#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১৮,১৯
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
১৮
সায়ন আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। এরপর আমাকে আগলে একপাশ করে জড়িয়ে ধরলো, যাতে পড়ে না যাই কিংবা ব্যাথা না পাই।
ঝর্নার পানি পাথরের উপর পড়ে ছিটকে যাচ্ছে সবদিকে। কাছে গিয়ে ছুয়ে দেখতে গেলে পোশাক সব ভিজে যাবে। উপায়ন্তর না পেয়ে ছিটকে আশা পানি ছুয়ে দেখতে নিলাম হাত বাড়িয়ে। পানির ফোটা হাতে পড়তেই শিউরে উঠলাম। হিমশীতল পানি যেন আমার সমস্ত ব্যাথাকে হারিয়ে দিচ্ছে বারংবার, এরসাথে রয়েছে সায়নের পরিতৃপ্ত হাসি। এই হাসি যেন বলে দিচ্ছিলো সে তার স্ত্রীর ইচ্ছাটা পূর্ণ করতে পেরে তৃপ্ত।
সায়ন আমাকে দাড় করিয়ে আমার ঠিক পিছনে দাড়ালো। আমি পিঠ তার বুকে রেখে তার গায়ে হেলান দিয়ে দাড়ালাম। সে আমার ডান হাতটা তার ডান হাতে নিলো।
সায়নের হাতের উপর হাত মেলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ ছোটো খাটো বিদ্যুৎ চমকানোর মত আলোর ঝলকানিতে ডানে তাকিয়ে দেখলাম কেও একজন ছবি তুলে নিলো তার ক্যামেরা দিয়ে। রাগ হলোনা বরং বেশ খুশিই হলাম। এই মুহুর্তটা স্মৃতিতে থাকার সাথে সাথে ছবি হয়েও থাকবে আজীবন।
সায়ন আমাকে আগলে নিয়ে পাথর থেকে নেমে সাইডের ওই লোকটার কাছে দাড়ালো। আমাকে নিজের বা হাত দিয়ে একপাশ করে আলতো জড়িয়ে রেখে লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আদাব, আমি সায়ন বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এটা আমার স্ত্রী।” লোকটা হাসি মুখে সায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি সুমন, বউকে নিয়ে এই প্রথম বার এলাম। আর আপনাদের সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ।”
লোকটার কথার পর চারজনে হাসি দিলাম।
ব্যাথাপায়ে তার পাশের মেয়েটা আমার কাছে এসে আমার দুইহাতে তার দুইহাত রেখে হাসি মুখে বলল, “আমি দীপা, দীপালি সরকার। তোমাকে দেখতে তো বেশ মিষ্টি লাগছে!”
আমিও হাসি মুখে তার হাতদুটো ধরে বলি, “আমি সাথী। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে বেশ ভালোলাগলো।”
মেয়েটা বলল, “ভালো লাগার অনেক বাকি এখনো। সিকিম ভ্রমণে আমাদের সাথে সঙ্গ দিতে আপত্তি নেই তো?”
আমি বা সায়ন কিছু বলার আগেই সুমন নামক লোকটা বলল, “ওদের রাজি হওয়ার দরকার নেই। এটা আমার দেশ, রাজি না থাকলে জোর করে ঘুরবো একসাথে।”
আমি বললাম, “কোলকাতার বাংকা এতো মিষ্টি শোনায় কেন?”
