চেনা_পথে,০৪

0
330

#চেনা_পথে,০৪
#Tahmina_Akhter

মধু আহাম্মক হয়ে গেলো! উল্লুককে উল্লুক বলেছে সমস্যা কোথায়? এ.এ.এক মিনিট উনার নাতিকে আমি উল্লুক বলেছি উনি এটা কোত্থেকে জানলেন? নিশ্চয়ই আদিবা? হায় আল্লাহ ; মধু এখন তোর কি হবে?

মধু মাথা নীচু করে সমীকরণ সমাধান করছিল। এদিকে আবৃত্তি আর দাদি মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ,, উনারা তো জানেনই যে মধু নিশ্চয়ই ভোল পাল্টাবে এবং বলবে সে এসবের কিছুই বলেনি।

— এই যে কথা কও ক্যান?

মধু শুকনো ঢোক গিললো। কারণ, উত্তর দেয়া ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই।

— আসলে হয়েছে কি? গতকাল আমি যখন আদিবাকে পড়াতে এসেছিলাম তখন ভুল করে আদিবার রুমে না ঢুকে পাশের ঘরে ঢুকে পরেছিলাম। তো সেখানে আগে থেকে যে আদিবার চাচ্চু ছিল এটা তো আমি জানতাম না। উনাকে টাওয়… ওম..ম।

দাদি আর আবৃত্তি চোখদুটোকে হাসের ডিমের আকৃতি ধারণ করে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দু’টোর মাঝে ইয়া বড়ো হা হয়ে আছে। কারণ,, মাশফি এসে মধুর মুখ চেপে ধরে রেখেছে। যার কারণে মধু কথা বলতে পারছে না।

অবাকের রেষ কাটিয়ে দাদি এগিয়ে এসে মাশফির কাছ থেকে মধুকে রক্ষা করলেন। মধু মাশফির কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে থাকে। আবৃত্তি মধুর অবস্থা দেখে দৌঁড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে এবং মধুকে পান করতে দেয়। মধু ঢোক ঢোক করে এক গ্লাস পানি নিমেষেই শেষ করে ফেললো।

— এই তুমি যাও। আগামীকাল ঠিক সময় আইয়া পড়বা। কথা আছে তোমার লগে?

দাদি মধুকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলে মাশফির কান ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজের ঘরের দিকে। এদিকে আবৃত্তি পরেছে দোটানায় মধুকে এগিয়ে দিয়ে আসবে নাকি মাশফির পেছনে যাবে। শেষমেশ বেচারি সিদ্ধান্ত নিলো মধুর পেছনে যাবে। কিন্তু,, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে মধু চলে গেছে। বাকি রয়ে গেছে মাশফি তাই ওর কাছে যাওয়া যায়।

আবৃত্তি ওর দাদি শ্বাশুড়ির ঘরের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লক করা। আবৃত্তি সাহস করে একবার দরজায় নক করেছিল। কিন্তু,, দাদির ধমক শুনে সুড়সুড় করে চলে আসে সেখান থেকে ।

দাদির ঘরের এককোনায় চেয়ারে বসে আছে মাশফি। ওর সামনে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দাদি। মাশফি বুঝতে পারছে যা কিছু করেছে ঠিক করেনি। এবার তো সন্দেহের তীর ওর দিকে এসেছে।

— তোমারে আমি আগেও কইছি এহনও কই বিয়াশাদী করো। কিন্তু, তুমি তো কথা শুনবার লোক না। আদিবার টিচারের মুখ চাইপা ধরছো আমাগো সামনে৷ তোমার দেহি লজ্জা শরম সবই শেষ। আর গতকাল কি কান্ড ঘটাইছো? মাইয়ারে কইতে দিলা না ক্যান?

শেষের কথাটি বলতেও দাদি কেমন সংকোচ ভুগছিলেন। মাশফির ওর দাদির কথার মমার্থ বুঝতে পারে। নিজের কপাল দেয়ালে গিয়ে ঠোকাতে ইচ্ছে করছে। কেন যে করতে গেলো?

