#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_১২
#পুষ্পিতা_প্রিমা
রাস্তায় তখন গনগনে সোনালি রোদ্দুর। গাছের পাতার ও নড়াচড়া নেই। ভ্যাপসা গরম পড়ছে। গরমে ঘেমে উঠেছে সজীব। বন্ধুদের সাথে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাই আজ দেখা করতে গিয়েছিল। ফেরার সময় রোদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিল একটি ছোটখাটো রেস্টুরেন্টে। চেয়ার টেনে বসতেই ছোটখাটো একটা ছেলে এসেই বলল,
‘ কি দেব সাহেব?
সজীব বলল,
‘ শুধু ঠান্ডা।
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। জুসের গ্লাস আসলে আধএকটু গালে দিল সজীব। বেশ উচ্চস্বরে একজন মহিলার চেঁচামেচি ভেসে আসছে পেছনে। সজীব কৌতুহল দেখালো না।
জুসটা শেষ করতে প্রায় পাঁচ ছয় মিনিটের মতো সময় গেল সজীবের। তখনও ওই মহিলার চেঁচামেচি থামল। আর যখনি থামল তখনি পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এল। কৌতূহল নিয়েই তাকালো সজীব। সুমন এখানে কি করছে? মহিলাটা কে? বিবাহিত মনে হলো। নিজেকে আড়াল করে নিল সজীব। যা যা শুনল তাতে চোয়াল ফুলে উঠল তার। সুমনের স্ত্রী আছে। বেশি কৌতূহল দেখালো না সজীব। এটুকুই যথেষ্ট তার জন্য।
একদম সুমনের সামনাসামনি পথ দিয়ে বের হয়ে এল রেস্টুরেন্ট থেকে। সুমন দেখল কি দেখল না সেটা ও দেখল না। তবে এটুকু বুঝেছে সুমনের গলা আর ভেসে আসছেনা। হয়ত চমকে গিয়েছে সজীবকে দেখে।
ছোটখাটো দুটো চকলেট কিনে শেখ বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা দিল সজীব।
তাকে ফিরতে দেখে কথা রান্না ঘরে দৌড়ে গেল৷ ফ্রিজ থেকে লেমন জুস বের করে নিয়ে গেল। সজীব চকলেটগুলো টেবিলের উপর রাখল। কথা এসেই তার দিকে শরবত বাড়িয়ে দিল। সজীব মাথা নিচু করে বলল,
‘ খাবনা, খেয়ে এসেছি।
কথা খুশি হলো এ কারণে যে সজীব তার সাথে কথা বলল। এই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষটার কাছে তার কিচ্ছু চাওয়ার নেই। কিচ্ছু পাওয়ার নেই সে আর কিচ্ছু চাইবেনা। শ্বাশুড়িকে দেওয়া কথা সে রাখবে। সজীবের পাশে থাকবে বন্ধু হয়ে। স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আর সজীবের সামনে সে দাঁড়াবে না। যার মনপ্রাণ শুধু একজনকে ঘিরে তার কাছে কিই বা চাওয়ার আছে?
কথার তো বরং কষ্ট হয় মানুষটাকে দেখলে। তার প্রিয় মানুষগুলো তাকে কিভাবে ছেড়ে চলে গেল। আপনহীন মানুষটার জীবনে সে কি পারবে আপন হতে?
টেবিলের উপর চকলেট দুটো দেখল কথা। মুখে হাসি ফুটল। চকলেট গুলো খুলল। সাদা রঙের চকলেটটা একটুখানি গালে দিল। সে চকলেট খায়না এমনিতে। কিন্তু এটা গালে দিতেই ভালো লাগল। সজীব তার জন্য চকলেট আনল?
কাপড় হাতে নিয়ে এগোতেই থেমে গেল সজীব। চোখে ভাসল মায়ার গাল নাড়িয়ে চকলেট খাওয়ার দৃশ্য। সজীব চকলেট দিলপ কত খুশি হতো মেয়েটা।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কথা ও থেমে গেল। শান্ত চোখে তাকিয়ে দু পা এগোলো সজীব কথার কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ তুমি চকলেট খাও?
