চেনা_পথে,১১,১২

0
224

#চেনা_পথে,১১,১২
#Tahmina_Akhter

১১.

নীচ থেকে হুৈ-হুল্লোর শোনা যাচ্ছে। মাশফির দাদি মাশফির মন ভালো করার জন্য অনুরোধ করলো যেন সে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। সকল আত্মীয়-স্বজনরা আসবে। তাদের সঙ্গে দেখা হলে কথা বললে ভালো লাগবে। মাশফি রাজি হয় ঠিকই তবে একটা শর্তে। শর্ত হলো ওর দাদিকে ওর সঙ্গে যেতে হবে। এই কথা শুনে দাদি বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,,

— বাথরুমে যাইতে আরেকজনরে লাগে আর নীচে যামু কি হাওয়ায় ভাইসা! তুই যা। আমি এহানে ঠিক আছি।

মাশফির খেয়ালই ছিল না যে ওর দাদি নিজ পায়ে হেঁটে যেতে পারবে না। কি যেন ভাবলো তারপর ওর দাদিকে পাজকোলায় তুলে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ওর দাদিকে বললো,,

— আমি আছি না কোলে তুলে নিয়ে যাব তোমায়। আজ আমার সঙ্গে বসে পুরো অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে থাকবে তুমি। দেখবে সবাই কত খুশি হয়েছে?

সত্যি সত্যি মাশফির কথা সত্যি হলো। আত্মীয়-স্বজনরা বাড়ির বায়োজৈষ্ঠ্য মানুষটাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা। বিশেষ করে মাশফির বাবা ইমতিয়াজ সাহেব।

মাশফি ওর দাদিকে সোফার পাশে রাখা হুইল চেয়ারে বসিয়ে ওর ভাবি আবৃত্তিকে ডাক দেয়। আবৃত্তি মাশফির ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে একপ্রকার দৌঁড়ে আসে। আবৃত্তি এলে মাশফি ওর দাদিকে দেখে রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়ে নিজের ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে চলে যায়। কারণ,, ফ্রেশ হতে হবে অনেকদূর থেকে জার্নি করে এলো। চটজলদি গোসল সেড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই বড়োভাই মাহবুবকে দেখতে পেলো। মাহবুব হাতে একটা শপিংব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাশফিকে দেখে মাহবুব এগিয়ে এসে মাশফির হাতে শপিংব্যাগটা দিয়ে বললো,,,

— সাদা পাঞ্জাবি পাজামা রাখা আছে ভেতরে। পরে নিস। এটা হলুদের ড্রেসকোড তাও আবার কনের বাপ-চাচা,,মামা-খালুদের জন্য। তাড়াতাড়ি চলে আয়। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি তোর জন্য।

মাশফির হাতে ব্যাগটা দিয়ে মাহবুব চলে যায়। মাশফির হুট করে হাসি পেয়ে যায়। সেই ছোট্ট আদিবার নাকি আজ গায়ে হলুদ। সেই উপলক্ষে ড্রেসকোড হিসেবে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পাচ্ছে। সম্পর্কের প্রমোশন হচ্ছে, বাহ্।

মাশফি তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সাদা পাঞ্জাবি পাজামায় মন্দ দেখাচ্ছে না। দেশীয় বস্ত্রে নিজেকে আজ সত্যিকার অর্থে বাঙালি মনে হচ্ছে। ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে পারফিউম ইউজ করে, চুলে আঙুল চালিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

নীচে গিয়ে দেখলো একঝাঁক তরুণ-তরুণী হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। হয়তো, বেয়াই-বিয়ানের দল এরা। মাশফি সেদিকে না গিয়ে বাগানের দিকে চললো যেখানে ওর সমবয়সী কাজিনরা আছে। যাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য মাশফির আর তোড় সইছে না।

বাগানে যাওয়ার পর যখন সকল কাজিনরা মাশফিকে পেলো তখন সবাই হুমড়ি খেয়ে পরে। কাজিনদের মধ্যে বোনগুলা সব দফায় দফায় চোখের পানি ফেলছে আর হু-হতাশ করছে। মাশফির যদিও ওদের কান্নায় কোনো মাথাব্যাথা নেই। তবে, মাথা ব্যাথা সহ অবাক হয়েছে বেশি। যেমন ওর সবগুলো সুন্দরী বোনদের চুলে পাক ধরেছে,, কয়েকটা নাকি শ্বাশুড়ি হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো আরও একধাপ এগিয়ে নাতিনাতনির মুখ অব্দি দেখা হয়ে গেছে।