— দাদি আপনি ভুল বুঝেছেন। আসলে হয়েছে কি গতকালের বিষয়টা কিছুটা পার্সোনাল ইস্যু। কিন্তু,, আদিবার টিচার আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে যাচ্ছিলেন তাই আমি উনাকে বাঁধা দিয়েছি। এর থেকে বেশি কিছু না।

— আদিবার টিচারের লগে তোমার পারসোনাল ইস্যুটা কি? এই তুমি ওই মাইয়ার লগে খারাপ কিছু করো নাই তো???

— ছিহ্ দাদি আপনি এমনটা ভাবতে পারলেন আপনার নাতিকে নিয়ে? আমি বলেছি না আপনাকে তবুও কেন বিশ্বাস করছে না!

মাশফি কাঁদোকাঁদো হয়ে কথাগুলো বলতেই ওর দাদির মুখ থেকে সন্দেহের ছাপ কিছুটা দূর হলো। মাশফিকে চলে যেতে বললেন। মাশফি তো ছাড়া পেয়ে একদৌঁড়ে নিজের ঘরে। বাপরে আজ বড়ো বাঁচা বাঁচলো!

মধু আজ ওর অন্য টিউশনিতে যায়নি। বেচারির শরীর কাঁপছে এখনো। প্রথমে দাদি এরপর নাতির আকস্মিক কান্ড দেখে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে।

মধুকে অবেলায় ঘরে দেখে যারপরনাই অবাক হয় ওর রুমমেট তুশি । মধুর সামনে গিয়ে আস্তে করে বললো,,

— কি হয়েছে রে মধু? অসময়ে তুই বাড়িতে?

তুশির গলা শুনে মধু কপাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে উঠে বসে। মনমরা হয়ে ছোট জানালার গ্রীল গলিয়ে দেখা উঁচু ইমারতের দিকে তাকিয়ে থাকে। মধুর যে আজ মন খারাপ তুশি বুঝতে পারলো। মধুর পাশে বসলো। তারপর,, মধুর হাতের ওপর একটি হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,,

— কি হয়েছে রে?

মধু তুশির দিকে না তাকিয়ে আনমনে বললো,,

— জানি না রে কি হয়েছে? কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসতে পারলে মনের শান্তি মিলত। শহরের বুকে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রে ভীষণ ।

শেষের কথাটি বলতে গিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠলো মধু। তুশি মধুর মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। দীর্ঘ একবছর ধরে পড়াশোনার তাগিদে এই শহরে বাস করছে মধু। ইদের ছুটিতে বাড়িতে যায়নি শুধুমাত্র বাড়তি খরচ হবে বলে। যেটুকু সে খরচ করে যেতে সেটুকু টাকা সে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় বাবা-মায়ের জন্য। হয়তো,, আজ মধু হাঁপিয়ে ওঠেছে। তুশি মধুকে বললো,,

— আজ তো ২ তারিখ দশ তারিখে তো তোর সবগুলো টিউশনি থেকে বেতন আসবে। একটা কাজ কর বেতন পাওয়ার পর তুই বাড়িতে গিয়ে তোর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে আয়।

তুশির কথা শুনে মধুর মনে হলো,, আসলেই তো এমাসে বাড়িতে গেলে মন্দ হয় না। মধু চট করে চৌকি থেকে নেমে তুশিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,,

— ধন্যবাদ বান্ধবী। ছেলেটাকে পড়িয়ে আসি নয়তো ওর মা বেতন কেটে রাখবে।

মধু ওর ব্যাগটা নিয়ে চলে যায়। এদিকে তুশি মধুর কান্ড দেখে হাসছে। মেয়েটা ওপর থেকে নিজেকে যতটা শক্ত দেখায় আদৌও ভেতর থেকে একেবারেই নরম মনের।

************

সময়টা শুক্রবার দিন,,,,

আদিবাকে আজ পড়াতে এসেছে মধু। গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকার সময় দারোয়ান মামার সঙ্গে দেখা হলো মধু। দারোয়ান মামা মধুকে দেখে বললো,,

