চেনা_পথে,পর্ব-০২

0
494

#চেনা_পথে,পর্ব-০২
#Tahmina_Akhter

আদিবাকে পড়াতে গিয়েও বেশ নাজেহাল হতে হয়েছে মধুকে। কারণটা সেই উল্লুক মহাশয়। বই খুলে প্রশ্ন দেখছে আনসার সলভ করার জন্য কিন্তু দেখা যায় প্রশ্নের জায়গায় সেই সময়কার ঘটনাগুলো একের পর এক চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। মধুর কাছে ব্যাপারটা একেবারে লজ্জাজনক। মধুর খালা কিছুটা ইসলামিক মাইন্ডের। তো উনি একবার বলেছিলেন যে, চোখের সামনে খারাপ ভাসলে “আস্তাগফিরুল্লাহ” পরলে নাকি শয়তান খারাপ কিছু দেখা হইতে বিরত রাখে। মধু সেই কখন থেকে আস্তাগফিরুল্লাহ পাঠ করেই যাচ্ছে বিড়বিড় করে।

আদিবাকে আজ বেশি সময় নিয়ে পড়াতে পারলো না মধু। কিছু বাড়ির কাজ দিয়ে চলে যায়। মধুর আকস্মিক পরিবর্তন দেখে আদিবা অবাক হয়। কারণ,, মধু কখনোই পড়ার মাঝখানে উঠে চলে যায় না। তবুও তো ছোট মানুষ তাই এতকিছু না ভেবে বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ করতে থাকে আদিবা।

রাতের খাবারের সময়,,,

মাশফি, মাশফির বড়ো ভাই-ভাবি, আদিবা,, মাশফির বাবা-মা এবং দাদি সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলে খাবার খাচ্ছিলেন। খাবার খেতে খেতে আদিবা হুট করে ওর চাচ্চু মাশফিকে জিজ্ঞেস করে বসলো,,,

— চাচ্চু, তোমার ঘরে নাকি একটা উল্লুক আছে? আন্টিকে নাকি আজ ভীষন জ্বালিয়েছে! সেজন্যই তো আজ আমাকে বেশিক্ষণ পড়ায়নি৷

আদিবার কথাটি সবার ওপর বর্জ্যঘাতের ন্যায় পরলো। সবাই একে-অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মাশফির দিকে নজর দিলো। কিন্তু,, মাশফির ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ও এসবের কিছুই জানে না৷ মাশফির ভাবি এ্যানি ভাতের প্লেটে আঙুল দিয়ে আকিঁবুকিঁ করছে আর মাশফিকে জিজ্ঞেস করে,,

— এই চুপ করো আছো কেন? বিদেশ থেকে আসার সময় উল্লুক নিয়ে এসেছো নাকি? যদি এনে থাকো তবে ঠিকঠাক ভাবে রাখবে তো নাকি? বেচারা মধু নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়েছে!

শেষের কথাটি আফসোসের সুরে বললো এ্যানি। এ্যানির কথা শেষ হতেই মাশফির দাদি বলে ওঠলো,,

— নিজেই তো একটা উল্লুক। আবার বিদেশ থেইক্কা উল্লুক আইনা দেহনের কি আছে? আয়নার সামনে খাড়াইয়া নিজেরে দেখলেই তো উল্লুক দেহনের শখ মিট্টা যাইব গা।

দাদির কথা শুনে এ্যানি মুখ টিপে হাসে। বাকি সবার মনের অবস্থা বোঝা গেলো না। মাশফির তো গলা দিয়ে ভাত নামছে না। সব হয়েছে রোকেয়া বেগমের আপডেট ভার্সনের জন্য। দেখা হওয়ার পর থেকে একের পর এক বিশ্রী ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমাকে উল্লুক বলা তাই না? আজকের দিনের হিসাব আমি তোমার থেকে কড়ায় গন্ডায় নিব মিস রোকেয়া। আত্মবিশ্বাসী হয়ে মনে মনে কথাগুলো বলছে আর ভাতে খাচ্ছে মাশফি।

একে একে সবাই খাবার শেষ করে উঠে চলে যায়। বাকি আছে মাশফির বাবা-মা এবং দাদি। মাশফি চলে যেতেই মাশফির মা রেখা নিজের শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

— আম্মা, মাশফি বড়ো হয়েছে না? কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলেন?

