চেনা_পথে,পর্ব-০৩

0
312

#চেনা_পথে,পর্ব-০৩
#Tahmina_Akhter

আমার জন্মের পর থেকে আজকের রাতের মতো এমন ভয়াবহ রাত বুঝি আর কোনোটাই যায়নি। রাতে স্বপ্ন দেখলাম,,

দূর পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছি,, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যেন মেঘ ছুঁতে পারি। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলাম নিবির্ঘ্নে। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্য দেখলাম; সূর্যদোয়ের। সূর্যদোয়ের চমৎকার দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার হাত ধরে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ফেললাম,,

“পৃথিবীতে তোমার পরে কাউকে দেখে বুঝি এত চমৎকার লাগলো আমার চোখে”

মেয়েটা আমার কথার পিঠে কিছু বললো না। মুচকি হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমি তার মাথায় চুমু খেতে যাব ওমনি সে মাথা উঁচু করে তাকালো আমার দিকে। ব্যস আমি শেষ!

ঘুমের মাঝে বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠলাম। ঘামে জবজবে শরীর,, নিঃশ্বাস ফেলছিলাম টেনে টেনে। কপালের ঘাম টুকু হাতের পিঠে নিয়ে মুছে ফেললাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায়। মিনিট দশকে লাগলো। তারপর, ঠিক আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসছিলাম। দুহাত দিয়ে কপালের চুলগুলো আঁকড়ে ধরলাম শক্ত করে। ভাবছি স্বপ্নের কথা। আমরা নাকি স্বপ্নে তাকেই দেখি যার কথা আমার সবসময় ভেবে পাড় করি। কিন্তু,, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে ভাববার মতো কিছুই নেই। ওর সঙ্গে মাত্র দুবার দেখা হয়েছে যদিও দুবারই দূর্ঘটনা হয়েছে। এরকম একটা মানুষ যে কিনা বাস্তবে ভেজালযুক্ত তাকে নিয়ে মিষ্টি স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না ।

মাশফি বালিশের নীচে থাকা মোবাইলটা নিয়ে সময়টা দেখলো ; তিনটা পয়তাল্লিশ। মাশফির তো এবার আরও ভয় হচ্ছে কারণ ওর দাদি বলে শেষ রাতের খোয়াব নাকি সত্যি হয়। সত্যি সত্যি কি মাশফির স্বপ্ন পূরণ হবে?

না আর কিছুই ভাবতে পারছে না মাশফি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। যা হবার হবে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? সামান্য স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতবাণী করার মতো বোকা লোক মাশফি নয়।

দীর্ঘ সময় নিয়ে চেষ্টা করার পরও মাশফির ঘুম এলো না। ফজরের আযানের কিছু সময় পর মাশফি বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে রুম থেকে বের হয়। হলরুমের কাছে যেতেই ওর বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। মাশফির বাবা ছেলেকে এত ভোরে ওমন পোশাকে দেখে অবাক হলেন। মাশফি ওর বাবাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,,

— চলেন বাবা একসাথে নামাজ পড়তে যাই।

ছেলের কথা খুশি হলেন। অতঃপর বাবা-ছেলে মিলে মসজিদে চলে গেলেন। নামাজ শেষ হলো। মাশফির বাবা আর কিছু সময় মসজিদে থাকবেন। কোরআন তিলাওয়াত করবেন। তাই মাশফি ওর বাবাকে রেখে বাড়ির পথে রওনা হয়েছে।

তিনবছর পর ঠিক এমন ভোরের দেখা মিললো৷

স্নিগ্ধ পরিবেশ,, শীতল হাওয়া,, থেকে থেকে দুএকটা রিকশার বেলের আওয়াজ,, চায়ের দোকান কিংবা হোটেলের শাটার খোলার শব্দ,, রাস্তার কোল ঘেষে থাকা ডাস্টবিনে কিছু কুকুরের আনাগোনা সবটাই যেন নতুন করে দেখতে পাচ্ছে মাশফি।

ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মাশফি ভাবছে সময় কত দ্রুত চলে যায়। এই তো কিছু বছর আগেও মাশফির এমন ছোটখাটো বিষয়ে সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করা হতো না। চোখের মুগ্ধতা তো পরের বিষয়। অথচ আজ সবটাই কেমন মুগ্ধ করে যাচ্ছে তাকে! হয়তো বিদেশের মাটিতে এমন ভোরের দেখা মেলেনি তাই! বিদেশে সবকিছুই কেমন পরিপাটি!

বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছেতেই মাশফি কাউকে দেখতে পেলো। খুব পরিচিত মুখ। মাশফি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা মাশফির উপস্থিতিতে বেশ খুশি গেলো। দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মাশফিও তাই । এত বছর পর বন্ধুকে দেখতে পেয়ে আনন্দিত হবারই কথা৷

— তুই সেই আগের মতো পাটকাঠি আছিস! আর আমাকে দেখ পেটের ভুড়ি আমাকে রেখে আধহাত আগে হাঁটে।

মাশফি ওর বন্ধুর কথা শুনে হাসতে হাসতে কাঁধে চাপড় দিয়ে বললো,,,

— সেটা তো দেখেই বুঝতে পেরেছি। তা কেমন আছিস???

— ভালোই আছি। বিয়ে-শাদি করে ফেললাম মাসখানেক হলো।

— কি বলিস! যোগাযোগ না-হয় আমার সাথে ছিল না। কিন্তু,, বাকিদের সঙ্গে তো ছিল। ওদেরকে জানালে কি হতো?

— পারিবারিকভাবে বিয়ে। আমি এখনো চাকরি পাইনি। এখনো সেই ব্যাচেলর আছি নামে মাত্র কারো স্বামী হলাম৷ চাকরি-বাকরি হোক তারপর ঘটা করে তোদের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবো সাথে আমার বৌয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব৷

মাশফি ওর বন্ধুর কথায় খুশি হলো। বাড়ির ভেতরে আর না যেয়ে দুই বন্ধু মিলে রহমান কাকার হোটেলে চলে গেলো সকালের নাশতা খেতে। বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে রোজ সকালে রহমান কাকার হোটেলের নাশতা খেয়ে দিনের শুরু হতো। ওর মায়ের হাতের সকালের নাশতা খুবই কম খাওয়া হতো। কারণটা হলো বাকিসব বন্ধুরা এই হোটেলে দলবেঁধে খেতে আসত।

রহমান কাকা প্রথমে মাশফিকে দেখে চিনতে পারলো না। পরে বাদল যখন পরিচয় করিয়ে দিলো তখন রহমান কাকা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে মাশফিকে বললো,,

— বিদেশ থেইক্কা আইছেন! আমি তো স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমার এত ছোট্ট হোটেলে আপনারে আর কখনো দেখতে পামু। কি খাইবেন কন?

— আগে যা খেতাম আজও তাই খাব৷ দুধ চা আর পরোটা। যদি ডিম থাকে তবে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কেটে দুটো ডিম ভেজে দেন।

তৎক্ষনাৎ রহমান কাকা উনার হোটেল বয়কে ডাক দিয়ে বলে দিলেন স্পেশালি নাশতা বানিয়ে দিতে। পনেরো বছরের ছেলেটা এর আগে কখনো দোকানের মালিককে খুশি হতে দেখেনি। হয়তো,, সুন্দর ভাইটারে দেইখা এত খুশি হইছে! ছেলেটা মালিকের হাসিমুখ দেখে তারাতারি রান্নাঘরে চলে গেলো নাশতা তৈরি করতে।

নাশতা খাওয়া শেষ। বাদল চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মাশফির অনুরোধে যেতে পারেনি। মাশফির কথা হলো এতবছর পর যেহেতু দেখা হয়েছে তবে আজ সারাদিন ঘুরাঘুরি করে তারপর বিকেলে বিদায় নিতে হবে তার আগে নয়। বাদল তো আর বন্ধুর কথা ফেলতে পারবে না। তাই সেও রাজি হয়ে যায়।

একটি রিকশা নিয়ে শহরের এই প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়ায়। কাজির দেউরি জাম্বুরি পার্ক,, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত,, শেষমেষ শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাটালি পাহাড় কিংবা লোকমুখে বলা জিলাপির পাহাড়ে চলে যায়।চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রামের শহরের সর্বাধিক উঁচু পাহাড়। এর উচ্চতা প্রায় ২৮০ ফুট। এই পাহাড়ের চূড়া থেকে বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম শহরের বড় অংশ পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।

পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস ছেড়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে মাশফি বললো,,

— জায়গাটা আগের মতোই আছে রে। শুধু বদলে গেছি আমরা। সব বন্ধুদের এখন কত ব্যস্ততা! চাইলেও হুটহাট প্ল্যান করে দেখা করা সম্ভব নয়।

বাদল মাশফির মনের অবস্থা বুঝতে পারে। মাশফির কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনার সুরে বললো,,

— সবে তো দেশে এলি। দেখবি সবাই মিলে একটা নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে ট্যুরে বের হয়ে গেছে। তো অন্য কথা বল । বিয়ে শাদি করবি??

