চেনা_পথে,০৯,১০

0
250

#চেনা_পথে,০৯,১০
#Tahmina_Akhter

৯.

মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময় আয়োজনে ঘেরা। জীবনে চড়াই-উতরাই পার করে একটা মানুষ উন্নতির শেখরে পৌঁছায় ঠিকই তবে পেছনে ফেলে আসা সেই ত্যাগ-তিতিক্ষা কারো চোখে পরে না। যা দেখে তা হলো সাফল্য। কিংবা শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধ জিতে নেয়া কোনো রাজ্যকে। কিন্তু,, মনভাঙা মানুষটার ব্যর্থতা ক’জনের চোখে পরে? এই যে একটা মানুষ দিনের পর দিন নিজের হৃদয়ের কোণে ধীরে ধীরে একটা মানুষকে ঠাঁই দেয় । একটু একটু করে আপন মানুষ হিসেবে ভেবে নেয়। কিন্তু,, একদিন হুট করে জানা যায় মানুষটা তার আপন মানুষ নয় বরং অন্যকারো। সে তো মরিচিকা মাত্র। যার জন্য এত আয়োজন ছিল তার জীবনের কোনো এক কোণায় তার অস্তিত্ব মাত্র নেই। তবে এতকাল ধরে ধ্যান করে যে তাকে পেল না এর মূল্য কি দিয়ে ঘোচানো যায়? উত্তর জানা আছে কি? জানি উত্তর নেই। প্রত্যেকের জীবনে একটা প্রেমের ব্যর্থতার গল্প থাকে। প্রেমে ব্যর্থতার কারণ হয়তো জানা কিন্তু প্রতিকার জানা নেই।

প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে ছুটে গেলাম। যাওয়ার পর বন্ধুর মৃত্যুকে নিয়ে আফসোস করব নাকি নিজের ভাগ্যকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হয়েছিল চলন্ত ট্রেনের সামনে লাফ দিয়ে প্রাণ দিয়ে দেব। কারণটা কি জানো তোমরা ? যার কাছ জীবনের সকল ভার নুইয়ে দিব ভেবেছিলাম সে আমার মৃত বন্ধুর স্ত্রী ছিল। যাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু পাড়া শুদ্ধো লোককে ঘটা করে জানানো হয়নি। আমি তখন কি করব কিংবা আমার কি করা উচিত আমি ভাবতে পারছিলাম না৷ চলে এসেছিলাম সেখান থেকে কারণ আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই জায়গায় আমার মৃত বন্ধু বাদল চিরনিদ্রায় শায়িত হবার অপেক্ষায় সাদা কাফন পরে অপেক্ষা করছিল। আমি পারছিলাম না ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীর দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাতে। চলে এসেছি। সবকিছু পেছনে রেখে চলে এসেছি। চাইনি তাকে আমার হৃদয়ে রাখতে। কিন্তু,, পারিনি। বরং,, আজ অব্দি সে যেন আমার বুকের ওপর সেঁটে আছে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে বাংলাদেশে চলে যাই । সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি যেই চেনা পথে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো তাকে দেখে আমার হৃদয় আমার না থেকে তার হয়ে গিয়েছিল।

কথাগুলো নিরব শ্রোতার মতো শুনে গেল সবাই। কথাগুলো বলা শেষ হলো যখন তখন সবার চোখে বেদনার ছাপ।তবে, করতালি দিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে দশজন ছেলে-মেয়ের একটি দল। মাশফি ওর স্টুডেন্টের দিকে আরও একবার তাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু ওর ছাত্রী লিসা পেছন থেকে ডাক দেয়। মাশফি থমকে দাঁড়াতে হয়। পেছন ফিরে তাকালো মাশফি। লিসা আঙুল তুলে একটি ছবির দিকে তাক করে বললো,,

—-Who is seen in the picture is your love? Is that why you have been living in this country for so many years?

