চেনা_পথে,১৬

0
349

#চেনা_পথে,১৬
#Tahmina_Akhter

— আপনার ভালোবাসা থেকে আমাকে মুক্তি দিন।
আমি চাই না কেউ আমাকে ভালোবেসে তার জীবন এভাবে নষ্ট করে ফেলুক।

যান্ত্রিক কন্ঠে বলা মধুর সকল কথা শুনলো মাশফি। ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপের হাসি। যার জন্য করলো চুরি সে বলে চোর। আরে কার জন্য সে জীবনটা এভাবে নষ্ট করে ফেলেছে? আরে নিশ্বাস নিতে ভুলে যাবে তবুও মধুকে ভালোবাসবে না’র মতো দুঃসাহসিক কাজ তার দ্বারা সম্ভব না।

জীবনে একজনকে ভালোবেসেছি তাকে ভালোবেসে মরণ হোক। এই উক্তির ওপর মাশফির জীবন অটল।

— ক্ষতিপূরণ হিসেবে যদি বলতেন আমার প্রাণত্যাগ করতে হবে। তবে আমি র্নিদ্ধিধায় আমার প্রাণটা আপনার চরণে সমর্পণ করতাম। কিন্তু,, আপনি কি চাইলেন! আমার হৃদয় থেকে আমার অস্তিত্বকে মুছে ফেলতে বলছেন! আরে আপনি টের পাওয়ার আগে থেকে আমি আপনাকে ভালোবাসি। কই তখন তো একবারও বারণ করেননি? বারো বছর ধরে যাকে ভালোবেসে আমার ক্লান্তি আসেনি,, বিরক্তি হয়নি সেই আমি আপনার কথায় তাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারব না। এর বাইরে যদি কিছু চাওয়ার থাকে তবেই আমাকে জানাবেন।

মাশফি সেখান থেকে চলে গেলো। মধু একা দাঁড়িয়ে রইলো। এতটা একাকিত্ব বোধ হয়তো এতবছরেও অনুভব করেনি যতটা আজ করছে।

মধুর চোখে অশ্রু। অশ্রুশিক্ত চোখ,, ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। মোবাইল হাতে নিয়ে কাউকে কল করে বললো,,

—- পৃথিবীতে মানুষ একজনের ভালোবাসা পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। আর আমার ভাগ্য দেখো দু’জন মানুষ আমাকে ভালোবাসলো ঠিকই তবে বিনিময়ে আমি তাদের কিছুই দিতে পারিনি। শূন্য হাতে,, বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে তারা আমাকে ভালোবেসে ফিরে যাচ্ছে শূন্য হাতে ।

— এটা তো বরং আপনার সৌভাগ্য। একজনের ভালোবাসায় হয়তো সাড়া দিতে পারেননি কারন তাকে যে আপনি ভালোবাসতে পারেননি। যে আপনাকে ভালোবাসে এবং আপনি যাকে ভালোবাসেন অন্তত তাকে সুযোগ দিন। ভালোবাসাহীন জীবন বড্ড কঠিন। জীবনটা তখন মরে যাওয়ার গাছের মতো হয়ে যায়। মরা গাছের তো জ্বালানি কাঠ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না । কিন্তু,, জীবন্ত গাছ থেকে ছায়া মিলে,, ফুল-ফল আসে,, মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড়ো উপাদান অক্সিজেন মিলে। এখন আপনি বলুন গাছ জীবন্ত নাকি মৃত ভালো?

— জীবন্ত ।।

— আপনার জীবনের সঠিক উত্তরও এই জায়গায়। জীবনটাকে মৃত না বানিয়ে। জীবন্ত করে তুলুন। যেখানে শুধু শান্তি মিলবে কষ্ট নয়।

— এতটা বড়ো কবে হলে আদিবা??

— যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম পেট ভরে খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো বেঁচে থাকা হলো ভালোবাসা। শরীরটা আমার কিন্তু হৃদয় অন্যকারো এই ব্যাপারটা যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম সেদিনই বড়ো হয়েছি।

— নাফিসকে ভালোবাসো??

— আমার সাধ্য অনুযায়ী।

— মাশফি সাহেবকে কি বলব??