কথা ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো। সজীব চলে গেল ওয়াশরুমে। আবার ও হাসল কথা। সজীব তার সাথে আবারও তার সাথে কথা বলেছে।
কলি তখন সোফায় বসা ছিল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। একপ্রকার তান্ডব বলা যায়। টিভিতে মনোযোগ দিয়ে কলি বিড়বিড় করল।
‘ কিছুক্ষণ আগেই তো কাঠফাটা রোদ ছিল। আর কিছুক্ষণ পর ঝড় এলে কি হতো? সুমন এখন ভিজে ভিজে আসবে।
মারজিয়া বললেন,
‘ সুমন আজ অফিসে যায়নি?
কলি বলল,
‘ না। ওর নাকি কোন বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। মোতালেব শেখ আসলেন। কলি উঠে দাঁড়াল। টিভির চ্যানেল পাল্টিয়ে নিউজ দিল। কথাকে ডাকল তার বাবা। বলল
‘ তোমার বর এসেছে?
কথা মাথা দুলালো।
সজীব যখন নিচে নামল তখনই সুমন এল। সজীব তাকাল না তার দিকে। সুমন পা বাড়াল। কলি বলল,
‘ তাড়াতাড়ি চলে এলে মনে হচ্ছে।
সুমন কোনো কথা বলল না।
হালিমা বেগম সজীবের পিছুপিছু এলেন। বললেন,
‘ নাতজামাই তোমার সাথে খুব জরুরী কথা আছে।
সজীব কোনো কথা বলল না। হালিমা বেগম কড়া কন্ঠে বললেন,
‘ হ্যা না কিছু একটা বলবা তো। তুমি কথা বলতে জানো।
সজীব বলল
‘ জ্বি।
মোতালেব শেখ বললেন
‘ মা এখানে না। উপরে গিয়ে কথা বলি?
হালিমা বেগম বলল,
‘ তোরা যাহ। আমি আসতেছি। নাতজামাই তোমার শ্বশুরের লগে উপরের ঘরে যাও। বেশি কথা বলাইওনা। আমার ছেলেটার শরীর খারাপ। কথা সজীবের দিকে চাইল। সজীব বলল,
‘ জ্বী।
কথা হাত মোচড়ামুচড়ি করল।
‘ বাবা আবার কি বলবে? বকবে না তো?
মোতালেব নিজের রুমে পায়চারি করলেন অনেক্ক্ষণ। সজীব এল কিছু পরে। বলল
‘ কিজন্য ডেকেছেন?
মোতালেব শেখের চাহনি নরম। আলতোসুরে তিনি বললেন,
‘ বসো।
‘ না বসব না। আপনি বলুন।
মোতালেব শেখ ড্রয়ারে হাত দিলেন। ঘেটেঘুটে কাগজপত্র বের করলেন। সব গোছগাছ করে সজীবের সামনে এলেন খালি হাতে। পেছনে হাত দিয়ে দাড়িয়ে সজীবকে প্রশ্ন করল,
‘ যদি এই পুরো বাড়ির দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হয় নিতে পারবে?
যেন খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন করল সজীবকে। কোনো ভাবান্তর নেই। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল সজীব।
‘ নিতে পারার কথা পরে। আমি নেবই কেন?
মোতালেব শেখ বিরক্ত হলেন না। খুশি হলেন। আবার ও প্রশ্ন করলেন
‘ কেন? তার উত্তর দিচ্ছি। মনে করো আমিই তোমার বাবা, আর তোমার শ্বাশুড়িই তোমার মা। আর তুমি এ বাড়ির উত্তরসূরি।
সজীব বলল
‘ আপনার দুই মেয়ে আছে।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ জানি। বাড়ির কথা ছাড়ো। কোম্পানির কথায় আসি। একটি শক্তপোক্ত ঢাল দরকার আমার যে আমার কোম্পানিটা নিজের মনে করবে। আমার ব্যবসার হাল ধরবে। আপনার কোম্পানির সুনাম বজায় রাখবে। আমার তো ছেলে নেই। মেয়ে দুটোর উপর ভরসা করা যায়না।
সজীব বলল,
‘ আমি কি করতে পারি? আমাকে এসব কেন বলছেন?
