চুপি চুপি ইচ্ছেরা-০২
লেখিকা – সাইমা ইসলাম প্রীতি
হলুদ আর সাদার কম্বিনেশনে একটা থ্রি পিছ পড়েছে তিতির। সাদা নেটের ওড়নার মাঝে হলুদ সুতার কাজ, কামিজ হলুদ আর সেলোয়ারে হলুদ আর সাদার সংমিশ্রন। চুল গুলো টানটান করে বেধে তাতে হলুদ গোলাপ গুঁজে নিয়েছে কয়েকখানি। নিঝুমের পছন্দ। একটু আগেই ফোন দিয়েছিল নিঝুম তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিতে বলেছে তিতিরকে। এক স্যারের বিয়ের দাওয়াত আছে রাতে। সারা বিকেল দুজনা টুকটাক ঘুরাঘুরি করে রাতে তিতির সমেত এটেন্ড করবে বিয়ে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝুমকা কানে জড়াতে জড়াতে কাল রাতের কথা মনে করলো তিতির। নিঝুম যে এতটা স্বাভাবিক থাকবে সবটা জানার পর কল্পনাও করতে পারেনি তিতির। অনেক ভাগ্য করে পেয়েছে ও নিঝুমকে। নিঝুম কিছু কাজ কম্লিট করে ফিরেই তিতিরকে নিয়ে ঘুড়তে বের হয়। নিঝুম ড্রাইভ করছে আর তিতির ওর পাশে সিটেই বসা। গাড়িতে বসা অবদি এখন পর্যন্ত নিঝুমকে চোখ দিয়ে আটকে রেখেছে তিতির। যেনো চোখে চোখে রাখছে। যদি পালিয়ে যায়!
কিছুক্ষন বাদেই তিতির হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে বলে,
‘ নিঝুম নিঝুম, প্লিজ স্টপ দ্যা কার। ‘
নিঝুম হতচকিত হয়ে বলে,
‘ কেন কোনো সমস্যা? ‘
‘ তাড়াতাড়ি থামাও। ‘
নওঝুম কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দ্রুত গাড়ি থামাতেই তিতির নেমে গেলো গাড়ি থেকে। নিঝুম গাড়ি থেকেই জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হয়েছে নামলে কেন? ‘
‘ গাড়িতে যাব না তাই। তুমিও নামো। ‘
নিঝুমও নেমে আসে।ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘ মানে? ‘
‘ রিকশা ডাকো। রিকশা করে ঘুরবো আজ। ‘
‘ হোয়াট তিতির! ‘
চমকে যায় নিঝুম তিতিরে কথায়। একটু থেমে আবার বলে,
‘ তুমি যে এতো আলতু-ফালতু বুদ্ধি কোথা থেকে পাও আল্লাহ্ মালুম। তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো। আমার এমন ভাঙ্গাচূড়া রিকশায় চড়া পছন্দ না। আর এখন রিকশায় উঠলে গাড়ি কোথায় রাখবো। ‘
‘ না না না। প্লিজ, রিকশায় যাব আমি। দেখো তুমি পাঞ্জাবি পড়া আর আমি শাড়ি। বাঙ্গালি মেয়েদের মতো সেজেছি একদম! আকাশটাও মেঘলা, এখন রিকশায় ঘুরলে ভালোলাগবে খুব দেখো! একদম উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার মতো হবে, তাইনা! ‘
নিঝুম মুচকি হেসে বলল,
‘ আরে পাগলি মেয়ে এখানে রিকশায় ওঠলে আমার পরে প্রবলেম হতে পারে। তার চেয়ে বরং অন্যকোনো দিন বাইকে ঘুরাবো তোমায়। আজ না সোনা পাখি। আসো তাড়াতাড়ি উঠে বসো। ‘
নিঝুম বসতে নিলে তিতির বাঁধা দিয়ে বলে, ‘ অন্য দিন না। আজই। আমি অপেক্ষা করছি যাও নিয়ে এসো। ‘
নিঝুম কিছু বলতে চাইলে আসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে তিতির। ব্ল্যাকমেইল করতে উস্তাদ মেয়েটা। তাও কি! এই ছলনাময়ীকেই যে চায়। ভালোবাসে। না চাইতেও তাই তিতিরকে সেখানে রেখে ফিরতি গিয়ে আবার বাইক নিয়ে আসে নিঝুম।
বাইকে খুব জরোসরো হয়ে বসেছে তিতির। নিঝুমে পেছন থেকে খাঁমচে শক্ত করে ধরে রেখেছে। এই প্রথম বাইকে বসার অভিজ্ঞতা হবে। নিঝুম ঠোঁট চেঁপে হাসছে তিতিরের কান্ডে। তিতিরে চোখ মুখ খিচে বসে আছে। বাইকের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পারছে নিঝুম ওকে। তিতিরকে এই মুহূর্তে কোনো অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না। মাথাটা পুরাই এলোমেলো করে দিলো এই মেয়েটা। এমন অসহায় করে দেয় কেন সবসময়? তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিঝুম। আর কিছু সময় দেখলে যেন চোখ ঝলসে যাবে তার।
