চেনা_পথে,১৫

0
280

#চেনা_পথে,১৫
#Tahmina_Akhter

—ভালোবাসার মতো এত অসাধারণ একটা ব্যাপারকে আপনি সাধারণ ভাবে হ্যান্ডেল করছেন কেন মি. মাশফি?

মাশফি বাটালি হিলের ওপরে দাঁড়িয়ে চিটাগং শহরকে দেখছিল। হয়তো,, এতকাছ থেকে আর কখনোই দেখা হবে না প্রাণের শহরকে! কারণ,, এদেশে ফিরে আসার যে কোনো ইচ্ছে নেই। যে শহরে শুধু না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাঁচতে হয় সে শহরে অন্তত কারো বসবাস না হোক। বড্ড কষ্ট হয় সহ্য করতে। কাউকে বলা যায় না শুধু নিজের বুকে ধারণ করে রাখা জমাট বাঁধা কষ্টকে উপভোগ করতে হয় নির্জনে। কাঁদতে হয় নিভৃতে।

চেনা কন্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মধু দাঁড়িয়ে আছে। পরনে আজ গোলাপি রঙা জামা। খুব যত্ন করে মাথায় সাদা ওড়না দেয়া। চোখেমুখে এক অন্যরকম আভা ফুটে উঠেছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম কি দরকার অন্যের মানুষকে এতটা গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর? কিন্তু,, এটা তো মানতেই হচ্ছে মধু সেই আগের মতোই আছে। এতটুকু বদলায়নি। বয়স তো শুধু সংখ্যা মাত্র।

—-আপনার কি ধারণা আপনি পৃথিবীতে একমাত্র চালাকচতুর মানুষ?

মধু মাশফির পাশে দাঁড়িয়ে কথাটি বললো তবে চোখের দৃষ্টি শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দালানকোঠার ওপর। মাশফি মধুর দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলো,,

— চালাক হলে নিশ্চয়ই আমার অবস্থান আজ অন্যরকম হতো।

মধু এবার মাশফির দিকে তাকালো। গালভরা দাঁড়ি,, চোখে চশমা,, কানের কাছে কিছু চুলে পাক ধরেছে। দূর থেকে দেখলে কে বলবে লোকটার বয়স হচ্ছে? মুখভর্তি যার এত গাম্ভীর্য তার হৃদয়ে যে এক বিশাল পাহাড় সমান ভালোবাসা জমা আছে কে বিশ্বাস করবে? চেহারা দেখলেই তো মনে হচ্ছে,, একের অধিক কথা বললে পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে দিবে। ডিসকওয়াও…

— একটা গল্প বলি শুনবেন???

মাশফি চুপ করে মাথা নাড়লো অর্থাৎ সে গল্পটা শুনবে।

—-বহুবছর আগে আমার এবং আমার পরিবারের ভীষন অর্থনৈতিক সংকট ছিল। তার মাঝে দাদির সিদ্ধান্তে আমার বিয়ে হলো বাদল ভাই অর্থাৎ আপনার বন্ধুর সঙ্গে। বিয়েটা যে হয়েছে তা পরিবারের লোক বাদে সকলের চোখের আড়ালে রয়ে গেলো। বাদল ভাই আমাকে নিয়ে এই শহরে এলেন। পাব্লিক চান্স পাইনি তাই ন্যাশনালে ভর্তি হলাম। বাদল ভাইয়ের সাধ্য অনুযায়ী আমাকে সাহায্যে করতেন৷ আমিও নিজে টিউশনি করাতে লাগলাম যাতে নিজের কিছুটা হ্যাল্প করতে পারি। তো টিউশনি করাতে আদিবা নামের একটা মিষ্টি পরিকে পড়াতে রোজ যেতাম ওদের বাসায়। একদিন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম আদিবাকে পড়ানোর উদ্দেশ্য। রাস্তায় বেখেয়ালি হয়ে হাঁটছিলাম এবং তখনি একটা ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পরে যাচ্ছিলাম কিন্তু শেষ মূহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। ছেলেটার কথায় অনেক রসিকতা খুঁজে পেয়েছিলাম। মানে সে নিজের প্রশংসা করছিল। রাগ করে তাকে বিভিন্ন কথা শুনিয়ে চলে আসি।
আদিবাকে রোজ ওদের ড্রইংরুমে বসিয়ে পড়াতাম কিন্তু সেদিন ওর দাদি বললো ওর ঘরে গিয়ে পড়াতে। আদিবার ঘর তো আমি চিনি না এই কথাটি আমি জিজ্ঞেস করতে পারতাম কিন্তু আমি করিনি। যার কারণে ভালো বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পরতে হয়েছিল। আদিবার ঘরে না গিয়ে ভুল করে অন্য ঘরে ঢুকে পরেছিলাম। ভেজা শরীর তার ওপর টাওয়াল পরে থাকা একটা ছেলেকে কেউ যদি হুট করে চোখের সামনে দেখে তবে একটা মেয়ের কেমন রিয়াকশন হওয়া উচিত?

