চুপি চুপি ইচ্ছেরা,পর্ব ৮
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
বিকেলে ষশ্মিথ তিতিরকে নিয়ে চলে এলো রকস মিউজিয়ামে। রিসোর্ট থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে ৩৫ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলো পঞ্চগড় মহিলা কলেজের সামনে। পঞ্চগড় মহিলা কলেজের ক্যাম্পাসের ভিতরে তৈরী করা হয়েছে এ জাদুঘর। জাদুঘরটি পাথর কেটে বানানো। কলেজের ভিতরে রকস পাথরের এ জাদুঘরে ঢুকার সময় ছোট নেইমপ্ল্যাট চোখে পড়লো তিতিরের।সেখানে এই জাদুঘরের বয়স সীমা লিখা আছে। ১৯৯৭ সালে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক ব্যাক্তিগত চেষ্টা গড়ে তুলেছিলেন এই জাদুঘর। তিতির লক্ষ করেছে অবশ্য অন্যান্য জাদুঘর থেকে এই জাদুঘর বেশ ব্যাতিক্রম। সম্পূর্ণ জাদুঘরটিই অনেক রকমের পাথর সজ্জিত। প্রাচীনকালের মানুষের ব্যবহার্য অনেক তৈজসপত্র সংরক্ষিত আছে।
নদী থেকে পাওয়া দুইটি দুটি বিশালাকার নৌকাও ঝুলিয়ে রাখা আছে জাদুঘরের মাঝখানটাতে, যা খুব আকর্ষিত করলো তিতিরকে। এর আগে এতবড় নৌকা তিতির দেখেনি। তিতির অবাক হয়ে ষশ্মিথকে বললো,
‘ কত্ত সুন্দর! ‘
ষশ্মিথ হেসে বললো,
‘ হুম। ভিন্ন না? ‘
‘ হুম। কি সুন্দর এ পাথর গুলো! ‘
‘ এগুলোই তো এর বিশেষত্ব। এটি শুধু বাংলাদেশ না পুরো এশিয়াতে অদ্বিতীয়। ‘
রকস মিউজিয়াম ঘুরা শেষে ষশ্মিথ তিতিরকে সেখানের স্থানীর ধাবায় নিয়ে গেলো। সেখানে পঞ্চগড়ের সকল ঐতিহ্যবাহী খাবার সহ সাধারণ বাঙ্গালি খাবারের ব্যবস্থাও খুব সুন্দর। খাওয়া দাওয়া সেরে রিসোর্টে ফিরলো। ঘরে ঢুকে শূণ্য বিছানায় তাকিয়ে বড় এক নিঃশ্বাস ছাড়লো তিতির। ধাপ করে বসে পড়লো খাটের এক কিনারায়। ষশ্মিথ তখনো করিডোরে। এখানকার সেই ছেলেটার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলাতে ব্যাস্ত। কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পারছে তিতির।
হঠাৎই তার চোখ ভর্তি হয়ে গেলো পানিতে। হৃদপিন্ডের দেয়ালের চারপাশে অবশ করা ব্যাথায় ঝিম ধরে গেলো সারা শরীর। মনে হলো যেনো বুকটা ছিড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে হৃদস্পন্দন গুলো। অসহ্য যন্ত্রণা।
গা গুলিয়ে গেলো তিতিরের। ষশ্মিথ ওকে ভালোবাসে, অন্তঃহীন ভালোবাসে। যে ভালোবাসার কোনো পরিধি নেই, নেই কোনো স্বার্থ কিংবা ভ্রম। যে ভালোবাসা ক্ষণে ক্ষণে শুধু শুভ্র ফুলের মতোন প্রস্ফূটিত হয়। বুকের সমগ্র অঞ্চল ঘুরে দানাবাদে বাম মহোনায়। গোপনে গোপনে যা বাসা বেঁধে পরিত্রাণ দেয় দেহের প্রত্যেকটা অঙ্গের তৃষ্ণা। টনিক হয়ে হাজারো বিষন্নতার।
