চুপকথার_গল্প #অন্তিম_পর্ব_১৫

0
1993

#চুপকথার_গল্প
#অন্তিম_পর্ব_১৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা

প্রথম সন্তানের পর দ্বিতীয়বার আবার ও ঘর আলো করে মেয়ে সন্তান জন্ম নেয় শেখ পরিবারে। হালিমা বেগম মনে করেছিলেন এইবার একটা পুত্রসন্তান হবে তার ছেলের । কিন্তু সেই আগের ঘটনা দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই বেশ নাখুশি হন তিনি। কিন্তু মুখে হাসি সরেনি মোতালেব শেখের। এই যেন ছোট্ট আরেকটি পুতুল। গোলমাল মুখের পুতুলটি তিনি না থাকলে হয়ত সেই ছোটবেলার জ্বর কাশিতে ও আক্রান্ত হয়ে পরপার হতো। মারজিয়া সহ্য করতে পারতনা এমন নয়, শ্বাশুড়ির খোঁটা তিনি সইতে পারতেন না। তাই ছোট্ট বাচ্চাটি যখন ম্যা ম্যা করে কেঁদে উঠত তিনি দৌড়ে যেত, কিন্তু যখন তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতো তখন বুকে যেন রক্তক্ষরণ হতো মারজিয়ার। আল্লাহ তাকে কেন পুত্রসন্তান দিলনা। আবার এ ও জানা গেল সে আর মা হতে পারবেনা। তার জীবনের রিস্ক আছে। মোতালেব শেখ দুই সন্তানকে নিয়ে বেশ খুশি। আর সন্তান দরকার নেই তার।
দেখা যেত বড় মেয়ে কলিকে মারজিয়া একটু বেশিই আদর যত্ন করত। আর ছোট মেয়ের বেলায় গাফিলতি। হালিমা বেগম তো দুনোটাকেই দেখলে নাক সিটকাতো। কিন্তু যখন সেই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো কথা বলা শিখল। সারাক্ষণ পাখির মতো কিচিরমিচির কিচিরমিচির শব্দ করত বাড়িতে। দুইবোন মিলে কখনো কখনো উচ্চস্বরে হাসি আবার কখনো একসাথে ঝগড়া। তখন একটু একটু মন গলতে শুরু করল হালিমা বেগমের।
ধীরে ধীরে বাড়িটার প্রাণ হয়ে উঠল বাচ্চাদুটো। মোতালেব শেখের কাছে হয়ে উঠল রাজকন্যা। দিনশেষে রাতে তার ও বাড়ি ফেরার তাড়ার মেয়ে দুটোর জন্য। তার পথ চেয়ে বসে থাকতো মেয়ে দুটো। বড় মেয়েটা হলো একটু মাথামোটা টাইপের। যা দেখত তাই বিশ্বাস করত, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু করতে পারেনা। কিন্তু ছোটমেয়ের বুদ্ধিমত্তা নজরকাঁড়া। যা দেখবে যা শুনবে তাই মাইন্ডে সেট করে রাখে সে। পেন্সিল নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এঁকে ফেলে তার আপার ছবি, মায়ের ছবি, বাবার ছবি, দাদুর ছবি। কি সুন্দর করে গান গায়। শুনলেই