বাদলের কথায় হাসতে গিয়েও মুখ অন্ধকার হয়ে আসে মাশফির । কারণ, গতরাতের সেই স্বপ্ন আবারও এসে হানা দেয় মাশফির চোখের সামনে। মাশফি দুবার চোখের পলক ফেলে সেই দৃশ্যটুকু সরিয়ে বাদলকে বললো,,,

— দেশে এলাম দেখি কি যায় করা ? তবে বিয়ে তো তাকেই করব যাকে দেখলে মাশফির পাষন্ড হৃদয় গলবে৷ কলেজের দিনগুলোতে তানিয়া তো আবার আমাকে “মাশফি পাষন্ড” নামে ডাকত।

তানিয়ার কথা মনে পরতেই বাদল হাসতে হাসতে বললো,,,

— বেচারি কিন্তু তোকে সত্যি সত্যি ভালোবাসত। তুই পাত্তা দিলি না।

— ওর আমাকে দেখলে স্পেশাল ফিলিংস হয় আমি এটার সম্মান করি। বাট আমার ওকে দেখলে বন্ধু বৈ আলাদা কোনো ফিলিংস আসেনি। হয়তো ওর মন রাখতে আমি ওর সঙ্গে একটা সম্পর্কে যেতাম কিন্তু সেই সম্পর্কটার ভবিষ্যত কি হতো? কিছুই হতো না। হয়তো তানিয়া একসময় আমার কাছ থেকে কিছু না পেয়ে চলে যেত। কিন্তু ওর মন ভাঙার বদদোয়া তো ঠিকই আমার ওপরে এসেই পরতো। ভাই যেভাবে আছি ঠিক আছি। ওসব প্রেম-ভালোবাসা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। যদি আমার বৌটা এসে আমাকে কিছু প্রেম-ভালোবাসা শেখায়?

কথাটি বলে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে মাশফি। আর বাদল তো ওর কান্ড দেখে হাসছে।

———————-

বিকেল চারটায় রোজ নিয়ম করে আদিবাকে পড়াতে আসে মধু। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। অন্যান্য দিনে যদিও এতটা সংকোচ হতো না কিন্তু গতকালের সেই ইন্সিডেন্টের পর থেকে মধুর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।

বাড়িতে ঢুকার পর থেকে আদিবার রুমে যাওয়া পর্যন্ত অসংখ্যবার চোরা চাহনিতে মাশফি নামক উল্লুকটার অস্তিত্ব আছে কিনা খুঁজে বেড়িয়েছে। যদিও পায়নি তবুও মধুর মনে শান্তি।

আদিবাকে পড়াতে বসলো। আদিবা বাংলা পড়ছিল এমন সময় মধু ওকে জিজ্ঞেস করলো,,

— তোমাদের বাড়িতে মেহমান এসেছে?

— জি আন্টি। আমার ছোট চাচ্চু এসেছে। তাও আবারও থ্রী ইয়ারস লেটার।

— উল্লুকের মতো দেখতে ওটা তোমার চাচ্চু?

মধু কেমন করে যেন নাক সিটকে কথাটি বললো। আদিবার মন খারাপ হলো। কেন তার চাচ্চু কি দেখতে শুনতে খারাপ? ওর চাচ্চু হচ্ছে পুরো ওয়ার্ল্ডের মধ্যে মোস্ট ওয়ান হ্যান্ডসাম মেন। আচ্ছা,আন্টির কি আমার চাচ্চুকে দেখে পছন্দ হয়নি?

— কি হলো কথা বলছো না কেন? তোমার চাচ্চুকে নিয়ে কমেন্ট করায় মন খারাপ করেছো?

আদিবা নিশব্দে লিখতে লাগল। মধু বুঝতে পারলো আদিবা মন খারাপ করেছে। তাই আদিবাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না কারণ আদিবা উত্তর দেবে না।

দেড় ঘন্টা পর যখন ছুটির সময় হয়ে এলো তখন মধু আদিবাকে পরেরদিনের পড়া দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে। আদিবা আজ মধুকে বায় বলেনি এটা নিয়ে অবশ্য মধুর মন খারাপ হয়েছে । মনে মনে সেই উল্লুকটাকে আচ্ছামতো বকে যাচ্ছে। কারণ,, আদিবার মন খারাপের কারণই তো হচ্ছে সে।

সদর দরজার কাছে যেতেই কেউ মধুকে পিছু ডাকলো। মধু পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো দাদি দাঁড়িয়ে আছেন সঙ্গে আদিবার মা আবৃত্তি। মধু সেদিকে এগিয়ে যায়। দাদি নিজের জায়গায় থেকে একটু সরে এসে মধুকে বসতে বললো। মধুর আরেকটা টিউশন আছে এবং দেরিও হচ্ছে কিন্তু যেতেও পারছে না। মধু চুপচাপ বসলো।

— তুমি আমার নাতিরে উল্লুক কইলা ক্যান? সে কি দেখতে উল্লুকের মতো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here