চুপকথার_গল্প #পর্ব_৪

0
1337

#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

তখন বিকাল চারটা। কথার স্কুল ছুটি হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু বাসায় ফেরার নামগন্ধ নেই দেখে মারজিয়া চিন্তিত হয়ে পড়ল। মোতালেব শেখ ড্রাইভারের ফোনে অনবরত কল দিলেন কিন্তু ফোন তুলল না ড্রাইভার। মোতালেব শেখের মাথা এমনিতে ও খারাপ। গত পাঁচদিন ধরে সজীব একবারও এই বাড়িতে পা রাখেনি। কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করার মতো জোঁ ও রাখেনি। ফোনবন্ধ। এখন কথা কোথায় গেল আবার?

রাস্তার পাশে বাইকের উপর বসা সজীবের বন্ধুদের দেখা গেল। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল কথা। এদের খুঁজতে গিয়ে কত সময় পার হলো। কথা দাঁড়িয়ে থাকল। ড্রাইভার গেল তাদের কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ মিঃ সজীব কোথায়? ওনি এখানে আসেননি?

সজীবের বন্ধুরা ড্রাইভারের পেছনে দাঁড়ানো নীল সাদা ড্রেস পড়ে দাঁড়ানো মেয়েটাকে দেখে নড়েচড়ে বসল সবাই। এই কি তাহলে সজীবের ওয়াইফ? শওকত এগিয়ে আসল।

‘ আসসালামু আলাইকুম ছোট আপু। কেমন আছেন?

কথা মাথা নাড়াল।
শওকত পরে বুঝতে পারল এই মেয়েটা কথা বলতে জানেনা। লজ্জায় পড়ে গেল শওকত। বলল,

‘ সজীব তো কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে।

কথা আঙুল গুছিয়ে গালের কাছে দিয়ে জানতে চাইল,

‘ উনি দুপুরে খেয়েছেন?

শওকত কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করল। হেসে বলল,

‘ জ্বি আপু। খেয়েছে। আমরা সবাই লান্চ রেস্টুরেন্টে সেড়েছি একসাথে।

কথার মুখে হাসি ফুটল। কি মিষ্টি একটা মেয়ে। বোবা বলে এত অবহেলা করে সজীব তাকে? তার ঘরে এমন একটা ছোট্ট বোন আছে। সারাক্ষণ বকবক করে তার মাথা খায়। বোনের কথা মনে পড়ে গেল শওকতের।

কথা ইশারা করল ড্রাইভারকে। ড্রাইভার বলল,
‘ ম্যাডাম বলতে চাইছেন, সজীব যে বাসায় থাকে ওটার ঠিকানা দেওয়ার জন্য।

শওকত ঠিকানা দিল।

‘ বেশি দূরে নয় আপু। বামপাশের গলিতে গিয়ে দুইতলায়। পেয়ে যাবেন ও এখন বাসায় আছে।

কথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হাসল। ইশারায় কি যেন বলল উঃ আঃ করে শওকত বুঝতে পারল না।
ড্রাইভার বুঝিয়ে দিল,
‘ আপনাদের সবাইকে ম্যাডামের বাসায় যেতে বলেছে।

সবাই হাসল। শওকত বলল,
‘ আচ্ছা যাব আপু।
কথা মাথা নাড়িয়ে হাসল। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল সবাইকে।
গাড়িতে বসে পড়ল। ড্রাইভার বলল, ম্যাডাম আপনার বাবা অনবরত কল দিচ্ছেন। আমার ভয় লাগছে। আমার গর্দান নেবে।
হেসে ফেলল কথা। ইশারায় বলল,
‘ কিচ্ছু হবেনা। আমি আছি।