সময়গুলো কত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায়! এই তো মনে হয় সেদিনও তারা একত্রিত হয়ে চাল উঠাতো,,জনপ্রতি ডিম,, কেউ তেল,, কেউ পেঁয়াজ এভাবে রান্নার সরঞ্জাম তুলে রান্না করত। এর নাম হতো চড়ুইভাতি। কি যে তৃপ্তি নিয়ে খেত ওরা সবাই মিলে? আহ্ সেদিনগুলো কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না।

বরপক্ষ থেকে হলুদের উপঢৌকন চলে এসেছে তাই আর দেরি না করে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। মাশফি কিছু একটার প্রয়োজনে অনুষ্ঠান থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। মেসেঞ্জার লিসার কল এসেছে। মাশফি কল ব্যাক করলো। ওপাশে কল রিসিভ হলো না। তাই মাশফি সেখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়ায় ঠিকই কিন্তু কদম এগুতে পারে না।

সবুজ রঙা জামদানী শাড়ি,, সাদা ব্লাউজ এলোমেলো চুল খোপায় বাঁধা। দু’হাতের চিকন দুটো সোনালি রঙা চুড়ি। গলা এবং কান অলংকারহীন। ঠোঁটের কোণায় হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে মধু।

মাশফির বুক কাঁপছে। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা কিন্তু…

— আপনি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে??

মাশফি তাকিয়ে রইলো কিন্তু জবাব দিতে পারলো না। মধু জবাব পাওয়ার আশায় মাশফির দিকে তাকিয়ে আছে। মাশফি জানে উত্তর না দিলে মধু ওকে মনে মনে বেয়াদব বলে গালি দিবে। আগে যেমন হুটহাট এটা সেটা বলে ফেলত। তাই মাশফি শুকনো ঢোক গিলে অন্যপাশে তাকিয়ে বললো,,

— আমার এক স্টুডেন্ট কল করেছিল কিন্তু রিসিভ করতে পারিনি। পরে আমি ওকে কল করলাম কিন্তু ও রিসিভ করলো না।

মধু মাশফির কথায় হাসি দিয়ে বললো,,

— স্টুডেন্টরা এমনই হয়তো রাগ করেছে। আপনি প্রথম কল রিসিভ করেননি এবার সে করেনি। ব্যাপারটা সমান সমান। পরেরবার কল দিয়ে দেখুন রিং বাজার আগে রিসিভ হয়ে যাবে।

মাশফি কিছু না বলে শুধু মধুর কথা শুনে গেলো। এই মানুষটাকে কখনো এতকাছ থেকে দেখা হয়নি। দুএকবার যাও দেখেছিল তাও পরিস্থিতি অনূকূলে ছিল না।

— এই মধুওওওওওওওও???

আবৃত্তি হাত উঁচু করে মধুকে ডাকছে। তাই মধু মাশফিকে এক্সকিউজ মি বলে সেদিকে আবৃত্তির দিকে এগিয়ে যায়।

মধুর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো মাশফি। মানুষটা কেন তার চোখের সামনে আসে? যাকে দেখলে হৃদয়ের ভিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে কেন চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে?

অনুষ্ঠান চলাকালিন সময় একফাঁকে মাশফি একটুখানি হলুদ আদিবার কপালে ছুঁয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে,, অন্ধকার ঘরে বসে নিজের বিগত দিনগুলোকে নিয়ে হিসেব কষতে বসে। পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার ওজন যেন বেশি।

পুরনো স্মৃতি,, পুরনো ক্ষত সবটাই যেন নতুন করে চাড়া দিয়ে ওঠেছে। বুকের মাঝে পূর্ণতা না পাওয়ার তীব্র ক্ষোভ নিয়ে রাতটা পার করতে হলো মাশফির।

সকাল যখন হলো তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পথে হাঁটতে বের হলো মাশফি।, চিরচেনা পথ গুলো অচেনা হয়ে গেছে। তবুও, হাঁটতে হবে অচেনা পথকে চিনতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে রহমান কাকার হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হোটেলটা আগের মতো নেই। আভিজাত্যপূর্ণ। ধীরপায়ে হেটে হোটেলে ভেতরে ঢুকলো মাশফি। রহমান কাকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মাশফির চোখ। রহমান কাকাকে খুঁজে পেলো না ঠিকই কিন্তু পরিচিত একজনকে দেখে রহমান কাকার কথা জিজ্ঞেস করলো। জবাবে যা শুনলো তাতে মাশফির মনটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। রহমান কাকা দশবছর আগেই ষ্ট্রোক করে মারা গেছে। এই হোটেল এখন উনার বড়ো ছেলে চালায়।

মাশফি বিমর্ষ মনে বের হয়ে আসে। ফুটপাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাবছে বিগত বছরগুলোতে কতগুলো মানুষ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। যেই রহমান কাকার হোটেলে বসে বন্ধুদের আড্ডা চলত। সেই আড্ডার মধ্যমনি বাদল সেও তো কবে চলে গেছে। রহমান কাকা নেই।

জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো যেই শূন্যতা রেখে যায় আমাদের মনে আদৌও কি তা অন্যভাবে কিংবা অন্যমানুষ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব?