আমার কথায় সবাই একসাথে হাসি দিয়ে উঠলাম আবারও। আমার জীবনে এই প্রথম ভারতে আসা, কিন্তু এই দুইজনকে দেখে মনে হচ্ছে এরা আমাদের চিরো চেনা কোনো প্রতিবেশী।
দুই দম্পতি আবার নিজেদের গন্তব্যের দিকে হাটতে লাগলাম। সবাই হাটতে লাগলাম বললে চরম ভুল হবে। তাদের বউকে তারা কোলে নিয়ে হাটছিলো।
রাস্তায় উঠে আমাদের সবার লাগেজ গুলো দিপাদের গাড়িতে রেখে আমরা চারজন একই গাড়িতে উঠলাম। গাড়িওয়ালা দেখলাম একটু নারাজ হলো। কিন্তু সুমনদার একটা বকাতে চুপ হয়ে গেছে। ভেবেছিলো তারা বাংলাদেশের কিন্তু যখন বুঝলো ওরা ভারতের তখন ভাড়া বাড়ানোর কথাটায় আর জোর দিতে পারলোনা।
গাড়িটা বড় হওয়ায় বসা নিয়ে কোনো বেগ পেতে হয়নি। মাঝের সারির তিন সীটে সায়ন আর সুমনদা বসলো এবং আমি আর দিপা পিছনের সীটে বসলাম। সায়ন আর সুমনদা নিজেদের মধ্যে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। আমি আর দিপাও এবার হাসি মুখে গল্প করতে লাগলাম। দিপা বলল, “তোমরা যখন ঝর্ণার দিকে যাচ্ছিলে তখন কি মনে করে যেন আমার স্বামীও আবার উল্টো ঘুরে ঝর্ণার দিকে যাচ্ছিলো। আমি জিজ্ঞাসা করতেই বলল যে কোলে নিয়ে ঝর্নায় পৌঁছে দিয়ে আগের বারের ভূল শুধরাতে চায়।”
আপনারা যারা কনফিউজড হচ্ছেন তাদের বলেই দিই। এটা সেই দম্পতি, যে মেয়েটা তার স্বামীকে তিরস্কার করছিলো।
আমি হাসি মুখে বললাম, “তোমাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর হলো দিপা?”
দিপা কেমন অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলল, ” ৬ বছর ১১ মাস ২৮ দিন। এনিভারসারিটা এবার সিকিমেই করার ইচ্ছা হলো আমাদের। এসে ভালোই করেছি বুঝলে! না আসলে তোমাদের মত কিউট কাপলের দেখা পেতাম না।”
আমি একটু অবাকই হলাম দিপার দিকে তাকিয়ে। প্রায় সাত বছর আগেই বিয়ে করলে তখন হয়তো দিপার বয়স ছিলো ১৩ কি ১৪ বছর। আমি কৌতুহল আটকাতে না পেরে এটা জিজ্ঞাসা করতেই সুমনদা আর দিপা হোহো করে হাসতে লাগলো। দিপা আমার নাক টেনে বলল, “তুমি মেয়ে আমার থেকেও প্রায় ৫-৬ বছরের ছোটো হবে।”
আমি কোনো প্রশ্ন না করে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চেহারায় তো বয়সের কোনো ছাপই নেই, দেখলে মনে হবে আমার সমবয়সী। তাইতো দিদি না বলে নাম ধরেই কথা বলেছি এতোক্ষণ।
দিপা আবার সেই আগের মত হাসি দিয়ে বলে, “আমার বয়স কিন্তু ২৫ বছর।”
কথাটা শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমি কিনা তাকে আমার সমবয়সী ভেবেছিলাম। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই সৌন্দর্য, এই মাধুর্য যেন দিপার সাথেই যায়, ভারতীয় এক রমনীর সৌন্দর্য। এ যেন শুধু চেহারার সৌন্দর্য না, তার মনেরও সৌন্দর্য।
হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে যেন আবার দিদি ডেকো না বয়সের কথা শুনে। আমাকে নাম ধরেই ডেকো, কেমন?”
আমিও প্রতিউত্তরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,”আচ্ছা ডাকবোনা। শোনো না, তোমাদের বিয়ের কাহিনীটা একটু বলোনা!”
