চেনা_পথে,০৭,০৮

0
245

#চেনা_পথে,০৭,০৮
#Tahmina_Akhter

৭.

— দাদি গো,, ও দাদি তোমার নাতি বুঝি আর বেশিদিন এই পৃথিবীতে বাঁচবে না।

কথাটি বলতে বলতে দাদির কোলে মাথা পেতে শুয়ে পরলো মাশফি৷ মাশফির দাদি নাতির মুখ ওমন কথা শুনে তওবা তওবা বললেন৷

— তওবা তওবা বললে কি আর সবটা মিটে যাবে? আমার জন্য দোয়া করো।

— ক্যান কি হয়েছে তোর? এমন কথা কইতাছোস ক্যান?

মাশফি ওঠে বসলো। ওর দাদির হাত নিজের হাতের মুঠোয় এনে বললো,,

— দাদি তোমার ভাষায় আমার মনে রঙ লেগেছে। এতটাই গাঢ় সেই রঙ আমার ধূসর আকাশে লালচে আলো,, হলদে আলো,, নীলচে আলো সব আলো এসে দখল করে নিচ্ছে।

নাতির কথায় সুফিয়া হাসতে হাসতে বললেন,,

— যার লাইগা এত রঙ জাগলো মনে সে কি জানে?

— না গো সে জানে না। সে যদি জানতে পারে তবে আমার থেকে গুনে গুনে একশ হাত দূরে থাকবে।

— কাছে আনার ব্যবস্থা কইরা দেই?

মাশফি ওর দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,,

— না দাদি,, সে বরং আমায় ভালোবেসে কাছে আসুক।

— হ হ এমন আশায় থাইকা পরে তুমি দেবদাস হও। অন্য কেউ আইসা চম্পট হইব তোমার রঙের দুনিয়া নিয়া।

কথাটি বলতে বলতে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসেন সুফিয়া। মাশফি তখনও ওর দাদির খাটে শুয়ে থেকেই ভাবছে আসলে কি অন্য কেউ এসে মধুকে নিয়ে যাবে? যদি এমনটা হয় তবে মাশফির কি হবে? প্রতিটা রাত জানে মাশফির প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে শুধুই মধুর বিচরণ। সেই যে গোলাপি রঙা জামায় দেখলো সেই থেকে গোলাপি ব্যাথায় হৃদয় জর্জড়িত হয়ে আছে। এই ব্যাথার তো কোনো ঔষুধ নেই। এই অসুখের জন্য শুধু একটাই পথ্য যার জন্য এত ব্যাথা তাকে শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরো। ব্যস,, সকল ব্যাথা ফুরুস। দেশে আছে দেড় মাসের মতো। এই সময়ের মধ্যে যদি মধুকে নিজের ভালোবাসার কথা বলতে না পারে তখন কি হবে? মেয়েটাও একটা বলদ থুক্কু বলদি। সামান্য মেসেজ দেখে যার হাঁটু কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায় সেই মেয়েকে সামনে বসিয়ে বিয়ের জন্য প্রপোজ করলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে।

মাশফি মনে মনে সেই মূহুর্তকে নিয়ে ভাবতে বসলো,, সে সময় মধুর কি রিয়াকশন হবে? যদি স্বাভাবিক থাকে তবে ওর উত্তর কি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বেচারা মাশফি ভাবতে ভাবতে ওর দাদির ঘরে ঘুমিয়ে পরলো।

এদিকে সুফিয়া আবারও নিজের ঘরে ফিরে এলেন মাশফির সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু,, মাশফি তো ঘুমিয়ে পরেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,,

— আল্লাহ গো আপনার ভান্ডারে কোনো কিছুরই অভাব নাই। আমার মাশফির দিলে আপনি কোনো দাগ লাগাইয়েন না। সে যারে মোহাব্বত করে তার লগে তার জীবনটা বাইন্ধা দিয়েন।

