেহেতু গেছি তাহলে গোসলটা সেরেই ফেলি। এতে দিনের বেলায়ও তোর লজ্জা কাটানো যাবে, কি বলিস?”
“সায়ন আপনি কিন্তু দিনদিন বেহা’য়া হয়ে যাচ্ছেন, সেটা কি খেয়াল আছে?”
সায়ন হাসতে হাসতে বলল, “নিজের বউয়ের সামনে সব পুরুষই বেহায়া হয়। আমিও নাহয় একটু আধটু হলাম।”
আর কথা হয়নি। সায়ন আমাকে জোর করে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। একসাথে গোসল করাটা আমার জন্য প্রথম এবং অন্যরকম অনুভূতির ছিলো। সায়ন বারবার বলছিলো, “এখানে লজ্জা পেলে কিন্তু আদর করবো। একটু ছাড় দেবোনা। তোকে এমনিতেই ভিজে গায়ে হ’ট লাগছে আর লজ্জাটা আমাকে নেশাগ্রস্ত করে দিচ্ছে।”
আমার লজ্জা কমে যাওয়ার বদলে হাজার গুণ বেড়ে যাচ্ছিলো এসব কথায়। তবুও তার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার পা থরথর করে কাপছে অনুভূতিতে। সায়নে আমার গালে গাঢ় একটা চুমু দিয়ে বলল, “পাগলি, কিচ্ছু করবোনা। লজ্জা পাসনা, আমার সামনে স্বাভাবিক হ একটু।”
আমি পারিনি তাকে জড়িয়ে ধরি, অন্যকোনো অনুভূতিতে জড়িয়ে ধরি। আমিও যে বেসামাল হয়ে যাচ্ছি সায়ন কি জানে?
পরদিন সকাল।
গাড়ি চলছে শিলিগুড়ি টু গ্যাংটক।
“বলেছিলাম না শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক যাওয়ার পথটায় প্রকৃতি দুইহাত মেলে আমাদের আমন্ত্রণ জানাবে। চোখ মেলে দেখ তো কেমন সুন্দর পরিবেশ। এভাবে ঘুমাসনা সাথী, বুড়ো বয়সে আমি যখন থাকবোনা তখন আমার নাতী-নাতনীদের সাথে কি গল্প করবি তুই, এসবই হবে তোর সময় কাটানোর মাধ্যম?”
রাগে রাগে চোখ মেলে তাকালাম আমি। এই লোক এতো সুন্দর পরিবেশ ম’রার কথা কেন বলছে! রাগে রাগে আমার দুই হাতের মধ্যে থাকা তার বাম হাতটা ঝাড়া মে’রে তার কাধ থেকে মাথা তুলি। টইটম্বুর চোখে অন্যদিকে ফিরে থাকি। আমার মন পড়া মানুষটা ঠিক সব বুঝে গেছে। হালকা হেসে আমাকে জোর করে নিজের কাছে নিয়ে বলল, ” না তুই পৃথিবীতে চিরদিন থাকবি, না আমি। একটা সময় আসবে যখন মানুষ অপরজনের স্মৃতিকে নিয়ে বেচে থাকে। এমন দিন আমাদেরও আসবেই, তাইনা?”
আমি কোনো কথা বলিনা। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। বাইরে তাকিয়ে থাকি। রাস্তার ধরন যেন আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছে। কোনো সময় অনেকটা উঁচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে তো কখনো কখনো দুইধারে উঁচু পাহাড়, মধ্য দিয়ে গাড়ি চলেছে। প্রায় দুইঘন্টা পর একটা ঝর্ণার পাশে গাড়ি দাড়ালো সায়নের কথায়। সায়ন আমার হাত ধরে বাইরে বের করে আনলো। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নিকটে থাকা ঝর্ণা দেখে মনটা ভরে গেলো। ইচ্ছা ছিলো ঝর্নাটা ছুয়ে দেখবো। আকুপাকু মন নিয়ে সায়নের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি বারবার। সায়ন বলল, “কিরে ওখানে যেতে ইচ্ছা করছে বুঝি?”