— কল করেন এবং সোজাসাপটা বলে দিন ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার আপনাকেই চাই।

আদিবার কথায় মধু লজ্জা পেয়ে কল কেটে দেয়। আসলেই কি এত সহজে কথাটি বলতে পারবে হয়তো না। মধু মরে যাবে তবুও কথাটি বলতে পারবে না।

— বাবা, আমি বিয়ে করব। আজ এবং এই মূহুর্তে।

মাশফির বাবা সবে মাগরিবের নামাজ আদায় করে বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন। মাশফির কথায় যদিও ইমতিয়াজ সাহেবের বিস্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু,, তিনি সামান্য চমকায়নি। মনে হচ্ছে মাশফি যে কথাগুলো বলছে উনি তা আগে থেকে জানতেন। টুপি খুলে পাঞ্জাবির পকেটে পুরে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,,

— আমি তো ভেবেছিলাম তুমি হয়তো বিয়েশাদির মতো ভেজালে জড়াবে না। কিন্তু,, না তুমিও সেই একই কাজ করছো! থাক সেসব কথা৷ এখন বলো মেয়ে কোথায় পাব? একটা বিবাহ উপযুক্ত ছেলেকে দেখে শুনে বিয়ে করাতে কতদিন সময় লেগে যায় জানো তুমি? আর সেই জায়গায় আটত্রিশ বছর বয়সী ছেলে না মানে সরি আধবুড়ো ব্যাটার জন্য আজকের মধ্যে মেয়ে খোঁজ করে এনে বিয়ে করানোর মতো দুঃসাহসিক কাজ করার মতো এ্যানার্জি আপাতত আমার শরীরে নেই। বিয়ে করতে রাজি হয়েছো খুশি হয়েছি। ভালো মেয়ে খোঁজ লাগিয়ে আনতে হবে কিন্তু সময়ের প্রয়োজন। অতএব,, ধৈর্য ধারণ করো।

— কিন্তু, বাবা…

ইমতিয়াজ সাহেব মাশফিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চললেন। এদিকে মাশফি যেন টেনশনে পাগল হবার উপক্রম। কারণ,, আগামীকাল রাতের ফ্ল্যাটে জাপানে ফিরে যেতে হবে। এরমাঝে যদি মধুকে বিয়ে করতে না পারে তবে আর কোনোদিনও কি সে মধুকে নিজের করতে পারবে? হয়তো না। সব সর্ম্পক মিছে হয়ে যাবে। মিছে হয়ে যাবে সব স্বপ্ন।

এই নারীকে ভালোবেসে গেছে কিন্তু ভালোবাসা জাহির করতে পারলো কই? বিদেশ ফিরে যাওয়ার আগে ধরে বেঁধে তাকে বিয়ে করে তবেই যাবে। দুবছরের মধ্যে আপনাআপনি মন বসে যাবে মাশফির ওপর । কিন্তু,, বাবাকে যে বিয়ের কথা বলল, বাবা তো পাত্তাই দিলো না। বিয়ে করবে কি করে? বাবার কোনো হেলদোল নেই,, এদিকে যাকে বিয়ে করবে সে রাজি হয় কি না কে জানে? ভাবির কথায় বড়ো ধরণের ভুল করতে যাচ্ছে না তো!

সোফায় বসে কথাগুলো ভাবছিল মাশফি এমনসময় কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মাশফি মাথা উঁচু করে তাকালো। ওর বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। মাশফি মাথা নীচু করে ফেললো কারণ ওর বাবা-মা যে এখন ওর কাছ থেকে ওর জীবনের বিশেষ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে এসেছে।

—- তোর বাবা আমাকে একবারই দেখলো তাও আবার আমার নানারবাড়িতে। সেখান থেকেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করলো কি করে আমাকে বিয়ে করা যায় ? অনেক কাঠখোড় পুড়িয়ে আমার নানা-নানিকে রাজি করালো। লোক পাঠিয়ে তোর দাদুকে নিয়ে গেলো এবং সেই রাতেই বিয়ে হলো তোর বাবার এবং আমার । তোর বাবা যদি নব্বই দশকে নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে তবে তুই এই যুগের মানুষ হয়ে কেন নিজের ভালোবাসাকে বুকের মধ্যে দাবিয়ে রাখবি? ভালোবাসা কি লুকিয়ে রাখার জিনিস? ভালোবাসা হচ্ছে স্বর্গীয় অনুভূতি। আর তুই ওমন স্বর্গীয় অনুভূতিকে বুকের মাঝে দাবিয়ে রেখে নিজের জীবনটাকে নরকে পরিণত করতে চেয়েছিস?