গলির কাছে গিয়ে গাড়ি থামল। ড্রাইভার বলল,
‘ আপনি যান ম্যাডাম। আমি এখানে আছি।
কথা এগিয়ে গেল। কয়েকজন মহিলা আঁড়চোখে দেখল কথাকে। এটা কি তাহলে সজীবের বউ? আহা কি মিষ্টি! মিষ্টি হলে কি হবে এ তো বোবা? প্রতিবন্ধী।
কথার সবার সাথে চোখ মিলিয়ে আবার হাঁটা ধরল। হাতে সজীবের জন্য আঁকা সেই ছবিটি। তার ঘরে টাঙিয়ে দেবে এই ছবিটি। কথার একটা অন্তত জিনিস সেই ঘরে। কথার শ্বশুরবাড়ি। ভাড়া বাসা হোক। তা ও তো। সেই ঘরে তার স্বামী থাকে।
দরজায় কড়া নাড়ল কথা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দুই তিনবার কড়া নাড়তেই সজীব বের হয়ে এল। উদাম গা। ঘুম ঘুম ফোলা মুখ, ফোলা চোখ। হাতের কব্জি দিয়ে চোখ ঢলে নিল সজীব। কে? বলার সাথে সাথে চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল তার। কপালে ভাঁজ পড়ল। চট করে রুমের ভেতর গিয়ে উলটপালট করল ড্রয়ার। শার্ট খুঁজে পেলনা তাড়াহুড়ায়।
কথা এগিয়ে গেল। বালিশের নিচে সামান্য চাপা পড়া শার্টটা টেনে নিয়ে ঝাড়ল। কুঁচকে গিয়েছে। একদম অগোছালো এই ছেলে।
সজীবের সামনে গিয়ে শার্টটা বাড়িয়ে দিল কথা। সজীব চট করে নিয়ে পিছু করে দাঁড়াল কথাকে৷ তাড়াহুড়ো করে গায়ে দিল শার্ট। শার্টের বোতাম লাগিয়ে মোবাইল হাতে নিল। মেসেজ পাঠাল কথাকে,

‘ এখানে কি চাই?

নতুন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।
কথা পাঠাল,

‘ আমার বরকে চাই। বাসায় ফিরবেন আমার সাথে। আমাকে ফেরাবেন না।

কোনো উত্তর এলনা কথার। সে হেঁটে হেঁটে দেখল পুরো ঘর। দুইটা রুম একটা রান্নাঘর। একটা বাথরুম। দুই রুমে দুইটা খাট। সজীবের রুমে পড়ার টেবিল, বইয়ের সেলপ, ওয়ারড্রব । মায়ের রুমে একটা আলমারি, কাপড়ের আলনা। কয়েকটা কম্বলের ব্যাগ উপরের তাকে রাখা। দুইটা স্যুটকেস। রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার, র্যাক, নানান ধরণের সরজ্ঞাম। কথার হঠাৎ মনে হলো এই সংসারটা তার। শাড়ি পড়ে কোমরে আঁচল গুজে সে রান্না করছে রান্নাঘরে। আর প্রাণসখা তাকে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে নাক টেনে বলছে, রান্নার সুগন্ধে খিদে বেড়ে গেল প্রাণসখী।
কিন্তু এমনটা কেন হয়না? হচ্ছে না।
কথা বলতে পারেনা বলে কি অমন স্বপ্ন দেখা বারণ?
ছবিটা সে টাঙিয়ে দিল সজীবের রুমে৷ কিছুই বলল না সজীব। আঁড়চোখে দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিল।

গলা খাঁকারি দিল সজীব। কালো শার্ট দুটো কথার ঘরে। সে দিয়েছে বলে সেই শার্ট বাইরে পড়েনা এই ছেলে৷ শুধু কথার সামনেই পড়ে। লোকজনকে দেখায় না সে বউয়ের দেওয়া শার্ট পড়ে। পায়ে নতুন স্যান্ডেলগুলো নিজে কিনেছে। কথার দেওয়া স্যান্ডেল রুমের বাইরে রুমের প্রবেশপথে রাখা আছে। কান্নায় বুক ভারী হয় কথার।
সজীব গিয়ে দাঁড়ায় রুমের বাইরে। হাতে তালা চাবি। কথা গিয়ে দাঁড়ায় সজীবের পাশে। তালা দেয় সজীব। কথার আগে আগে গিয়ে নামে নিচে। কয়েকটা মহিলা উপর থেকে গলা উঁচিয়ে দেখে বলল,
‘ সজীব তোমার বউয়ের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দাওনি যে?
সজীব সেদিকে তাকাল ও না।
‘ মারেম্মা এই ত্যাড়া ছেলের মুখ কোনোদিন খোলেনা।
সজীব গলি পেরিয়ে চলে গেল। কথা দৌড়াল সেদিকে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে তাদের পেছন পেছন গেল। সজীব রাস্তায় রিকশার জন্য দাঁড়াতেই কথা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হাতের ফাঁকে হাত গলিয়ে ধরল শক্ত করে সজীবের হাত। ভয়ে গলা শুকিয়ে এল। অদম্য সাহস দেখিয়ে ফেলল সে। কি শাস্তি হবে এর?