তিতির কান্নাগুলো সব দলা পাকিয়ে যায়। ঠোঁট চেঁপে কাঁদতে থাকে। ষশ্মিথ আছে। ওর কাছেই আছে। কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। প্রত্যেক পদক্ষেপে মরিচিকার মতো ষশ্মিথকে পায় তিতির। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চলে ও। তিতিরের আজ নিজের প্রতি রাগ হয়ে। ক্ষোভ হয়। অবিষ্কার করে ও ষশ্মিথকে অন্ধের মতো ভালোবাসতে চলেছে! কিন্তু সামান্য অবহেলার প্রাচীরে ঘিড়ে হাজার শত বর্ষ দূরে ঠেঁলে রেখেছে! আরো কিছু চায় ও। অনেক গভীরে গিয়ে ভালোবাসার স্বচ্ছ গন্ধে উঁকি দিয়ে তার আভা পেতে চায়। স্ত্রীর অধিকার চায়। মোহ চায়। আসলপ সবটা চায়।
–
বিভা হলুদ শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে খাটে বসে আছে অনেক বেলা হলো। আসন করে বসে একবার তাকালো নিঝুমের বালিশের দিকে। বালিশটা কাছে এনে তার ঘ্রাণ ভরে নিলো নিজের ভেতর। নিজকে বড্ড মাতাল মাতাল মনে হচ্ছে তার। আচ্ছা নেশা করলেই কি মাতাল হওয়া যায়? কেমন লাগে মাতাল হলে?
যা খুশি তা করা যায়? মাথাটা কি ঝিম ধরা লাগে? মনে হয়কি কেউ টুসঠাস শিল দিয়ে বারি দিচ্ছে মস্তিষ্কে? খুব হাসি পেলো বিভার। মনে মনে ইচ্ছে মতো হেসে নিলো সে। বালিশটার দিকে তাকাতেই আবার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো। কালকের রাতটা সে তার বোকামুতে মাটি করেছিল। নিঝুম বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কেঁদেছিল খুব। শাড়ি জড়িয়েই ফ্লোরে শুয়ে ছিল, কখন চোখ লেগেছে জানে না। চোখ মেলতেই কাঠের ঘড়িটাতে দেখে কাটা দেড়টা পেড়িয়েছে। মনে মনে রাগ ও হলো। এ বাড়িতে এতটা মানুষও কি তার খোঁজ নেবে না? পরক্ষণেই চট করে মনে হলো নিঝুম বাড়ি ফেরেনি আর। নির্বুদ্ধিতার জন্য সারাদিন কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। শায়লা জোর করে তিনটা দিকে খাইয়ে দিয়ে গেছে। সাথে এক গাদা বকা। নিচে শুয়ে জ্বর বাধানোর জন্য। তবে আজ সেই ভুল সে করবে না বিভা। নিঝুমের সব রাগ তুচ্ছ করে দেবে ওর ভালোবাসার সামনে।
–
মৃদু মোমের আলো আর রবীন্দ্রনাথের স্মরণ এক রাতকে প্রাপ্তিভূত করে তোলে। ঈশাণ কোণ থেকে ভেসে আসা এক ঝাপটা মোলায়েম বাতাস আর সাথে হাসনাহেনার সৌরভ, মনের কুঞ্জে কিঞ্চিৎ কালবৈশাখী ঝড় খেলে দিতে যথেষ্ট। ষশ্মিথ এ ঝড়ে সামলে হিমশীম খেয়ে পড়লো তিতিরপাখির দোপাটে। মৃদু আলো খেলছে আর প্রশান্তির ছায়ায় হিমশীতল দোলা খাচ্ছে ঘরময়। ষশ্মিথ ঘন্টাখানেক আগে বের হয়ে ছিল আমীনের সাথে। আমীন তাদের গাইডের মত সব দেখিয়ে দিচ্ছে। ফিরে এসে দেখে ঘরজুড়ে হাসনাহেনার সৌরভে টইটুম্বর আর মৃদু মোমের আলো। খোলা জানালা বেয়ে ঝির ঝির বাতাস ঢুকছে। তিতিরের শাড়ির আঁচল মাটিতে পড়ে রয়েছে। জানালার কাছে দাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ছে,
‘ দিবসরজনী আমি যেন কার
আশায় আশায় থাকি।
তাই চমকিত মন,চকিত শ্রবণ,
তৃষিত আকূল আঁখি।।
চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াই,
সদা মনে যদি দেখা পাই,
‘কে আছিস’ বলে কমকিয়ে যাই
কাননে ডাকিলে পাখি।।
জাগরনে তারে না
দেখিতে পাই,
থাকি স্বপনের আশে-
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়
বাঁধিব স্বপন পাশে। ‘
