#চেনা_রোদে_বসন্ত
#পর্ব_৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
“সরাসরি কিছু বলতে পারব না আমি! শুধু এতো টুকুই বলব, রিয়াশা নামের মাঝেই অনেক অজানা সত্য লুকিয়ে আছে! যার অস্তিত্ব তুমি পাঁচ মাস ধরে বহন করে চলছ রিয়াশা! তরুন তোমার মাঝেই অন্য কারো ছায়া খুঁজে পায়। ভাবে তুমিই হয়তো সেই ছায়াধারী ব্যক্তি! যাকে তরুন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসত! এমনকি যার ভালোবাসায় তরুন এখন পাগল হয়ে উঠেছে!”
দ্রুত পায়ে হেঁটে আপু প্রস্থান নিলেন। চোখের পলকেই যেনো তিনি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন! আমার আকস্মিক, উদ্বিগ্ন এবং হটকারি চাহনি এখনও আপুর যাওয়ার পথে সীমাবদ্ধ। ঘোর কাটিয়ে যেনো কিছুতেই সম্বিত ফিরে আসছে না আমার! কী বলে গেলেন তিনি এসব? আমার নামের মাঝেই কোনো অজানা সত্য লুকিয়ে আছে? আমার মাঝেই তরুন অন্য কারো ছায়া খুঁজে পায়? আর সেই ছায়াধারী ব্যক্তির ভালোবাসায় তরুন এখন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠেছে? আদৌতেই কী এসব সত্যি? নাকি আপু আমাদের সাথে ছলনা করছেন? আপুর উপর থেকে সন্দেহের তীর ঘুরানোর জন্য আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন? এই মুহূর্তে আমি দিক-বিদিক শূণ্য, হিতাহিতজ্ঞান শূন্য। কিছু বলার বা করার পরিস্থিতিতে নেই! দারুন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।
ইতোমধ্যেই রাফায়াত ভাই উদ্বিগ্ন চিত্তে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। কপালে লেপ্টে থাকা বেসামাল চুল গুলো টেনে তৎপর গলায় শুধালেন,,
“মহিলাটি কী আসলেই আমাদের সত্যি বলে গেলেন? নাকি নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বোকা বানিয়ে গেলেন?”
শুকনো ঢোক গিলে আমি রাফায়াত ভাইয়ার দিকে তাকালাম! আবদার সূচক দৃষ্টিতে রাফায়াত ভাইকে শুধালাম,,
“যাবে আমার সাথে আমার শ্বশুড় বাড়িতে? শ্বাশুড়ী মায়ের কাছ থেকে আমি আসল সত্যিটা জানতে চাই এট এ্যানি কস্ট।”
তিনি উৎকন্ঠিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন! অতঃপর তব্ধ শ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় বললেন,,
“যাব। অবশ্যই যাব। তবে এর আগে তোকে শান্ত হতে হবে। নিজেকে স্থির করতে হবে। এরপর দুজন মিলে খেয়ে-দেয়ে ঐ বাড়ি যাব। আমি জানি তোর ক্ষিদে পেয়েছে এখন। আগে নিজেকে ঠিক রাখতে হবে তো নাকি? নিজের বাচ্চার কথা আগে ভাবতে হবে না? ভুলে গেলে চলবে? তুই এখন মা হতে চলেছিস?”
অপারগ আমি! তাই কথা না বাড়িয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। পেটে হাত রেখে মুর্ছে আসা গলায় বললাম,,
“অর্ডার দাও তাড়াতাড়ি। হালকা খাবার হলেও চলবে৷ বেশি সময় নেই কিন্তু আমাদের হাতে। তরুনের পাশে দাঁড়ানোটাই এই মুহূর্তে আমার অতি গুরুত্বপূর্ণ।”
আমার কথা অনুযায়ী তিনি দ্রুত ওয়েটারকে ডেকে দিলেন। মেন্যু অনুযায়ী হালকা খাবারের অর্ডার করে দিলেন! খাবার আসার আগ অবধি তরুনের টেনশানে অনবরত কেঁদে চলছি আমি। রাফায়াত ভাই বিভিন্ন ভাবে আমায় বুঝানোর চেষ্টা করছেন। তবে কিছুতেই উনার বুঝ মানতে ইচ্ছে করছে না আমার। এতে যেনো কষ্ট দ্বিগুন বেড়ে যাচ্ছে! এতো বুঝানোর পরেও তিনি সামান্যতম বিরক্তবোধ হচ্ছেন না আমার প্রতি। উল্টো ঠান্ডা মাথায় আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন! বিভিন্ন ভাবে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করছেন। তবে আফসোস! এই মুহূর্তে আমার হাসি তো দূরে থাক। কান্না বন্ধ করতেও ইচ্ছে করছে না! মনের মধ্যে ঠিক কতোখানি ঝড় বয়ে চলছে আমার শুধুমাত্র আমিই জানি৷ তা অন্য কারো জানার ক্ষমতা নেই। আর যতক্ষন অবধি না আসল সত্যিটি আমি জানতে পারছি, ততক্ষন অবধি কোনো কিছুতেই শান্তি হবে না আমার।
কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলে আসতেই কোনো রকমে খাবার গুলো গিলে আমরা বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। রিকশা ধরে শ্বশুড় বাড়ির দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় কেউ কোনো কথা বলি নি আমরা৷ নিজেদের মতোই যতোটা সম্ভব নীরব হয়ে থেকেছি! রাফায়াত ভাইয়াও কোনো রকম চেষ্টা করেন নি আমার সাথে কথা বলাতে। হয়তো তিনিও আমার মতো ক্লান্ত, শ্রান্ত, অত্যধিক যন্ত্রণায় জর্জরিত!