মোতালেব শেখ হেঁটে গেলেন ড্রয়ারের কাছে। সব পেপারস এনে দিলেন সজীবের হাতে। সজীবের হাতটা ধরা। সজীব তাকাল মোতালেন শেখের হাতের দিকে। মোতালেব শেখের কন্ঠ নামানো। চোখের কোণায় ভাসছে নোনাজল। সজীবের প্রতি তার অগাধ, বিশ্বাস, ভরসা।
সজীব হাত সরাতেই পারলনা। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কথা,মারজিয়া আর হালিমা বেগম। মোতালেব শেখ বলেন,
‘ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। মনে করো তোমার বাবাই তোমাকে অনুরোধ করছে।
সজীব বাকহারা হয়ে পড়ল।
‘ কি হচ্ছে এসব? আর কোনোকিছুর মায়ায় সে নিজেকে জড়াবেনা। কারো মায়ায় প জড়াবে না। সে পারবেনা এত দায়িত্ব কাঁধে নিতে। পারবেনা।
সজীব বলল,
‘ আমাকে আর ঋণী বানাবেন না।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ মনে করো ঋণ শোধ করতে বলছি।
সজীব এবার হাল ছাড়ল। মারজিয়া এসে সব পেপার আর ও ভালো করে তুলে দেয় সজীবের হাতে। বলে,
‘ ফিরিয়ে দিওনা বাবা। তোমার শ্বশুর তোমাকে খুব ভরসা করে। বিশ্বাস করে। কটুকথা গুলো মন থেকে বলেনা।
সজীব পেপারসগুলো রেখে দেয়। দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,
‘ আমি দুঃখিত। আমার কাছে কোনোকিছু আশা করবেননা প্লিজ। আমার কাছে কেউ ভালো থাকেনা। থাকবেনা। আমি কারো দায়িত্ব নিতে পারবনা।
সজীব চলে যায়। মোতালেব শেখ বসে পড়েন। বলেন,
‘ সুমনকে ডেকে নিও এসো মারজিয়া।
মারজিয়া চলে যায়। কলিসহ সুমন আসে অনেক্ক্ষণ পর। সুমন ভীত চোখে তাকায় সবার দিকে। সজীব কিছু বলে দেয়নি তো?
মোতালেব শেখ সজীবের মতো সুমনকে ও সবটা বলে। পেপারসগুলো হাতে দিয়ে বলে
‘ কোম্পানিটার সব দায়িত্ব নিতে পারবে? নিজের মনে করে সব ম্যানেজ করতে পারবে?
সুমন কলির দিকে তাকালো। বলল
‘ আমি কি পারব?
কলি বলল,
‘ কেন পারবেনা? তুমি পারবে। দেখো।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ কোম্পানির একাংশ তোমার, আরেক অংশ কথার নামে। কলিরটা তুমি পাবে।
সুমন বেজায় বিরক্ত।
” একাংশ দেওয়ার জন্য এত ঢং?
কলি বলল,
‘ আমার লাগবেনা কিছু, সুমনের নামে করে দাও ওটা। আমি তো বাড়ির ভাগ পাব।
মোতালেন শেখ বললেন,
‘ বাড়ি আমাদের। বাড়ি এখনো ভাগ হয়নি কলি। কলি চুপ হয়ে গেল।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ আমি উকিলে সাথে কথা বলব। সইচ্ছায় তোমার অংশটা সুমনের নামে করে দেব।
সুমন বলল,
‘ কথার ও শেয়ার আছে ওই কোম্পানিতে। তাহলে কি আমি একাই ম্যানেজ করব সবটা?
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ আমি মরে যাইনি এখনো।
সুমন বলল
‘ ঠিকআছে।
সুমন আর কলি চলে গেল। মারজিয়া সাথেসাথে বলল,
‘ অর্ধেক বললেন কেন? ওখানে তো পুরোটার কথা ছিল। তাছাড়া কোম্পানি দুইভাগ হয়ে গেলে কেমন হবে? কি করছেন আপনি?
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ পুরোটাই লিখে দিয়েছি। এসব আমার ব্যাপার তোমরা নাক গলাবেনা।
মারজিয়া মাথায় হাত দেয়।
‘ এইলোক কি বলছে এসব? পুরোটা লিখে দিয়েছে মানে কি?