সজীব মাথা নামিয়ে দেখল নিজের হাত কার কাছে। অবাক চাহনি দিয়ে তাকাল কথার দিকে। যেন কথা কতবড় ভুল কাজ করে ফেলেছে। সজীবের চাহনিতে ভড়কালো না কথা। আর ও শক্ত করে ধরে চোখের ভাষায় মিনতি করল সে ও যাবে রিকশায়। সজীব শক্ত হয়ে দাঁড়াল সেটা বুঝে গেল কথা। রিকশা এল। উঠে বসল সজীব। কথার হাতে তার হাত। কথা উঠে বসতেই চেপে বসল সজীব। কথা তার চেপে বসার ধরণ দেখে চুপ করে রইল। রিকশা চলল তার গতিতে। কথা তাকাল সজীবের দিকে। সজীব দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে সামনে। যেন কোনো রোবট। কথা নিজের হাতের তালুতে নিল সজীবের হাতটা। সজীবের কাঁধে মাথা রাখতেই চট করে হাতটা কেড়ে নিল কথার কাছে থেকে। অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করছে আজ মেয়েটি। কথা আবার ও সেই হাত নিয়ে নিল নিজের হাতের মুঠোয়।
এই দিন, এই ক্ষণগুলো খুবই দামী কথার কাছে। খুবই।
শেখ বাড়ির গেইটের কাছে গিয়ে রিকশা থামল। কথা ভাড়া মিটিয়ে দিল। সজীব হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ডুকে পড়ল বাড়িতে। মোতালেব তখন বাইরে দাঁড়ানো ছিলেন। সজীবকে ডুকতে দেখে আবার তার পিছু পিছু কথাকে দেখে যা বুঝার বুঝে নিলেন তিনি। সজীবকে কোনোপ্রকার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না৷ এই ছেলেকে উল্টাপাল্টা কিছু বলা ও যায়না। এত গরম দেখায় যেন অট্রালিকা ভেসে যাচ্ছে তার। অথচ শহরে একটা তলা ও নেই। কোন গ্রাম থেকে চাকরির খোঁজে এসে কপাল করে এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে।

_______________

ম্যানাজারিং করা মানে এমন নয় যে কর্মচারী রা কাজে ফাঁকি দিলে বা ভুল করলে তাদের গায়ে হাত তুলে তাদের শিক্ষা দেওয়া। ম্যানাজারিং মানে কর্মচারীরা কাজ ফাঁকি দিচ্ছে কিনা সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, কাজে কোনো ভুল করছে কিনা তা তদারকি করা। কোনো কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলে তার সেইদিনের বেতন কেটে খাওয়া আমার কোম্পানির কোনো ম্যানাজার করেনা। সবকিছু তে ঠিক ঠিক চলছিল। হঠাৎ করে এমন কি হলো সুমন?

কাঁচুমাচু করে বসল সুমন। কলি বলল,
‘ ও এখনো নতুন আব্বা। ওকে সব শিখিয়ে দিতে হবে।
মোতালেন সাহেব ধমক দিল কলিকে।
‘ তোমাকে কে মাস্টারি দেখাতে কে বলেছে? আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলছিনা, সুমনের সাথে বলছি।