মন ভরে যেত। ধীরেধীরে যখন ছোটমেয়ে বড় হয় মারজিয়ার মন গলতে থাকে তত। এ তো তার গর্ভের সন্তান। এই সন্তান তারই। তার মনমাতানো গলার সুর আর হারমোনিয়ামের শব্দ শুনে পাগলপারা হতো হালিমা বেগম। অপছন্দের এই নাতনি কখন তার হৃদয়গহীনে জায়গা করে নিল বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। তিনি বুঝলেন ছেলে সন্তানই সবকিছু নয়, মেয়েরা ও সব পারে। মেয়েরা ও বাবার দায়িত্ব নিতে পারে। স্কুলের টপ হওয়া মেয়েটি ছবি আঁকা আর গানের জন্য স্কুলে পরিচিতি লাভ করে অল্পতেই। তার খ্যাতি ছড়িয়ে যায় দ্রুত। কিন্তু বাঁধ সাধে তার গলার ব্যাথা। মারজিয়া মনে করল গান গাওয়ার কারণে গলা ব্যাথা হয়। তাই তিনি কথাকে গানের জগত থেকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখলেন। কিন্তু কথা কি তা আর মানে? তার শিল্পীমন গুনগুন করে গান গেয়ে ছবি আঁকে। মায়ের বারণ শোনে কই?
ঠিক একদিন সেই ইজেলের ক্যানভাসের উপর বমি করে ভাসায় সে৷ রক্তবমি সাদা ক্যানভাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভয়ংকর রূপ দেয়। সেইদিনের পর আর গান গাইতে পারল কই? ডাক্তার সিটিস্ক্যান করিয়ে জানায় যে তার স্বরনালিতে টিউমার বাসা বেঁধেছে, শীঘ্রই অপারেশন করিয়ে সেই টিউমার অপসারণ করতে হবে নইলে বিরাট সমস্যা হয়ে যেতে পারে। এমনি ক্যান্সারের সম্ভাবনা। তাতে মৃত্যু ও ঘটতে পারে। ভয়ংকর রোগের এই ভয়ংকর অপারেশনের পরে কথা শুধু গান গাওয়া নয় কথা ও বলতে পারল না। তার কথা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। বাঁচাল মেয়েটি ধীরধীরে হয়ে পড়ল শান্ত। তার দুঃখ এটা নয় সে বাকিদের মতো কথা বলতে জানেনা, তার দুঃখ এটাই সে গালভরে মাকে আর বাবাকে ডাকতে পারেনা। আপা ডাকতে পারেনা৷ তার নাম কাউকে বলতে পারেনা। গান গাইতে পারেনা। কথা বলতে না পারার শোকে সে ছবি আঁকা বন্ধ করে দিল কিন্তু তার পাশে তার উৎসাহদাতা হয়ে দাঁড়ালো তার পরিবার। মা, বাবা, দাদু। কথা বলতে পারছেনা তো কি হয়েছে? শুনতে তো পাচ্ছে। অনেকবার এমন হয়েছে কথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার গলা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে কথার৷ আল্লাহ কেন গলার স্বর কেড়ে নিল৷ কি অপরাধ তার?