নিঝুম বাইক স্টার্ট দিতে দিতে ফাজলামি করে বলে,
‘ এই ছাড় আমাকে। এমনে ধরছিস কেন আসামির মতো। ‘
‘ আরে পরে যাবো তো। ‘
‘ এর আগে কারো বাইকে ওঠিসনি? ‘
‘ কে ওঠাবে আমাকে বাইকে শুনি? ‘
‘ কেন তোর ষশ্মিথ! ‘
কথাটা বলেই মুখ চেঁপে হাসছে নিঝুম।জানে তিতির খুব রেগে যাবে। বকবে ওকে। হয়ত বাইক থেকে নেমেও যাবে। ম্যাডামের আবার মান ভাঙ্গিয়ে জোর করে তুলতে হবে বাইকে।
কিন্তু না, তেমন কিছুই হলো না। তিতির আরো চুপ করে বসে আছে। হাতটাও আলগা হয়ে গেছে নিঝুমের বুক থেকে। নিঝুম নামতে বলাতে চুপচাপ নেমে পড়ে বাইক থেকে। নিঝুম নেমে তিতিরকে বাইকের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে ওর সামনে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হলো? ‘
‘ ওনার বাইকে ওঠেছিলাম একবার। বিয়ের আগে। মা জোর করে পাঠিয়েছিল উনার সাথে। ‘
‘ বাব্বাহ! তো আর কি কি করেছো তার সাথে শুনি? ‘
‘ ভাইয়া! ‘
‘ কি? ‘ নিঝুমের চোখে যেন কেবল তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ পায়।
তিতির জড়তা নিয়ে বলে,
‘ ষশ্মিথ ভালো মানুষ। তাছাড়া খুব বেশি ভালোবাসেন আমাকে। আমি তাকে অপমানিত হতে দেখতে চাইনা। আর আমার ভালোবাসার মানুষটা দ্বারা তিনি অপমানিত হোক তা একদমই চাচ্ছি না। ‘
‘ আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে? ‘
চমকে উঠে তিতির।
‘ জানি না। ‘
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিতির আবার বলল,
‘ ওনা চোখে কাল আমি আমার জন্য একটা ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি। গভীর ভালোবাসা। আমাকে না পাওয়া অবসাদ ভাষা-লেশহীন করে দিয়েছে ওই চোখ দুটোকে। ‘
নিঝুমের গাল মুখ দৃঢ় হয়ে আসে। এতটাই রাগ হচ্ছে যে ষশ্মিথ যদি ওর ডিফেন্সে দুবছরের সিনিয়র না হতো এখনি গিয়ে বেঘোর মেরে রক্তাক্ত করে আসতো। কন্ঠে তেঁজ নিয়ে নিঝুম বলল,
‘ তো তার চোখ পড়াও শিখে নিয়েছিস এখন? বাহ! ‘
তিতির অবাক হয়ে দেখে নিঝুমকে। সে এমন উগ্র আচরণ কেনো করছে। তিতির তার প্রতি কতটা দুর্বল সে তা খুব ভালো করে জানে। তিতির বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘ এসব কথা বলে এখনের সময়টা কেনো নষ্ট করছো? আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা। ‘
নিঝুম তিতিরে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘ কতদিনের পরিচয়ে তোর বিয়ে হয়েছিল ষশ্মিথের সাথে? ‘
‘ পাঁচদিন। ‘
নিঝুমের সারা শরীর জ্বলে ওঠলো এবার। রাগে গলার রগ খাড়া হয়ে ফুঁলে ওঠেছে।
‘ বাহ! মাত্র পাঁচদিনের পরিচয়েই তুই আমার আর ষশ্মিথের ভালোবাসা গুলিয়ে ফেলছিস? এত কিসের টান তোর ওর প্রতি যে একটু ওর নামে বলতেই গায়ে লেগে গেলো? ‘
‘ নিঝুম এমন কেনো করছো তুমি। আমি তো…। ‘
‘ তুই ভালো করেই জানিস আমি পৃথিবীতে একমাত্র তোর ব্যাপারেই এতো পসেসিভ। সহ্য করতে পারিনা তোর আশেপাশেও কাউকে।আর কোনদিন যাতে ষশ্মিথের নামটাও না শুনি তোর মুখে। এই তাকা, তাকা আমার দিকে। ‘
‘ হুহ। ‘ তিতির কেঁপে ওঠে তাকায় নিঝুমের চোখে। রাগ আর অশ্রু মিশ্রিত হয়ে এক ভয়ংকর রূপ ধারন করেছে চোখ দুটো। রাগী কিন্তু ঠান্ডা ভাষায় নিঝুম আবার বললো,
‘ ওইটা প্রথম আর ওইটাই শেষ। এর পর থেকে আমি ছাড়া আর কারোর বাইকে তুমি বসবে না তিতির। ‘
–
ষশ্মিথের সাথে নিঝুম তিতিরের ব্যাপারে কথা বললে ষশ্মিথ জানায় তিতির যাকে ভালোবাসে, যার সাথে সারাজীবন থাকতে চায় তার সাথেই থাকতে পারবে। নিঝুমকে বিয়ে করলেও তাতে ষশ্মিথ কিছুই বলবে না। ওদের মাঝেও থাকবে না। শুধু তিতিরকে ডিভোর্স দিতে পারবেনা ষশ্মিথ।
নিঝুম এ কথা শুনার পর বেশ চটে যায়। কেনো ওর হুবু স্ত্রীর উপর অন্য কারোর অধিকার থাকবে?