মাশফি লিসার দেখানো সেই ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে সেখানে থেকে চলে আসে। লিসা তার উত্তর পেয়ে গেছে। স্যারের মুখে এমন মিষ্টি হাসি সচারাচর দেখা যায় কই?

বাংলাদেশ সময় রাত দশটা…

আদিবা একটি ঘরে বসে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য ; নেই শুধু মাশফি। মাশফি সে তো জাপানে আছে আজ বারো বছর ধরে।

মাশফির বাবা-মা বয়সের ভারে কিছুটা নুইয়ে পরেছেন । আদিবার বাবা-মার কানের কাছের কয়েকটা সাদা চুল উঁকি দিয়ে জানান দিচ্ছে বার্ধক্যের চিহ্ন।

আদিবা ওর মোবাইল হাতে নিয়ে মাশফির নম্বরে কল দিলো,,,

রিং বাজছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। একে একে পাঁচবার ট্রাই করার পর কল রিসিভ হলো,, সেই দুষ্টুমি ভরা কন্ঠ শোনা গেল না। কন্ঠে একরাশ গাম্ভীর্যের ছোঁয়া লেগেছে যেন!

— হ্যালো, আদিবা কেমন আছিস???

আদিবার কন্ঠ কেঁপে উঠল। পিতৃসম চাচার গলা শুনে। চাচাকে দেখার জন্য আর কতগুলো বছর অপেক্ষা করতে হবে আদিবার জানা নেই৷ এই যে ওর দাদা-দাদি শেষ বয়সে এসে ছোট ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় রোজ অপেক্ষা করেন সেই মূল্য কি তারা বেঁচে থাকতে পাবেন?

— ভালো আছি। তুমি কেমন আছো চাচ্চু?

— ভালো আছি রে।

কথাটির শেষে দীর্ঘশ্বাসের আভাস পেলো আদিবা। সেই দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়তো আদিবা জানে!

— চাচ্চু,,, জিজ্ঞেস করবে না আমরা সবাই কেমন আছি?

আদিবার কন্ঠে অভিমান। মাশফি স্বাভাবিক ভাবে বললো,,

— সবাই ভালো আছিস। রোজ কেউ না কেউ ছবি পোস্ট করছিস। এখানে সেখানে বেড়াতে যাচ্ছিস। খারাপ থাকলে কি এতকিছু করা যায়? তারমানে কি দাঁড়ালো তোরা সবাই ভালো আছিস।

আদিবার স্পষ্ট মনে আছে লাস্ট টাইম যখন দেশে ফিরলো তখন ওর চাচ্চুর মুখ থেকে কথা নয় মিষ্টতা বের হতো। শুনলেই পরান ঠান্ডা হয়ে যেত। সময়ের পালাবদলে সেই চাচ্চু আজ এত এত শক্ত কথা বলে। যে কথা শুনলে হৃদয়ে ব্যাথা লাগে।

মাশফির মা এগিয়ে এসে নাতনির হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে বললেন,,,

— বাবারে তোর কি আমাদের দেখতে ইচ্ছে করে না? আমার দুটো চোখ তোকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। এই দিন দেখার জন্য তোদের দুইভাইকে পেটে ধরেছিলাম? মাহবুবটা আমার চোখের সামনে বড়ো হলো এখন মেয়েকে বিয়ে দেবে। আমার এটুকু বাচ্চাটাকে চোখের সামনে পরিণত হতে দেখছি। কিন্তু,, তোকে যে দেখতে পারছি না। তোকে সেই কবে দেখলাম,, যুবক বয়সের দুষ্টমিতে ভরা মাশফিকে। এরপর আর দেখার সু্যোগ হলো কই? আয় না বাবা তোকে একটু প্রাণ ভরে দেখি। তোর গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখি। আমার সেই ছোট্ট মাশফি আজ কত বড়ো হয়েছে একটুখানি চোখের দেখা দেখব বাবা। ফিরে আয়।।।

