#চুপকথার গল্প
#পর্ব_১
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আচমকা তর্ক লেগে গেল খাবার টেবিলে শ্বশুর জামাইয়ের। কথা দৌড়ে এল। সজীবের তীব্র রাগী চোখ দেখে ভড়কে গেল সে। মোতালেব সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ির মেয়েদের তিনি ভেতরে যেতে বলে জামাইয়ের সাথে কি এমন গোপন কথা সাড়লেন যার জন্য এত রেগে লেগে গেল সজীব?
কথার মা মারজিয়া বেগম কিছু বুঝে পেলেন না। ছেলেটা একটু খেতে বসেছে লোকটা আবার কি বলল কে জানে ? ছেলেটা যে তার মেয়ে জামাই হয় লোকটা কি ভুলে যায়?
কথা চলে আসায় মোতালেব সাহেব উঠে চলে গেলেন। মারজিয়া ও ভেতরে চলে গেল। কাজের লোক আর কথারর বড় বোন কলি ও চলে গেল। অন্যদিকে মুখ করে চেয়ারে বসে রইল সজীব। মধ্যবিত্ত হলে ও আত্মসম্মান প্রবল তার । তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার। চোখ বন্ধ করে আবার খুলে তীব্র রাগ,ক্রোধ সংবরণ করল সজীব। কে এল, কে গেল তা দেখার চেষ্টা করল না।
খিদেয় পেট চো চো করছে। কিন্তু মোতালেব সাহেবের কথা শুনে আর খাবার নামবে না তার। টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই হাতে টান অনুভব হলো সজীবের। নীরব প্রাণীটির নীরব চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলোনা সজীবের। নরম হাতটা এত শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে ছেড়ে যাওয়ার জোঁ নেই।
হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকল সজীব। এত অধিকার নিয়ে তাকে ছুঁই। কই তার তো কখনো এই মেয়েকে ছোঁয়ার ইচ্ছে হয়না। কখনো হয়না।
কথা চোখের ভাষায় অনুনয় করল টেবিল ছেড়ে চলে না যাওয়ার জন্য। সজীব আবার চেয়ারে বসে গেল। নিজ হাতে প্লেটে খাবার নিয়ে দিল কথা । আজ নিজ হাতের রান্না করেছে, এই মানুষটা না খেলে সব বৃথা যাবে। একটু খেয়ে দেখুক। বলুক, কথা রান্না খুব ভালো হয়েছে। কথার কান জুড়াক সেই গম্ভীর কন্ঠস্বরে ভেসে আসা একটু প্রশংসায়। মন জুড়াক। প্রাণ জুড়াক। কিন্তু এই মানুষটা আজ পর্যন্ত কোনোদিন তার নাম ধরে ডেকেছে কিনা সন্দেহ। নামটা ও কি জানে কিনা কে জানে?
কথা সজীবের পছন্দের চিংড়ি তুলে দিল পাতে, কষা মাংস। সজীবের সামনে প্লেট বাড়িয়ে দিলে ও সজীব তাকাল না। কিংবা খাওয়ার উৎসাহ দেখাল না। অন্যদিকে মুখ করে রাখল। শক্ত হয়ে বসে থাকল। কথা বুঝতে পারে এই লোকটা আজ খাবেনা। খাবার না পানি ও খাবেনা এ বাড়ির। কিন্তু লোকটার খিদে পেয়েছে। চেহারায় তা দেখা যাচ্ছে। আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে এই লোকটা কখনোই খাবার মুখে তুলবেনা। কখনোই না। কথা তা হতে দিতে পারেনা আজ। উজ্জ্বল চেহারাটা ফ্যাকাশে দেখতে তার খারাপ লাগছে। পাপা কেন এমন সময় ঝগড়া বাঁধালো?