মধুর জীবনটা দূর্বিসহ হয়েও ওঠলো। এতটাই অসহায় বোধহয় নিজেকে সে আগে কখনো ভাবেনি। রাত নেই, দিন নেই মোবাইলে সেই আগন্তুকের মেসেজ আসছে। বেশিরভাগ মেসেজ তাকে নিয়ে। যেমন: আজ তোমাকে হলুদ জামায় দেখে আমার সারাদিন সরষে ক্ষেতের ঘোরেই কেটেছে।

দেখা গেলো সত্যি সত্যি মধুর গায়ে হলুদ জামা। যে এই ধরণের কাজটা করছে সে নিশ্চয়ই মধুর আশেপাশে আছে। নয়তো, এতটা নিখুঁতভাবে বর্ননা করা তো মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

গতকাল রাতে বারোটার দিকে আরও একটি মেসেজ আসে ঠিক এরকম,,

“সামনের বার আমার খুব কাছে আসবে না বুঝলে৷ কাছে এলে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে তোমায়। তোমার গালদুটো শক্ত নাকি নরম দেখার খব ইচ্ছে বুঝলে। কিন্তু,, ওভাবে ছুঁয়ে দিতে সাহস হয় না আমার। আমি তো ভদ্র ছেলে। আর ভদ্র ছেলেরা নিজের স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে চায় না। তাই আমি ভাবছিলাম কি,, আগে তোমার সাথে আমার প্রণয় হোক তারপর তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব। মাঝেমধ্যে একটুআধটু চুমু খাব তুমি কিন্তু রাগ দেখাতে পারবে না। আমি যতবার আদর করে তোমায় চুমু খাব ঠিক ততবার তুমি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিবে। ভুল করেও চোখ রাঙানি দিতে পারবে না। নয়তো ভালোবাসার ওভারডোজ চলবে ”

এমন ভয়ানাক মেসেজ পাঠিয়েছে। মধুর তো মনে হচ্ছে ইদানিং ওর শরীরের ব্লাড প্রেশার কমে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু অস্পষ্ট দেখছে। কানে কম শুনছে। ভাত খেতে গেলে বুকে কাশি বেঁধে কেলেঙ্কারি অবস্থা। চোখ বন্ধ করলে সেই ভয়ানক মেসেজের এক একটি শব্দ চোখের পাতায় নক করে জাগিয়ে দিচ্ছে তাকে। সব মিলিয়ে একটা বিশ্রি অবস্থা! এর থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় কি তাও তো ভেবে পাচ্ছে না। কার সঙ্গে এই ব্যাপারটি শেয়ার করলে উপকার মিলবে তাও বুঝতে পারছে না মধু। তবে,, অতি শীঘ্রই এই ব্যাপারটা মেটাতে হবে। নয়তো মধুর পাগল হতে বেশিদিন বাকি নেই।

সেদিন সন্ধার পর ওভাবে হুট করে চলে আসায় মধুর মন খারাপ হচ্ছিল। মাশফি হয়তো তাকে বেয়াদব ভাবছে। নয়তো,, একটা মানুষ তাকে নিয়ে খাওয়ালো,, আড্ডা দিতে চাইলো কিন্তু এর বিনিময়ে সে কি করলো তাড়াহুড়ো করে চলে এলো! সামান্য একটু ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন কি ছিল না? দিন দিন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে সে। আবার দেখা হলে সরি বলবে। ট্রিট হিসেবে জরিনার মায়ের হাতের জাদুকরী এলাচিগুঁড়ার চা খাওয়াবে। তখন নিশ্চয়ই মাশফি ওকে স্বার্থপর ভাববে না।

আদিবাকে পড়াচ্ছে আর আকাশ-পাতাল চিন্তা-ভাবনা করছিল মধু। মধুর মনে হুট করে একটি প্রশ্ন জাগলো,, তাই আর দেরি না করে আদিবাকে জিজ্ঞেস করলো,,

— আদিবা???

— জি ; আন্টি।

— আন্টির মোবাইল নম্বর তুমি কিভাবে জানলে?? আমি তো তোমার কাছে কখনোই আমার নাম্বার দেইনি।

ব্যস, আদিবা তো শেষ! কোত্থেকে নাম্বার পেয়েছে এটা তো বলা যাবে না। কিন্তু,, আন্টিকে সত্যি কথা না জানালে আদিবার গিল্ট ফিল হবে। কারণ,, ওর মা বলেছে,, মিথ্যা বলা মহাপাপ। এমন মহাপাপ করার কোনো ইচ্ছেই নেই আদিবার। কিন্তু,, ওয়াদা ভঙ্গ করা কি ঠিক হবে?