____________

রান্নাঘরে কুটকুট তরকারি কাটতে কাটতে মারজিয়া চোখের জল মুছলেন। সজীব চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। বলল
‘ কাঁদবেন না আম্মা। যা হয়ে গিয়েছে তাকে তো আর ফেরানো যায়না। আমি ভেবেছিলাম কথা জন্ম থেকেই বাকপ্রতিবন্ধী।
মারজিয়া আবার গাল মুছলেন। সজীব কফির মগ হাতে নিল। বলল
‘ আমি যাই।
মারজিয়া মাথা নাড়ালো। কথা তখন রুমে ছবি আঁকায় ব্যস্ত। তার আর সজীবের ছবি। ব্রাশে শেষ রঙ লাগিয়ে লাগানোর সময় সজীব এসে হাজির। দরজা বন্ধ করে কথার পেছনে এসে দাঁড়াল৷ তার কাঁধে চিবুক রেখে বলল
‘ কথারাণী আপনার কফি।
সজীবের সামনে ফিরল কথা। অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে কথা বলার চেষ্টা করল সে৷ যেন এই শব্দগুলো সে শুধু সজীবের জন্য উৎপত্তি করে। আর সজীব যেন সে ভাষা বুঝতে পারে। সজীব চোখ উপরে তুলল। বলল
‘ আমি জানি আপনি ছবি আঁকছেন কিন্তু কফি ও খাওয়া যায় ম্যাডাম।
কথা গলা কাত করে চাইল সজীবকে। যেন সে সজীবকে বুঝিয়ে ক্লান্ত। সজীব কথার হাত তুলে ব্রাশে থাকা রঙগুলো লাগিয়ে দেয় কথার মুখে। চোখ বড় বড় করে ফেলে কথা। ঠোঁট ফুলায়। হেসে দেয় সজীব। তার হাসি দেখে কথা আরও রাগে। ব্রাশটা সজীবের দিকে এগিয়ে দিতেই পালায় সজীব। কফির মগ টেবিলে রেখে সে লুকোয় খাটের পেছনে। কথা দৌড়ায় তার পিছুপিছু। আজ রঙ লাগিয়ে দিয়ে একদম ভূত বানিয়ে ছাড়বে। কথা খাটের পেছনে গেলে হেসে উঠে সজীব। মুখে হাত দিয়ে ছুটে আবার। ধপ করে খাটে শুয়ে পড়ে বালিশ টেনে নেয় মুখের উপর। মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করল না কথা। জোরে টান দিয়ে নিয়ে ফেলল সে বালিশ। তার পর আধশোয়া হয়ে শুয়ে সজীবের কপাল থেকে থুতনি অব্ধি রঙ লাগায়
সজীব আর বাঁধা দিলনা। সে খাঁচায় আটকা পড়েছে। কথা হাসতে হাসতে ব্রাশটা দিয়ে ইচ্ছেমতো রঙ লাগিয়ে দিল সজীবকে। ভূত বানিয়ে ছাড়ল। ভাবল, এই মশাই এত শান্ত কেন? রঙ লাগানো শেষে উঠার সময় ঘটল আরেক বিপত্তি। কথাকে টান দিয়ে ফেলে তার উপর ঝুঁকে পড়ল সজীব । কথা স্তব্ধ। ডাগর ডাগর চোখ মেলে সে সজীবের উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করল। তাকে অবাক করে দিয়ে সজীব তার গালের পাশ লাগালো কথার গালে। নিজের মুখের রঙ মাখিয়ে দিয়ে সে রাঙিয়ে দিল কথার মুখ। চুপটি করে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারলনা কথা। রঙমাখা শেষে সজীব যখন স্থির দৃষ্টি রাখল তার মুখের উপর তখন বালিশ টেনে মুখের উপর রাখল কথা। সরালো না। সজীব তার মাথা ফেলে রাখল সেই বালিশের উপর। হাসল। বালিশের নিচে চাপা পড়া কথা ও হাসল।