সকাল আটটা বাজতে চলল,, বাড়ির সবাই একে একে নিজেদের কাজে লেগে পরেছে। নারীরা রান্নাবান্না এবং ঘর গুছানোর কাজে।

মাশফির প্রচন্ড খুদা লেগেছে। তাই ডাইনিংটেবিলে সামনে গিয়ে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে নিলো। গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখার সময় একটি হাত এগিয়ে আসে মাশফির সামনে।

পিঠাভর্তি প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধু। মধুকে সকাল সকাল চোখের সামনে দেখে মাশফির মাথায় হুট করে বিরক্তি চাড়া দিয়ে ওঠে।

— পিঠা খেয়ে পানি খান। মিনা আন্টি সবে খিচুড়ি বসিয়েছে। নয়টার আগে হয়তো খিচুড়ি পাবেন না। পিঠা খেয়ে আপাতত পেটের খিদাকে বায় বায় করুন।

মধু হাসিমুখে কথাটি বলে টেবিলের ওপর প্লেটটি রেখে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু,, প্লেট ভাঙার বিকট শব্দ শুনে মধু থমকে যায়। আবৃত্তি,, মাশফির মা রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে আসে। এসেই দেখলেন প্লেটের ভাঙা টুকরো,, পিঠা একসঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে।

মাশফির মা এগিয়ে এসে ছেলেকে প্রশ্ন করার আগে মাশফি গটগট করে সেখান থেকে চলে যায়। সবাই ভীষন অবাক হলো।

তবে,, মধু অপমানিত বোধ করলো। কিন্তু,, কাউকে কিছুই বুঝতে দিলো না। সবার সঙ্গে কাজে লেগে পরলো। কি দরকার খামোখা কথা বাড়ানোর? বিকেলে আদিবার বিদায় হলে সেও চলে
যাবে। এই বাড়িতে আর কখনো আসবে বলে মনে হয় না।

#চলবে

#চেনা_পথে
#Tahmina_Akhter

১২.

আদিবাকে বৌ সাজিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওকে ঘিরে আছে ওর কিছু বান্ধবী এবং কাজিনরা।

আবৃত্তি মেয়ের বিদায়ের আগে কান্নাকাটি শুরু করেছে। এদিকে মেয়ের মাকে সামলাবে নাকি গেস্ট সামলাবে তা নিয়ে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মাহবুবকে।

তবুও,, সবকিছুর উর্ধে আবৃত্তি প্রাধান্য পেলো। মাহবুব ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। মাশফির বাবা – মা বরপক্ষ থেকে আসা মেহমানদের সঙ্গে কথা বলছেন।

কথা বলার একফাঁকে মাশফির মায়ের মনে পরলো এখনও মাশফি আসেনি। বাড়িতে রয়ে গেছে। ইমতিয়াজ সাহেবকে আড়ালে ডেকে এনে কথাটি বলতেই ইমতিয়াজ ছেলের নাম্বারে কল করলো। নাম্বার বন্ধ। ইমতিয়াজ সাহেবকে কিছুটা চিন্তিত মনে হলো। মাশফির মা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আদিবার হবু শ্বশুর ইমতিয়াজ সাহেবকে ডাক দেয় যার কারণে উনি সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হোন। মাশফির মা এবার মাহবুবকে খুঁজতে বের হলেন। মাশফির খবর নেয়া দরকার। বাড়ি থেকে বের হবার আগে যখন শেষবার কথা হলো তখন তো বলেছিল একঘন্টার মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু,, দু’ঘন্টার ওপরে হয়ে যাচ্ছে এখন অব্দি আসছে না।

মধু সবে গোসল সেরে সাদা রঙের জামদানী শাড়ি পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমে এলো। রুমে যে আগে থেকে একজন উপস্থিত আছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না মধু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে একসময় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে আরও একটি প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করলো। মাশফিকে এই ঘরে দেখে মধুর কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। চোখেমুখে তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। হাতের টাওয়াল ড্রেসিংটেবিলের চেয়ারের ওপর রেখে মধু শাড়ির আঁচল টেনে কাঁধে জড়িয়ে নিলো।

মাশফি একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ নীচু করে ফেললো।

— কিছু বলবেন?