আদিবাকে আকাশ-পাতাল ভাবতে দেখতে মধুর মনের সন্দেহ এবার পাকাপোক্ত হলো। তাই আর শক্তভাবে আদিবাকে জিজ্ঞেস করলো এবং ওয়ার্নিং করলো যদি সে সত্যি কথা না বলে তবে ওর বাবার কাছে বিচার দিবে।

বেচারি আদিবা আমতাআমতা করে বলতেই যাচ্ছিলো এমন সময় মধু আউচ শব্দ করে ওর কপালটা চেপে ধরলো। নাক মুখ কুঁচকে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো মাশফি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মধু কিছু বলতে যাবে তারআগে মাশফি একটু নীচু হয়ে মধুর বামহাতের তালুতে কিছু একটা দিয়ে বললো,,,

— ছিহ্ তোমার মাথায় উঁকুন! এত উঁকুন নিয়ে ঘুমাও কি করে? আমার তো তোমার জামাইয়ের জন্য ভয় লাগছে। বৌয়ের মাথার উঁকুন নিজের মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে। একটু পর পর মাথা চুলকাবে। আহারে,, জীবনটা এত কষ্ট দায়ক কেন? এমনিতেই বিয়ে হলে বৌয়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। সেই সাথে যদি মাথায় উকুন নিয়ে ঘুরতে হয় তখন বেচারার ওপর দিয়ে কি বয়ে যাবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আমার।

মধু বোকার মতো তাকিয়ে রইলো মাশফির দিকে। উনার এত হা-হুতাশ দেখে মধুর মনে হচ্ছিল যেন,, মধুর স্বামীর মাথায় না বরং উনার মাথায় কেউ উঁকুন ছেড়ে দেবে!

আদিবা ওদের দুজনের কান্ড-কীর্তি দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ওর চাচ্চু এমন কেন! ইশশ্ আন্টি নিশ্চয়ই ব্যাথা পেয়েছে! আদিবা উঠে এসে মধুর কপাল থেকে হাত সরিয়ে দেখলো কপালের একপাশে নখের দাগ বসে লাল হয়ে আছে। আদিবা বিরক্তি প্রকাশ করে ওর চাচ্চুকে বললো,,

— এটা তুমি কি করলে চাচ্চু? আন্টির কপালের তিলকে উকুন ভেবে এভাবে চিমটি কাটতে পারলে তুমি? বেশি ব্যাথা পেয়েছো আন্টি?

মধু মাথা নাড়ালো সে ব্যাথা পায়নি। মাশফি তো যেন আকাশ থেকে পরলো। মানে কি? সে তো ভেবেছিল!

মাশফি আদিবার হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই দেখলো। আসলেই কপালের কাছে একটা গাঢ় তিল। মাশফিকে এতটা কাছ থেকে দেখে মধুর অস্বস্তি হচ্ছে।

—লোকটা নিশ্চয়ই দামি পারফিউম ইউজ করে। কেমন মাথা ধরানো গন্ধ! পাছে না আমার গায়ের সস্তা লোশনের গন্ধ তার নাকে লেগে যায়।

আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে মধু নিজের শ্বাস আঁটকে বসে আছে। যেন শ্বাস ফেললো মাশফি টের পেয়ে যাবে। মধুর কাছ থেকে মাশফি সরে এলো। মধু হাপ ছেড়ে বাঁচলো।

— আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আমি তো ভেবেছিলাম ওটা উকুন হবে। তাই ওভাবে… আপনাকে দেয়া ব্যাথা তো আমি ফিরিয়ে নিতে পারব না। তবে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে অনেকগুলো সরি।

শেষের কথাটি বলতে বলতে নিজের কানে ধরলো মাশফি। মধু হাত বাড়িয়ে মাশফির হাত নামিয়ে দিয়ে বললো,,