সুমন বলল,
‘ আমার ভুল হয়ে গিয়েছে আব্বা। এরকমটা আর হবেনা।
মোতালেব সাহেব চুপ করে থাকলেন অনেকক্ষণ।
তারপর বললেন,
‘ ঘরজামাই রাখব ভেবেছি কথার জামাইকে। রাখতে হয়েছে তোমাকে। তোমার বাপের রাগ কি এখনো কমেনি? কলিকে ঘরে তুলবে কখন?
সুমন তাকাল কলির দিকে। কলি বলল,
‘ কথার জামাই না আসলে তোমার চিন্তা বাড়ে, আর আমারটা থাকলে তোমার বোঝা মনেহয়।
‘ একদম চুপ। মুখে মুখে কথা বলবে ঠাসস করে দেব বেয়াদব মেয়ে। আমি তোমার বরের সাথে কথা বলছি। তোমার সাথে নয়। তোমার বর চুপ কেন? কথা বলতে জানেনা?
সুমন বলল,
‘ আমার বাবা কলিকে ঘরে তুলবেন না বলেছেন আব্বা।
মোতালেব সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েন।
‘ এই কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেল আমার। টাকাপয়সা তো কামাচ্ছ, বাসা ভাড়া নিয়ে থাকো বউকে নিয়ে। মুখ দেখাতে পারিনা আমি সমাজে। ছোটটার কপাল তো জন্ম থেকেই পোড়া। আর বড়টা নিজের কর্মদোষে পুড়ল।
রাগে কিড়মিড় করল কলি৷ আব্বা সবসময় তাকে কথা শোনায়। আর কথাকে মাথায় তুলে রাখে।
কথা নিচে নেমে। মারজিয়াকে ডাকল,
‘ আঃ আঃ।
মারজিয়া আওয়াজ করল।
‘ আয়। আমি রান্নাঘরে।
কথা রান্নাঘরে দৌড়ে গেল৷ মাকে আবার ডাকল,
‘ আঃ আঃ।
মারজিয়া ধমক দিল,
‘ মা ডাক না মুখ পুরী। মা ডাকতে পারিস না। আঃ আঃ কি? মা ডাক।
কথা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মারজিয়া মেয়েকে দেখল। মন খারাপ করে ফেলেছে।
মেয়েকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মারজিয়া। কথা চুপ করে রইল। মা তাকে গালে আদর দিল। বলল,
‘ এতবড় হয়ে ও আদর পাস। কত ভালো তোর ভাগ্য। খবরদার মন খারাপ করবিনা। কথা বলতে পারিস না এটাই তোর দুর্ভাগ্য নয় সৌভাগ্য মনে করবি। আমি তো এমনি এমনি বকি, সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে না পারলে কত কষ্ট, কত যন্ত্রণা হয় মা হলে বুঝবি।
কথা ইশারা করল,
‘ না না আমি মা হবোনা।
মারজিয়া বলল,
‘ কেন হবিনা।
কথা বুঝাল,
‘ যদি সে ও বোবা হয়।
গাল ভিজে গেল মারজিয়ার। তিনি কেঁদে দিলেন আওয়াজ করে। জড়িয়ে ধরলেন কথাকে।
‘ সে কেন বোবা হবে রে? সে বোবা হবেনা। সে তো খুব বাচাল হবে।
কথা মাকে ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
সে বলল না, তার মা হতে খুব ইচ্ছে করে। খুব।

মারজিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
‘ কিজন্য ডাকছিলি?
কথা মাকে ছেড়ে দাঁড়ায়। মাকে ফ্রিজ দেখিয়ে দেয়। আপেল নিয়ে নেয়। মারজিয়া হাসল।
‘ বরের জন্য?
কথা মাথা নাড়াল।
‘ তোর বর কি তোর খোঁজ নেয়?
কথা মায়ের কথায় কান দিল না। আপেল দুটো নিয়ে চলে গেল।
‘ সজীব তখন বই নিয়ে বসেছে। পড়ায় মন বসছেনা। স্টুডেন্টের অভিভাবকরা ফোন দিচ্ছে ঘনঘন। তাদের সজীবকেই চায়।
রুটিন চেন্জ করতে হবে। এখানে ও ফিরতে হবে৷ টিউশনি ও পড়াতে হবে।
কথা ডুকে এল রুমে। আপেল দুটে কেটে দিল প্লেটে করে। সজীব নিয়ে খেলনা। কথা প্লেটটা নিজের হাতে নিল। সজীবের দিকে একটুকরো বাড়িয়ে দিল। মুখের সামনে থেকে সরালো না। সজীব খেতে চাইল না। কথা ও জেদ ধরল। খেতেই হবে। কথার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে গালে নিল সজীব। ঠান্ডা আপেলের টুকরো।
কথা বসল সজীবের পাশে। বইটা নিয়ে ফেলল হাত থেকে। খেতে খেতে পড়তে নেয়।
সজীব অবাক। দিনদিন সাহস যেন বেড়েই চলেছে এই মেয়ের৷
কথা একটা একটা করে খাইয়ে দিল সজীবকে। বিরক্তি নিয়ে খেল সজীব। কথার ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।
খাওয়া শেষে কথা বসল সজীবের পাশে। এই পাঁচটা দিন সে খুব মিস করেছে তার বরকে। খুব।
সজীব শান্ত চোখে তাকাল কথার দিকে। কি আশ্চর্য! মেয়েটা চায় কি তার কাছে?
কথা বলতে চাইল,
‘ আপনি মিস করেননি আমায়?
কিন্তু বলতে পারল না। সজীব নড়েচড়ে খাট থেকে নেমে যেতেই কথা ধরে ফেলল তার হাত। সজীব আবার বসে পড়ল। ভ্রু কুঞ্চন করে তাকাল কথার দিকে।
কথা সজীবের হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিল।
আচমকা জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা রাখল সজীবের। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আপার বর খুব খারাপ। খুব। সে এই কথা কাকে বলবে? বরটা ও তো বুঝেনা।
দরজা ঠেলে চট করে ডুকে পড়ল সুমন। কোনো ভাবান্তর নেই তার। সজীবকে বলল,
‘ তোমার শ্বশুর আব্বা তোমায় ডাকছে। প্রেম পিরিতি পরে করো।
মেজাজ বিগড়ে গেল সজীবের। কথা দূরে সরে বসল। কি বেয়াদব মানুষ!
সজীব বের হয়ে গেল রুম থেকে।
শক্ত চোয়ালে সিঁড়ি বেয়ে দুমদাম সজীবকে নামতে দেখে মোতালেব শেখ অবাক হয়।

‘ কি সমস্যা? কি হয়েছে?

সজীব মোতালেব শেখের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘ সমস্যা আমার নয়। সমস্যা আপনার বড় মেয়ের জামাইর। কারো বেডরুমে হুটহাট ডুকে পড়াটা নিশ্চয়ই কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয়।

মোতালেব শেখ তাকালেন পিছু পিছু নেমে আসা সুমনের দিকে।

‘কাঁচুমাচু করল সুমন।
‘ আসলে আব্বা আমি বুঝতে পারিনি। তাছাড়া ওদের মধ্যে,,,
‘ একদম চুপ। তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি সুমন। সবকিছুর একটা সীমা থাকে।
পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়ানো সজীবের চোখ মেঝেতে নিবদ্ধ।
সুমন চলে গেল।
মোতালেব সাহেব সজীবের দিকে ফিরলেন।
‘ তুমি টিউশনি শুরু করছ আবার?
‘ জ্বি।
‘ কেন?
‘ আপনার কাছ থেকে আমি টাকা নিতে পারবনা। অনেক করছেন। বসে বসে খেতে ইচ্ছে করেনা আমার। আমার পড়াশোনার জন্য হলেও টিউশনি করতে হবে আমার।
মোতালেব সাহেব কিছু বলার পেলেন না।
‘ এই পাঁচদিন কোথায় ছিলে? তোমার মাঝেমাঝে হয় কি? তুমি ঠিক কি করতে চাইছ?
‘ কিছুই করতে চাইছিনা আপাতত।
‘ ঠিক আছে। যাই করো বাড়ি ফিরবে ঠিকমতো। ফোন ধরবে।
সজীব কিছু বলল না। আবার উপরে চলে গেল।
মারজিয়া এসে বলল,
‘ টিউশনি করতে চাইছে করুক না। বারণ করিয়েন না আর। ছেলেটা জোর দোস্তি পছন্দ করেনা। তাকে তার মতো করে থাকতে দিন।
মোতালেব সাহেব বললেন,
‘ ছেড়ে তে দিয়েছি। কিন্তু কি হচ্ছে? ফলাফল শূন্য। তার মায়ের অপারেশন শেষ হলে কি করবে সে? ওর মাকে নিয়ে তখন অজুহাত বেড়ে যাবে। আবার আসবে না এখানে। একদিন আসবে, আর পাঁচদিন ওখানে পড়ে থাকবে।
মারজিয়া কিছুই বলল না।
কিছুই বলার নেই।