হালিমা বেগম চলে যান মেজ ছেলের কাছে। আবার আসবেন।
দুপুরে সজীবের সামনাসামনি হলো সুমন। সজীবকে দেখে মনে হচ্ছেনা সে কিছু শুনেছে বা দেখেছে। তারপরও ভয় যাচ্ছেনা সুমনের। সোনালীর ব্যাপারটা যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। কোম্পানির পেপারসগুলো হাতে আসলে হয়ে যাবে। অর্ধেক শেয়ার বেঁচে দিয়ে চিরতরে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সে। কলি মলি মরুক, পঁচুক তাতে তার কি? এই বুড়ো শ্বশুর তাকে কম জ্বালা জ্বালায়নি। অফিসে গাঁধার মতো খাটতে বলে। খাওয়ায় খাওয়ায় আবার খোঁটা দেয়। মজা দেখাবে সে। সোনালীর কাছে তাকে ফিরে যেতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা সে। সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিল সোনালী। কলির ব্যাপার সে জেনে গেলে কেয়ামত হবে। গত ছয়মাস সে কাজের বাহানা দিয়ে এখানে পড়ে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে সোনালী এই শহরে চলে এসেছে। এখানে আসবেনা তার গ্যারান্টি কি? খাওয়া শেষে সজীব সোজা উপরে চলে গেল। শুধু একবার সুমনের প্লেটের দিকে তাকিয়েছে। যারা এত বিশ্বাস করে তাকে, কি করে সে তাদের ঠকাতে পারে? কি করে? অমানুষ কি তাহলে এদের বলে? তাদের খেয়ে তাদের পিঠে কুড়াল মারছে।
মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করা মানুষগুলোর পরিণতি কেমন হওয়া দরকার?
কি আশ্চর্য পৃথিবীর নিয়ম!
কেউ প্রাণ দিয়ে চাইলে ও প্রিয়জনকে ধরে রাখতে পারেনা। আবার কেউ কেউ প্রিয়জন কাছে থাকলেও মূল্য বুঝেনা। এমন কেন হয়?
উকিল দিয়ে সব কোম্পানির অর্ধেক অংশ সুমনের নামে করা হয়। কলির চাওয়া পূরণ করল মোতালেব শেখ। কথার অংশটুকু কথার নামে। সজীব এসবের মাঝে থাকতেই চায়না। কেমন আনমনা ছেলেটা।
কোম্পানির পেপারস হাতে পেয়েই সুমনের রূপ পাল্টাতে থাকে গিরগিটির মতো। কলির উপর কথা না বলা ছেলেটা কলিকেই আদেশ করে। কথায় কথায় ছেড়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। কলির মতো অন্ধ ভালোবাসায় নিমজ্জিত বোকা মেয়েটা ও পালন করে সুমনের আদেশ। এছাড়া তো তার আর কোনো উপায় নেই। সে ভালোবাসে সুমনকে। ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। সেই মানুষটাকে আগলে রাখার জন্য খারাপ হয়েছে মায়ের কাছে, বাবার কাছে, একমাত্র ছোট বোনের কাছে। ইদানীং বেশি খারাপ আচরণ করে সুমন তার সাথে। তুই তুকারি ও করে। বাচ্চার কথা বললে চেঁচামেচি করে যাতে কলি আর সে কথা মুখে নেওয়ার সাহসটুকু ও করতে না পারে। কলি হয়ে পড়ে দিশেহারা। কি হয়েছে সুমনের? সে কি পরনারীতে আসক্ত? কি করবে কলি? সুমনের ফোন থেকে ও কোনোকিছু তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। কোথায় যে রাখে ফোনটা? সন্দেহ করলে সোজা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ও বলেছে। তাই কলি কিছু জিজ্ঞেস ও করতে পারেনা। যেইনা একবার ফোন হাতে পেল, তা ও ফোন লক করা। আর ও ভেঙে পড়ল কলি। কি করবে সে এখন? সুমন যদি অন্য নারীতে আসক্ত হয় তাহলে সে মা বাবাকে মুখ দেখাবে কি করে? মা বাবার ইজ্জত সম্মান সব ধুয়েমুছে যাবে। কলি খেয়াল করল,
‘ কারো দোষ নেই আসলে, সবই সুমনের দোষ। সুমনই বলত তাকে মা বাবা বোন কেউ সহ্য করতে পারেনা। কলির কান ভারী করেছে। আসলে তা পুরোটাই মিথ্যা। অন্ধভালোবাসা শেষ করে দিল কলিকে। আসল কথা তো সুমনই সহ্য করতে পারেনা কাউকে। তারমানে কথা ঠিকই বুঝাতো যে সুমন ওর দিকে বাজেভাবে তাকায়। ঘৃণা উপচে পড়ল কলির। এ কেমন মানুষকে ভালোবেসেছে সে?