— ম্যাডামে আদিবা মামনিরে নিয়া উনার বাবার বাড়িতে গেছে। আজকে বাড়িতে চইলা যান আপনে।

মধুর মন খারাপ হয়ে গেছে এমন কথা শুনে। কারণ, আজ দশ তারিখ। মধু ভেবেছিল আদিবাকে আজ এক্সট্রা পড়িয়ে যাওয়ার সময় ওর মায়ের কাছ থেকে বেতন নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু…

মধু মন খারাপ করে গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় কারো বুকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে! মধু নিজেকে সামলাতে পারে না পরেই যাচ্ছিলো কিন্তু,, দুটো বলিষ্ঠ হাত আঁকড়ে ধরে মধুকে। মধু ও আল্লাগো বলে সেই যে চোখ বন্ধ করেছে আর খুলছেই না।

এদিকে মধুকে এমন অবস্থায় দেখে দারোয়ান মামা আর মাশফি ভেবেছে হয়তো সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মাশফি দারোয়ান মামাকে পানি আনার জন্য অনুরোধ করতে না করতেই মধু এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়। মাশফি যদিও নিজেকে সামলে নেয়। মধু ওর গায়ের ওড়না খুব ভালো করিয়ে জড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধৃত হয় কিন্তু পেছন থেকে মাশফির ডাক শুনে থেমে যেতে হয় তাকে। মধু আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নীচু করে। কারণ, এই মানুষটার সঙ্গে দেখা হলেই একটা না একটা কান্ড ঘটে যায় ওদের ঘিরে। নরমাল হলে মানা যায় ব্যাপারটা এমন হয় যে গায়ের সঙ্গে গা মিলে যায়। পুরো ব্যাপারটাই বিদ্ঘুটে।

— আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?

মাশফি মধুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে। মধু মাথা নীচু করে জবাব দেয়,,

—আদিবা বাড়িতে নেই।

— ও আচ্ছা।

মাশফি চুপ হয়ে যায়। এদিকে মধুরও চলে যাওয়ার সময় হচ্ছে। শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি? তাই মধু চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। হুট করে মধুর মনে হলো আদিবার চাচ্চুকে বলে দেয়া যে,, ও কিছুদিনের জন্য বাড়িতে যাবে। বাড়ি থেকে এলেই আদিবাকে পড়াতে আসবে।

যেই ভাবা সেই কাজ মাশফিকে কথাগুলো বলে মধু চলে আসে। রাস্তার ফুটপাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মধু। মাথায় হাজারো দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। একটা টিউশনির টাকা না হয় পেলো না কিন্তু অন্য দুটোতে যদি না পায় তখন কি করবে মধু? এদিকে বাড়িতে সবাই জেনে গেছে আগামীকাল সকালে মধু বাড়িতে যাবে। প্ল্যান ক্যানসেল করার কোনো ওয়ে নেই। ভাবতে ভাবতে অন্য ছাত্রীর বাড়িতে পৌঁছে যায় মধু।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে আসে মধু। দুটো টিউশনির টাকা পেয়েছে। এতেই ভীষন খুশি মধু। ফিরে আসার পথে জামানো কিছু টাকা দিয়ে বাবার জন্য একজোড়া ভালো জুতা,,মায়ের জন্য একটা শাড়ি নিলো মধু।

ব্যাগ গুছিয়ে রান্না করতে চলে যায় মধু। একেকদিন একেকজন রান্না করে এটাই নিয়ম। ওরা চারজন বান্ধবী মিলে সাবলেটে থাকে। চারজনের চোখে অভিন্ন স্বপ্ন কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সবারই একই প্রচেষ্টা।

শাক ভাজা,, আলু ভর্তা,, পাতলা ডাল,, আর ধোঁয়া ওঠা এক প্লেট গরম ভাত তৃপ্তিসহকারে খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো মধু। কারণ,, আগামীকাল খুব ভোরে ওঠতে হবে। সকাল সাতটার বাসে করে রওনা হতে হবে।