বৌয়ের কথায় জবাব না দিয়ে পানের বাটা থেকে পান সাজিয়ে একটা ছেলের দিকে এবং আরেকটা বৌয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দাদি বললেন,,

— যেই কান্ড আইজকা করছে তোমরা দেখলে কি কইতা আমি হলফ কইরা কইতে পারি। বিদেশ থেইক্কা আইছে একটু দেইখা শুইনা চলতেই পারে। আদিবারে পড়াইতে আহে যেই মাইয়াডা সে না হয় ভুল কইরা মাশফির রুমে ঢুইকা পড়ছিল। মাশফির উচিত ছিল তারে সুন্দর করে বুঝাইয়া কওনের। কিন্তু, না হেয় মাইয়ারে এমন ডর দেহাইছে মাইয়া তো দুইবার কইরা এমন চিক্কুর মারছে আমি তো লাফাইয়া উঠছি। ঘর থেইক্কা বাইর অইয়া দেহি আদিবা আইসা ওর ঘরে লইয়া যাইতেছে। এটা ঠিক করে না মাশফি। হাজার বিদেশ থাকুক আদব-কায়দা হইছে বড়ো ব্যাপার৷ তুমি একটু বুঝাইবা। ভালো মাইয়া দেইখা বিয়ে পর করানের ব্যবস্থা করো। বিয়ার পরে সব তাংফাং বন্ধ হইয়া যাইব গা।

নিজের শ্বাশুড়ির কথার পিঠে আর কিছুই বললেন না মিনা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাকিরের মাকে ডাক দিলেন ডাইনিং টেবিলের এঁটো থালাগুলো রান্নাঘরে রেখে আসার জন্য। মাশফির মা চলে যাওয়ার পর মাশফির বাবা উঠে গিয়ে বেসিনে পানের পিক ফেললো। কুলকুচি করে মুখে পানি দিয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখটা মুছে আবারও ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসলো। তারপর,, আমতাআমতা করে উনার মাকে বললেন,,,

— মাশফির বিয়ের বয়স হইছে নাকি আম্মা? বাদ দেন ছোট মানুষ হয়তো একটু-আধটু দুষ্টুমি করছে তাই বলে কি বিয়ের মতো একটা ভয়ানক দায়িত্ব ওর ওপরে চাপানো ঠিক হবে?

ছেলের কথা শুনে সুফিয়া বিরক্ত হলেন বটে। মুখ শক্ত করে বললেন,,

— বিয়ার মতো এত ভয়ানক কান্ড তো তুমি মাশফির বয়সে থাকতে করছিলা৷ এতবছর পর আইসা তোমার মনে হইতাছে বিয়া ভয়ানক ব্যাপার!

মায়ের যুক্তিতর্ক শুনে জিহ্বায় কামড় দিলেন ইমতিয়াজ সাহেব। লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলেছেন তিনি। সুফিয়া বলতেই থাকলেন,,

— প্রেম কইরা বিয়া কইরা আনছো। মিনারে না পাইলে নাকি তুমি দেহত্যাগ করবা। দেহত্যাগ করার কি দরকার? তাই তো তোমার আব্বায় তোমারে বিয়া করাইয়া দিলো। তোমার মরণ পথের থেইকা ফিরাইয়া আনলাম কি এতবছর পর এই কথা শুনবার লাইগা যে বিয়া ভয়ানক ব্যাপার!

— আম্মা আপনি আমার কথার মানে বুঝেন নাই। আসলে মাশফির তো চালচলনের ঠিক নেই তাই বলেছিলাম আর কি? আপনি যা বলবেন তাই সই। যদি বলেন একমাসের মধ্যে মাশফির বিয়ে সারতে হবে তাই করব। তবুও আপনি রাগ গোস্বা কইরেন না আম্মা।