কলির সন্দেহই ঠিক হলো। সেদিন মাঝরাতে সুমনকে পাশে না দেখে সে ঘর থেকে বের হয়। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে সে এগোয় রান্নাঘরের দিকে। সুমন এতটাই চালাক। কথা বলার জন্য সঠিক জায়গা খুঁজে নিল। কোনো এক মহিলার রুক্ষ কন্ঠ শুনল কলি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে।
ভয় হলো কলির। চুপিচুপি এসে সে শুয়ে পড়ে বিছানায়। সুমন কথা বলা শেষ করেই আসল। বিছানায় শুয়ে পড়ে কলিকে কাছে টেনে নিল।
ভেতরে ভেতরে গুমরে মরল কলি। কাউকে বলতে পারলনা কিছু। বুঝাতে পারলনা কিছু। সে বুঝতে পেরে গেছে সুমন এতদিনে তাকে শুধু ব্যবহার করেছে। তাকে ফাঁসিয়েছে শুধু প্রোপার্টির জন্য। কলি কাকে বলবে এখন এতসব? কে দাঁড়াবে কলির পাশে?
________
তখন সন্ধ্যা। কলি আর কোনোপথ খুঁজে পেলনা। মা, বাবা, ছোটবোনটার দিকে তাকালেই নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। লজ্জা হয়। অনুতাপ হয়। কলি বেছে নিল আত্মহত্যার পথ। এটিই তাকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে। নইলে এই পোড়ামুখ সে দেখাবে কি করে?
ফ্যানের সাথে ওড়না ঝুলিয়ে কত চেষ্টা করে। শেষপর্যায়ে এসে আবার গুটিয়ে নেয় নিজেকে। ছাদে এসে দাঁড়ায়। নিচে দাঁড়িয়ে মৃত্যু দেখে।
এখান থেকে নিচে লাফ দিয়ে পড়ে গেলেই তো সব শেষ হবে। ছাদের দরজা কেউ জোরে ঠেলতেই জোরে আওয়াজ হয়। কলি শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার আগেই জোরে টান পড়ে তার হাতেই। কলি মানুষটাকে না দেখে চিৎকার করে কাঁদে আর হাত ছাড়াছাড়ি করতে করতে বলে,
‘ ছাড়ো আমায়। আমাকে ঠকিয়েছ তুমি।
সজীব কষে চড় বসায় কলির গালে। কলি হু হু করে কেঁদে বসে পড়ে নিচে। ছাদের দরজা ঠেলে আর ও আসে সুমন। কথা, মারজিয়া মোতালেব শেখ।
সুমন আসার সাথে সাথেই বলে,
‘ বাহ নিজের বউকে ছেড়ে এখন বউয়ের বড় বোনকে বেছে নিয়েছিস। তোর রুচি তো দেখছি দারুণ ছোটলোকের বাচ্চা।
সুমন খেয়াল করেনি কথা তার পাশে ছিল। সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসায় কথা সুমনের গালে। সুমন ক্ষেপে কথার গালে বসায় আরেক চড়। মোতালেব শেখ আর মারজিয়া বেগম হতবিহ্বল। কি হচ্ছে এসব?
কথাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মারজিয়া বেগম। কেঁদে উঠে কথা।
সুমনের চোয়াল বরাবর ঘুষি বসায় সজীব। পড়ে যায় সুমন। পা দিয়ে জোরে লাতি বসায় সজীব। বলে,
‘ প্রতারক। বের হ এই বাড়ি থেকে। বের হ। সবাইকে তোর মতো ভাবিস?
মোতালেব শেখ বলেন,
‘ কি হচ্ছে এসব সজীব?
সজীব বলল,
‘ আপনার বড় মেয়ে সুসাইড করতে যাচ্ছিল।
মারজিয়া বেগম আঁতকে উঠে। কলি মাথার চুল টেনে ধরে। মোতালেব শেখ বললেন,
‘ কেন?