— প্লিজ,, এরকম করবেন না। ভুল মানুষেরই হয়। তাছাড়া, এই তিলটা নিয়ে বড্ড জ্বালায় পরেছি। যে প্রথম প্রথম দেখে সেই চিমটি কেটে আনতে যায়। আর আমি লাল-নীল ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠি।

— কিন্তু…

মাশফি কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগে মধু হাত উঁচিয়ে বারণ করলো,,

— কারো দেয়া ব্যাথা ফিরিয়ে নেয়া যায় না ঠিকই। কিন্তু,, সেই মানুষটার চোখের অনুতাপ দেখলে সকল ব্যাথা ভুলে যাওয়া যায়। আপনার চোখে সেই অনুতাপ আমি দেখতে পাচ্ছি।

কথাটি বলে মধু আদিবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। মধুর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে মাশফি। নিজের কাছে নিজেকে কেমন ছোট মনে হচ্ছে!

যাকে বুকের ভেতর ভরে রাখতে ইচ্ছে করে তাকে ব্যাথা দিয়েছে ভেবেছে চোখমুখে বেদনার ছাপ ফুটে ওঠেছে মাশফির মুখে

#চলবে

#চেনা_পথে
#Tahmina_Akhter

৮.

ক্যান্টিনে বসে রং চা খাচ্ছে মধু। পাশে বসে থাকা তুশি মোবাইলে কথা বলছে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। মধু চা খেতে খেতে ভাবছে সেই অজানার কথা।

—-যে কি-না লাগামহীন কথাবার্তা পাঠায় জমকালো আয়োজন করে। হাজারো উৎকন্ঠার ফাঁকে ভালো লাগে মেসেজ পড়তে। একেকটা শব্দ যেন ভালোবাসা পাবার জন্য বুক পেতে অপেক্ষা করছে। আচ্ছা,, মানুষটা কি নিছক মজা করছে নাকি সত্যি তার মনে আমার জন্য কিছু আছে? আগে কখনো চোখে কাজল দেয়া হতো না কিন্তু আজ দুদিন ধরে চোখে কাজল দিতে ভুলে যেতে হয় না। যদি অজানার মেসেজ না আসে এই ভেবে।

পরক্ষণে মধু আনমনে আবারও ভাবলো,,

— সে কি প্রশয় দিচ্ছে না ব্যাপারটাকে? লোকটাকে বিশ্রী কয়েকটা গালি দিয়ে ব্যাপাটাকে মেটানোর দরকার ছিল। কিন্তু,, সে তো কিছুই করছে না উল্টো ব্যাপারটাকে উপভোগ করছে পৈশাচিক ভাবে।

— কিরে কি ভাবিস?

তুশির কথায় মধু মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালো যার অর্থ কিছুই না।

— সামনের মাসে সেমিস্টার ফি দিতে হবে। টাকা ম্যানেজ করে রাখিস। নয়তো,, ভোগান্তি পোহাতে হবে।

— জমা টাকা আছে সমস্যা হবে না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে পড়াশোনা ছেড়ে দেই। এত প্যারা নিতে পারছি না আমি বুঝলি।

মধুর গলা কাঁপছে কথাগুলো বলার সময়। তুশি মধুর হাতের ওপর হাত রেখে বললো,,

— ধ্যান যত কঠিন হবে সাধনার ফল তত মিষ্টি হবে। এতবছরের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে দিলে তো হবে না। তোর একটা সাফল্যের গল্প হোক এটা তুই চাস না? ব্যর্থতার গল্প সবার জীবনে আছে। সবাই সেটা গর্ব নিয়ে বলে কিংবা দীর্ঘশ্বাসের ফাঁকে শোনায় । সাফল্যের গল্প কয়জন শোনাতে পারে? তুই শোনাবি সবাইকে তোর সাফল্যের গল্প।

তুশির কথায় নতুন করে উদম্য খুজে পায় মধু। এরকম বান্ধবী থাকলে হয়তো হোচট খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে ফেলা যায়।

মধুর মোবাইলে কল এলো। ওর বাবা কল করেছে। মধু ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে একপাশে নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে সালামের জবাব এলো শান্ত সুরে।

— মধু??