মাশফির মায়ের কথায় উপস্থিত সবার চোখে জল। মোবাইলের ওপাশে থাকা মাশফির চোখেও জল। মা’কে স্বান্তনা দেবার ভাষা নেই। কন্ঠ কাঁপছে,, এখন যদি কথা বলতে চায় নির্ঘাত সে কেঁদে ফেলবে। মাশফি কিছু না বলে কল কেটে দিলো।

এদিকে ছেলের এমন আচরণ দেখে মিনার কান্না যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। ছেলেটা এত পাষাণ হলো কি করে এটাই বুঝতে পারছেন না।

আবৃত্তি এগিয়ে এসে শ্বাশুড়ির কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিতে থাকলো। আদিবা ওর মোবাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ছাঁদের দিকে রওনা হলো। আজ যে কিছুর বিনিময়ে হোক চাচ্চুর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। চাচ্চুর জীবনে কি তাদের কোনো প্রায়োরিটি নেই? শুধুমাত্র একজনের ভালোবাসা পাবে না বলে পরিবারের ভালোবাসা , মায়া-মমতাকে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না।

—————————

অক্টোবর মাস,,,

শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার করে বেরিয়ে এলো মাশফি। পরনে কালো শার্ট,, কালো প্যান্ট,, হাতে ট্রলি নিয়ে এগিয়ে এসে একটি ক্যাব ডেকে ভাড়া ঠিক করে উঠে বসলো। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে গাড়িটা যখন প্রধান সড়কে উঠে এলো তখনই মাশফি বুক ভরে শ্বাস নিলো।

তার নিজের দেশ জন্মভূমিতে আজ কতগুলো বছর পর এলো। চিরচেনা পথ গুলো অচেনা হয়ে গেছে। তবে উন্নত হয়েছে আগের থেকে। গাড়ির জানালা গলিয়ে বাইরে মাশফির দৃষ্টি তখনো বাইরের দিকে।

গাড়ি যখন চিরচেনা পথের দিকে চলতে শুরু করলো তখনই মাশফির হৃদয়ে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করে। মনে হচ্ছে যেন এই পথে মধুকে আবারও দেখতে পাবে। সেই প্রথমদিনের মতো। যেখানে মধুর সঙ্গে তার প্রথম দেখা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঝগড়া। পুরনো সেই ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি হবার আশায় মাশফি সেই পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ধীরে ধীরে সেই পথ ছেড়ে মাশফিদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেমে গেছে। মাশফি দরজা খুলে বের হয়ে এলো। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে দেখতে থাকলো। সব বদলে গেছে বদলায়নি শুধু মাশফিদের বাড়ির দেয়ালের রং। আসমানী রঙা দেয়াল গুলো যেন সেই আগের মতোই আছে। ড্রাইভার ব্যাগ গুলো বের করে গেইটের কাছে এনে রেখে দিলেন। মাশফি গাড়িভাড়ার সঙ্গে কিছু টাকা টিপস দিলেন ড্রাইভারকে। ড্রাইভার খুশি হয়ে চলে যাচ্ছেন।

মাশফি ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মনের মাঝে হাজারো উৎকন্ঠা। বাবা-মা’র কি রিয়াকশন হবে ভেবে মাশফি যেন আরও নার্ভাস ফিল করছে?

সদর দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল বাজালো। দ্বিতীয় বার বেল প্রেস করে অপেক্ষা করতে লাগল কখন দরজা খুলবে?

#চলবে

#চেনা_পথে
#Tahmina_Akhter

১০.

সেই একই চাহনি,,দুচোখে একরাজ্য সমান বিস্ময়। ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা হাসিটা হয়তো আগের মতো নেই। ঘাড়ের ওপর ফেলা রাখা চুলের খোপাটা যেন খসে পরতে চাইছে। চেহারায় লাবন্যতা কমে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু আদুরে মাখা ভাবটা সেই আগের মতোই আছে। কত পরিণত হয়েছে সে? শাড়ির আঁচল টেনে কি সুন্দর করে কাঁধের উপর রেখে দিয়েছে! শালীনতা সেই আগের মতোই আছে হয়তো আগের থেকে কিছুটা বেড়েও গেছে বয়সের ভারে!