সুমন বলল,
‘ সব মিথ্যাে কথা। তুই ওকে,,
সজীব আবার ও লাতি বসায়। কলি কেঁদে উঠে জোরে। সজীব বলল
‘ ওর আরেকটা বিবাহিত বউ আছে। আপনার বড় মেয়ের আগে ও আরেকটা বিয়ে করেছিল। আপনার বড় মেয়েকে বিয়ে করেছে শুধুই সম্পত্তির জন্য। আর কিছুইনা।
মোতালেব শেখ হা করে তাকিয়ে থাকেন। কলিকে জিজ্ঞেস করল
‘ কলি তুমি এজন্যই।
কলি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সুমনের গালে জোরে চড় বসালো মোতালেব শেখ। রাগে, ঘৃণায় তরতর কাঁপতে কাঁপতে তিনি জ্ঞান হারান। মারজিয়া আর কথা ধরে ফেলে। সজীব ও এগিয়ে যায়। ছাদে থাকা ফুলের টব তুলে নিয়ে সুমন পেছন থেকে জোরে আঘাত করে সজীবের মাথায়। মাথায় হাত চেপে ধরে সজীব। কথা চিৎকার দিয়ে উঠে। মোতালেব শেখ ততক্ষণে হাত পা ছেড়ে দেন। কথা গিয়ে সজীবকে ধরে। এলোমেলো সুরে কেঁদে দেয়। সুমন ধরে কথার হাত। টানতে থাকে। কথা চেঁচিয়ে কাঁদে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হয়। সুমন আর ও জোরে আঘাত করে সজীবের মাথায়। ঢলে পড়ে সজীব। তবে হাতের মুঠোয় কথার হাত। সুমন টানাটানি করার পর্যায়ে দেখতে পায় সজীব কথাকে ধরে রেখেছে। জোরে লাতি বসায় সে।
সজীব এবার ছেড়ে দেয়। বলে,
‘ কথা!
কলি উঠে বসে। সুমনের হাত থেকে কথাকে বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,
‘ শয়তান ছাড় আমার বোনকে।
সুমন এক ধাক্কা দেয় কলিকে। কলি গিয়ে পড়ে ছাদের রেলিঙে। কপাল ফেটে তরতর করে রক্ত বের হয়। সেও অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কথা চিৎকার করে কাঁদে। সুমন তাকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। পেপারস এনে বলে,
‘ সই করো তাড়াতাড়ি। নাহলে তোমার পুরো পরিবারকে খুন করব আমি। সই করো। ওই কোম্পানির অর্ধেক আমি অলরেডি বিক্রি করে দিয়েছি। তোমার সই এলে এটা ও বিক্রি হয়ে যাবে। করো তাড়াতাড়ি।
কথা ইশারায় বলল,
‘ আমার পরিবারকে ছেড়ে দাও। সই করে দেব।
সুমন ইশারা বুঝল না। বলল,
‘ সই দাও তাড়াতাড়ি। আমি চলে যাব এখান থেকে। তাড়াতাড়ি সই দাও।
কথা সই বসায় তাড়াতাড়ি। হো হো করে হাসে সুমন। পেপারসগুলো গুছিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কথা দৌড়ে উঠে ছাদে। মারজিয়া স্বামীকে রেখে একবার সজীবের কাছে যায় একবার কলির কাছে যায়।
কলির কপাল বেয়ে রক্তস্রোত। সজীবের ও। কথা হাউমাউ করে কেঁদে একবার সজীবকে ডাকে, একবার কলিকে।
তখনি ছাদে চলে আসে উকিল। এডভোকেট হামিদ সবাইকে এই অবস্থায় দেখে ভড়কে যান। বলেন,
‘ কি হয়েছে এখানে? বাইরে ও দরজা বন্ধ করা দেখলাম। এখানে না আসলে তো কিছুই দেখতাম না।
কথা ইশারায় বলে
‘ সবাইকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। সবাইকে।
হামিদ সাহেব সাহায্য করে। তার কিছু আগেই সজীবের হুশ ফিরে সামান্য। কথা তার চোখ আধখোলা আধখোলা দেখে আবার ও জোরে কেঁদে দেয়।
কলির উপর এবার রাগ উঠছে।
কলির জন্য তার বর এত আঘাত পেল। কিন্তু কলি ও তো ঠকে গিয়েছে। আঘাত পেয়েছে।
কলি আর সজীবকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। আর মোতালেব শেখকে। ওনি হার্টের রোগী। স্ট্রোক করেছেন।
প্রায় তারপরের দিন ফজরের আজানের পরপর জ্ঞান ফিরল কলির। কাঁদল সে। সজীব কপাল চেপে বেড থেকে নামার আগে কথা দৌড়ে আসল। তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদল হিঁচকি তুলে তুলে।
সজীব ভাবল এভাবে সে মায়ার জন্য কেঁদেছিল। মায়া কি ফিরে এসেছে আবার? কথারূপে? নাহলে কথা এত ভালোবাসে কেন তাকে? মায়াবতী ছাড়া সজীবকে কে এতটা ভালোবাসবে? এ নিশ্চয়ই মায়াবতী। কথারূপে আবার এসেছে সজীবকে আগলে রাখতে। ভালোবাসতে। কথার প্রতিটি কান্না, আর চোখের জলই বলে সজীবকে সে কতটা ভালোবাসে। ভালোবাসা এমন কেন?