আর বলতে পারলো না তিতির। তার আগেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। কেঁপে ওঠলো হৃদয়। নগ্ন পেটে থাকা ষশ্মিথের হাত চেঁপে ধরলো বাম হাতে। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে এলো গলায় ষশ্মিথের নাকের ছোঁয়া পেয়ে। বুকের উঠানামা বেরে গেলো। ষশ্মিথ চোখ বুজে তিতির গলার স্পষ্ট নীল শিরাতে চুমু দিয়ে গুনগুনিয়ে বললো,
‘ এতো ভালোবাসি এতো যারে চাই
মনে হয় না তো সে যে
কাছে নাই,
যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে
তাহারে আনিবে ডাকি।। ‘
কবিতা শেষ করতে করতেই আরো কয়েকটা চুমোতে ভরিয়ে দিলো তিতিরের গলা-কাধ। দুই হাতে বাহু জড়িয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে একাগ্রচিত্তে চেয়ে রইলো এ মায়াময় মুখে। কিছু একটা ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। তিতিরের শূণ্য বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠলো। অভিমাণে বললো,
‘ মানুষটা এমন কেনো? আরেকটু কাছে এলে কি হতো? আমি কি না করেছিলাম নাকি। ‘
লম্বা উন্মুক্ত করিডোরের উত্তর পাশে কাঠের সিড়ি আর দক্ষিণ পাশে তিনটে ঘর। ষশ্মিথ করিডোরে গিয়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা। একবার সিড়ির কাছে এসে উল্টো মুখ করে আবার ঘরের দরজায় কাছে ফিরে এলো। আবার চলে এলো সিড়ির কাছে। দু’টা সিড়ি নেমে প্রথমটাতে বসে পড়লো। মন শুধু চুপি চুপি বলে চলছে,
‘ তুই ভুল না ষশ্মিথ! তিতির তোকে ভালোবাসে। তিতির তোকে ভালোবাসে! ‘
সিড়ি থেকে ওঠে সোজা ঘরে ডুকে দরজা আটকে দিলো ষশ্মিথ। পিছন ফিরে দেখে তিতির বেশ অভিমাণী চোখে দেখছে তাকে। এগিয়ে এসে তিতিরের চপালে নিঃশব্দে চুমো খেলো ষশ্মিথ। তিতিরের চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা জল। বললো,
‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি ষশ্মিথ। ‘
ষশ্মিথ মুচকি হেসে তিতিরের কানের কাছে বললো,
‘ আজ চুপি চুপি ইচ্ছেরা অন্য কিছু চাইছে কিন্তু। একটু আদর করবো? ‘
লজ্জায় তিতির নতঃমাথা করে দুইহাতে মুখ চেঁপে নিজেকে ষশ্মিথের বুকে ঠেঁকালো। অস্ফূস্বরে বললো,
‘ ভারী অসভ্য লোকা আপনি! ‘
ষশ্মিথ তিতিরকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগুলো। ভালোবাসাগুলো দুটি স্বত্তার ইচ্ছের ডানায় ভর দিয়ে বৃষ্টি কণার মতো ঝরে পড়তে লাগলো।
–
বিভার খাটে বসে নিঝুমকে দেখছে। কিছু সময় আগেই এসেছে। এসে বিভাকে খাইয়ে দিয়ে তারপর নিজে খেয়েছে। সোফার কর্ণারে ঠেস দিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে ল্যাপ্টপে কাজ করছে। আজও বকুল ফুল নিয়ে এসেছিল বিভার জন্য। খুব অদ্ভুত লাগে বিভার।নিঝুমের অনেক আচরণে মনে হয়ে সে বিভাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে আর অনেক আচরণ বিভাকে বারে বারে স্মরণ জাগায় ‘আমার সর্বস্ব তিতিরের অধিকার’।
‘ ঘুম আসছে না?’