মাশফির মায়ের চোখের জল গড়িয়ে পরে। মাশফির বাবা এগিয়ে এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিয়ে মাশফির মাথায় হাত রাখলেন। পরম আদরে জিজ্ঞেস করলেন,,

— আদিবার কাছে কিছুটা জেনেছি আমরা। আবৃত্তির কাছ থেকে পুরোটা জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু আবৃত্তি চায় তুই আমাদের সবটা জানাস। তাই আবৃত্তিকে জোর করিনি। তোর কাছে জানতে চাই মেয়েটা কে? যে আমাদের চেয়েও বেশি দামি তোর কাছে। যার কারণে বিদেশ-বিভুঁইয়ে রয়ে গেলি বুড়ো বাপ-মাকে দেশে একলা ফেলে।

মাশফির আজ লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গেছে। সত্যিই তো মধুকে ভুলে থাকার জন্য সে তার শেকড়কে ভুলে গিয়েছিল। তাদেরও যে সন্তানের প্রয়োজন আছে এটা কখনোই মাশফির মাথায় আসেনি। যদি না সেদিন আদিবা তাকে কল করে কথাগুলো বলতো। তাহলে তো কখনো জানার ইচ্ছাও জাগতো না।

মাশফি দু’হাতে বাড়িয়ে ওর বাবা-মাকে দুপাশে বসিয়ে সোফার সামনে রাখা ছোট্ট টি-টেবিলের ওপরে বসে বলতে শুরু করলো,,

— মেয়েটাকে ভুলে যাওয়ার জন্য বিদেশ ফিরে গিয়েছিলাম। দেশে ফিরে আসার কথা ভাবলেই মনে হতো দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। তবুও, একবার সাহস করে দেশে এসেছিলাম। কিন্তু, এয়ারপোর্টে নামার পর মনে হলো আমি শ্বাস নিতে পারছি না। বহু কষ্টে নিজেকে তিনদিন হোটেলে রাখলাম। তারপর,, ফিরতি ফ্লাইটে আবারও জাপানে ফিরে গেলাম৷ তোমরা কেউই জানলে না এই ব্যাপারে। কিন্তু,, এবার আদিবার কথায় নিজেকে আটকাতে পারিনি তাই তো চলে এসেছি আপন নীড়ে। কিন্তু, এখানে আসার পর বুঝতে পারলাম বারো বছর আগে আমারও কিছু ভুল হয়েছিল যার কারণে অন্য একটা মানুষকে সেই খেসারত ভুগতে হচ্ছে । আজ তার সঙ্গে কথায় হয়েছে। কিন্তু তার সাথে কথা হওয়ার আগে আবৃত্তি ভাবির কাছ থেকে জানতে পারলাম সে কারো জীবনের সঙ্গে জড়ায়নি। এখন বাবা-মা ; আমি কি তাকে পাওয়ার জন্য কিছুই কি করতে পারব না? যাকে কোনো একসময় পাওয়ার জন্য মরতে গিয়েও মরতে পারিনি তাকে যখন পাওয়ার সুযোগ পেয়েছি তখন হাতছাড়া করি কি করে??

মাশফি কথাগুলো বলতে বলতে ওর মায়ের কোলে মাথা রাখলো। মিনা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজের চোখের জলটুকু মুছে বললো,,

— মেয়েটা কে?

মাশফি ওর মায়ের কোল থেকে মাথা উঁচু করে বসলো। পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে সেটা ওর বাবা-মায়ের চোখের সামনে মেলে ধরলো।

মেয়েটাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছে। মিনা যখনি ছবির মেয়েটাকে চিনতে পারলো তখনি ছেলের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো।

মাশফি ওর মায়ের চাহনি দেখে মাথা নীচু করে ফেললো।

— ইশশ,, মা যদি এখন রাজি না হয়?

ম্যানিব্যাগটা মাশফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিনা। মাশফির বাবা স্ত্রীর কার্যকলাপ দেখে কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকলেন আসলে সে কি করতে চাইছে?

মাশফির মা একে একে নিজের বড়ো ছেলে, ছেলের বৌ এবং আদিবাকে কল করে আসতে বললো তাও এক্ষুনি। সবাইকে আসতে বলে এবার নিচতলায় থাকা কোণার ঘর গিয়ে নিজের শাশুড়িকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে এলেন। মাহবুব অফিস থেকে চলে এলো। আবৃত্তি ওর ঘর থেকে দৌঁড়ে এসেছে। বাকি রয়ে গেছে আদিবা। যদিও সে জানিয়েছে যে ও সিএনজিতে করে আসছে। হয়তো আর দশমিনিট সময় লাগবে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here