কথাটি বলার সময় মধু হাসতে থাকে। মধুর হাসিতে আজ মাশফি মুগ্ধ হয় না৷ অবাক হয় কারণ সেসময়ের ঘটনাগুলো মধুর এতটা সুক্ষ্মভাবে মনে থাকার কথা না। তবুও সে রেখেছে এবং এটাই মাশফির জন্য বিস্ময়কর।

মধু হাসি থামিয়ে আবারও বলতে থাকলো,,,

—– তাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম কারণ রেগে ছিলাম যে প্রচুর। কারণ, সে এবং রাস্তায় দেখা হওয়া সেই ছেলেটা একই মানুষ ছিল। সে আমার কথায় রেগেমেগে এগিয়ে আসতে গিয়ে পায়ের সঙ্গে পা বেঁধে পরে গিয়েছিল কিন্তু আমার ওপরে। তার গায়ের ভার আমি নিতে পারছিলাম না। তাই আমি আবারও দুচারটা কথা শুনিয়ে দিলাম। বেচারা উঠলো ঠিকই তবে বিপত্তি সৃষ্টি করে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে আমি পড়িমরি করে ওই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি? দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেলাম। আমার মনে হয় এখনো যদি কপালে হাত রাখি না তবে সেদিনকার ব্যাথা এখনও অনুভব করতে পারব।

কথাগুলো বলার সময় মধু হাসতে হাসতে চুপ হয়ে গেছে। মাশফি মধুর দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ অব্দি। মধুকে চুপ হয়ে যেতে দেখলো তবে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মধু নিজ থেকেই বললো,,,

— ঘটনাগুলো আমরা দুজনে জানি কারণ দুজনেই ভুক্তভোগী। তবে এরপরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে কেউ কিছু জানি না।

— আমি জানতে চাই না মধু।

মাশফির দিকে ফিরে তাকালো মধু। মাশফির চোখে চোখ রেখে বললো,,

— কিন্তু,, আমি জানতে চাই এবং জানাতে চাই।

মাশফি হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো কারণ মধুর কন্ঠে কিছু তো একটা অবশ্যই ছিল। যাকে উপেক্ষা করে মাশফি এখান থেকে যেতে পারবে না।

— প্রথবারের মতো আমার মোবাইলে একটি বার্তা এলো অচেনা নাম্বার থেকে। অচেনা নাম্বার হলে কি হবে বেশ চেনা মানুষের মতোই ছিল তার কথার ধরণ। মনে হতো সে আমাকে খুব কাছ থেকে চেনে। একের পর এক বার্তা রোজ আসতে লাগলো। আমি সেই বার্তায় এতটাই প্রভাবিত হলাম যার কারণে নিজের বৈবাহিক সম্পর্ক ভুলে গিয়েছিলাম। আমার অপেক্ষায় যে কেউ একজন আছে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার স্বামী নামক মানুষটা একদিন আমাকে দেখতে এসেছিল যেখানে আমি সাবলেটে ভাড়া থাকতাম। তার হাসিমাখা মুখটা আমার চোখে এখনও ভাসে। সে আমার দিকে একটা শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল,, মধু তোকে এখন পর্যন্ত কিছুই দিতে পারি নাই। অনেকদিন ধরে কিছু টাকা জমিয়ে আজ এই শাড়িটা কিনলাম। তুই কিন্তু রাগ করিস না। আমার চাকরি হলে তখন তোকে এরচেয়েও দামি শাড়ি গিফট করব।
সেদিন তার দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম আমি তাকে ঠকাবো। কারণ,, মনের কোণে কখনোই সে আমার ছিল না। কিন্তু,, তখন আমার মনে অন্যকেউ যে রোজ আমাকে বার্তা পাঠাতো। তো তাকে মনে রেখে বাদল ভাইকে নিয়ে সংসার পাতা মানে বাদল ভাইকে ধোঁকা দেয়া। আমি তাকে ধোঁকা দিতে পারব না বলেই সেদিন তার হাতে শাড়ির ব্যাগটা তুলে দিয়ে বলেছিলাম,, আমি আপনার সংসার করতে পারব না। সময় হলে আমি সবাইকে বলে দিব আমি আপনার যোগ্য না। তখন দেখবেন আপনাকে কেউ কিছু বলবে না বাদল ভাই।
মানুষটা সেদিন আমার কথার পিঠে কিছুই বলেনি। যদি বলতো তবে মনকে এতটুকু হলেও বোঝাতে পারতাম। মানুষটা সেদিন রাতে নাকি বাড়ি ফিরে গিয়েছিল শেষবারের মতো। তারপর,, তো গিয়ে তাকে দেখলাম সে চিরনিদ্রায় শায়িত হবার জন্য অপেক্ষা করছিল খাটিয়ায় শুয়ে। বুকে ব্যাথা নিয়ে মানুষটা চলে গিয়েছিল। আমি জানতাম সেই কারণ। কিন্তু কাউকে বলার মতো সাহস হয়নি৷