নিঝুমের প্রশ্নে হতচকিত হয়ে বিভা বললো,
‘ কিভাবে ঘুমাবো আপনি তো নেই। ‘
‘ অদ্ভুত বালিশে মাথা রেখে ঘুমাও! ‘
বিভা সাথে সাথে ঘনঘন মাথা দুইদিকে হেলিয়ে বললো, ‘ ‘ উহুম। আজ আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমবো। নয়তো সারারাত জেগে থাকলাম আপনি কাজ করুন। ‘
নিঝুম উপায়ান্ত না দেখে বিছানায় এসে ধাপ করে শুয়ে বিভাকে একটানে নিজের বুকের উপর ফেললো। বিভা একটু ঘাবড়ে গেলেও খুশি হয়েছে বেশি। এই প্রথম কোনো রাগ কিংবা দ্বিধা ছাড়া নিঝুম তার কথা শুনলো। নিঝুম বিভার কপালে আলতো করে চুম দিয়ে বলে,
‘ নাও ঘুমোয় এবার। ‘
বিভাও আয়েশিভাব করে নিঝুমের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। নিঝুম ভাবনার সাগরে ডুব দিলো। মেয়েটা ওকে খুব করে চায়। ওর ভালোবাসা চায়। ওর অনুভূতি গুলো চায়। তাছাড়া নিঝুম নিজেও ওকে চাইতে শুরু করেছে। তবে তা কি কেবলই শারীরিক? নাকি ও বিভাকে ভালোবাসতে শুরু করেনি তো! মন শরীর হৃদপিন্ড চুপি চুপি বললো,
‘ হয়তো! ‘
তবে সে যে আর কোনো মায়া মোহ চায় না।
–
সকালে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় তিতিরের। নিজেকে ষশ্মিথের বুকে আবদ্ধ পায়। ষশ্মিথের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সে খুব আরাম করেই ঘুমোচ্ছে।তিতির গভীর ভাবে দেখতে লাগলো ষশ্মিথকে। নাকটা তীরের ছুঁটের মত খাড়া, ঠোঁটটা খুব চিকন অথচ সুন্দর, চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে, কাঁধ ছুঁই ছুঁই। গায়ের রং একদম ফর্সা। ফর্সা বলতে ধবধবে ফর্সা। তিতিরের এবার রাগ হয়। পুরুষমানুষ মেয়েদের থেকে বেশি সুন্দর হবে কেনো? তারা হবে কালো অথচ মায়াবী, অসুন্দর অথচ মনোরম, কঠিন অথচ তৃষ্ণার্থ, রাগী কিন্তু শ্রান্ত। তবেই না সে পুরুষ। ভাবতে ভাবতে তিতিরের চোখ যায় ষশ্মিথের বুকে। দুই তিনটা কামর আর অসংখ্য খামচির দাগ। দেখেই লজ্জায় চুপসে যায় তিতির। গতকালের রাতের সব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে থাকে অবিরাম। চোখ বুজে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ায় লাজুকলতা।
গোসল সেরে কালো রংয়ের একটা সিল্কের শাড়ি পড়ে বের হয় তিতির। বিয়ের পর সত্যিই ওর কপাল ফেটেছে। প্রত্যেক দিন শাড়ি পড়তে হয়। ষশ্মিথের কড়া নির্দেশ। এখন অবশ্য ভালো লাগে তিতিরের। তিতির আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে খেয়াল করলো খাটে বসে ষশ্মিথ বেঘোরে তাকে দেখে যাচ্ছে। চোখ পড়তেই তিতির লজ্জায় নতঃমাথা করে ফেলে। ষশ্মিথ মুচকি হেসে ওঠে তিতিরের পেছনে দাড়িয়ে জড়িয়ে নিলো ওকে। মুখ ডুবিয়ে দিলো স্নিগ্ধ ভেজা চুলে। তিতির লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