সবার চাইতে গুরুতর অবস্থা মোতালেব শেখের। তিনি সুস্থ হোন প্রায় একসপ্তাহ পর। হসপিটালের বেডে থাকা অবস্থায় ডাকেন সজীবকে। সজীবের হাত ধরে বলে,
‘ আমার এই পরিবারটাকে একটু আগলে রেখো। আমি আর কয়দিন থাকব? ওই পুরো কোম্পানিটা আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি। তুমি এবার আর না করোনা। সুমনের আসল রূপ বের করতে আমাকে এই খেলাটা খেলতে হলো। নাহলে কলি বিশ্বাস করতনা আমার মুখের কথা। সজীব বলল
‘ তারমানে সুমনের পেপারসগুলো?
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ পেপারসগুলো নকল। উকিল সাহেবের সাথে কথা বলে আমি এসব করেছি। সুমন যাদের সাথে কোম্পানি বিক্রির ডিল করেছে তারা ও ঠকে গিয়েছে। কারণ ওই পেপারস গুলো যে নকল সেটা তারা ধরতে পারেনি। তবে খুব শীঘ্রই বুঝে যাবে ওগুলো নকল। উকিল সাহেব তো আছেই।
সজীব বলল,
‘ সব ঠিক আছে কিন্তু আমার নামে কেন করলেন? আপনার দুই মেয়ে।
মোতালেব শেখ শক্ত করে ধরে সজীবের হাত। বলে,
‘ আমাকে কথা দাও। এই পরিবারটাকে নিজের পরিবার হিসেবে দেখবে। আগলে রাখবে। পাশে থাকবে। কথা দাও। একজন বাবা তোমায় অনুরোধ করছে।
সজীব কথার দিকে তাকালো চোখ তুলে। মারজিয়া বলল,
‘ কথা দাও। মানুষটাকে আর ফিরিয়ে দিওনা বাবা।
সজীব হাত রাখল। বলল
‘ কথা দিলাম। ভালো রাখব। ভালো থাকব।
মোতালেব শেখ হাসেন। আনন্দের হাসি। এবার তিনি নিশ্চিন্ত।
সজীব বের হয়ে যায় হসপিটাল থেকে। তখন এশার আজান পড়ছে। মসজিদের কাছাকাছি গিয়ে বসে পড়ে সজীব। পকেট থেকে বের করে দুটো ছবি। একটা মায়ের, অপরটি প্রিয়তমার। ছবি দেখেই বিড়বিড় করে
‘ আম্মা আমি তো বাঁধনহারা পাখির মতো উড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবার জড়িয়ে পড়লাম মায়ার বাঁধনে। আবার ও জড়িয়ে পড়লাম একটা পরিবারের সাথে। এখন আমার উপর নির্ভর করছে পুরো পরিবারের ভালো থাকা। আমাকে দোয়া করো আম্মা । যাতে আমি ভালো রাখতে পারি সবাইকে।
মায়ার ছবির দিকে তাকায় সজীব। বলে
‘ তুমি তো আমাকে একদম নিঃস্ব করে চলে গিয়েছ মায়াবতী। যেখানেই থাকো ভালো থাকো। তুমি কি মাঝেমাঝে আসো কথার মাঝে?
আমি কথার মাঝে তোমার প্রতিচ্ছবি কেন দেখতে পাই? কথা ও কেন আমাকে ভালোবাসে? আমার কপালে এত ভালোবাসা সয়না মায়াবতী। ভালোবাসা পেলে হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে ধরে। আমি আর নিঃস্ব হতে চাইনা মায়াবতী। আমি এবার একটু ভালো থাকতে চাই। একটু ভালো রাখতে চাই।
চলবে,
সবার মন্তব্য আশা করছি।