এবার দিপা না, সুমনদা উত্তর দিলো, “সমবয়সী হওয়ায় আমাদের দুইজনের পরিবারকে রাজি করাতে পারছিলাম না। তখন কেবল উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছি। প্লান করলাম আত্মহত্যার নাটক করবো। দুইজন বাজার থেকে নকল বিষ কিনে যার যার বাড়িতে যাই। জানতাম ওটা খেলে মরবো না। প্লান মাফিক দুইজনই সকালে ওই নকল বিষ খেয়ে ফেলি। কিন্তু কে জানতো ওটা আসল বিষই ছিলো। ভাগ্য ভালো ছিলো দুইজনের কেউই পুরোটা খাইনি। খেলে আর এই জীবনে একসাথে থাকা হতো না। দুইজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাকিটা তো বোঝোই, পরিবারের কান্নাকাটি, মেনে নেওয়া এরপর বিয়ে। কিন্তু বিয়ের সময় তারা বলেছিলো আমাদের সংসার নাকি টিকবেনা। তাদের চোখে আঙ’ুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছি গত সাত বছরের কাছাকাছি। দুইজনই একই স্কুলে চাকরি পেয়েছি। বেশ এভাবেই চলছে আমাদের দুষ্টু-মিষ্টি-ঝগড়াটে জীবন।”
দিপা জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাদের বিয়ের কাহিনী বলো শুনি!”
সায়ন পিছন ফিরে তাকিয়ে ছিলো। আমি তার চোখে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিলাম। আমাদের বিয়েটা তো তাদের মত এতোটা রোমাঞ্চকর ছিলোনা। বললে তো তারা মজা পাবেনা। সায়ন বলল, “অন্য একসময় জানাবো।(আমার দিকে তাকিয়ে) এখানে বললে ও লজ্জা পাবে।” আমি বুঝলাম না আমাদের বিয়ের কাহিনীতে কি এমন আছে যেটা শুনলে সে লজ্জা পাবে।
গল্পে গল্পে দুপুরে র্যাংপো পৌঁছে গেলাম। ইনার লাইন পারমিট নিতে প্রায় ৩০ মিনিটের মত সময় লাগে। এরপর আবার যাত্রা শুরু। বিকাল নাগাদ সিমিকের রাজধানী গ্যাংটকে পৌঁছে গেলাম। পায়ের ব্যাথাটাও প্রায় অনেকটা কমে গেছে, যদিও হাটতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। তার ক্লান্ত শরীরে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছিলো না।
এমজি মার্গ, গ্যাংটকের অধিকাংশ হোটেলগুলো এইখানেই। আমাদের জন্য নাবিল আর তার মা দাঁড়িয়ে ছিলো মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির নিচে। আমাদেরকে দেখে আন্টি ভীষণ খুশি হলেন। আমাদের সাথে অন্য একজোড়া মানুষ দেখে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। সবাই পরিচিত হলে হোটেলে রওনা দিলাম।
তারা আমার আর সায়নের জন্য আলাদা দুইটা রুম বুক রেখেছিলো। দিপাদেরকে একটা রুম নিতে বলল কিন্তু আমি বারণ করলাম। তারা একটু অবাক হলো। ভাবলো আমি আর দিপা এক রুমে থাকবো সায়ন আর সুমনদা অন্যটায় থাকবে।
পাশাপাশি দুইটা রুম আর মুখোমুখি আরও দুইটা রুম। নাবিল নামক লোকটা সায়নের হাতে দুইটা চাবি দিলে সায়নের হাত থেকে একটা চাবি আমি নিয়ে নিই আরেকটা চাবি সুমনদার হাতে দিয়ে দিই। দরজা খুলে সায়নের হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে আনি, এরপর দড়াম করে দরজা আটকে দিই। আমার এমন উ’গ্রতা দেখে সায়ন বেশ অবাক হলো। আমাকে বলল, “এটা কি হলো সাথী? সবার সামনে এমন অভদ্রের মত কেন করলি, তারা কি ভাববে বলতো?”