— ভালো আছেন?

বহুবছর পর মরুভূমিতে যখন ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরের মাঝে এক পশলা বৃষ্টির আগমনে শীতল হয় পরিবেশ। ঠিক তেমনি করে আজ মাশফির চৌচির শূন্য হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির স্পর্শের ন্যায় ছুঁয়ে দিয়েছে তার কন্ঠ শুনে। আহ্,, এতকাল ধরে কি তবে মাশফি এরই অপেক্ষায় ছিল??

— কে এসেছে ; আন্টি??

আদিবা ওর হলদে শাড়ির কুচি আলতো হাতে উঁচু করে দরজার কাছে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করছিল। মধু আদিবার দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বললো,,

— তোমার চাচ্চু মি.মাশফি সাহেব এসেছেন।

মধুর কথা শুনতেই আদিবা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো,, সত্যি সত্যি তার চাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে। আদিবার চোখে জল জমা হতে শুরু করে ঠিকই কিন্তু কন্ঠে একরাশ আনন্দ। হারিয়ে যাওয়া কোনো বস্তুর হটাৎ ফিরে পাওয়াতে মানুষ যেমন খুশি হয় ঠিক তেমন খুশি।

আদিবা চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো। আবৃত্তি আর মিনা তখন রান্নাঘরে,, ইমতিয়াজ আর মাহবুব একটি কক্ষে বসে আদিবার বিয়ের আয়োজন নিয়ে আলাপ করছিল। আদিবার হটাৎ চিৎকার শুনে সবাই হাতের কাজ রেখে তাড়াহুড়ো করে দৌঁড়ে আসে। সবাই এসেছিল আদিবার চিৎকার শুনে কিন্তু এসে যে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখবে এটা কি ভেবেছিল?

মিনা এতগুলো বছর পর ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। মা ছেলের কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইমতিয়াজ সাহেব তখনও ছেলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন,, সত্যি কি মাশফি এসেছে? নাকি অবচেতন মনের কল্পনা মাত্র!

ইমতিয়াজ সাহেবকে ভুল প্রমাণিত করে মাশফির হাত ধরে এগিয়ে আসেন মিনা। এসেই ইমতিয়াজ সাহেবের হাতের ওপর মাশফির হাত রেখে বললেন,,

— দেখো তুমি তো চেক করে মাশফি সত্যি এলো কি না? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!

স্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে ইমতিয়াজ সাহেবের কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আগের মতো কষ্টটা ততটা ঘায়েল করতে পারছে না। কারণ,, আজ সত্যি সত্যি যে মাশফি তাদের মাঝে ফিরে এসেছে। এতবছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ তাদের ছোট ছেলে তাদের বুকে ফিরে এসেছে। ইমতিয়াজ সাহেব মাশফিকে বুকে টেনে নিলেন। মাশফি বাবার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকলো। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু আদর আর স্নেহ অনুভব করার সময় এখন।

মাহবুব এগিয়ে গিয়ে অন্যপাশ থেকে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

— মাশফিকে আদর করছেন বাবা? আমি কি পর?

ইমতিয়াজ সাহেব আর মাশফি মুচকি হাসি দিয়ে মাহবুবকে জড়িয়ে ধরলো। উপস্থিত সবার চোখে তাদের পূর্ণমিলনী দেখে আনন্দ অশ্রুর দেখা মিললো।

আবৃত্তির সঙ্গে কথা শেষ করে আদিবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মাশফি। আদিবা মাথা নীচু করে চোখের পানি আড়াল করতে ব্যস্ত। মাশফি আদিবার থুতনিতে হাত রেখে উঁচু করে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,,,

— এই তোর চাচ্চুর জন্য মায়া? আমাকে ভীনদেশ রেখে ঠিকই তো বিয়ে করে ফেলছিস। অথচ, সেদিন কে যেন আমাকে পরিবার স্নেহ-মমতা সম্পর্কে এতবড়ো লেকচার দিয়েছিল।