টিউশনি করে, মায়ের দেখাশোনা করে সবকিছু সামলিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরী হয় সজীবের। অনেকগুলো পরীক্ষা সামনে। একটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট টিচার হিসেবে যোগদান করবে।
রাত করে বাড়ি ফিরে খেতে ও ইচ্ছে হয়না তার। কিন্তু কথার জন্য না খেয়ে ও ঘুমাতে পারেনা। জোর করে নিজ হাতে হলেও খাওয়াবে এই মেয়ে। বিরক্তিকর। সবসময় মুড কি একরকম থাকে? এদের তিনবেলা খেয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কোনো চিন্তা নেই।
যতসব চিন্তা সজীবের। মায়ের অপারেশনের দিন ঘনিয়ে এল। অপারেশনের দিন কথা নিজ থেকেই গেল হসপিটালে। টিউমার হয়েছে সাজিয়া বেগমের। অপারেশন শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা। সাজিয়া বেগম ছেলের হাত ধরে ফেললেন।
‘ বৌমাকে কবে ঘরে তুলবি আব্বা?
সজীব কোনো উত্তর দিলনা তখন।
কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল শুধু।
সজীব মাকে নিয়ে বাসায় উঠল। কিন্তু কথার কাছে গেলনা। ফোনের উপর ফোন দিল মোতালেব সাহেব। এই ছোটলোকের বাচ্চা আবার কথা দিয়ে কথা রাখছেনা। মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। আর সহ্য হচ্ছেনা।