‘ আগে ফ্রেশ হয়ে নিন। ‘
‘ হুম, তবে আজ যেন একটু বেশি সুন্দর লাগছে তিতিরপাখিকে! ষশ্মিথের আদরের এফেক্ট নাকি হুম? ‘
লজ্জায় লাল হয়ে তিতির বলে, ‘ ওফ! যান তো! ‘
হেসে ফেলে ষশ্মিথ। বলে, ‘ সুন্দর করে তৈরি হয়ে নাও কেমন। আধ ঘন্টার মধ্যে বের হব। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
গোসল সেরে এসে চুল আচড়ে, তিতিরের সাথে ম্যাচিং করে ব্ল্যাক কার্লারের শার্টটা পড়তে পড়তে ষশ্মিথ বললো,
‘ বাপরেহ তিতির, কি দাঁত আর নখ বানিয়েছ তুমি?কয়দিনের ক্ষুদার্থ ছিলা সোনা? যে ভাবে কামরাইছো! গোসল করতে গিয়ে পানি পরার পর টের পাইছি। জ্বলে ছারখার হয়ে গেলাম আমি। ‘
তিতির যেন আরো লজ্জা পেয়ে গেলো। কোথায় লুকোবে বুঝতে না পেরে দৌড়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
সকালের নাস্তা শেষে ষশ্মিথ এবং তিতির বের হলো গোলকধাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। কটেজ থেকে তাদের জিনিস পত্র সকালেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তেঁতুলিয়ায়। গোলধাম মন্দিরে রির্জাভ গাড়ি দিয়ে যেতে প্রায় দেড় ঘন্টা লাগলো। এই গোলকধাম মন্দিরটি দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নে অবস্থিত। ১৮৪৬ অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের নির্মিত চমৎকার নিদর্শন মন্দিরটি। দেবীগঞ্জ জেলা সদর থেকে ১২ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। তিতির ঘুরে ঘুরে মন্দিরটি দেখলো। কয়েকজন হিন্দু গ্রামবাসীর সাথে পরিচয় ও হয়ে গেলো। মন্দিরটি গ্রিক ঐহিহ্য এবং স্থাপত্য অনুকরণ করে তৈরী করা হয়েছিল।
গোলকধাম মন্দির থেকে চলে এলো পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়ের দে.ভি. বদেশ্বরী মৌজায়। সেখানে প্রায় ২ দশমিক ৭৪ একর জমির উপর নির্মিত বদেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের প্রবেশ করার সাথে সাথে ষশ্মিথ বললো,
‘ চট্রগ্রামের সীতাকুন্ড মন্দির আর পঞ্চগড়ের বদেশ্বরী মন্দির একই কারণে তৈরী করা হয়েছে। ‘
তিতির উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললো,
‘ কি? ‘
‘ হিন্দু সমাজের মানুসের কথানুযায়ী তাদের দেবতা শিব তার স্ত্রীর মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সহধর্মিণীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে উম্মাদের মতো সারা পৃথিবী ঘুরতে থাকেন এবং প্রলয় সৃষ্টি করতে থাকেন। ‘