আমি রাগে রাগে পা উচু করে তার কলার ধরে বললাম, “বা’ল ভাববে। মুখখারাপ করবো কিন্তু আমি। এই মিয়া আমি আপনার বউ না? হাত ধরি আর চুমু খাই এতে কে কি ভাবলো দেখার দরকার আছে? বা’লের আলাপ করতে আসছে। ধুর, ট্যুরে আসাটাই আমার ভুল দেখছি।”
সায়ন যেন অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়। অবাক হয়ে বলে, “এসব কি অসভ্যের মত কথা বলছিস? কি শব্দ এসব?”
রাগে যেন আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে।
“একশোবার বা’ল বলবো। দেখিস নি তুই ওই মহিলা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। শোন তুই যদি আজকে ওকে না বলিস সব কিছু তাহলে আমি ওই বারান্দা থেকে লা’ফ দেবো।”
সায়ন বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু বারান্দাতে তো লোহার গ্রিল দেওয়া। লা’ফ দিবি কিভাবে? আর এতো অভদ্র হয়ে গেছিস কেন এইটুকু সময়ে। স্বামীকে তুই তোকারি করছিস!”
লাউঞ্জে সবাই বসে আছি। মহিলা আন্টি আমার সামনে এসে আমাকে বললেন, “তুমি তখন বলোনি কেন তোমরা ভাই-বোন না?”
আমি লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলি, “আমরা ভাই-বোনই তো। আমার একটু দুর-সম্পর্কের ফুফাতো ভাই সে। সে আমার স্বামীভাই, আমি তার স্ত্রীবোন।”
মহিলা আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন, “যেমন শয়’তান ছেলে, তেমন শয়’তান বউ।”
,
চলবে
#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১৯
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
“আন্টি, আপনি কি এতোই অবুঝ যে কোনটা ভাই-বোন আর কোনটা স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারেন নি? কিভাবে পারলেন একজন বিবাহিত মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে? উত্তর আছে কোনো?”
সায়নের কথা শুনে আন্টি থতমত খেয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে তাকিয়ে বললেন, “আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেমন যেন! স্বামী-স্ত্রীর ভিতর কোনো মোহাব্বত নেই যেন। এ সম্পর্ক বেশীদিন টিকবেনা। স্বামী স্ত্রীকে তুই বলে স্ত্রী স্বামীকে আপনি বলে আর……….”
সায়ন আন্টির কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে, “সবাই তো বলেনি আন্টি, আমি বলি। কারণ তুই শব্দটা আমার স্ত্রীর সাথেই যায় আন্টি। ওর ছোটোবেলা থেকেই তুই তোকারি করি। আর এটাই ওর জন্য আমার কাছে প্রিয় শব্দ। এই নিয়ে আমার মোটেও আপসোস নেই। পৃথিবীর কেও আমাদের স্বামী-স্ত্রী ভাবলো কি না ভাবলো তাতে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। আমার মাথাব্যাথা আপনার সামনে বসা মেয়েটাকে নিয়ে। আরেকটা কথা আন্টি মোহাব্বত মানেই সংসার না। সংসার একটা পবিত্রতা দিয়ে শুরু হয়, বিধাতার সাক্ষী নিয়ে এজীবনে পদার্পণ করতে হয়। এই মেয়েটার মনে আমার জন্য অনেক ভালোবাসা আন্টি। আমি বেচে থাকলে তো সে আমার সাথে থাকবেই, এমনকি আমি মা’রা গেলেও তাকে কেও আমার নাম থেকে আলাদা করতে পারবেনা। এটা আমার বিশ্বাস, ওর প্রতি বিশ্বাস(আমার দিকে তাকিয়)।”
অনেক লম্বা একটা ভাষন দিয়ে অবশেষে সায়ন লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলল। মহিলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই লাউঞ্জে দিপা এবং সুমনদা হাজির। পরিস্থিতি তারা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলো। তারাও যুক্ত হলো একই পয়েন্টে। সুমনদা বলল, “আন্টি ভুলটা আপনারই। কেন আপনি সব না জেনেই বিয়ের কথা চিন্তা করেছেন?”