তিতিরের কিছুতেই ঘুম আসছে না। এতদিন খারাপ লাগলেও এখন পাপ বোধটা আরো বেশি নারা দিয়ে ওঠেছে। ঘড়িতে দেখে সাড়ে তিনটা বাজে। একা একাই চলে এলো ছাদে। আচ্ছা ওর বাবার স্ত্রী ওই মহিলাটা যদি ভালো হতো আজ ওর এই অবস্থা হতো না, তাই না।
মি.ইলমি টাকার লোভে বিয়ে দেন তিতিরকে ষশ্মিথের সাথে।
দু’বছর আগের কথা ভাবে তিতির ইলমি তার বান্ধবির বিয়েতে তিতিরকে সাথে করে নিয়ে যান। তিতিরকে ওখানে দেখেই ভালোলেগে যায় শৈলী হোসমামের। ছবিও তুলে নিয়ে যান। ষশ্মিথ তখন সবে মাথ ইন্টার্নি করছে। আরো ছয়মাস বাকি পড়া কমপ্লিট হতে।
ষশ্মিথের ও ভীষণরকম ভালো লেগে যায় তিতিরকে। যে ছেলের মেয়ের দিকে তাকায়ই না, আর না আছে যার বিয়েতে কোনো আগ্রহ, সে এক দেখাতেই বিয়েতেও রাজি হয়ে গেলো! শৈলী তাই দ্রুত ছেলের বিয়ে সেরে ফেলতে চান এবার। পরে না আবার মত পাল্টে যায়! তিনি আর ষাহবাব যখন বিয়ে ঠিক করতে গেলে ইলমি পাঁচলক্ষ টাকা চেয়ে বসে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে না ও করতে পারেন নি শৈলী। তখনই তিনি বুঝে গিয়েছে ইলমি কি ধরনের মহিলা। কেবল নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন মেয়েকে। ষাহবাব এভাবে বিয়ে দিতে রাজি না হলেও শৈলী রাজি করান। বিয়ের মাত্র দু’দিন আগে জানানো হয় তিতিরকে। ষশ্মিথ তিতিরকে নিয়ে আলাদা ভাবে কথা বলতে যায় তাই জানতে পেরেছিল তিতির, নাহলে হয়ত বিয়ের আগ মুহূর্তে জানতে পারত। নিঝুম তখন ফ্রান্সে। ছয়মাস পর ফিরবে। তিতিরের ছটফটানিতে তিতিরের ফোনটা পর্যন্ত নিয়ে নেন ইলমি।হাজার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি তিতির নিঝুমের সাথে।
তিতির তখন সবে মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ওঠেছে।ষশ্মিথের ও পড়া শেষ হয়নি। তাই ঘরোয়াভাবেই হয় বিয়েটা। ষশ্মিথ যে তিতিরকে খুব ভালোবাসে বিয়ের পরই টের পায় তিতির। কিন্তু বিয়ের তিনদিনের মাথায় সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গেছে সে। যে অন্যায় সে করছে ষশ্মিথের সঙ্গে তার বোঝা সে কি করে বয়ে যাবে সারাজীবন সে জানে না। অথচ ওই মানুষটার মন কতটা পবিত্র!