হাত ধুঁয়ে প্লেটে হাত দিল কথা । ভাত মাখতে লাগল একহাতে, অন্য হাতে ধরে রইল সজীবের হাত। ভাত মেখে সজীবের মুখের সামনে দিয়ে তাকাল অন্যদিকে। সজীব উঠে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হাতটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল কথা । চোখ পিটপিট করে ছলছলে চোখ লুকোলো। সজীব খেল কথার হাতে।
হাতটাতে দুই ঠোঁট আর জিভের কিঞ্চিৎ স্পর্শে আঁতকে উঠল কথা । তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নিতেই সজীবের ঠোঁটের পাশে লেগে গেল ঝোলভাত। বিরক্তি নিয়ে তাকাল সজীব। অন্যকিছু হাতের কাছে না পেয়ে গায়ের পড়া ওড়নার আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দিল কথা । অনুতাপ নিয়ে তাকাল। সজীবের চোখজোড়া স্বাভাবিক হয়ে আসলে বাড়িয়ে দিল আরেক লোকমা ভাত। খিদের চোটে খেল সজীব। শান্তি পেল কথা । এবার সে নিশ্চিন্তে থাকবে।
খাওয়া শেষে পানি খেয়ে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সজীব। একমুহূর্ত ও দাঁড়াল না। তাকাল না পেছনে।
মোতালেব সাহেব চেঁচালেন বাড়ি কাঁপিয়ে। কেমন বেয়াদব ছেলে? আমার বাড়ির জামাই হয়ে সে নাকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করাবে? আমার কোম্পানি চাকরি করলে নাকি তার মানসম্মান ধুঁয়ে যাবে। বেয়াদব ছেলে। এই মোতালেব শেখকে চেনেনি তাই এমন কথা বলতে পারল। আমার মেয়ের জামাই করে কি আমি টেকাই পড়েছি?
কথার বড় বোনের স্বামী সুমন। শ্বশুরকে শান্ত করাতে পারল না। বড়লোক বাপের ছেলে , কিন্তু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলায় বাপ বাড়িতে আর জায়গা দেইনি তাকে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মোতালেব সাহেব মেয়ে জামাইকে কোম্পানির ম্যানাজারিং পদে রাখেন। তার কথার ভাঁজে ভাঁজে অহংকার। যেন কোম্পানিটা তার বাপের। সজীবকে দাপট দেখিয়ে কথা বলে ও শান্তি পায়না সে। সজীব সবসময় তাকে খুব সুণিপুণভাবে এড়িয়ে চলে। যেন চোখ থাকতে ও অন্ধ, মুখ থাকতে ও বোবা। সুমন মনে করে বোবা বউয়ের বাতাস লেগে সজীব ও বোবা হয়ে গেছে।
কথা মায়ের রুমে চলে গেল দৌড়ে। বাবার চেচাঁমেচি কানে এসেছে। মায়ের হাতে জোরে চিমটি বসিয়ে দৌড়ে চলে গেল কথা । মারজিয়া হাত ঢলতে ঢলতে বললেন,
‘ জামাইকে কিছু বলতে পারবেনা, রাগ দেখাবে আমার উপর। তোর বাপকে গিয়ে মার না চিমটি।
কলি মায়ের চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এল।
‘ কি হয়েছে মা?
মারজিয়া হাত ঢলতে ঢলতে বললেন,
‘ দেখলি কিভাবে চিমটি মেরে চলে গেল বুবোনি?
কলি নাক সিটকালো।
‘ আর ও প্রশয় দাও তাকে। মাথার উপর তুলে রাখো। চিমটি দেবেনা আদর দেবে।
______________
রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। ইজেলের ক্যানভাসে আঁকা অর্ধেক ছবিটার দিকে বড়ব্রাশের কালো রং ঘষে দিল কথা । এই লোকটার ছবি সে কেন আঁকবে? কেন আঁকে?