___________

সময় থেমে থাকেনা। নিজের স্বকীয়তা বজার রাখতে তার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু থেমে থাকে কলির মতো কিছু ঠকে যাওয়া মেয়ের জীবন। যারা পাগলের মতো ভালোবেসে, আগলে রেখে অপর মানুষটার কাছে ঠকে যায় তখন নিজেকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবা ও যেন অপরাধ। অন্যায়। কিন্তু জীবনটাকে আর ও একবার সুযোগ দিলে মন্দ হয়না। এক অপরাধীর জন্য সে কেন এভাবে দিনের পর দিন ধুঁকে ধুঁকে মরবে?
সুমনকে শাস্তি দেওয়ার অনেক রাস্তা খোলা ছিল। কিন্তু কলি দেইনি। শোনা গিয়েছে সুমনের স্ত্রী সোনালি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছে সম্প্রতি। রেখে যাওয়া সন্তানকে দত্তক দিয়েছে সুমন। সে ফিরতে চায় কলির জীবনে। কলি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে। পাপ কখনো তার বাপকে ছাড়েনা। মোতালেব শেখ কলিকে বিয়ে দিলেন এবার নিজ পছন্দের পাত্রের সাথে। কলি মেনে নিল বাবার সিদ্ধান্তকে । তা ও অনেক কাহিনী। নিজের নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ তার এই দশা। সজীবের অফিসে কর্মরত মুহিব বেশ ভালো বংশের ছেলে। মা বাবা গত হয়েছেন তিনবছর। তিনবোনের এক ভাই সে। মুখে যেন সবসময় হাসি ঝুলে থাকে ছেলেটার। মোতালেব শেখের ভারী পছন্দ এই ছেলেকে। তার অনুরোধ ফেলতে পারেনি মুহিব। কলেজ যাওয়ার পথে সে দেখত কলিকে। কিন্তু কলি ছিল প্রচন্ড দাম্ভিক আর রগচটা। যার কারণে ভালোলাগার কথা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি মুহিব। যেদিন শুনেছে কলি বিয়ে করে নিয়েছে সেদিন যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল মুহিবের মাথায়। যেন মনে হয়েছিল কলি তাকে ভীষণ ঠকিয়েছে। অথচ ঠকানোর প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? সেই কলিকে শেষমেশ তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হলো। মুহিব সন্তুষ্ট এতেই যে কলির ভুল ভেঙেছে। দম্ভ কমেছে। নিজেকে চিনতে শিখেছে। বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে। সে ও নিজেকে সুযোগ দিতে চাইনি কলির জন্য। তার জীবনের প্রথম ভালো লাগা ছিল কলি। তাই তো আর বিয়ে নামক বন্ধনে জড়ায়নি। হয়ত উপরওয়ালা তাই চেয়েছিলেন। সজীব তার ছোটভাইয়ের মতো। কোম্পানির চেয়ারম্যান হয়ে ও সারাক্ষণ মুহিব ভাই, মুহিব ভাই ডাকতে থাকে ছেলেটা। এত ভালো লাগে। মুহিবের মনে হয় যেন তার ছোট্টভাই হিসেবে সে সজীবকে পেল। ছোট বোন হিসেবে পেল কথাকে। মা বাবা হিসেবে মোতালেব শেখ আর মারজিয়াকে।
আর জীবনসঙ্গী হিসেবে কলিকে। যা সে অনেক আগেই চেয়েছিল।
অতিরঞ্জিত লোকদেখানো ভালোবাসা আর প্রকৃত ভালোবাসার পার্থক্য কলি হারে হারে টের পায় মুহিবকে দেখে। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে বোধহয় সবাই পারেনা। সবার দ্বারা সম্ভব হয়না। কথায় কথায় ভালোবাসি না বলে, আর ওভার কেয়ারিং না দেখিয়ে ধমকানোর ভেতর আর রাগের আড়ালে ও ভালোবাসা সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। কলি বিচলিত হয় মাঝেমাঝে সুমনকে সে ধমকাতো। অথচ এই মানুষটা তাকে উল্টো ধমকায়। কোনো কিছুর ভয় নেই। সুমনের তাহলে সম্পত্তি হারানোর ভয় ছিল? এজন্যই কলিকে এত মান্য করত?
কোম্পানির অর্ধেক শেয়ার সজীব কলির নামে লিখে দেয়, বাকিটা কথার নামে। মোতালেব শেখ এতে তার উপর অসন্তুষ্ট হয়। সজীব তার হাত ধরে বুঝায়,
‘ আব্বা দেখুন, কথার যা আমার ও তা। কলির যা মুহিব ভাইয়ের ও তা। ভালোথাকার জন্য, ভালো রাখার জন্য তো এসব সম্পত্তির প্রয়োজন নেই আব্বা। প্রয়োজন বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসার। আর একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান। টাকা আর সম্পত্তি বিষয়াদি সবকিছু তো নামমাত্র। আমাদের ভালোথাকার মূলমন্ত্র হচ্ছে প্রিয়জনদের কাছে থেকে তাদের আগলে রাখা। তাদের ভালোরাখা। আর তাদের ভালোথাকতে দেখে নিজেও ভালো থাকা। এর চাইতেও বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই তো।
ভুল ভাঙল মোতালেব শেখের। এই বাচ্চাগুলোর কাছ থেকে কতকিছু যে শেখার আছে!
ভুল ভাঙল মারজিয়ার ও। দুই মেয়ের পাশে দাঁড়ানো এই ছেলেদুটো কিভাবে তাকে আম্মা ডাকে!
কে বলে তাদের ছেলেসন্তান নেই? এই যে দুইজন এভাবে গালভরে আম্মা ডাকে। যেই ডাক শুনলেই চোখে বৃষ্টি আসে। তার চাইতে বড় সুখ কি আর আছে?
সজীব আর মুহিব দুইজনই যেন ভাই ভাই। কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে কাজ করে দুজনই। মোতালেব শেখের আর চিন্তা নেই। তিনি বাড়িটার দুই অংশ দুই বোনের নামে লিখে দেন। এইবার মরে ও শান্তি।

