চেনা_পথে,অন্তিমপর্ব

0
589

#চেনা_পথে,অন্তিমপর্ব
#Tahmina_Akhter

ড্রইংরুমে সবাই উপস্থিত। সোফায় মাথা নীচু করে বসে আছে মাশফি। সকলের ভাবমূর্তি এমন যেন মাশফিকে চিবিয়ে খাবে। আদিবা ওর ভীতু চাচ্চুকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। আদিবা ওর চাচ্চুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

— যেভাবে বসে আছো মনে হচ্ছে প্রেম করতে গিয়ে দাদুর কাছে ধরা পরেছো। আরে তুমি বিয়ে করবে এই কথাটা বলতে এত সংকোচের কি আছে?

— ওকে আমি বিয়ে করাচ্ছি। প্রেম করে,, কিন্তু বলতে পারে না। বিদেশ গিয়ে দেবদাস বনে যায়। কেন রে ভালোবাসতে পারিস বলার সাহস নেই কেন তোর? এখন এই মাঝ বয়সে এসে বিয়ে করার ভূত মাথায় এলো কোত্থেকে? তোকে আমরা কেউই বিয়ে করাবো না। বিয়ে করার এত তাড়া থাকলে তোর বাপকে নিয়ে যা।

ছেলেকে আদুরে গলায় বকছেন মিনা। বাকি সবাই হাসছে আর মাশফি সেই আগের মতোই মাথা নীচু করে রেখেছে।

— এহন এমনে চেতো ক্যান বৌ? আমার পোলায় তো তোমারে এক দেখায় ভালোবাইসা বিয়া করছে। এহন আমি নাতির পছন্দের কথা হুইনা চেত দেহাইবা না। এই আদিবা তোর ওই ম্যাডামের খবর পাঠা। কি করন লাগব সব আমি বুঝব। ওগো ঢং দেখলে পিত্তি জ্বলে! নিজেরা ঢং কইরা বিয়া করব আর পেটের পোলাপাইনের পছন্দের কথা হুনলে তেলেবেগুনে ছ্যাত কইরা ওঠব।

বহুবছর পর শ্বাশুড়ি বৌয়ের সেই মান-অভিমান৷ অভিযোগ-অনুযোগ দেখে সবাই হাসছে। সেই পুরনো
দিনগুলো যেন হুট করে এসে ধরা দিয়ে গেলো।

আদিবা মোবাইল বের করে কল করলো মধুর নাম্বারে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো আদিবা গম্ভীর গলায় আদেশের সুরে বললো,

— আপনাকে সবাই দেখতে চাইছে এখুনি। দেরি করা যাবে না চটজলদি চলে আসুন। আপনার বখাটে প্রেমিক আজ নম্র ভদ্র হয়ে বসে বসে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ,, আপনি এলেই আজ তার রক্ষা হবে।

এদিকে আদিবার মুখ থেকে “বখাটে প্রেমিক” শব্দ শুনে মধু এবং মাশফি দুজনেই অবাক। মেয়েটা যে ওদের নাস্তানাবুদ করছে তা হারে হারে টের পাচ্ছে।

মধু পরনের শাড়ি আর বদলায়নি। হাতে মোবাইল আর পার্স নিয়ে তাড়াহুড়ো করে রওনা হলো মাশফিদের বাড়ির উদ্দেশ্য।

কারণ,, অন্তরালের কথা আজ প্রকাশ্যে আনতে হবে। কতকাল এভাবে নিজের কাছে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখবে???