মধুর চোখ গড়িয়ে জল পরছে। মাশফির তাকিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই। এই যে এতকিছু হলো সেখানে কি তার বিন্দুমাত্র দোষ নেই? অবশ্যই দোষ আছে৷ পরোক্ষভাবে সে যদি মধুকে সরাসরি ভালো লাগার কথা বলতো তবে মধু তার বৈবাহিক সম্পর্ক জানাতে পারত। কিন্তু,, মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে সে যা কিছু করেছে তা ঠিক করেনি। একটা সংসার ভেঙেছে। মানুষ হত্যার মতো পাপ করেছে। আসলেই তো তার শাস্তি হবার দরকার। কঠিন শাস্তি মানুষ কেন পশু অব্দি যেন সেই শাস্তি দেখে শিউরে ওঠে। মধু যে তাকে কোনো একসময় পছন্দ করেছিল এটা শুনে সে মোটেও খুশি হতে পারেনি। বরং,, মনে হচ্ছে সে তার বন্ধুর প্রতি অন্যায় করেছে। মধুর প্রতি অন্যায় করেছে।

এরপর,, মাশফি এবং মধু দুজনে চুপচাপ। বাতাস বইছিল,, সূর্য তখন পশ্চিমের আকাশে অবস্থান করছে। সূর্যের হলুদাভ কিরণ এসে মাশফি এবং মুর গায়ে পরছিল। দূর থেকে কেউ দেখলে ভাববে দুজন কপোত-কপোতী। কিন্তু,, তারা দুজন যে সেতুর দুপ্রান্তের মানুষ। যারা কেবল একে-অপরকে দেখতে পারবে,অনুভব করতে পারবে কিন্তু ছুঁতে পারবে না।

—আদিবার বিয়ের দিন আপনাকে ভাবি কল করেছিল আমার নাম্বার থেকে। এই নাম্বারটা এ-র আগেও আপনার কাছে ছিল। কারণ,, আমি এই নাম্বার থেকে আপনাকে বহুবছর আগে মেসেজ পাঠাতাম। যার কারণে আপনার হয়তো চিনতে অসুবিধে হয়নি। ভাবি গতকাল আমাকে কিছু কথা বলেছে যার মধ্যে আদিবার বিয়ের দিন আমার নাম্বার দিয়ে আপনাকে কল করার কথা উঠে আসে৷ তখনি আমি বুঝে ফেলেছি আপনি হয়তো আমার নাম্বার এবং আমাকে চিনতে পেরেছেন। এবং এতকাল যাবত যা কিছু আড়ালে ছিল সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিছুদিন ধরে আপনার আচার-আচরণ,, কথাবার্তা সবটা মিলিয়ে বুঝলাম হয়তো আমার সম্পর্কে জানার পর থেকে আপনি এমন অদ্ভুত কাজগুলো করছেন৷ আর আজ যে কথাগুলো বললেন,, সবটা শোনার পর আমার নিজেকে কেমন নীচ মনে হচ্ছে জানেন? বাদলের প্রস্থান,, আপনার আজকের অবস্থানের জন্য যে একমাত্র আমিই দায়ী এরমাঝে কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো,, আগের মতো করে সবটা তৈরি করে দিতে পারব না। তবুও বলছি ক্ষতিপূরণ হিসেবে আপনি কি চাইছেন মধু?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here