— জি ; বাবা?

— আমি তো শহরে আসছি।

— কবে এলেন? আমাকে জানাননি কেন? কোথায় আছেন? আমি আসব?

মধু অবাক এবং খুশির মিশ্রিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো। মধুর বাবা মেয়ের প্রশ্নের জবাবে বললেন,,

— আমি তোমার বড়ো মামার বাড়িতে আছি। তুমি ওখানেই এসো। কাপড়চোপড় নিয়ে এসো তোমার আমাদের সঙ্গে কিছুদিন বেড়াবে এখানে।

কল কেটে দিলেন মধুর বাবা। মধুর মন খারাপ হয়ে গেছে ওর বড়ো মামার বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে। নিশ্চয়ই এবার কোনো ফয়সালা হবে? হয়তো,, এবারের সিদ্ধান্তে মধুর জীবনে আমূল-পরিবর্তন হবে। কিন্তু,, মধু যে এমন পরিবর্তন চায় না। সে চায় মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় আকাশে উড়ে বেড়াতে। যেখানে নেই কোনো বাঁধা।

——————————-

——জানো আজ কি হয়েছে? মধু আন্টির কপালের তিলকে উকুন ভেবে চাচ্চু চিমটি কেটেছে। আন্টির কপাল কীরকম লাল হয়ে গিয়েছিল! ইশশ, আমার তো ভীষন খারাপ লাগছে জানো তোমরা ?

আদিবার কথায় ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা প্রত্যেকটি মানুষ বিস্মিত হলো। এতটাই বিস্মিত হলো যে,, মাশফির বাবা চায়ের কাপ মনে করে পানির গ্লাসে চুমুক দিলেন। মাশফির মা উনার শ্বাশুড়ির পাতে সাদা রুটি না দিয়ে তেলে ভাজা পরোটা দিয়ে দিলেন। আবৃত্তির মুখ থেকে রুটির টুকরো পরে গেলো। বেচারা মাশফি তো মাথা নীচু করে জায়গা খুঁজছে। টেবিলের কোথাও একটা হোল সৃষ্টি হোক আর তাতে ঢুকে পরুক অনন্তকালের জন্য। এত লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে এর আগে কখনো পরেছে কি না মনেই পরছে না।

— মধু শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার মতো এত ভদ্র ছেলের এই করুন অবস্থা। দেখো দেখো সবাই আমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন পয়সা খরচ করে চিড়িয়াখানায় ঢুকে বাঁদর বাঁদরামি দেখছে।

— মাথাডারে টেবিলের তলায় ঢুকাইয়া রাখ। কেউ দেখব না৷ মাইয়া মাইনষের গায়ের লগে ঘসা ঘসি করতে বারণ করছি না৷ তারপর, সাইধ্যা চইলা যাস ক্যান? এই তোর আদিবার টিচারের লগে ভাবসাব আছে নাকি?

শেষের কথাটি সন্দিহান হয়ে বললেন দাদি। দাদির কথায় আবৃত্তি সহ বাকি সবাই মাশফির মুখের দিকে তাকালো উত্তর জানার জন্য।

— ভাবসাব আবার কি? ওকে তো দেখলেই মনে হয় টুপ করে একটা বোতলে ভরে রাখি। ছোটবেলায় টেলিভিশনে যেমন দেখাতো দুষ্ট জ্বীনকে বোতলে ভরে রাখে। হয়তো মধু দুষ্ট জ্বীন নয় কিন্তু আমার কাছে তো ও দুষ্ট ভালোবাসা। ওকে দেখলে পঁচা ভালোবাসা,, দুষ্ট ভালোবাসা,, গাঢ় ভালোবাসা,, সব রকমের ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

— এই কিছু জিগাইছি আমি? ওমন কইরা রুটির তাকাইয়া কি ভাবছ?

দাদির কথায় মাশফি কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে হাসি দিয়ে মাথা চুলকানোর ভান করে বললো,,

— দাদি আপনি কি যে বলেন না!