আদিবা কাঁদতে কাঁদতে ওর চাচ্চুর বুকে মাথা রেখে বললো,,

— চাচ্চু আ’ম সরি। সেদিন আমি তোমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু,, কি করব বলো? সবার মনমরা চেহারা,, দাদির কান্না সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই ওভাবে দুটো কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম।

আদিবাকে বুকের কাছ থেকে উঠিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো মাশফি। সেই ছোট্টবেলার মতো আদিবার নাকের ডগায় টোকা দিয়ে বললো,,

— আমার আদিবা মা যে এত বড়ো হয়ে গিয়েছিল জানতেই পারিনি। কিন্তু,, সেদিন বকা খেয়ে টের পেয়েছি আর ভয়ও পেয়েছি। তাই তো ইমডিয়েটলি বাংলাদেশের প্লেনে চড়ে চলে এলাম। নয়তো,, আমার ছোট মা’র বিদায়বেলার মূহুর্ত দেখার সৌভাগ্য যে আমার হতো না।

আদিবার মাথায় হাত বুলিয়ে শেষের কথাটি বলতে গিয়ে মাশফির কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে। আদিবার আজ বড্ড খুশি খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে জীবনের সকল পূর্ণতা পেয়ে গেছে আজ তার পরিবার।

এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল মধু। পরিবেশ ধীরে ধীরে যখন ঠিক হলো তখন মধু আদিবার সামনে গিয়ে বললো,,

— আমি আসছি আদিবা। সকালে চলে আসব।

মধুর কথা শুনে মাশফি এবং আদিবা দু’জনেই তাকিয়ে রইলো। মাশফি কি বলবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ,, ওকে বারণ করার কোনো অধিকার নেই মাশফির কাছে। আদিবা মধুকে বললো,,,

— বাড়িতে গিয়ে কি করবে আন্টি? একটু পর ও বাড়ি থেকে লোক এসে আমাকে হলুদ লাগিয়ে যাবে। তুমি না থাকলে হবে বলো? আগামীকাল অব্দি আমি তোমাকে জ্বালাতে পারব এরপর আর কে জ্বালাবে তোমাকে?

আদিবার কথায় মধুর চোখে অশ্রু জমা হয়। কিন্তু, গড়িয়ে পড়ার আগে মধু নিজেকে সামলে নেয়। আদিবার গালে একহাত রেখে বললো,,

— কথায় কথায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা এখনও যায়নি আদিবা! আজ শেষবারের মতো তোমার এই বদভ্যাসের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করলাম। কারণ,, এমন আদুরে চেহারা নিয়ে সেই ছোট্ট আদিবা কি আর আমার সামনে এসে বায়না ধরবে?

আদিবা মধুকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

— আমি সবসময় তোমার কাছে সেই ছোট আদিবা থাকব। যে হাজার বায়না করবে আর তুমি নাক ফুলিয়ে মিথ্যা বকা দেয়ার অভিনয় করবে ঠিকই কিন্তু সেই বায়না তুমিই পূরণ করবে।

মাশফি দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো লাগছে দৃশ্যটা দেখতে। এত মায়া নিয়ে কথা বলতে পারে মধু এর আগে কখনোই শোনা হয়নি মাশফির। হয়তো, দূরের মানুষ বলে। কাছের মানুষ হলে হয়তো….

মাশফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে যাচ্ছে ওর দাদির ঘরে। মানুষটাকে দেখা হয় না,, সেই বকা দেয়া মানুষটা আজ তাকে দেখলে কি রিয়াকশন দেবে কে জানে?