যথারীতি ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলো মধুর। গোসল সেরে নতুন একটা সুতির থ্রী-পিছ পরে নিলো। গাড়ো গোলাপি রঙের জামা। ওড়না পাজামা সাদা রঙের। কোমড় অব্দি ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। শুকিয়ে গেলে বেঁধে ফেলবে। চোখে একটুখানি কাজল৷

সব বান্ধবীরা তখনও ঘুমিয়ে কাঁদা। মধু তুশির কাছে গিয়ে ওকে ডেকে তুললো। এরপর,, বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। অপেক্ষা করতে থাকে একটা রিকশার জন্য।

মিনিট দুয়েক যাবার পর একটি রিকশা আসে। তাতেই ব্যাগটা উঠিয়ে তারপর নিজেও বসে পরে মধু।

রিকশা কিছুদূর এগুতে পারেনি তারআগে কেউ একজন মধুর নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। মধু প্রথমে অবচেতন মনের ভুল ভাবে। কিন্তু,, ডাক যখন বারবার আসছিল তখন মধু রিকশার পেছনে তাকিয়ে দেখলো,, আদিবার চাচ্চু ওকে ডাকছে। বেচারা দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসছে।

মধু রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে অনুরোধ করে। রিকশা থামলো মধু নেমে পরলো। ততক্ষণে মাশফি এসে রিকশার পাশে থামলো। বেচারা হাঁপিয়ে ওঠেছে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলছে। মধু উনার এমন অবস্থা দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,,

— পানি খাবেন??

মাশফি হাত উঁচিয়ে বারণ করলো। তারপর, সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পকেট থেকে একহাজার টাকার নোট তিনটে বের করে মধুর দিকে বাড়িয়ে দিলো। মধু একবার টাকার দিকে তাকিয়ে আবারও মাশফির মুখের দিকে তাকায় উত্তরের আশায়।

মধুকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাশফি বললো,,

— ভাবি গতকাল রাতে আপনার বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে আমাকে পাঠালেন আমি যেন আপনাকে টাকাটা দিয়ে যাই। ঠিকানা নিয়ে এখানে এসে দেখলাম আপনি রিকশায় চড়ে রওনা হচ্ছেন। এত ডাকলাম শুনলেন না তাই দৌড়ে পিছু নিতে হলো।

মধুর মাশফির প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ হলো। কারণ,, মানুষটা এত সকালে কষ্ট করে না এলেও পারত। কিংবা রিকশার পেছনে এত কষ্ট করে দৌঁড়ে টাকাটা না দিলেও পারত৷ মানুষটাকে খারাপ ভেবেছিল কিন্তু ওতটাও খারাপ না সে।

মধু ধীরে ধীরে ওর হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলো। টাকাটা ব্যাগে ভরে রিকশায় ওঠ বসলো। মাশফি রিকশার সামনে এসে বললো,,

— আসলে প্রথম দিনের ঘটনার জন্য সরি।

— সমস্যা নেই। ভুল মানুষেরই হয়। আমি ভুল করে আপনার রুমে ঢুকে পরেছিলাম সেদিন। ভুলটা আমারই হয়েছে । ভালো থাকবেন।

— আপনিও ভালো থাকবেন। বায়।

মাশফি হাত নাড়িয়ে মধুকে বিদায় জানালো। মধু প্রতিউত্তরে একটুখানি হাসলো। রিকশা চলতে শুরু করেছে।

মধুর সেই একটুখানি হাসি যেন মাশফির মুখে বড়ো হাসি ফুটিয়ে তুলেছে।সেই একটুখানি হাসি যেন বড়ো কিছু কেড়ে নিয়েছে মাশফির। নয়তো ওর চোখের সামনে থেকে সেই হাসিমুখটা সরতেই চাইছে না কেন? চোখ বন্ধ করে শুধু সেই মুখটাই ভাবতে ইচ্ছে করছে মাশফির।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here