‘ তারপর? ‘
‘ তা স্বর্গের রাজা বিষ্ণুদেব সহ্য করতে না ফেরে তার হাতে থাকা চক্র নিক্ষেপ করে এবং শবদেহটি ৫২ খন্ড হয়ে বিভিন্ন স্থানে পড়ে। বাংলাদেশে দুটি সীতাকুন্ড আর এখানে পড়ে। তারপর এদের কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় পীট। ‘
বিকাল গড়ার আগেই ষশ্মিথ তিতিরকে নিয়ে পৌঁছে গেলো তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ডাকবাংলো। ভারতের সীমান্তবর্তি এলাকাতেই। তিতির এবার সত্যিই তার ভাষা হারিয়েছে। খুবই নিরিবিলি পরিবেশে এ ডাকবাংলো।
কেয়ারটেকার এসে লাগেজগুলো বাংলোর ভেতর নিয়ে গেলো। ষশ্মিথ বেছে বেছে এমন একটা রুমই নিয়ে যেখান থেকে কাঞ্চনজংঙ্ঘা সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যাবে। সাধারণের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ মিটার উচ্চতায় এ ডাকবাংলো। ঘরে ঢুকে খাটে বসে জুতা খুলতে খুলতে ষশ্মিথ বললো,
‘ বুঝলে তিতির, ভেবেছিলাম হুট করেই এসেছি হয়ত রুম পাব না আর পেলেও কাল চলে যেতে হবে। কিন্তু দুই দিনের জন্য পেয়ে গেলাম। ‘
তিতির খুশিতে একপ্রকার চিৎকার করেই বললো,
‘ তাহলে তো একদিন বেশি থাকব তাইনা? ‘
‘ হুম। ‘ মুচকি হাসলো ষশ্মিথ।
তিতির বড় জানালার পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো ঝকঝকে উজ্জ্বল প্রস্ফূটিত কাঞ্চনজংঙ্ঘা। তিতিরের বুকের ভেতরটা খুশিতে নেচে ওঠলো। এত সুন্দর ফকফকে বরফের পাহার সে এর আগে কোনদিন দেখেনি। মনে হচ্ছে এখানে দাড়িয়ে শ্বাস নিলেই যেন কাঞ্চনজংঙ্ঘার গন্ধ সে পাবে।
ষশ্মিথ উঠে এসে তিতিরের কোমরের দুইপাশে হাত দিয়ে দাড়ালো। তিতির আস্তে করে মাথা ঠেকে দিলো ষশ্মিথের বুকে। এই মুহুর্তে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ মনে হচ্ছে তিতিরের। ষশ্মিথ মুচকি হেসে বললো,
‘ ভালো লেগেছে? ‘
‘ খুউব। ‘
‘ এখানে তো শুধু ব্যাক সাইড দেখা যাচ্ছে। পরেরবার আসলে পুরোটা উপভোগ করাব তোমায়। ‘
তিতির মুচকি হেসে শাড়ির উপরে থাকা ষশ্মিথের হাতে হাত রাখলো। ষশ্মিথ ও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো তিতিরকে।
–
তিতির ভাসছে সুখের সমুদ্রে আর তার দহনে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে নিঝুমের জীবন। তিতির তাকে ছেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু কোথাও যেনো নিজের ছাঁয়া অবশিষ্ট রেখে গেছে যা বিভাকে পোড়াচ্ছে প্রতিক্ষণে।