–
‘ তিতির একটু শুনবে? ‘
কন্ঠটা শুনে একটু অবাক হয়ে পেছনে ফিরে দেখলো তিতির। চকলেট কার্লারের শার্ট পড়া একজন ব্যাক্তি ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। তিতিরকে ফিরতে দেখেই মুচকি হেসে বলল,
‘ একটু সময় হবে কিছু কথা বলতাম। ‘
ঢোক গেলে তিতির। ভয় হচ্ছে তার। ষশ্মিথকে মুখমুখি দেখে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে তার। কি বলবেন উনি? যদি কৈফিয়ত চান তার সঙ্গে করা অন্যায়ের? কি বলবে সে! কেনো ভালো না বাসলেও করেছে বিয়েটা! নিজের অনিচ্ছা স্বত্বে তিতির বলে উঠে,
‘ হুম,বলুন। ‘
ষশ্মিথ আস্তে করে তিতির পাশে বসে পড়লো। ঠিক তিতিরের মতো করেই। নদীর পাড়ে পা দুটো পানিতে ভিজিয়ে। বসে তাকালো তিতিরের দিকে। তিতির তখন এক প্রনয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ষশ্মিথও তাকে ফলো করে তাকালো আকাশে। অন্ধকারের কালো মায়া ডুবে রয়েছে আকাশ। তার মাঝে পাঁচ ছয়েক তারা উঁকি দিচ্ছে। দৃঢ় কন্ঠে ষশ্মিথ বলল,
‘ কি খুঁজচ্ছো? ‘
‘ বাবাকে। ‘
‘ কেনো তোমার বাবা তোমার কাছে নেই? ‘
তিতির চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো ষশ্মিথের দিকে। কিছু না বলে কতক্ষন চেয়ে রইলো। তারপর নদীর কালো কুচকুচে পানিতে তাকালো।
‘ তিতির, জানো তো মা যদি হৃৎস্পন্দন হয় তাহলে বাবা হৃৎপিন্ড। তোমার বাবা আছেন। সর্বক্ষন তোমার পাশে আছেন, তোমার মাঝে আছেন। হয়ত বা তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছো না, তাকে ছুঁতে পারছো না। তবে তোমার অনুভূতি, তোমার সকল স্মৃতিতে তিনি মাঝেই বেঁচে আছেন। ‘
তিতিরের চোখ দিয়ে এবার নিঃশব্দে পানি ঝড়তে লাগলো। হাত আপনা আপনি চলে গেলো বুকের বাম পাশে। ষশ্মিথ তিতিরের মাথায় হাত রাখে বলল,
‘ যেহেতু তোমার বাবা তোমার মাঝেই বেঁচে আছেন,
তুমি খুশি না থাকলে ওনিও ভালো থাকবেন না। তাই ভালো থাকতে হবে তোমাকে। উনি যদি পৃথিবীতে থাকতেন তোমাকে এভাবে দেখে নিশ্চয়ই খুব একটা খুশি হতে পারতেন না। ‘
ষশ্মিথ তিতিরকে আকস্মাৎ নিজের দিকে ফিরিয়ে চোখ দুটো মুছে দিয়ে কপালে নিজের ঠোঁটের নরম পরশ বুলিয়ে দিলো। তিতির অবাক হয়ে দেখছে ষশ্মিথকে। যাকে এত কষ্ট দিয়ে, সারাজীবন চলার জন্য হাত ধরেও পেছনেই ফেলে রেখে এসেছে, সেই মানুষটাই আজ মুছে দিচ্ছে ওর চোখের জল! শুধু কি তাকে বিয়ে করেছে বলে? তিতির তার স্ত্রী বলে? নাকি সবার মতো করুণা করে?
তিতির আস্তে করে ষশ্মিথের হাতটা সরিয়ে দিলো ওর গাল থেকে। ষশ্মিথ ও ঠিক হয়ে বসলো এবার। অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে সে। হুট করে এমন কাজটা কি করে করলো সে! এ তো তার বৈশিষ্ট্যে নেই। তিতির যে তার নয়, অন্য কারো। তবে এই মেয়ের চোখের জল এতো পুড়ায় কেনো ওকে? কষ্টগুলো এতো কেন স্পর্শ করে? তিতির তো এখন আর ওর না। নিঝুম আজ সন্ধ্যায় এসে তিতির আর নিঝুমের বিয়ের কার্ড দিয়ে গেছে। ষশ্মিথকে নাকি প্রথম কার্ড দিয়েছে। আর মাত্র দুমাস পর বিয়ে তিতিরের। তাও কেনো মনে হয় তিতির সব ছেড়ে ছুটে আসবে ওর কাছে! আচ্ছা ওর কি উচিত হয়েছে তিতিরকে নিঝুমের হাতে তুলে দেয়া? তিতির তো ওর স্ত্রী তাই না? তাছাড়া যে পুরুষ পাশে থাকার পরও তার তিতির কাঁদতে সুযোগ পায় এমন কারো কাছে কি তাকে তুলে দিয়ে ঠিক করেছে সে?
দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে ষশ্মিথ।
‘ এত রাতে এখানে একা কেনো এসেছো? ‘
‘ প্রায় আসি। মনখারাপ হলে। ‘
‘ ভয় করে না একা? অফিসার্স মেস থেকে তো অনেক দূর, সিকিউরিটি নেই। ‘
‘ আপনি এলেন যে? ‘
‘ কারোর কথা মনে করে ঘুমাতে পারিনা তাই! ‘
‘ মাত্র পাঁচদিনেই এতো ভালোবাসা? ‘
‘ ভালোবাসতে পাঁচ মিনিট ও লাগেনা তিতির। সেখানে তুমি আমাকে পাঁচটা দিন দিয়েছ।’
অবাক হয় তিতির। এতোটা কন্ফিডেন্ট ষশ্মিথ।
‘ কিন্তু নিঝুম যে বলে ওর সাথে আমার সম্পর্ক চার বছরের, তাই ও আপনার থেকে বেশি ভালোবাসে আমাকে। ‘
‘ হয়ত! একজনের সাথে কি আরেকজনের ভালোবাসার পরিমাপ করা যায়? ‘
তিতির চিন্তিত হয়ে বলে,
‘ না। ‘
‘ তাহলে? আসলে ভালোবাসা পরিমাপ করতে চাওয়াই ভুল। এর কোনো সীমা নেই। তবে হ্যা একেকজনের ভালোবাসার ধরণ একেক। নিঝুম নিঝুমের দিক থেকে তোমায় খুব ভালোবাসে আর আমি আমার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমায়। ‘
‘ ছেড়ে গেছি তাও? ‘
‘ হুম। ‘
এবার কান্না করে দেয় তিতির। মানুষটা কতো ভালো। অথচ ও কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। তিতিরকে অবাক করে দিয়ে ষশ্মিথ বলল,
‘ নিঝুমকে ভালোবাসো না তুমি। ‘
হচকিত হয়ে তিতির বলল,
‘ কি বলছেন কি আপনি এসব? নিঝুম আমার সব। খুব ভালোবাসি আমি ওকে। ‘
‘ আর আমি যদি বলি নিঝুম তোমার মোহ! কৈশরের অবুঝ প্রেম। তোমার ইচ্ছার চাহিদা নিঝুম কিন্তু মনের না। ওর সাথে ভালো নেই তুমি!’
‘ আপনি কে এ কথা বলার? জাস্ট লিভ মি এলোন। ‘
চেঁচিয়ে উঠে এবার তিতির।
‘ এ আমার ক্ষমতার উর্ব্ধে। ‘
‘ অদ্ভুত আপনি। ‘
‘ হুম। ‘
‘ আমি যাচ্ছি। আপনি কি শুধু আমার জন্য এখানে এসছেন? ‘
‘ না। কোয়াটার এখানে। ‘
‘ ওহ! ‘
‘ চলে যাবে? ‘
‘ হ্যা। ‘
‘ আরেকটু থেকে গেলে হয় না? শুধু একটা ঘন্টা কি আমাকে দেয়া যায় না আমাদের বিবাহিত জীবনে? খুব কি বেশি হয়ে যাবে? ‘
‘ যায়। ‘
কথাটা বলার পর নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলো তিতির। মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। ঠিক নিজেই বুঝতে পারছিলো না কেনোই বা তার সাথে এক ঘন্টা কাটাবে সে? তাও এই রাতে? নিজের অজান্তেই হ্যা কেনো বলে দিলো ?
নিঝুম প্রায় ঘন্টাখানিক ছাদে বসে আছে। আজ ষশ্মিথকে বিয়ের কার্ডটা দিয়ে এসে অনেক শান্তি লাগছে। কারণটা অজানা। ষশ্মিথকে ওর এখন সহ্যই হয়না। একবার তিতিরের সাথে বিয়েটা হয়ে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচা যাবে। তিতিরকে হারানোর একটা ভয় মনের মাঝে ঝড়োসরো হয়ে আছে। কিন্তু কেনো? তিতির তো ওরই তাহলে সমস্যাটা কই?
পাশা-পাশি হাটছে ষশ্মিথ আর তিতির। মাঝে এক হাত দূরত্ব বললেও বেশি হবে। কিন্তু এতো কাছাকাছি দুটো মানুষের, মনের দূরত্ব সহস্র মাইল। নিরবতা ক্রমশঃ গ্রাস করে যাচ্ছে তিন তিনটে হৃদয়কে। দুজন তার ভালোবাসাকে নিজের করার নেশায় মত্ত। আর একজনের ধরণার বাহিরে জীবন তার সাথে কি খেলায় মেতেছে? জীবনটাই উদ্ভট। ভালোবাসার মানুষ আছে তো ভালোবাসা নেই, আর ভালোবাসা থাকলে ভালোবাসার মানুষটাই নিখোঁজ!