ছেলের কথায় মনে মনে পুলকিত হলেন সুফিয়া। তবে মুখে সেই আগের মতোই মুখে কাঠিন্যতা বজায় রেখে চেয়ার ছেড়ে ওঠে চলে গেলেন। মাকে চলে যেতে মাশফির বাবা ওঠে রওনা হলেন নিজের ঘরের দিকে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে এসে দেখলেন উনার স্ত্রী মিনা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। মা-ছেলের সবকথা শুনে ফেলেছেন নিশ্চয়ই । রাগে উনার মুখ লাল হয়ে আছেন। মাশফির বাবা তো গেঁড়াকলে পরেছেন আজ। নয়তো,, জীবনের দুজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারী আজই কেন ভয়াবহ কথাগুলো শুনিয়ে যাচ্ছেন এবং শুনে ফেলেছেন। টেনশনে দরদর করে ঘামাচ্ছেন ইমতিয়াজ। মিনা কিছু না বলেই সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। উনার পিছু পিছু ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ হাঁটছেন আর দোয়া করছেন যেন আজকে বৌয়ের কাছ থেকে পাওয়া সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা হতে নির্বিঘ্নে বেঁচে ফিরতে পারেন। আমিন…

—————————————–

মধু রাতের খাবার খেয়ে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বই পড়ছিল। বাংলা বিভাগের ছাত্রী। পড়তে পড়তে হুট করে মধুর মাশফির কথা মনে পরে গেলো। তেতো মুখ হয়ে এলে যেমন মুখ করে মানুষ ঠিক তেমনি ভাব করলো মধু। উল্লুকটাকে নিয়ে ভাবতে চায় না তাই পড়ায় মনোনিবেশ করে কিন্তু মনটা যেন মাশফির কাছ থেকে ফেরতই আসতে চাইছে না! ভারী অদ্ভুত তো! নয়তো এমন উল্লুকের কথাই বা মনে পড়তে যাবে কেন? মধুর তেইশ বছরের জীবনে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি যেটা আজ দুপুরে ঘটে গিয়েছে। মধুর ভুল হয়েছে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু,, নিজের ঘরে এতটা বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে চলা কি ঠিক? ভদ্র ছেলেরা সবসময় ভদ্রতা দেখিয়ে চলবে আর উনি কিনা,, ছিহহ্…

ভাবতেই লজ্জা লাগছে মধুর।

সেই রাতে মধুর আর পড়াশোনা করা হলো না। উল্লুকের চিন্তা-ভাবনা থেকে বাঁচার জন্য ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা চলছিল। বৃথা চেষ্টা একসময় সাফল্য পায়। আশ্চর্যজনক হলেও অনেকগুলো বছর পর আজই রাত দশটার আগে মধু ঘুমোতে গিয়েছে। নয়তো,, মধু তো ফজরের আযানের আগে কখনো ঘুমাতে যায় না।

—————————

— নিজেই মাতবরি করে আমার ঘরে ঢুকে আবার নিজেই চিৎকার করে আমার কানের বারোটা বাজিয়ে আমার ইজ্জতের রফা দফা করে আবার আমাকেই উল্লুক সাজানো হয়েছে? বাহ্ আমার লাইফে কি দু’জন নারী কম ছিল যে আরও একজন বিশেষ নারীর সঙ্গে ওপর ওয়ালা সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছেন। নারীজাত কেন একধাপ এগিয়ে থাকে বুঝি না?

কথাগুলো নিজের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে মাশফি। মেসেঞ্জারে গ্রুপ কলে সব বন্ধুরা মাশফির কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। বন্ধুদের হাসি দেখে মাশফি রাগ দেখিয়ে বললো,,

— হাসার মতো কি বললাম আমি? দেখ তোরা এখন আবার মজা নিস না।

আকাশ নামের বন্ধুটা বলে উঠলো,,,

— না ভাই হাসার মতো কিছু হয়েছে নাকি?

কথাটি বলে আমার অট্টহাসিতে মেতে উঠলো সব বন্ধুরা। মাশফি ওদের ঠাট্টা-তামাশা হজম করতে না পেরে কল কেটে ডাটা অফ করে শুয়ে পরে। চোখ বন্ধ করতেই বেগম রোকেয়ার আপডেট ভার্সনের ভয় পাওয়া চেহারাটা ভেসে ওঠে। একটা ছেলকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখলে যে একটা মেয়ে এতটা ভয় পেতে পারে জানা ছিল না মাশফির। হুট করে মাশফির মনে পড়লো বেগম রোকেয়ার দৌড়ে যাওয়ার সময় দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খাওয়ার কথা৷ আফসোস সুরে মাশফি মনে মনে বলে উঠলো,,

— নিশ্চয়ই ভীষণ ব্যাথা পেয়েছিল?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here