বিছানায় সারাদিন শুয়ে থাকা,, নার্স কিংবা ছেলের বৌয়ের সাহায্য নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়া,, কিংবা নামাজের সময় তাদের সাহায্য নিয়ে ওযু করা। এই তো জীবন চলছে সুফিয়ার।

বয়স যতই বাড়ে ততই মানুষের কর্মক্ষমতা,, হাসি-আনন্দ,, জীবনের মূল্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একটা সময় মনে হয় কারো বোঝা নয় হয়ে টুপ করে যদি মরণদূত এসে নিয়ে যেত। সকল ঝামেলা একেবারে শেষ। কিন্তু,, সব পরিকল্পনা কি আর নিজের পরিকল্পনা মতো বাস্তবায়ন হয়? ওপরে যে একজন আছেন তিনি তো সকলের চেয়ে সর্বউত্তম পরিকল্পনাকারী। উনার দয়ায় হয়তো এত অসুস্থতার মাঝে পৃথিবীতে এখন অব্দি অনেকের শ্বাস চলছে। আর অনেকের পরিণত বয়স হবার আগে মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মাশফি। ধীরে ধীরে দাদির বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর,, ওর দাদির পায়ের কাছে বসলো। কিছু বললো না শুধু চুপটি করে দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা একসময় একহাতে সংসার সামলিয়েছে। তিন ফুপিকে বিয়ে দিয়েছে,, বাবাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছে দাদার অবর্তমানে। আর আজ সেই মানুষটা শয্যাশায়ী। মাশফি ধীরে ধীরে ওর দাদির হাতের হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকালেন দাদি।

আগের মতো অতটা চোখেও দেখেন না। কিন্তু, ঝাপসা চোখে তাকিয়ে তিনি যেন মাশফির মুখটা দেখলেন৷ অন্য হাত বাড়িয়ে মাশফির হাতের ওপর হাত রেখে বললেন,,

— এতদিন পর আইলি দেশে? আমি মইরা যাওনের পর আইতি?

দাদির মুখ থেকে মৃত্যুর কথা শুনে মাশফির চোখের কোণায় জল জমা হতে শুরু করে। মাশফি শক্ত করে ওর দাদির হাত চেপে ধরে বললো,,

— দাদি,, আপনি মরে গেলে আমাকে কে জ্বালাবে বলেন তো? আপনার মুখে বয়ানকৃত ভয়ংকর কথাবার্তা শুনব তারপর না মনে হবে যে না এবার আমি সত্যি সত্যি বাংলাদেশে আছি,, আমার দাদির কাছে এসেছি।

সুফিয়া নাতির কথায় আজ রাগ করলেন না। শুধু হাসতে থাকলেন। কতবছর পর মনে হচ্ছে আজ যেন সময়টা বহুবছর পেছনে ফিরে গিয়েছে। সব আগের মতো আছে।

ধীরে ধীরে পরিবেশের গুমোট ভাবটা কমে গেল। মাশফি বসে বসে ওর দাদির পা টিপে দিচ্ছে। যদি ওর দাদি বারণ করেছে কিন্তু মাশফি শোনেনি৷ নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো,,

— তোর সেই মানুষটা কেমন আছে রে?

দাদির কথায় মাশফি স্তব্ধ হয়ে যায়। হাত চলে না। কি উত্তর দেবে সে?

কি বলবে সে?যে, ও ভালো আছে।
দেশে এসেই তো সর্বপ্রথম তার মুখ দেখলাম। অথচ,, তাকে দেখার কথা ছিল না আমার। যাকে ভুলে থাকার জন্য দেশ ছেড়ে ভীনদেশে পরে আছি দেশে ফিরে তাকে দেখলাম। চোখের তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা যেন বিফল হয়ে গেছে। সে তো নিশ্চয়ই অন্যের ঘরের ঘরণী। তার দিকে ভালোবাসার নজরে তাকালেও যে পাপ।

“কিন্তু,, পাপের ভয় কি আর হৃদয়ের আছে? হৃদয় তো কেবল জানে যাকে ভাবলে শান্তি মিলে সে সারাক্ষণ তার বুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকুক।
ভালোবাসা এত কষ্টের তবুও কেন মানুষ ইচ্ছে করে সেই কষ্ট পেতে চায়? যেই ভালোবাসা কেবল বুকে ব্যাথা সৃষ্টি করে সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরিয়া আমরা”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here