ষশ্মিথ আস্তে করে বলল,
‘ চা খাবে? ‘
‘ এতরাতে চা? কোথায় পাবেন শুনি? ‘
‘ আহা চলোই না। সামনে গেলে পাবে। তোমাকে স্পেশাল চা খাওয়াব আজ। ‘
প্রতিউত্তরে মুচকি হাসলো তিতির।
ডিফেন্স এরিয়ার কর্ণারের সাইডে ছোটো খাটো এক প্রান্ত ঘেঁষে টং মতন দোকান। এদিকটাতে তিতির এর আগে আসেনি কখনো। আর্ম সৈন্য এবং ক্যাডেটদের ট্রেনিং এর কিছু অংশ এখানটাতে হয়। ষশ্মিথ সামনে এগিয়ে গিয়ে কাওকে ডাকতে লাগলো। তিতির বেশ উৎসাহ নিয়ে খেয়াল করছে ব্যাপারটা। কিছুক্ষন বাদেই টং এর সামনের ঝুলানো টিন উপরের দিকে তুলে বের হয়ে এলো একজন বয়স্ক লোক। ষশ্মিথ ওনাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। চিটাগাং এর ভাষায় কিভাবে যেনো কথা বললো তা সবই তিতিরের মাথার উপর দিয়েই গেছে। তিতির যতটা বুঝলো লোকটা এ দোকানের মালিক। ষশ্মিথ তাকে ভালো করে দু’কাপ চা বানাতে বলো। তারপর তিতিরের কাছে ফিরে এসে চাচাকে আবার জোর গলায় বললো,
‘ বুঝলা চাচা ভালো করে বানাবা চা। ওকে তোমার চায়ের অনেক প্রসংশা করে নিয়ে আসছি কিন্তু। ‘
লোক ওনার সবগুলো দাঁত বের করে হেঁসে বললো,
‘ তা বানামু ঠিক আছে। তো ম্যাডাম নাকি? ‘
‘ তেমন কিছু না। তোমার স্পেশাল চা খাওয়াতে নিয়ে এলাম। ‘
‘ আচ্ছা বাপ দাড়াও,আমি চা বানাই। ‘
টং থেকে কিছুটা দূরে এসে একটা বড় পাথরের গা ঘেঁষে বসলো তিতির। ষশ্মিথ সামনে দাঁড়ানো। বিব্রত বোধ করে তিতির বলল,
‘ আপনি বললেন না কেনো আমি আপনার বউ? ‘
‘ বললে কি হতো? আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক? ‘
তিতির চুপ করে রইলো,ষশ্মিথও আর কিছু বলল না।কিছুক্ষন বাদে গিয়ে চা নিয়ে এলো। নিরবতার মাঝেই চায়ের স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো দুজন।
–
তিতিরের হাসতে হাসতে পাগল হওয়ার উপক্রম। ষশ্মিথ যে এতটা পাজি ওকে দেখলে বোঝাই যায় না। একটু আগেই এক এরিয়া কমান্ডরের বাড়ির সামন দিয়ে আসার সময় তিতিরের বায়নায় ওনার বাংলোর বাগান থেকে গোলাপ ফুল নিয়ে আসতে গিয়েছিল ষশ্মিথ। আর ফিরে এসছে দু’টো শেফার্ড কুকুরের তাড়া খেয়ে। এজন্যেই এভাবে লাফিয়ে-দৌড়ে এলো! ফুল নিয়ে এসছিল ঠিকি। কিন্তু দৌড়ে আসার দরুন হাতে কয়েকটা কাটাযুক্ত ডাল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই দেখে তিতিরের কি হাসিরে বাবা!
চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে তিতির। কুকুরের তাড়া খেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়ে এসেছে দুজন। অনেকদিন পর এভাবে বাঁচ্চাদের মতো দৌড়েছে ও। কোনো রকম শ্বাস নিতে নিতে কুকুরের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছিল তিতির। এমন পাজি কুকুর সে কোনোদিন দেখেনি।
বকতে বকতপ হঠাৎ তিতির ঘাড়ে গরম নিশ্বাসের আভা পেয়ে ঘাবড়ে যায় তিতির। দুটো হাত তিতিরের পেটে স্লাইড করতে করতে এসে ওর শক্ত করে ধরেছে। ষশ্মিথ পেছন থেকে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে শুষে নিচ্ছে ওর শরীরের সব ঘ্রাণ। একটা মাতাল করা ঘ্রাণ সব সময় লেগে থাকে তিতিরের শরীরে। ষশ্মিথকে উম্মাদ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট এটা। নিজেকে তখন আর পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে আসা কোনো আসামি মনে হয় ষশ্মিথেট।
এদিকে তিতিরের তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কোনো ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই ওর লজ্জা লাগে সেখানে ষশ্মিথ ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। শরীর কাঁপছে তার।
কিভাবে আটকাবে ও ষশ্মিথকে? চাইলেও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই ওর। তিন কবুল পড়ে বিয়ে করা বউ ও ষশ্মিথের। এই বন্ধন তো আর এতো ঠুনকো না! ষশ্মিথ হালাল ওর জন্য, ও হালাল ষশ্মিথের জন্য। কি করে বাধা দেবে তিতির? তবে ষশ্মিথের ছোঁয়া গুলোর মাঝে একটা অন্যরকম পবিত্রতা খুঁজে পায় তিতির। এতটা নিঝুমের মাঝেও আজ অবধি কোনো দিন পায়নি! একটা ভালোবাসার অনুভূতি আছে ষশ্মিথের প্রতিটা স্পর্শে। আছে স্নেহ, না পাওয়া বেদনার ছোঁয়া আছে।একটা অদ্ভুত প্রাপ্তি আছে। এটাই হয়ত স্বামী-স্ত্রী বন্ধন, অদৃশ্য কোনো মায়া।