হুট করে একদিন রাতেই ফিরল সজীব। তাও গায়ে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে। মোতালেব সাহেব শুধু দেখছেন সজীবের কান্ড। মারজিয়া খেতে ডাকল। সজীব বলল,
‘ মায়ের কাছে খেয়ে এসেছে। আসলে খেতে ইচ্ছে করছিলনা৷ তেঁতো লাগছে সবকিছু।
মোতালেব সাহেব এবার রেগে গেল৷
‘ তুমি ঠিক কি করতে চাইছ? তুমি কি আমার মেয়েকে পুতুল পেয়েছ?
সজীব বলল,
‘ কিছুই চাইছিনা। আপনার মেয়ে পুতুল হতে যাবে কেন?
‘ তাহলে কয়দিন কয়দিন পরপর কি এখানে বেড়াতে আসো?
সজীব বলল,
‘ জ্বি না।
কথা মাথা নাড়িয়ে মোতালেব সাহেবকে কিছু না বলার জন্য ইঙ্গিত করল। মোতালেব সাহেব বললেন,
‘ তুমি কি আমার মেয়েকে রাখবে? নাকি রাখবেনা?
সজীব কথার দিকে তাকাল।
‘ এসব কথা কেন উঠছে?
মোতালেব সাহেব বললেন,
‘ তাহলে? তুমি এমন করলে তো হবেনা। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কোনো দায়িত্ব আজ পর্যন্ত তুমি পালন করেছ? আমার মেয়েকে বউ মানতে অসুবিধা হবে জেনে ও বিয়েটা তুমি করলে কেন?
‘ অসুবিধার কথা কখন বলেছি? বিয়েটা করেছি কেন সেটা আপনি ভালো করে জানেন।
‘ তাহলে? তুমি ফিরোনা কেন কথার কাছে?
‘ আপনাকে অন্ধ মনে হচ্ছে আমার। এই যে ফিরলাম।
‘ আজ ফিরেছ। আবার কাল আসবে না।
সজীব কিছুই বলল না। মোতালেব সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। কি করবেন তিনি এখন?
কথা এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ তাকে নিয়ে যায় না কেন এখান থেকে? তার স্বামীর ঘরে যেতে ইচ্ছে করে।
সজীব কথা না বাড়িয়ে উঠে গেল উপরে। মায়ের ফোনে কল দিয়ে বলল,
‘ ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আম্মা।
সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ তোকে এখন আসতে হবেনা আব্বা। থেকে যাহ সেখানে। দিনে একবার এসে আমাকে দেখা দিয়ে যাস শুধু। ঝামেলা করিস না।
সজীব কিছুই বলল না।
আজ টিউশনির বেতন পেয়েছে। মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনেছে। আর ও একটা কিনেছে। একটা সাদা আকাশী পাড়ের। অন্যটা খয়েরী রঙের। বিছানার উপর রেখেছে প্যাকেটটা।
কথা ধীরপায়ে হেঁটে রুমে এল। বিছানার উপর প্যাকেট দেখে কৌতূহল বাড়ল। শাড়ি দেখে চোখজোড়া চকচক করে উঠল কথার। তারজন্য বর শাড়ি কিনেছে?
সাদা শাড়িটা যে শ্বাশুরির জন্য কিনেছে তা বুঝে ফেলল কথা। আর খয়েরীটা তার জন্য।
সজীব দেখল গায়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে হাসছে কথা। চোখ সরিয়ে নিল সজীব। ঘরের লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কথা ভীষণ অবাক। সে জেগে আছে আর এই লোক লাইট বন্ধ করল কেন?
অন্ধকারে আর ও একটা সুযোগ হলো। চট করে কাপড় পাল্টে শাড়িটা পড়ে নিল কথা। এলোমেলো ভাবে। তারপর লাইট জ্বালিয়ে দিল। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। না বরের পছন্দ খুব সুন্দর। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। প্রসাধনী মাখল কথা। তার এই রূপ বোধহয় পছন্দ না বরের। সাজলে যদি দেখে?
সজীব ঘুমিয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসছে। এই শব্দটা কাঁপিয়ে তোলে কথাকে। খুব কাছে টানে তাকে। একেবারে কাছে গিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে সেই শব্দ। খোলাচুল এলেমেলো ভাবে হাতখোঁপা করল কথা। শাড়িটার কুঁচি ধরতে না পারায় সামনের দিকে ফুলে আছে। শাড়ি ঠিক করতে করতে কথা গিয়ে দাঁড়াল সজীবের সামনে। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল সজীব। কথার মন খারাপ হলো। তাকে বলবেনা এই শাড়িতে কেমন দেখাচ্ছে?
সজীবের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল কথা। ফিরল সজীবের দিকে। সজীবের নিঃশ্বাস এসে ঠেকল তার মুখের উপর। চোখ বন্ধ করে নিল কথা। দূরত্ব কমিয়ে শুয়ে পড়ল। চওড়া বুকে মাথা রাখল। অনেক্ক্ষণ পর মুখ তুলে দেখল সজীবের ঘুমন্ত মুখ। গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বর এসেছে নিশ্চয়ই। কথা কপালটাতে ঠোঁট ছুঁয়ালো। জলপট্টি আনতে যেতেই বাঁধা পেল কথা । সজীবের হাত ধরে রেখেছে তার পিঠ। কথার সরল না। সরাতে চাইল না সেই হাত। সজীবের মুখের তাপ শুঁষে নিয়ে ভিজিয়ে দিল সে। সজীবের অন্য হাত নিজের পিঠের উপর দিয়ে ঘুমন্ত সজীবকে বলতে চাইল,
‘ ধরুন আমায়।
উত্তপ্ত বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে পড়ল কথা।
ঘুমের ঘোরে,জ্বরের তাপে উষ্ম আরাম খুঁজল সজীব। পাশ ফিরে কথাকে টেনে নিল কাছে। নিজের অজান্তেই বুকের সাথে লেপ্টে রাখল কথাকে। কিন্তু মুখ দিয়ে বিড়বিড় করল,
‘ দূরে যেওনা মায়া। যেওনা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে কথা সজীবকে থম মেরে বসে থাকতে দেখল। দৌড়ে গেল কথা। সজীবের গলায় হাত দিয়ে দেখল জ্বর জমেছে কিনা। সজীব ধরল তার হাত। আঁতকে উঠল কথা। সজীব ধীরে নিচে নামিয়ে দিল কথার হাত। কথা তার হাতের দিকে ছলছলে চোখে তাকাল। সজীব কথার দিকে চেয়ে চেয়ে বের হলো রুম থেকে।

‘ শাড়িটা সে এই মেয়ের জন্য তো কিনেনি?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here