আমি আহ্লাদী বাচ্চাদের মত মাথা উপরনিচ করি। সায়ন আমার হাত ধরে বলে, “ব্রিজের পাশ থেকে চিকন একটা ঢালু রাস্তা নেমে গেছে। এটা দিয়ে নেমে তারপর ১৫ মিনিট হেটে যাওয়া লাগবে।”
আমি অবাক হয়ে বলি,”এতো দূর তো মনে হচ্ছেনা।”
সায়ন বলল, “দূরে তো না। কিন্তু নিচে নদীর পাশে পাথর ছড়িয়ে আছে তার ভিতর দিয়ে সাবধানে হাটতে হবে। নাহলে পা মচকাবে।”
সায়নের শার্ট খামচে বলি, “সায়ন, চলুন না ওখানে যাই! আমার জীবনে এই প্রথম ঝর্ণা দেখলাম। ওটাকে ছুয়ে দেখতে চাই। প্লিজ চলুন না।”
ড্রাইভাইরকে অপেক্ষা করতে বলে আমি আর সায়ন ব্রিজের পাশ থেকে নামতে লাগলাম। ছোটো নুড়ি পাথরের ঢালু পথ নামতে সায়নের খুব একটা সমস্যা না হলেও আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আমার হাত ধরে সায়ন নেমে চলেছে। আমার পা যদি হড়কে যায় তো এই ঢালু পথে সায়নও আমাকে আটকাতে পারবেনা, গড়াতে গড়াতে নিচে যাবো একেবারে। তবুও আমার সাহস হয়ে থাকার জন্য বাম হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সায়ন।
ঢালু দিয়ে নামতে সমস্যা হলো না খুব একটা কিন্তু একদম নিচে নেমে বিপাকে পড়ে গেলাম। মাঝারি সাইজের দুই পাথরের মাঝে আমার বাম পা আটকে গিয়ে হোচট খেলাম। যা হবার তাই হলো। সায়নও পড়ে গেলো আমাকে ধরে থাকার কারণে, কিন্তু সেই মুহুর্তে আমার একটু খারাপ লাগা কাজ করছিলো না। পাথরে নদীর ভিতরে কল কল করে পানি বয়ে চলেছে। কানের ভিতর যেন এই শব্দটা আমাকে নতুন জগতে স্বাগতম জানাচ্ছে। এ যেন স্বপ্ন রাজ্যে চলে এসেছি। উপরে তাকিয়ে দেখলাম ব্রিজের উপরে আমাদের ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার ব্রিজের ধারে বসে হাত নাড়াচ্ছে। সে ইঙ্গিতে আমাদের বোঝাচ্ছে সাবধানে চলতে।
সায়ন উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, “একটু দেখে চল সাথী। শুরুতেই সব ভেস্তে দিসনা। এখনই যদি আঘাত পাস তাহলে কিন্তু ভ্রমণটা মাটি হয়ে যাবে।”
আমি মাথা দুলিয়ে উঠে দাড়ালাম। বাম পা চিনচিন করছে। সায়নের সাথে সামনে পা বাড়াতে গিয়ে বুঝলাম অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি। মুখ থেকে ‘উ’ শব্দ বের হয়ে গেলো। যন্ত্রণায় চোখ থেকে পানি বের হয়ে গেলো। সায়ন একটু বিরক্ত হলো, একটু না অনেকটা বিরক্ত হলো। ঠোঁট আর দাত দিয়ে একধরনের বিরক্তকর ‘চ’ জাতীয় শব্দ বের করলো। আমি অসহায় চোখে তার দিকে তাকালাম। সে বলল, “তুই আঘাত পেয়েছিস বলে বিরক্ত হয়নি সাথী, আমি নিজের জন্য বিরক্ত হয়েছি। আমার স্ত্রী আজকে আমার কাছে একটা জিনিস চাইলো আর আমি তাকে দিতে পারলাম না। এই আপসোস আমার আজীবন থেকে যাবে।”
আমি কষ্টের মধ্যেও তার কথায় খুব ব্যাথা পেলাম। তার মনের ব্যাথাটা বুঝলাম। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, “একটু পা-ই তো মচকে গেছে, ঠিক হয়ে যাবে। গাড়িতে ব্যাথার যে স্প্রে টা আছে ওটা দিয়ে দিলেই ভালো হয়ে যাবে অল্প সময়ে। চলুন আমরা উপরে যায়। আমার বাম পায়ের অবস্থা খারাপ তাই আপনাকে এবার উঠার জন্য অনেকটা বেগ পেতে হবে কিন্তু।”
সায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছন ফিরে আমার দেহটা তার গায়ে হেলিয়ে নিয়ে বলল, “যখন বাম পা ফেলবি তখন সমস্ত ভার আমার দেহের উপর দিবি ডান পা টা স্বাভাবিকভাবে ফেলবি তাহলে উপরে উঠতে খুব একটা সমস্যা হবেনা তোর।”
আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালাম। তার গায়ে ভর দিয়ে পা ফেলতে যাবো কিন্তু তার আগেই অন্যকিছু ঘটে গেলো। হঠাৎ করেই নিজেকে শূণ্যে আবিষ্কার করলাম। টাল ঠিক রাখার জন্য সায়নের শার্ট খামছে ধরলাম। সায়ন উলটো পথে হাটা ধরলো। আমি অবাক হয়ে বললাম,” কোলে নিলেন কেন? আর উলটো যাচ্ছেন কেন?”
সায়ন ঝর্নার দিকে তাকিয়ে বলল, “তার অনুভূতিকে আগলে রাখা আমার কর্তব্য, তার ইচ্ছাকে পূরণ করা আমার দ্বায়িত্ব।”
অনেকেই ঝর্নার দিকে যাচ্ছে আবার অনেকেই সেখান থেকে ব্রিজের দিকে ফিরে আসছে। ফিরে আসছিলো এমন একটা ভারতীয় দসম্পত্তির দেখা হলো। মেয়েটা আমার বয়সী হবে। সায়নকে কোলকাতার মিষ্টি বাংলায় বলল, “দাদা এটা কি আপনার বউ? পায়ে লেগেছে বুঝি?”
সায়ন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে একবার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে দুই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো একইসাথে। মেয়েটি এবার তার সাথে থাকা তার স্বামীকে তিরস্কার করতে করতে বলল, “দেখে শেখো কিছু। মোচকে যাওয়ার কারণে আমিও তো খুড়িয়ে হাটছি, কই কোলে নিলে না তো। নাকি বিয়ের বয়স ছয়মাস হয়ে গেছে বলে আর ভালো লাগছেনা।”
তার স্বামী এবার তাকে সত্যিই কোলে তুলে নিলো। এতোক্ষণ সবার সামনে তিরস্কার করা মেয়েটাও লজ্জায় তার স্বামীর শার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে রাখলো।
সায়ন ঝর্ণার দিকে চলতে লাগলো। আমি মাথাটা বের করে মিষ্টি দম্পতিকে দেখতে লাগলাম। মেয়েটাও একটু পর মাথা বের করে লজ্জিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াতে লাগলো। আস্তে আস্তে উল্টো দিকে যেতে যেতে অনেক দূরে চলে গেলাম দুই দম্পত্তি।
,
চলবে ইনশাআল্লাহ