আন্টি এবার রাগে রাগেই বললেন, “তোমার বন্ধু, সেই বলেছিলো তারা ভাই-বোন। আমি কি এমনি আমার ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম এই মেয়েকে!”
অবশেষে মহিলা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় শাসিয়ে গেছে রুম বুক করার সমস্ত টাকা ফেরত দিয়ে দিই যেন আমরা। উনি যেতেই সায়ন হোহো করে হাসতে হাসতে বলল, “সব ভন্ডুল করে দিলি। দেখতাম ওরা কত খরচ করতে পারতো তার জন্য।”
আমি রাগে রাগে ওখান থেকে উঠে আসি। সায়ন পিছন থেকে ডাক দেয়। আমি রুমে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ি। মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেলো। আচ্ছা মন খারাপের কারণই বা কি আর এর ওষুধই বা কি?
একটুপর সায়ন আসলো, আমার পাশে বসে আমার কপালে হাত রেখে বলল, “তোর তো জ্বর এসেছে। হঠাৎ জ্বর বাধালি কি ভাবে?”
“লাউঞ্জ থেকে আসার সময় জ্বরের সাথে দেখা হলো। আমি বললাম চলো গল্প করি তাই একসাথে আছি, যত্তসব।”
মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরলাম। সায়ন হাতের ঘড়িটা টেবিলের উপর রেখে বলল, “তোর পার্সে না জ্বর ঠান্ডা আর গ্যাসের কিছু ট্যাবলেট রাখা আছে না?”
আমি জবাব দিলাম না। নিজেই সে ওষুধ বের করলো সাথে ছোটো তিনটা প্যাকেট। এগুলো দেখে ভীষণ লজ্জা লাগলো। এসব কোথা থেকে আসলো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। সায়ন লজ্জার মাত্রা বাড়ানোর জন্য বলল, “মা হতে চাস আবার ব্যাগে করে এসব নিয়ে এসেছিস, দিস ইজ নট ফেয়ার সাথী।”
“কু’ত্তা, বিড়া’ল, ছাগ’ল আপনিই এসব রেখে এখন আমাকে দোষ দিচ্ছেন। লজ্জা করেনা বউয়ের ব্যাগে এসব জিনিস রাখতে। অন্যকেও দেখলে আমি লজ্জায় মা’রা যেতাম।”
সায়ন প্যারাসিটামলের একটা ট্যাবলেট বের করে একগ্লাস পানিসহ আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি কাত হয়ে ওষুধ আর পানি খেয়ে নিই। সায়ন হাত থেকে গ্লাস নিয়ে টেবিলের উপর রেখে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “ঘুমিয়ে পড়। আমি।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। এখন খাওয়া লাগবেনা। খেলে তোর বমি হবে।”
আমি স্বাভাবিক হয়েই তাকে জিজ্ঞাসা করি, “বা’*লের স্বামী আপনি। বউয়ের অসুখে জোর করে খাওয়াবেন তা না করে বলছেন এখন খেতে হবেনা ঘুমা!”