জলের মধ্যে ছোট ছোট কাগজের নৌকা ভেসে গেলে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে বাচ্চাগুলো। তাদের মনে দৃঢ় ধারণা এগুলো যাবে, বহুদুর যাবে। যাবে স্বপ্নের দেশে। এক সময় বিভাও ভাসাতো। ওর স্বপ্নের রাজকুমাকে নিয়ে আসতে। ওর ফর্সা, সুন্দরী বান্ধবীদের নৌকা ভিজে জলে তলিয়ে গেলে বিভারটা বহুদুর যেত। খুশিতে যখন দপাদাপি করতো, সবাই মুখ ভেংচি কাটত। টিম্পনি কেটে বলতো,
‘ হা হা। তোর মত কাইল্ল্যা মাইয়্যার নৌকা ভাসলেই কি আর ডুবলেই কি? তরে তো কেউ বিয়াই করব না। দেখলে ভাববো ভূত।হাহা। ‘
বিভার কান ঝাঝরা করে আজো বাজে এই কথাগুলো। কিচ্ছুটি ভুলেনি সে। সত্যিই তো হল! রাজকুমার ও এলো নৌকা ভেসলো। কিন্তু ভাগ্য ও তাকে ভেংচি কেটে গেলো।
বিভার এস.এস.সি পরীক্ষার ফল বের হলো কাল। নিঝুম মনে মনে যতটুকু আশা করেছিল তার থেকেও খুব ভালো ফলাফল করেছে বিভা। মেয়েটাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে নিঝুম। এরকম ফুলের মত প্রস্ফূটিত যার মন তাকে কি ভালো না বেসে থাকা যায়। তবুও বুকের ভেতর কালচে লাল রঙ্গে ছোট হৃদযন্ত্রতে এখনো তিতির নামের কাটা লেগে আছে। সেই কাটা যতই সে উপরে ফেলতে চায় ততই যেন ক্ষতের সৃষ্টি করে। গভীর ক্ষত। রক্তক্ষণ হয় অনেক! সেই রক্তের ছটাকের মাঝে মাঝে বিভার জন্য ভালোবাসাও খুব সূক্ষভাবে ঝিলিক দিয়ে নিমিষেই বিলীন হয়। নিঝুমের হাসি পায় তখন খুব। তিতির ওকে মারছে। খুড়ে খুবলে খাচ্ছে। সাথে বিভা নামক মায়াবী প্রানিটার শান্তিও শুষে নিয়েছে।
নিঝুমের বড়ই অবাক লাগে বিভাকে দেখে। মেয়েটা ছোট আর অবহেলিত হলে কি হবে! যতটুকু আছে পুরোটাই জেদ আর আত্নসম্মানে ভরপুর। ও ভালোবাসতে পারবেনা বলে নিজে জোর করে আদায় করে নিবেনা স্বামীর প্রেম? এ কেমন কথা? ভালো ফলাফলের জন্য যখন ওর নিঝুমের কাছ থেকে কিছু চাইতে বললো তখন সহজ কন্ঠে বলে দিলো,
‘ আপনাকে খুব জোরে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই আর গ্রামে গিয়ে থাকব ক’দিন আপনি সমেত। ‘
ব্যাছ এত সূক্ষ তার চাওয়া।নিঝুম কিছুক্ষন ঘরের মাঝে ছটফট করলো। সাঝ সকাল থেকে বিভার দেখা সে পায়নি। জামাই এসছে বলে বাড়ি ভর্তি লোক। এর মাঝে এই পুচকে একরক্তি মেয়ে ডাকতে গেলেও তো লজ্জার মুখে পড়তে হবে তাকে। শার্ট,প্যান্ট আর তোয়ার হাতে বাইরে আসতেই বিভার এক মামাতো বোন এগিয়ে এসে বললো,
‘ চলুন জামাইবাবু ঘাটে যাবেন? ‘
শালিদের সাথে গল্প করতে করতে নদীর বাধানো ঘাটে এসে দেখে ঘাটের পাশেই ঘাসে ছাগলের ছানা কোলে চুপচাপ বসে আছে বিভা। গায়ে হলুদ শাড়ি।গ্রামের মেয়েদের মতন করে পড়েছে। বিভা বলে ডাকলো শশী। হাত নাড়িয়ে আসতে বললো এদিকটাতে। বিভা চোখ ফিরিয়ে নিঝুমের দিকে তাকাতেই বুকে বড়সর এক ধাক্কা খেলো নিঝুম। মায়া মরিচিকায় আটকা পড়েছে ও। অনুভূতির নদী বয়ে গেছে মেয়েটার চোখের ভেতর দিয়ে।