— আমি যা কই ঠিকই কই। তোর বাপেও এমন বেশরম কাম করতো তোর মায়ের লগের পিরিতির সময়। আমার তো মাথায় ভর্তি শেয়ানা বুদ্ধি বুঝছোস? তোর বাপ আর তুই হইলি গিয়া এক ঘাটের মাঝি। তোর বাপে প্রেম কইরা বিয়া করলল আর তুই কি সিরা বাদে মিষ্টি খাবি? মাহবুব কেমনে জানি ভালো হইল? তাই তো আবৃত্তির মতো বৌ পাইছে। কথায় আছে না নিজে ভালো তো জগত ভালো।

শেষের কথাটি যে তিনি মাশফির মায়ের উদ্দেশ্য বললেন টেবিলে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকেই টের পেলেন। মাশফির বাবা আড়চোখে একবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এরপর দ্বিতীয়বার আর সাহস জোটেনি তাকানোর।

— আহ্ আম্মা আপনার বয়স হইছে না এত পুরনো কথা টানার দরকার আছে?

— তুই চুপ থাক। আহাম্মক একটা। বুড়াকালে আইয়াও বৌয়ের কথায় উঠে আর বয়। এই যদি জানতাম এডা বড়ো হইলে বৌয়ের কথায় লেজ নাড়াইবো তাইলে এডারে অতি শিক্ষিত না বানাইয়া গোয়াল ঘরে পাঠাইতাম৷

দাদি শ্বাশুড়ির কথায় আবৃত্তি মুখ টিপে হাসছে সাথে মাশফির বড়ো ভাই, মাশফি। রোজকার ঘটনা তাই হয়তো এতটা স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে ওরা। রাগে ফুসছে মিনা। এতবছর হয়ে গেলো বিয়ের কিন্তু উনার শাশুড়ি আজও খোঁটা দেন। আর গাধাটা খালি মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে শুনে কিছুই বলে না। ছেলে এবং ছেলের বৌয়ের সামনে পুরনো কথা তুললে কেমন লাগে যদি উনার শ্বাশুড়িকে কেউ বুঝাতো?

দাদি চলে গেলেন। এরপর একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। বাকি রয়ে গেলো মাশফির বাবা-মা। মাশফির বাবা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন,, চোখদুটো ছলছল করছে। হয়তো রাগ সামলাতে পারছেন না বলেই চোখের পানি টলটল করছে। মিনড় হাতের হাতের ওপর রাখলেন ইমতিয়াজ । মিনা চোখ উপরে তুলে তাকাতেই দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পরলো। ইমতিয়াজ স্ত্রীর চোখের জলের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

— আম্মা’র কথায় কাঁদছ তুমি? আরে পাগলি মা কিন্তু তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। হয়তো প্রকাশ করতে চায় না।

— আমি জানি সে কথা। কিন্তু,, ছেলেদের সামনে রোজ রোজ একই কথা শুনতে কার ভালো লাগে বলো?

চোখের পানি মুছে কথাটি বলে ওঠে দাঁড়ালেন। এঁটো থালাগুলো বেসিনে রেখে এলেন ইমতিয়াজ ঠায় বসে রইলেন। কারণ,, এখন তিনি যদি হাজারবার মিনাকে ডাকেন তবুও শুনবে না এটা সেটার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে চলবে। কিন্তু,, ছেড়ে দেবার পাত্র তিনি নন । মিনার কাজ শেষ না হওয়া অব্দি আজ এখানে বসে থাকবেন। হুহ্।

মাশফি ওর ঘরে এসে সবে বিছানায় শুয়েছে এমন সময় নোটিফিকেশন আসে মোবাইলে। মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করতে স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ,, তার হাসোজ্জল বন্ধু বাদল এই পৃথিবীতে নেই। এমন একটা স্ট্যাটাস ফেসবুকে পোস্ট করেছে ওদের বন্ধু আকাশ। সেই পোস্টে মাশফিকে ট্যাগ করেছে। মাশফি উদভ্রান্তের মতো দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আবৃত্তির সঙ্গে দেখা হয়। আবৃত্তি ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল কিন্তু মাশফি যেন কানে শুনতে পায়নি এমন ভাব নিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here