সায়ন মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “জোর করে তোকে খাওয়াতে ঠিকই পারবো। কিন্তু জানিসই তো, ছোটো থেকেই তোর জ্বরের সময় খাওয়ালে সাথে সাথেই বমি করিস। পানি ছাড়া তোকে কিছুই খাওয়ানো যায়না। মনে আছে ভার্সিটিতে যেবার চান্স পেলি কিভাবে খাবার না খেয়েছিলি তিনদিন। শুধু পানির জোরে হয়তো উপরওয়ালা তোকে বাচিয়ে রেখেছিলো। আমি রিস্ক নিতে চাইনা। বমি হলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে।”
আমি হঠাৎ ভরা চোখে তাকে বলি, “প্লিজ সায়ন আমাকে একটু জড়িয়ে ধরেন। খুব জোরে জড়িয়ে ধরবেন কিন্তু! আমার হাড়গোড় ভে’ঙ্গে গেলেও যেন ছাড়বেন না।”
সায়ন একটু কাছে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। আমার বুকে উপর নিজের মাথা রেখে বলল, “এইতো তোর বুকে মাথা রেখেছি। যত জোরে পারিস জড়িয়ে ধর আমাকে। এই আমিটা সম্পুর্নই তোর সাথী। নে না আমাকে নিজের পাজরে ঢুকিয়ে!” কথাগুলো এমন নেশাময় ছিলো।
আমি সায়নের মাথাটা আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি। “সায়ন একবার ভালোবাসি বলবেন? আপনার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার জন্য আমি ব্যাকুল, অনেক ব্যাকুল।”
সায়ন আমার বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, “তোকে কি আমি ছেড়ে যাচ্ছি সাথী? বিশ্বাস কর তুই আমার সাথে থাকলে আমার সব খারাপ লাগা ভালোই পরিবর্তন হয়ে যায়, আমার মনের ব্যাথা দূর হয়ে যায়। কিন্তু আমি তোকে এখনো ভালোবাসি নি। তোর প্রতি আমার যেটা আছে সেটা সম্পুর্ন শারীরিক টান।”
আমার চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি পড়ে বালিসে। একটুখানি আগে ওই আন্টি বলা কথাটা মনে পড়তেই মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। আসলেই তো লোকটা আমাকে না, আমার শরীরকে ভালোবাসে। তাইতো ভ্রমণে এসেও ব্যাগে করে উল্টোপাল্টা জিনিস আনা লেগেছে।
সায়ন বলে, “আমাকে ভুল ভাবতেই পারিস তুই। কিন্তু বিশ্বাস কর, ভালোবাসাটা আমি হঠাৎ করেই বাসতে চাইনা। আগে তোকে অনুভব করতে চাই, তোর সাথে প্রেম করতে চাই। তোকে কথা দিচ্ছি, তোর সব ইচ্ছাকে আমি পূর্ণ করবো। সারাদিন ভালোবাসি বলবো। তুইতো আমার প্রেমিকা ছিলিনা যে তোকে ভালোবাসবো এতো তাড়াতাড়ি। আরেকটা কথা, স্ত্রীর সাথে আলিঙ্গন করবেই প্রত্যেক স্বামী, ভালাবাসা না থাকলেও করবে। গল্পের মত আবেগ বাস্তবে থাকেনা। বাসর রাতেই স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবেসে ফেলেনা তবুও তারা এক হয়ে যায়। আমিও সেই অধিকার থেকেই তোর সাথে আলিঙ্গন করি।”
“সায়ন, আমি না খুব ভীতু মানুষ। আপনি তো আমাকে ছোটো থেকেই জানেন। আমার চাওয়া পাওয়া কোনোদিন অপূর্ণ রাখেনি আমার বাবা-মা। তাই কষ্টটা অনুভব হয়নি ঠিক ভাবে। আপনি একটু তাড়াতাড়ি ভালোবেসেন আমাকে। ততদিন আমার শরীরকেই ভালোবেসেন নাহয়।”
আমার তাচ্ছিল্য করে কথা বলাটা সায়ন একটু অন্যভাবে নিলো। আমাকে বলল, “আজকের পর থেকে আমি জোর করবোনা তোকে। দেখি কয়দিন আমার কাছে আশা থেকে নিজেকে আটকাতে পারিস। দুইদিনও পারবিনা, এটা আমার বিশ্বাস।”