কিছু না বলে দ্রুত নদীতে নেমে পড়লো নিঝুম। বিভা সরু চোখে পর্যবক্ষেন করছিল সব। বাড়ি ফেরে এসেও মেয়েটা একটা বার তার ঘরে আসেনি। সারাবিকাল মামির সাথে বসে শ্বাশুড়ির জন্য পিঠা বানিয়েছে তারপর রান্নায় সাহায্য। নিঝুমের প্রতিক্ষা শেষ হলো যখন রাতে সবাই খাওয়ার পর গোসল করে খোলা চুলে বিভা ঘরে ঢুকলো। দঁরজায় খিল দেয়ার সময় নিঝুম রাগের মাথায় বলেই দিলো,
‘ এলে কেনো? না আসলেই পারতে! ‘
অভিমাণে ভাড়ে নুইয়ে বিভা কোনরকমে বললো,
‘ আচ্ছা চলে যাচ্ছি। ‘
কি তেজ মেয়ের। বাবাহ! সত্যি সত্যি দরজা খুলে চলে যাচ্ছিল। একরকম দৌড়ে গিয়ে খাপ করে পেছন থেকে একহাতে পেট জড়িয়ে আরেক হাতে দরজা আটকে দিলো নিঝুম। আকস্মাৎ নিঝুমের এরকম কান্ডে ঘাবড়ে গেলো বিভা। নিঝুম একটু নুইয়ে বিভার কানের কাছে বললো,
‘ এই মেয়ে এভাবে চলে গেলে আমার বুকে ঘুমোবে কে?আদর করবে কে শুনি? ‘
নিঝুমের কথা শুনে ঝিম ধরে গেলো বিভার মাথা। কি বলেন কি উনি? আদর করবে কে মানে? বিভা একটু ভয়ে ভয়ে বললো,
‘ কি বলেন কি এসব? ঠিক আছেন আপনি? ‘
বিভার কথা উত্তর না দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে ঠোঁট ডুবালো বিভার কোমল গলায়। বিভা চমকে গেলো। কিন্তু নিঝুমকে আটকাবার শক্তি তখন তার নেই। হাত পা কেঁপে কেঁপে ওঠছে ওর। গলা ছেড়ে কপাল, গাল, ঠোঁট।
মোবাইলের রিংটোনে হোঁশ ফিরলো নিঝুমের। খুব দ্রুত নিজেকে আলাদা করে নিলো বিভার থেকে। বিভা তখনো লজ্জায় চোখ বুঝে আছে। স্বামীর এই গভীর স্পর্শ গুলো সকল স্ত্রীর কাছেই কাম্য। বিভাও চেয়েছে। নিঝুম মোবাইলের স্কিনে দেখলো স্পষ্ট করে নামটা ভাসছে, ‘তিতির’
মনের ভেতর কেমন যেন একটা করে উঠলো। একমুহূর্তের জন্য ও ভুলে গিয়েছিল ওর পাশে শায়িত মেয়েটা ওর স্ত্রী। আর তিতির অন্য কারো। তিতিরের কন্ঠটা শুনার লোভ জাগছিল খুব। কল রিসিভ করে কানে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
‘ তি….তিতির। ‘
সাথে সাথেই বিভা দ্রুত চোখ খুলে তড়িঘড়ি ওঠে বসলো। টেবিলে রাখা রিস্ট্ ওয়াচে দেখলো ঘন্টার কাটা এগার পার হয়েছে। এই সময়টা তো নিশ্চয়ই কাউকে বিরক্ত করা ছাড়া ফোন করার নয়!
বিছানা ছেড়ে শশীর ঘড়ে চলে এলো বিভা। শশী ঘুমিয়েছে। বিড়ালের ছানার মতো তার পাশে গাঁ এলিয়ে দিলো বিভা। ও জেগে থাকলে আর উপায় ছিল না।
বিভার ওঠে যাওয়া দেখে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মোবাইল কানে তুললো নিঝুম।
‘ হুম তিতির বলো। ‘
চলবে…