ষশ্মিথের স্পর্শগুলো আস্তে আস্তে বেরে চলেছে। হাতগুলো বিচরণ করছে তিতিরের হাতে। এবার সে ঠোঁট দিয়ে খুব যত্নে ছুঁয়ে দিলো তিতিরের কাধ! দম আটকে দাড়িয়ে আছে তিতিরের। নিজেই আটকে যাচ্ছে তিতির, ষশ্মিথকে কি আটকাবে। আলতো ভাবে তিতিরের কানে একটা কামড় দিয়ে ষশ্মিথ ফিশফিশিয়ে বলে,
‘ এত টানো কেনো আমায়? ভালোই যদি না বাসো তবে মায়ার জালে এভাবে জাড়াও কেনো? পড়ে তো ফেঁসে যাবে আমার মাঝে! তখন আমার জেলখানার চির আসামি করে তোমাকে বেঁধে ফেলবো কিন্তু। ‘
ষশ্মিথের কথা শুনে চোখ দুটো বড়বড় করে ফেললো তিতির। লজ্জায় কাঁচুমাঁচু হয়ে গেছে একদম। ষশ্মিথ কোমড় ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয় তিতিরকে। বেশ লাগছে ওর প্রিয়সীকে। রাতের আধারে ওর সৌন্দর্য বেড়ে গেছে হাজার গুন। লজ্জা পেলে যে আরো মায়াবি লাগে। তবে মনে মনে স্থির করেই ফেলেছে ওর মায়াবিনী শুধুই ওর, আর কারো ছাঁয়া অবধি পড়তে দেবে না তিতিরের উপর। তাতে যা যা করতে হয় সব করবে ষশ্মিথ। সব!
–
তিতিরপাখির সঙ্গে দেখা হয়েছে মাঝে দুদিন পার হয়ে গেছে। সেদিন তিতিরপাখির সামান্য ছোঁয়াতেই গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল ষশ্মিথের। দুদিন পর আজ একটু জ্বরটা কমেছে কিন্তু মাথাব্যথা করছে প্রচুর। এদিকে কাজও জমে গিয়েছে আকাশচুম্বী। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েই খাট থেকে ওঠে স্টাডি টেবিলে বসলো ষশ্মিথ। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ক’দিন যাবৎ প্রচন্ড ডিস্টার্ব করছে। তাও টেবিলের মুকখানা ঠিকই দেখতে হচ্ছে। কথায় আছেনা,ডাক্তার মানুষের পড়ার কোনো শেষ নেই। কাল ক্যাডেটের ছেলেদের একটা স্পেশাল ক্লাস নিতে হবে ষশ্মিথকে। স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে ছোট্ট একটা এসাইনমেন্ট মতন তৈরী করে নিলো ষশ্মিথ। সারা রাত ধরপ লিখা শেষে চোখ বুলিয়ে নিল একবার এসাইনমেন্টের উপর,
‘ মাঝরাতে আচানক ঘুম ভেঙে গেলো। শিরশিরে অনুভূতি। পুরো শরীর নিস্তেজ। চোখ দুটিকে কোনরকমে নড়াচড়া করা গেলেও যেন ভারি হয়ে আসছে চোখের পাতা। অনুভূতিটা এমন, যেন বুকের উপর ভারি কোন কিছু বসে আছে। আর তাতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হল কালো একটি ছায়া চারপাশ ঘিরে রেখেছে। সাময়িকভাবে একে বোবা ভূতের কর্মকাণ্ড বলা হয়ে থাকলেও আদতে এটি এক ধরনের অসুস্থতারই লক্ষণ। যা ঘুমের মধ্যে হয়ে থাকে। আর বৈজ্ঞানিক ভাষায় এ অসুস্থতাকে বলা হয়ে থাকে স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুমের অচলাবস্থা। ২০১১ সালে ৩৫টি গবেষণা প্রতিবেদনকে একত্রিত করে দেখা যায় মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। আর ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। স্লিপ প্যারালাইসিস প্রকল্পের গবেষক ড্যানিয়েল ডেনিসের মতে, এ অবস্থায় মানুষের মন সজাগ থাকে কিন্তু শরীর অচেতন থাকে।
১৯৯৯ সালে স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, স্লিপ প্যারালাইসিসের কারণে মানুষের তিন ধরনের ভ্রম হতে পারে। প্রথমত, মানুষ বুকে এক ধরনের চাপ অনুভব করে। শ্বাস নিতে না পারার অনুভূতি তৈরি হয়। গবেষকদের মতে, শ্বাস-প্রশ্বাস মূলত মানুষের অভিব্যক্তির উপর নির্ভর করে। মানুষ যখন ভয় পায় এবং চোখের গতিবিধি বেড়ে যায়, তখন তাদের শ্বাসের গভীরতা কমে যায় এবং শ্বাসপথ সরু হয়ে পড়ে। আর তখন মানুষের যতটুকু অক্সিজেন দরকার তার পুরোপুরি সে গ্রহণ করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, এক ধরনের সচেতন উপস্থিতি, আতঙ্ক এবং দৃশ্যমান হ্যালুসিনেশন হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি হয় যা থেকে আতংক কিংবা হুমকি অনুভূত হয়। আর সেসময় অনেকের মুখ দিয়ে ভীতিকর শব্দ উৎপন্ন হতে পারে। তৃতীয় ধরনের অনুভূতিটি খুবই সাধারণ। এক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে শরীর থেকে আলাদা বলে মনে করে। মানুষের মধ্যে এমন এক ধরনের অনুভূতি হয় যেন সে শয়নকক্ষের ভেতরে উড়ে বেড়াচ্ছে। গবেষকদের মতে, ব্রেনস্টেম এবং কর্টিক্যাল ভেস্টিবুলারের সক্রিয়তার কারণে এ ধরনের অনুভূতি হতে পারে।