সেদিনটা খুব একটা ভালো না গেলেও পরদিন সকালে নতুন যাত্রা শুরু। একটা নতুন পরিবেশ, কিছু নতুন মানুষ আর একগুচ্ছো নতুন অনুভূতি। বড় একটা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। ভাড়া বললে ভূল হবে এজেন্সি থেকে যে প্যাকেজ নেওয়া হয়েছিলো তার ভিতরই ছিলো গাড়ি ভাড়াটা। নাবিল ভাইয়া ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে, সায়ন আর সুমনদা মাঝের সীটে আর একদম পিছনের সারিতে আমরা তিনজন মেয়ে মানুষ। আগেই বলে রাখি, আন্টিরা আমাদের সাথে একই সাথে যেতে চাচ্ছিলোনা, এমনকি আমি নিজেও চাচ্ছিলাম না। সায়ন সকালে আমাকে বুঝিয়েছে, সেই থেকেই মনটা ভালো হয়েগেছে। সকালে আন্টি আর নাবিল ভাইয়া সাথে যাবে শুনে ব্যাগ গোছানো বাদ দিয়ে শুয়ে ছিলাম। সায়ন পাশে বসে বলল, “একজনের জীবনে একটা পুরুষই থাকে। তুই ভাবতো জীবনে কতগুলো প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিস। প্রস্তাব পেয়েছিস তাই বলে কি তাদের প্রেমিকা হয়ে গেছিস তুই? তুইতো আমারই আছিস, কত মানুষ তো তোকে পছন্দ করে। তুই কি তাদের মনে ঢুকে তোর নাম মুছে দিতে পারবি! পারবিনা। একজন তার বউমা হিসেবে তোকে পছন্দ করেছিলো, এখনতো সবটা ক্লিয়ার। আমরা তাদের ইগনোর কেন করবো, তারা কি অন্যায় কিছু করেছে?”
আমি দাতে দাত চেপে বললাম, “আমি আপনার বউ।”
“তো? তুই কি হারিয়ে গেছিস। শোন, অন্যের সব ইচ্ছাকে তুই পূরণ ঠিকই করতে পারবিনা। তবে তার ইচ্ছাকে সম্মান দিবি তাহলে তুই সম্মান পাবি।”
“তাহলে আমি ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা পাইনা কেন?” সায়ন চুপ।
এভাবে বেশকিছুক্ষণ কথা বলে বুঝলাম আন্টিদের আসলেই কোনো দোষ নেই। তাই একসাথেই যাত্রা। যাত্রাপথে আমি একদম আন্টির সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবো প্লান করলাম। আন্টি প্রথমে একটু জড়াতে নিয়ে থাকলেও আস্তে আস্তে প্রাণ খুলে গল্প করতে লাগলো। যাত্রা শুরুর প্রায় দুই ঘন্টা পর গাড়ি থামলো।
সিকিমের বেশকিছু ব্যতিক্রম এবং সুন্দর নিয়ম আছে। আপনি নর্থ সিকিমে প্লাস্টিকের বোতলে পানি নিয়ে যেতে পারবেন না, নোংরা তো করতেই পারবেন না। জেল হবে এর জন্য। পুলিশ আমাদের কাছ থেকে তিনটা প্লাস্টিকের বোতল পেলো। এসব রেখে দিলো। আমি বাইরে মাথা বের করে দেখলাম অনেক নিচ দিয়ে একটা নদী বেয়ে যাচ্ছে। গাড়ি রাস্তার ধারেই ছিলো, কেমন ভয় ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই গাড়িটা উলটে পড়ে যাবে ওই নিচের নদীর ভিতর। সায়ন ততক্ষণে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।
একটু পর সায়ন আমার পাশের দরজাটা খুলে বলল, “বাইরে আয়।”
আমিও নিচের ওই নদী দেখার লোভে বাইরে পা বাড়ালাম। রাস্তার একপাশে বড় পাহাড় আরেক পাশে, অনেকটা নিচে নদী। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে চেয়ে রইলাম। পানিটা কেমন দুধসাদা, সায়নকে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “দূর থেকে দেখছিস তাই এমন দেখাচ্ছে। কাছে গেলেই স্বাভাবিক লাগবে।”
কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম নিচের দিকে। সায়ন বলল, “তোকে যদি কেও পিছন থেকে ধাক্কা দেয় তাহলে কি হবে?”
কথাটা শুনে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো আমার। সায়নের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার গায়ে থাকা সোয়েটার খাম’চে ধরলাম। সায়ন কানে বলল, “যাবি ওখানে?”
চলবে ইনশাআল্লাহ