__________

কথা ছবি আঁকে মুহিব আর কলির। সবাই বসেছিল ড্রয়িংরুমে। কথার হাতে দুইটা ছবির একটা দেখে মারজিয়া জিজ্ঞেস করল
‘ এটা কার জন্য এঁকেছিস?
কথা আওয়াজ করে, ভাঃ ভাঃ।
মুহিব বুঝে যায়। জিজ্ঞেস করে
‘ ভাইয়ের জন্য এঁকেছ? দেখি দেখি।
মুহিব ছবিটা হাতে নিয়েই চমকায়। দেখে কলি আর মুহিবের কোলে একটি ছোট্ট বাচ্চা শিশু। মুহিব চোখ পাকিয়ে থাকে। কলি আসে। কেড়ে নিয়ে বলে
‘ এভাবে দেখছেন কেন? দেখি কি এঁকেছে?
কলি হা করে তাকিয়ে থাকে। কথা হাসে। বাচ্চা দোলানোর মতো দুলিয়ে বলতে চাই
‘ আমাদের বাড়িতে বাবু লাগবে। আমি খালামণি হবো।
লজ্জায় পড়ে যায় কলি আর মুহিব। আওয়াজ করে হেসে দেয় মোতালেব শেখ। বলে,
‘ আমার মা একদম ঠিক কথা বলেছে। কাজের মতো কাজ করেছে। বাবু তো লাগবেই।
কলি আর মুহিব মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কলি বলল
‘ আরেকটা কার জন্য এঁকেছিস?
কথা ভড়কে যায়। সজীবের দিকে তাকায়। কথা লুকোতে চাই ছবিটি। কলি গিয়ে কেড়ে নেয়। বলে
‘ লুকোচ্ছিস কেন কথা?
কথা তাকায় সজীবের দিকে। সজীব চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।
‘ কি ব্যাপার!
কলি ছবিটা ভালো করে দেখে৷ বেশকিছুক্ষণ পর বলে
‘ এটা কে কথা? ভাইয়ার সাথে এই মেয়েটা কে?
সজীব কৌতূহল নিয়ে এগোলো। কলির হাত থেকে ছবিটা কেড়ে নিয়ে চট করে তাকালো কথার দিকে। কথা এগিয়ে আসলো। সজীবের হাত থেকে ছবিটা কেড়ে নিতে গিয়ে ও পারল না। শক্ত করে ধরে তাকিয়ে আছে সজীব। কথা বারবার তার সাথে অন্যায় করে। জেনে-বুঝে করে। এ ভারী অন্যায়। কথার হাতে ছবিটা দিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সজীব।
অতীত সে ভুলতে চাইনা কখনো, মায়া ভুলার নয়। মায়াকে সে কখনোই ভুলতে পারবেনা। জীবনটা নাটকীয় নয়, জীবনই কঠিন বাস্তবতা। আপন মানুষগুলোকে ভুলার চেষ্টা করা ও অন্যায়। কিন্তু সজীব নিজেকে কথার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কথাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছে। ভালোরাখার চেষ্টা করেছে। এই কম কিসের? কিন্তু কথা? কথা কি চাই? কথা বারবার নিজের জায়গায় মায়াকে বসিয়ে কি প্রমাণ করতে চায়?
সজীব মায়াকে ভালোবাসে, কথাকে বাসেনা? অন্যরকম ভাবতে পারতো কথা। কথা ভাবতে পারতো, সজীব তাকে ভালোবাসে কিন্তু সেই ভালোবাসা আরেকজনের সাথে তুলনা করাটা বোকামি। সজীব মায়াকে ভালোবেসেছে। এটা চিরন্তন সত্য। আর বেসে যাবে। তারমানে এই নয় সে কথাকে ভালোবাসেনা। তার জীবনের দুই সত্য কথা আর মায়া। একটা সত্যি হয়ে অপরটা মিথ্যে হয়ে যেতে পারেনা। তাহলে ভালোবাসা শব্দটাই মিথ্যে হয়ে যাবে। কথা ভেবে রেখেছে সজীব কথার মাঝে মায়াকে খুঁজে পায়। এজন্যই নিজেকে এত গুটিয়ে রাখে। সত্যি বলতে সজীব মায়ার মাঝেই মায়াকে খুঁজে নিত। আর এখন কথার মাঝে কথাকে। কথাকে সে ভালোবাসে এর চাইতে ও বড় সত্যি আর কিছুই হতে পারেনা। মায়াকে সে ভালোবাসতো। বাসে। বাসবে। তবে সেই ভালোবাসা নেওয়ার জন্য মায়া কখনো ফিরে আসবেনা। সে মায়াকে ভালোবাসে তার মানে এটা নয় সে কথাকে ভালোবাসেনা। সে ভালোবাসে কথাকে। কিন্তু সে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ। কথা ও বুঝেনা। ভালোবাসার আড়ালে সে শুধু শুধু অভিমান জমায়। হাসির আড়ালে সে কান্না জমায়। বুঝেনা কিসে দূরত্ব কমায়। বুঝেনা। কথা বুঝতেই চায়না। সজীব বুঝিয়ে ও কূল পায়না।