মধুর প্রশ্ন শুনে মাশফি মাথা উঁচু করে তাকায়। মাশফির কি উত্তর দেয়া দরকার বুঝতে পারছে না। আসলেই কি ও এখানে এসেছে মধুকে কিছু বলতে? নাকি…

মধুর মোবাইলে কল এলো। মাশফির হাতের কাছেই মোবাইলটা ছিল। মধু এগিয়ে আসার আগে মাশফি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো,, মাহবুবের নাম্বার থেকে কল আসছে। মধুর দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। মধু মোবাইল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আবৃত্তি মাশফির কথা জিজ্ঞেস করে। মধু জানায় মাশফি বাড়িতেই আছে। ওর ঘরে আছে এটা বললো না। মাশফিকে নিয়ে মধু যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে এতটুকু বলে আবৃত্তি কল কেটে দেয়।

মধু মাশফিকে বললো,,

— আবৃত্তি আপু আপনাকে যেতে বলেছে।

— আমাকেও যেতে বলেছে প্লাস এটাও বলেছে যেন আপনি আমি একসঙ্গে চলে যাই।

মাশফির কথা শুনে মধু লজ্জা পেয়েছে। মোবাইলে কথা বলার সময় যে শব্দ দূর থেকে শোনা যায় এটা খেয়াল ছিল না। এখন কি ভাববে লোকটা?

— আমার সঙ্গে গেলেও মাইন্ড করব না আর না গেলেও মাইন্ড করব না। আমার শুধু কিছু জানার আছে আপনার কাছে। বাড়িতে কেউ নেই তাই এখনই উপযুক্ত সময়।

শেষের কথাটি বলার সময় মাশফিকে বেশ অন্যরকম লাগছিল মধুর কাছে। তাছাড়া,, মাশফির ওর কাছেই বা কি জানার আছে?

— বলব??

মাশফিকে বলার সুযোগ দিলো মধু। চেয়ার টেনে বসলো। মাশফি খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো।

— বাদল কিভাবে মারা গিয়েছিল??

বহুবছর পর “বাদল” নামটা শুনে মধুর বুকে ধুক করে ওঠে। মানুষটার নাম জানল কি করে?

— কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেন?? সময় খুবই কম সেন্টারের উদ্দেশ্য বের হতে হবে আমাদের।

মধুর চোখে সেদিনের স্মৃতিগুলো এক এক করে ভেসে ওঠছে। মাশফির কাছে জবাব দেয়ার মন-মানসিকতা যেন নেই মধুর। তবুও, বলতে হবে।

মধুর চোখমুখে আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে মাশফির দিকে তাকিয়ে বললো,,

— হার্ট অ্যাটাক করেছিল।

সুস্থ সবল মানুষটা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে এটাই মানতে পারল না মাশফি। কিন্তু,, অবিশ্বাস্ করার কারণও নেই। শুধু কারণটা জানতে চাইলো কেন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলো? সে কি এতটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিল?

— প্রচন্ড ডিপ্রেশনে ভুগছিল। পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে আমার নানি অর্থাৎ বাদল ভাইয়ের দাদির শেষ ইচ্ছের মান রাখতে আমার মা এবং বড়ো মামা মিলে বাদল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়। পারিবারিক ভাবে যদিও সবাই জানত কিন্তু বাইরের কেউ জানত না। আমরাও ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করব,, ভালো চাকরি করব। বাবা-মাকে নিয়ে সুখের একটা সংসার হবে। যেখানে অভাব-অনটন কিছুই আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। আমার চোখে দেখা সেই স্বপ্ন যেন বাদল ভাইয়ের স্বপ্ন হয়ে গেলো । তাই তো নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি আমার পড়াশোনার খরচ চালানোর চেষ্টা করতেন। ছোটখাটো চাকরি করতেন নিজের পকেট খরচ চালাতে যেখানে হিমশিম খেতে হয় সেখানে আরেকজনের খরচ চালিয়ে যাওয়াটা সম্ভব না। আমি একসময় বুঝতে পারলাম সে পারছে না। তাই আমি মেসে থেকেই আমার রুমমেটদের সাহায্য নিয়ে তিন-চারটা টিউশনি করাতাম। নিজের পড়াশোনাসহ থাকা-খাওয়ার খরচ চলত। আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বড়ো মামা-মামি ভালো চোখে দেখতেন না কিন্তু বাদল ভাইয়ের কারণে কিছু বলতে পারতেন না। কিন্তু,, একদিন হুট করে বাবা কল দিয়ে বললেন,, কাপড়চোপড় নিয়ে বড়ো মামার বাসায় যেতে। আমি স্বাভাবিক ভাবে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে মানুষটার নিথর দেহ দেখব এটা কখনো ভাবিনি। দুঃস্বপ্নের মতো আমার জীবনটা উলোটপালোট হয়ে যায়। মানুষটার আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই হতবিহ্বল হয়।