যার জন্য এতকিছু করে সে একবার ফিরে ও দেখেনা সেসব। কেমন আনমনা, আনমনা? আজ কি কোনো বন্ধুর বাসায় থেকে আসবে? নাকি আসবে কথার কাছে। আজ তো দুপুরে এসেছিল তারমানে রাতে ও আসবে।
এগারোটার পর আর জাগতে পারেনা কথা । বিছানায় ঢলে পড়ে।
সাড়ে এগারটার দিকে বাড়ি ফিরে সজীব। টিভি দেখা সুমন বলল,
‘বেকার সাহেবের ঘুরাঘুরি কি শেষ? আজ কোনো বন্ধু জায়গা দিলনা?
সজীবের হাঁটার ধরণ দেখে মনে হলোনা সে সুমনের কথা শুনেছে কিংবা গায়ে মেখেছে। সুমন বুঝে গেল সজীব তাকে খুব সুণিপুণভাবে এড়িয়ে চলছে। সুমনের তীব্র আক্রোশ ফেটে পড়ল যেন। সে বিড়বিড় করল,
‘ ফকিরের বাচ্চা।
দোতলা থেকে ধপ করে ফুলের টব পড়ে গেল নিচে। মাটিতে মাখামাখি হলো মেঝে। কে ছুঁড়ে মারল কেউ দেখলনা। সুমন ভয়ে আঁতকে উঠল।
দরজা ঠেলে রুমে ডুকে ওয়াশরুমে চলে গেল সজীব। এত বড় বাড়ি, এত আভিজাত্য, কোনোকিছু টানেনা তাকে। বিছানার উপর ধলা হয়ে পড়ে ঘুমোনো মেয়েটিকে ও দেখলনা সজীব।
কথার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিল প্রাণপুরুষ এসেছেন। সে চট করে উঠে টেবিলে রাখা ভাতের প্লেট, বাটি দিয়ে ছোট্ট টেবিলটা সাজিয়ে ফেলল।
সজীব ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুখ মুছে নিল। কথা ঘুমিয়ে পড়ল আবার। সজীব খেয়ে শুয়ে পড়ল। কথাকে ডিঙিয়ে ল্যাম্প বন্ধ করল।
ভোরবেলায় ফজরের আজান ভেসে আসল। কথার ঘুম ভাঙে ঠিক তখনি। নড়াচড়া করতে গিয়ে বাঁধা পেল কথা ৷ নিজের উদরের উপর ভার ভার অনুভব হতেই থমকে গেল কথা । শ্বাসরোধ হয়ে এল। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল। লোকটা আর ঘুমানোর জায়গা পেলনা? একেবারে গায়ের উপর।
সরাতেই চেয়ে ও পারল না কথা । সজীবের গায়ে দিতে গিয়ে ও আটকে গেল সে। নড়াচড়া করতে লাগল সে সামান্য সামান্য। তারসাথে সাথে সজীব ও নড়ল। চোখ কচলে কথাকে আর ও শক্ত করে আগলে ধরে রাখল। কথা এবার সজীবের মাথা সরাতে গেল৷ সজীব চট করে উঠে বসল। ঘুমঘুম চোখ খুলতেই কথাকে দেখল। নিজে কোথায় তা দেখে চোখ আর ও বড় হলো তার। চট করে সরে পড়ল সে। বিস্ময় নিয়ে তাকাল কথার দিকে। লজ্জায় মাটিতে নিচে ডুকতে ইচ্ছে হলো কথার। বিছানা থেকে নেমে গেল সে তাড়াতাড়ি। গায়ের ওড়না রেখেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। ওড়নাটা রয়ে গেল সজীবের হাতে। ওড়নাটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল সে।
রুম থেকে বেরোতেই দেয়াল চেপে দাঁড়িয়ে থাকা কথাকে দেখল। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে কথা ।
সজীব ওড়নাটা কথার দিকে ছুঁড়ে মারল। তারপর আবার রুমে চলে এল।
চলবে,