সেদিন যে বেরোলো সজীব, ফিরল একদম রাত করে। কথা তাকে ফিরতে দেখে অপেক্ষা করল ঘরে। দরজা ঠেলে ডুকতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সজীবের বুকে। মানুষটা খুব আঘাত পেয়েছে নিশ্চয়ই? কথা আঘাত করল? কি করে পারল? এত ভয়ংকর সুন্দর অতীত ভুলে কথাকে আপন করে নিয়েছে এটা কি যথেষ্ট নয়? আমরা এমন কেন? যত পায়,ততই চায় কেন? অল্প দিয়ে হয়না কেন?
সজীব গম্ভীর কন্ঠে শুধালো।
‘ তুমি কাঁদছ কথা?
কথা চোখ তুলে তাকালো। মাথা নাড়ালো ঘনঘন। সজীব বলল
‘ তোমাকে কাঁদতে কে বারণ করেছে? কাঁদো, ইচ্ছেমতো কাঁদো। তবে এটুকুই মনে রেখো কথা তোমার চোখের জলের কারণ যাতে আমি না হই। আমি কারো চোখের জল হতে চাইনা কথা।
কথা ফোঁপাতে ফোঁপাতে চেয়ে রইল। সজীব বলল
‘ আমি কি তোমাকে ভালো রাখতে অক্ষম হয়েছি কথা?
কথা মাথা নাড়ালো। সজীব তার দুবাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল
‘ তাহলে? তাহলে এসব কেন কথা? আমার ভীষণ কষ্ট হয় যখন মনে হয় আমি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছি। ভীষণ কষ্ট হয় কথা। তুমি আমাকে আজও বুঝলেনা। কেউ বুঝল না। না বুঝল আম্মা, না বুঝল মায়া, আর না তুমি। কেউ বুঝলে না।
কথা সজীবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বুকে মাথা ঘষে বলতে চাই
‘ আমি দুঃখিত, আপনাকে কষ্ট দিয়ে দুঃখিত।
আপনি ভালো না থাকলে আমি ও থাকিনা।
সজীব তার হাতটা রাখলো কথার মাথায়। চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল
‘ তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি চুপকথা। তুমি কেন বুঝে ও বুঝোনা?

______

প্রায় দুইবছর পর,

কলি এক ছেলে সন্তানের জননী। বয়স এক বছর চলছে। মুহিব তাকে নিয়ে অন্যত্র থাকে। কথা আর সজীব ও। মারজিয়া কান্নাকাটি করলে আবার চলে আসে। আবার বাড়িতে থাকতে থাকতে বোর হলে বাইরে চলে যায় পনের দিন কিংবা সপ্তাহের জন্য। কথা তখন অসুস্থ। সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। সামান্য স্বাস্থ্য এসেছে। মুখ বড় হয়েছে। গায়ের রঙ আর ও উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। আর ও অন্যরকম সৌন্দর্য। মা হওয়ার সৌন্দর্য।
মারজিয়া কথাকে কোথাও যেতে দিল না। তার কাছে রেখে দিল। এসময় একটু যত্ন আত্তিরের প্রয়োজন পড়ে। দেখেদেখে রাখতে হয়। সজীবের গলার আওয়াজ শুনল নিচে। দৌড়ে যেতে গিয়ে ও গেলনা। বকবে তাকে। সজীব নিজেই উপরে উঠে আসল। কথা দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরল তার।
সজীব বলল
‘ আবার কি হয়েছে?
কথা রাগ করল। সে কি এমনি এমনি জড়িয়ে ধরতে পারেনা?
কথা হাত নামিয়ে ফেলতে হাতজোড়া ধরল সজীব। পড়নের ব্লু রঙের পাঞ্জাবির পকেট থেকে চুড়ি বের করে পড়িয়ে দিল। কপালে কপাল মিলিয়ে বলল
‘ কেমন চলছে আপনার দিনকাল?
মিঠে হাসল কথা।
সজীব শাড়ি দেখিয়ে দিল। বলল
‘ শাড়িটা এনেছি। আজকে পড়বে। ঢিলেঢালা করে, বেশি টাইট করে পড়বেনা। তোমার অসুবিধা হবে।
কথা মাথা নাড়ালো। সজীব চাইল তার দিকে। গাল দুপাশ ধরে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল
‘ ঘুম হয়েছে?
কথা মাথা নাড়ালো।
সজীব আবার ও তার ছুঁয়ে দিল গভীরভাবে।