মানুষ যখন ঘুম আর জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থান করে এবং সেসময় স্বপ্ন দেখা থেকে নিজেকে দূরে সরাতে চায় তখনই মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। মানুষ তখন শরীরকে নড়াচড়া করার জন্য ছটফট করতে থাকে। যারা স্বাভাবিক থাকেন তারা নড়াচড়া করতে পারেন। কিন্তু যাদের মলিকিউলার ক্লকে অকার্যকারিতা থাকে তাদের সেসময় স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। অর্থাৎ জেগে ওঠার পরও সেসব মানুষ তার ঘুমন্ত অবস্থায় থেকে যায়। আর এ পর্যায়টি কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে ১০- ১৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
তবে তখন যে ছায়াটি মানুষ দেখতে পায় তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি গবেষকরা। ইউসি সান দিয়েগোর গবেষকদের মতে, মস্তিষ্কে নিজের সঙ্গে কথোপকথনই ওই ছায়ারূপে হাজির হয়। তাদের মতে, মস্তিষ্কের নিউরনগুলো শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়া করতে বলে। কিন্তু শরীর যখন নিউরনের সে নির্দেশ মানতে পারে না তখন ওই ছায়ার অনুভূতি হয়।
আবার কোন কোন গবেষকের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা নামে আতঙ্ক তৈরিকারী যে অংশটি থাকে তার অতিরিক্ত সক্রিয়তার কারণে এ ধরনের ছায়া দেখা যেতে পারে। তাদের মতে ঘুমের মধ্যে মানুষের অ্যামিগডালা যখন অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন মানুষ আতঙ্কিত হয়ে জেগে যায়। মস্তিষ্ক তখন এ আতঙ্কের কারণ নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। আর সেসময় ছায়া অনুভূত হতে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিসজনিত অনুভূতি নিয়ে প্রচলিত মিথ প্রভাব ফেলেছে সংস্কৃতিতেও। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, মুভ্যি এমনকি চিত্রকলায়ও ধরা পড়েছে সে হ্যালুসিনেশন। যেমন- ডেভিল ইন দ্য রুম ডকুমেন্টারিতে স্লিপ প্যারালাইসিসের বিভিন্ন মিথ ধরা পড়েছে। এমনকি ১৭৮১ সালে হেনরি ফুসেলির আঁকা তৈলচিত্র ‘নাইটমেয়ার’-এও পাওয়া যায় স্লিপ প্যারালাইসিসের ব্যাখ্যা। গবেষকদের মতে সমাজ, সংস্কৃতি আর পরিবেশ ভেদে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। যেমন- কারো কাছে ভূতের অস্তিত্ব অনুভূত হলেও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির লোকরা ওই ছায়াকে সিঁধেল চোর, ধর্ষক কিংবা ভীন গ্রহের প্রাণী হিসেবে মনে করতে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিস বংশগত হওয়ার কারণে যেকেউই এ ধরনের অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারে। কম ঘুম, ঘুমের বিঘ্নতা, কর্মক্ষেত্রে শিফট সিস্টেম ইত্যাদির কারণে অনেক সময় স্লিপ প্যারালাইসিসের অনুভূতি বেশি হতে পারে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষন্নতাও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। গবেষকদের মতে, বিষন্নতা দূর এবং পর্যাপ্ত ঘুমানোর পাশাপাশি আরও কয়েকটি কাজ মানুষ করতে পারে। তাদের মতে, যারা চিৎ হয়ে ঘুমান তাদের স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। সেক্ষেত্রে এমন কোন পোশাক পরা যেতে পারে যেন চিৎ হলে পিঠে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি হয়। এছাড়াও জেগে যাওয়ার পর যদি মনে হয় শরীর নড়াচড়া করা যাচ্ছে না, তখন সর্বশক্তি দিয়ে আঙ্গুল নাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। যখনই কোন পেশীকে নাড়ানো সম্ভব হবে তখন শরীরের নড়াচড়াও সম্ভব হবে বলেই বিশ্বাস গবেষকদের।
চলবে.