কথাগুলো বলতে গিয়ে মধুর দুই চোখের পানি গড়িয়ে পরে। মধুর চোখে অন্যকে হারানোর বেদনা দেখে মাশফির সহ্য হলো না। তবুও, মানতে হবে কারণ বাদল মধুর প্রিয় মানুষ ছিল। আর মাশফি সে তো কেউ না। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ।

মধুকে স্বাভাবিক হবার জন্য মাশফি সময় দিলো। মধুর কান্না ফুরিয়ে এলে মাশফি অনুরোধ করলো তৈরি হবার জন্য। বের হতে হবে এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। মধু ভেজাচোখে একটিবার মাশফির মুখের দিকে তাকায়,, শুকনো গলায় মাশফিকে জিজ্ঞেস করলো,,

— মানুষটা আপনার পরিচিত ছিল তাই না?

মধুর কথায় মাশফি একপলকের জন্য তাকালো ওই চোখে। যে চোখে তাকিয়ে নিজেকে ভালোবাসায় নিঃশেষ করে দেয়ার অদম্য আগ্রহ ছিল। কিন্তু???
সে চোখে যে অন্যকারো বাস। মাশফির সে চোখে তাকানোর সাহস হলো না। চোখ ফিরিয়ে নিলো।

মাশফি ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ায়। বের হবার সময় মধুকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলো,,

— বাদল আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ছিল।

মাশফি চলে গেলো। শূন্য ঘরে,, শূন্য হৃদয়,, হারানো মানুষটার অসংখ্য স্মৃতি মস্তিষ্কে নিয়ে পাথরের ন্যায় বসে রইলো মধু। জীবনটা কোনো এক পর্যায়ে এসে থমকে যায়। কিন্তু,, এভাবে থমকে যাওয়ার কথা যে ছিল না।

মাশফি ওর মোবাইল নেয়ার জন্য ঘরে গিয়েছিল।মোবাইল নিয়ে মধুর কাছে যখন ফিরে এলো তখন দেখলো ঘরটা খালি। মধু নেই। মাশফি কয়েকবার ডাকও দিয়েছিল কিন্তু সাড়া পায়নি। হয়তো,, তার আগেই সেন্টারে চলে গেছে। মাশফি তড়িঘড়ি করে রওনা হলো। অনেক দেরি করে ফেলেছে। আদিবা বুঝি কেঁদেই ফেলেছে এতক্ষণে।

———————————-

সিএনজি চলছে। গ্রীলের ফাঁকে হাত রেখে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে মধু। মাশফির সঙ্গে মিথ্যে বলেছে সে। বাদলের হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ হচ্ছে মধু। সেদিন যদি মানুষটাকে ওরকম কথা না বলত তবে আজ হয়তো সে বেঁচে থাকত। মধুকে নিয়ে না হোক হয়তো অন্যকাউকে নিয়ে সুখের সংসার করত। মানুষটা তাকে ভালোবাসে একরত্তি যদি জানত তাহলে মধু কখনোই নিজের ভাললাগার কথা তাকে বলত না। শুধু বাদলের ভালোবাসা গ্রহণ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতো। সেই অচেনা মানুষটার দু’চারটা লেখা শব্দ দেখে মধু এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে চোখের সামনে একবুক ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে সে অগ্রাহ্য করেছে। হয়তো,, প্রত্যাখান মেনে নিতে পারেনি তাই তো বুকে সহস্র ব্যাথা,, অভিমান নিয়ে চলে গেছে। আর কখনোই ফিরে আসেনি কিংবা আসবেও না ভালোবাসার দাবি নিয়ে। মধু আসলেই কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য নয়। পাপ করেছে সে। তাই তো পাপের প্রায়শ্চিত করছে। এ-ই জীবনে কাউকে আর জায়গা দেয়নি। কারো কাছে নিজের হৃদয়ের ভার নামায়নি। একা হাতে সবটা সামলে যাচ্ছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here