— বখাটের প্রেমে পড়া সহজ! মোটেও না। বখাটের প্রেমে পড়া মানে সমাজের দেয়া একঝাক দুশ্চিন্তা। কিন্তু, এতকিছু জানার পরও আমি সেই বখাটের পরলাম। কেন পরলাম তাও জানা নেই কিংবা কখনো জানতে ইচ্ছে করেনি। কারণ, আমার বখাটে প্রেমিক কেবল আমার কাছে বখাটে ছিল। তার লেখা বাদে তার সম্পর্কে আর কিছু জানতাম কই? আমি শুধু এতটুকু জানি আমার এত সহজ-সরল জীবনে সেই বখাটে এসেছিল বলেই ভালোবাসার মতো এত স্নিগ্ধ ব্যাপারটাকে উপভোগ করতে পেরেছিলাম। হোক সেটা অল্প সময়ের জন্য তবুও তো ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম। স্বামী নামক মানুষটার ভালোবাসা হৃদয় স্পর্শ পাবার আগে বখাটে প্রেমিকের বখাটেপনা পরখ করে প্রেমে পরলাম। হৃদয়ের অত্যন্ত সুপ্ত কোণায় অবিরাম,, অন্তহীন ভালোবাসা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি। বলবার সুযোগ পেলাম কই? কিন্তু,, হুট করে সে আমার কাছে ক্ষতিপূরণ চাইলো। আমিও বোকার মতো তাকে বললাম,, আমাকে তার ভালোবাসা থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু,, সে রেগে গেলো ভীষন। চলে গেলো। এরপর, আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে কিছু টিপস দিলো ভালোবাসা বিষয়ক ব্যাপার নিয়ে।

মস্তিষ্কে ঢুকলো ব্যাপারটা। আসলেই ভালোবাসাহীন জীবন কতদিন অতিক্রম করা যাবে? যেই মানুষটা আমাকে ভালোবেসে বিরামহীন অপেক্ষায় থাকতে পারে নির্দ্বিধায় তাকে ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে দেয়া যায়। যে ভালোবাসা পাবার আশা বুকের সুপ্ত কোণায় রেখে এই দুয়ার থেকে ওই দুয়ার পর্যন্ত ঘুরে ফিরছিলাম। আজ সেই ভালোবাসা আমার দুয়ারে এসে শূন্য দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ফিরে যেতে দেই কি করে? হয়তো,,আর কিছু সময়ের অপেক্ষা তারপর আমি হয়তো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব এক গুচ্ছো লাল গোলাপ আর অজস্র ভালোবাসা নিয়ে সেই চিরচেনা পথে যেখানে প্রথমবারের মতো আমার বখাটে প্রেমিককে আমি দেখে ছিলাম।

********************************

মধু হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন চোখে অপেক্ষায় আছে প্রিয় মুখটাকে শেষবারের মতো আর একবার দেখতে। মধুর পরনে গোলাপি রঙা শাড়ি,, কপালের কয়েকগাছি চুল এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর এবড়োখেবড়ো হয়ে ঝুলে আছে। ঠোঁট শুকিয়ে আছে। চোখের পাপড়ি জলে ভিজে আছে। গালের ওপর চোখের জল গড়িয়ে শুকিয়ে দাগ পরেছে। বুকটার ভেতরে যে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ব্যাথা হচ্ছে তা যদি কাউকে দেখাতো পারত!

প্রিয়জন হারানোর বেদনা কেন এত কষ্টকর হয়? যাকে ভালোবেসে বুকে নিয়ে বাঁচবে বলে জীবন পণ করে সেই জীবন কেন ভালোবাসাকে একলা রেখে চলে যায়? আছে কি জবাব? নেই জবাব ।

যার সঙ্গে দেখা করবে বলে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিল। সেই মানুষটা নাকি ঘন্টাখানেক আগে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মধু কি খুব বেশি সময় নিয়েছিল? এই এক জীবনে মাশফিকে কখনোই তার “ভালোবাসি” কথাটি বলা হয়ে ওঠেনি। হয়তো,, আজকের পর আর বলার সুযোগ থাকবে না। মানুষটা যে নেই। অন্তরালের ভালোবাসা অন্তরালে রয়ে গেলো। জীবনের প্রতিটা পাতা শূন্য। শেষের পাতাটায় হয়তো প্রাপ্তি লেখার কথা ছিল। কিন্তু,, তাও শূন্য রয়ে যাবে। একেবারে শূন্য…

মাশফির কাটাছেঁড়া দেহটা নিয়ে আসছে দুটো লোক। সাদা কাপড়ে মোড়ানো দেহটার উপরিভাগে লাল রক্তের ছিটা। রক্ত দেখে আমার চোখমুখে অন্ধকার নেমে এলো। নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে! একজন এগিয়ে এলো আমার কাছে জিজ্ঞেস করলো,,

— উনাদের কি হোন আপনি???

আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি উত্তর দিব? আমি কি বলব যে,, তাদের বাড়ির মেয়েকে কোনো একসময় আমি পড়াতাম। নাকি এটা বলব তাদের ছোট ছেলের আত্মার আত্মীয় আমি। ভালোবাসায় কেন একটা নামের প্রয়োজন হয়? রোজ কত প্রেমিক-প্রেমিকা মরে কিন্তু তাদের জন্য কি তাদের ভালোবাসার মানুষ মন খুলে প্রকাশ্যে কাঁদতে পারে? পারে না। কারণ,, এই সমাজ মানবে না। সমাজের চাই নাম যে নামের রেষ ধরে একজন জীবিত মানুষ মৃত মানুষের জন্য মাতম করতে পারে। সবটা ভেবে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কাঁদতে পারি না।ভাবছি কোনটা বললে মানাবে? ভেবে দেখলাম কোনোটাই মানাবে না। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,,,

— শুভাকাঙ্ক্ষী।

— ওহ্ তাই বলুন। উনাদের আপনজন থাকবে কোত্থেকে বলুন তো? দুটো গ্যাস সিলিন্ডারের একটায় বোধহয় লিকেজ ছিল। আগুনের সংস্পর্শে এসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। ড্রইংরুমের পাশেই রান্নাঘর ছিল বুঝি। ড্রইংরুমে থাকা পরিবারের সবাই এই বিস্ফোরণে তৎক্ষনাৎ মরে গেলো। একজনও যদি বাঁচত তবে মনে শান্তি পেতাম। কিন্তু,, আফসোস কেউ বেঁচে নেই। দেখি আশপাশের কারো কাছ থেকে উনাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নাম্বার পাওয়া যায় কিনা?

লোকটা চলে যাচ্ছে। আমি তার চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছি। লাশগুলো কারো কাছে দিতে পারলে বুঝি নিজের ডিউটি শেষ হতো।

একে একে সবার লাশ মর্গের করিডোরে এনে রাখলো । মধু সাহস করে একবার করে সবার মুখ দেখতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সাহস জুটলো না। মনটা শুধু আকুপাকু করছিলো মাশফিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। মধু যখন লাশগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে মুখ মলিন করে দাঁড়িয়েছিল তখনি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো একজন ডোম যাচ্ছিলো। মধুকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,, কেন এভাবে দাঁড়িয়ে আছে?? মধু আস্তে করে বললো,,,

— মাশফি নামের একজন আছে উনার মুখটা দেখতে পারব?

মধুর মনের ব্যাকুলতা বুঝলো না কিনা লোকটা। করিডোরের শেষ মাথায় এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে সবার লাশ রাখা আছে। একটি লাশের সামনে দাঁড়িয়ে মধুকে ডাক দিলো। মধু ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে,, মাশফিকে একটুখানি দেখার জন্য।

সাদা কাপড়ে ঢাকা মুখটা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো কাপড়টা সরিয়ে দিলে। মুখটা অক্ষত আছে। সেই গুরুগম্ভীর মুখ,, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। কপালের উপরিভাগ কাপড় দিয়ে মোড়ানো। মধু খেয়াল করে দেখলো মাশফির শুষ্ক ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে আছে যেন। মধু হাত বাড়িয়ে মাশফিকে ছুঁতে চাইলো কিন্তু… সেই অধিকার মধুর নেই। মধু হাত গুটিয়ে নিয়েছে। চোখের জল অঝোর ধারায় গড়িয়ে পরছে। গলার কাছে যেন গগনবিদারী এক চিৎকার আঁটকে আছে। আপনজন কাউকে যদি পেত তাকে ধরে বুঝি এই চিৎকার দিয়ে মধুর বুকটা হালকা হতো। কিন্তু, কেউ নেই মধুর। কেউ নেই।