_________

ঢিলেঢালা করে শাড়িটা পড়ল সে। শাড়ি পড়া বন্ধ করেছে অনেকদিন। আজ পড়ল। পেট আর ও উঁচু হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ঠান্ডা বাতাস আসছে। শীত শীত ভাব। কাটা দিল গায়ে। কথা খেয়াল করল শাড়ির আঁচল তুলে গায়ে জড়িয়ে দিল সজীব। পেছনে থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে শ্বাস নিল তার কানের নিচ থেকে। নরম গলায় বলল
‘ কেমন আছেন রাণীসাহেবা? আমার বাচ্চা কেমন আছে?
কথা ফিরতে পারল না। এক হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে সজীবের মুখ ছুঁল শুধু। আবেশে চোখ বন্ধ করল। সজীব তার উত্তর পেয়ে গেল। সজীব তার কানের কাছে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল একটি জিনিস দেখবে?
কথা মাথা নাড়ালো। সজীব তাকে ছেড়ে একটি ডায়েরি নিয়ে আসল।

এসে আবার ও একিভাবে বেঁধে ফেলল কথাকে। তারপর ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল
‘ এটা কি বলতে পারো?
কথা মাথা নাড়ালো।
সজীব বলল
‘ এটা ডায়েরি। এই ডায়েরিতে কিসের গল্প লেখা আছে জানো?
কথা না জানালো।
সজীব বলল,
‘ এটা এক ঘাড়ত্যাড়া, জামাই শ্বশুরের কাছে নিজের ছেলে হয়ে উঠে হওয়ার গল্প। এক পাষাণ, নির্দয়, একরোখা ছেলের একজন দায়িত্ববান স্বামী হয়ে উঠার গল্প। এই গল্প ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া এক মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রামের গল্প। এই গল্পে আছে প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক আবার প্রবল ভালোবাসাবাসির মানুষ। তুমি জানো কথা এই গল্পে এক করুণ প্রেমের কাহিনী ও আছে। একটি করুন প্রেমের গল্প ও আছে। সেই প্রেমের বেদনার কথা লেখা আছে গল্পে। শুধু একটা নয় কথা আরও একটি প্রেমের গল্প লেখা আছে। যে প্রেমের সাথে আমি এই মুহূর্তে ও জড়িয়ে আছি। এই গল্পে এক নীরব প্রাণী আছে, যে ভালোবাসি বলতে পারেনা কিন্তু ভালোবাসতে জানে। স্বামীকে আগলে রাখতে জানে। ভালোরাখতে জানে। শাস্তি সরূপ চিমটি মারতে জানে।
যদি ও সে এই গল্পটিতে অবদান রেখেছে অল্প। তারপরেও আমি এই কাহিনীর নাম দিলাম, #চুপকথার_গল্প।
কথা সামনে ফিরে সীমাহীন মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে থাকল সজীবের দিকে।
সজীব ধীরেধীরে ভালোবেসে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিল তার চুপকথাকে। ভীষণ ভালোবাসার নেশায় আসক্ত হয়ে শুধালো সজীব
‘ ভালোবাসি আমার চুপকথা। ভীষণ রকম।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here