গেইট পেরিয়ে কেউ আসছে দৌড়ে দৌড়ে। করিডোরের সামনে এসে বলছে,,

— ইমতিয়াজ সাহেব আমার চাচা হোন।

কথাটি যেন ওখানে উপস্থিতরত পুলিশের জন্য খুশির বার্তা হিসেবে এসেছে। উঠে এলো সেই লোকটার সামনে।

আমি ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে বের হয়ে এলাম। পেছনে রেখে এলাম সেই মানুষটাকে যাকে সবার আড়ালে মন গহীনে লুকিয়ে ভালোবাসতাম । আজও তাকে ভালোবাসি। আগামীতেও তাকে ভালোবাসব তবে লুকিয়ে। কারণ,, ওপর ওয়ালা হয়তো কখনো চায়নি আমি মাশফিকে প্রকাশ্যে ভালোবাসি। তাকে ভালোবাসি ব্যাপারটা যেন এই সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখি। জীবনের কোনো কিছুর ওপর আর লোভ নেই। একজীবনে মানুষের যা পাওয়ার চাহিদা থাকে তা হয়তো সবাই পায় কেউ পায় না। আমি না হয় না পাওয়ার দলে রইলাম।

কিন্তু,, আসলেই কি আমি কিছু পাইনি?

মাশফির অব্যক্ত ভালোবাসা কি যথেষ্ট নয় আমার বেঁচে থাকার জন্য। আমার জীবনেও একটা ভালোবাসা প্রাপ্তির গল্প আছে। হয়তো আমাদের শারিরীক পূর্ণতা পায়নি কিন্তু একে অপরের কাছে মন বিলীনের পূর্ণতা কিন্তু ঠিকই হয়েছে।

হয়তো,, আর কিছু বছরের অপেক্ষা আমি একদিন চলে যাব না ফেরার দেশে। আর সেই দেশে হয়তো মাশফি আমার অপেক্ষায় থাকবে। আমাকে দেখলে বুঝি ভীষণ খুশি হবে! ততদিন অব্দি আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। সেই চেনা পথে আমাদের আবারও দেখা হবে। আকাশের বুকে ঠিক সেদিনের মতোই সূর্যের তীব্র আলো নিয়ে উঁকি দিবে। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ থাকবে। ব্যস্ততম শহরে আমাদের আবারও দেখা হবে। ঠিক সেদিনের মতো যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম। আমাদের আবারও ঝগড়া হবে,, লুকিয়ে প্রেম হবে। তারপর,, পরিণয় ঘটবে।

এতটুকু অপেক্ষা আমাকে করতে হবে….

পেছনে সবটা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে মধু। মধু কিছুই জানবে কি? আবৃত্তি,, আদিবা,, মিনা, ইমতিয়াজ , মাহবুব,, দাদি উনারা সবাই যে মধুর জন্য অপেক্ষা করছিল এটা কখনোই জানবে না।

মধু কি কখনো জানতে পারবে,, মাশফি মৃত্যুর আগে তাকে বৌ বানাতে চেয়েছিল? নাকি এটা জানবে মৃত্যুর আধ সেকেন্ড আগেও মাশফির চোখে শুধু মধুর ছবি ভাসছিল?? সেই হাসির রেষ ধরে যে মাশফির ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে আছে মৃত্যুর পরও।

সবটা অজানা রয়ে যাবে। শুধু থেকে যাবে মধুর জন্য মাশফির ভালোবাসাময় কাব্য।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here