প্রায় ঘন্টা খানিক পর।
বাড়ির বসার ঘরে শ্বাশুড়ী মায়ের মুখোমুখি বসে আছি আমি এবং রাফায়াত ভাই! শ্বাশুড়ী মা হঠাৎ আমাদের দেখে থতমত খেয়ে বসে আছেন৷ মাথা নুঁইয়ে তিনি হাত কচলাচ্ছেন! আমাদের হুট করে চলে আসা বোধ হয় উনার পছন্দ হয় নি! যা উনার বিরক্তিকর দৃষ্টি ভঙ্গি দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে আমি আমার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং জেদে অনড়। কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিই আমাকে এই উদ্দেশ্য থেকে দূরে রাখতে পারবে না। তাৎক্ষণিক রাফায়াত ভাইয়ার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। সোফায় শ্বাশুড়ী মায়ের পাশ ঘেঁষে বসলাম। রাগান্বিত দৃষ্টিতে শ্বাশুড়ী মায়ের দিকে অনেকটা ঝুঁকে আমি অবলীলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,
“বলুন মা? তরুন ঠিক কোন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন? যে সমস্যায় ভুগলে তার স্ত্রী তার পাশে থাকতে পারবে না? তার থেকে দূরে থাকতে হবে? উন্মাদের মতো যা ইচ্ছে তা ব্যবহার করবে?”
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে শ্বাশুড়ী-মা মাথা উঁচিয়ে আমার দিকে তাকালেন! একই দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি হঠাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন! অন্য পাশ ফিরে কম্পিত গলায় বললেন,,
“এএএ আবার কেকেমন ধরনের প্রপ্রশ্ন বউ মা? আমি তো তোমাকে জাস্ট কয়েকদিনের জন্য তোমার বাপের বাড়িতে বেড়ানোর সুযোগ দিয়ে এলাম! এখানে তুমি দোষের কী দেখলে?”
“মিথ্যে বলছেন আপনি! তরুনের কোনো দুর্বলতাকে আপনি প্রাণপনে লুকানোর চেষ্টা করছেন। প্লিজ বলুন কী সেই দুর্বলতা? দয়া করে আমাকে আর অন্ধকারে রাখবেন না মা। তরুনের ওয়াইফ আমি। সেই জায়গা থেকে আমার শতভাগ অধিকার আছে তরুনের প্রকাশ্য/অপ্রকাশ্য সমস্ত সমস্যা সম্পর্কে জানার। তার ভালো-মন্দ দিক গুলো জানার।”
অস্থির দৃষ্টিতে শ্বাশুড়ী মা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন! অল্প সময় একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর তিনি হঠাৎ আমার হাত দুটো শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরলেন! কান্না জড়িত গলায় আমায় শুধালেন,,
“কথা দাও আমায়? সত্যিটা জানার পর তরুনকে তুমি ছেড়ে যাবে না? মৃত্যুর আগ অবধি তরুনের পাশেই থাকবে? তরুন এবং আমাদের কোনো প্রকার ভুল বুঝবে না?”
দৃষ্টি ঘুরিয়ে আমি রাফাযাত ভাইয়ার দিকে তাকালাম! অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! তাৎক্ষণিক জোরপূর্বক হেসে তিনি ইশারায় মাথা নাড়িয়ে বুঝালেন শ্বাশুড়ী-মাকে কথা দিতে! আজীবন তরুনের পাশেই থাকতে! ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি! শ্বাশুড়ী মায়ের হাত দুখানা শক্ত হাতে ধরে বললাম,,
“কথা দিলাম মা! তরুণকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷ মৃত্যুর আগ অবধি আমি তরুনের পাশেই থাকব। প্লিজ আপনি এই নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা বা ভয় পাবেন না৷ তরুনের সমস্যা গুলো নির্দ্বিধায় আমায় খুলে বলুন।”
মৃদু হেসে উঠলেন শ্বাশুড়ী-মা! স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন৷ ভরসা পেয়ে তিনি অনর্গল বলতে আরম্ভ করলেন,,
“রিয়াশা!” রিয়াশা নাম ছিল মেয়েটির। আজ থেকে প্রায় দু’বছর আগে তরুনের সাথে কোনো ভাবে প্রেমের সস্পর্কে জড়িয়েছিল মেয়েটি! সম্পর্কের প্রায় দেড় বছর পর বিষয়টি জানতে পারি আমি। বলতে পারো তরুন তখন নিজ থেকেই বিষয়টি আমার কাছে শেয়ার করেছিল৷ এমনিতেও তরুন যেকোনো ছোট খাটো বিষয়ও আমার কাছে শেয়ার করতে পছন্দ করত। কোনো ক্ষুদ্র কথাও আমার কাছে গোপন রাখত না সে। তরুনের কথা মতো মেয়েটির সাথে কথা বলে এবং দেখা করে বুঝতে পারলাম মেয়েটি সত্যিই খুব ভালো! নিঃসন্দেহে মেয়েটিকে ঘরের বউ করে আনা যায়। তাছাড়াও তরুন রিয়াশা অন্ত প্রাণ ছিল! পাগলের মতো ভালোবাসত মেয়েটিকে। সারা দিন রাত শুধু রিয়াশাকে নিয়েই মেতে থাকত। বলতে পারো মেয়েটি তরুনের এক প্রকার অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নেশার মতো ছুটত রিয়াশার পেছনে৷ দিন-দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতিই টান কাজ করত না তার। তরুনের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে তখন আমি এবং তরুনের আব্বু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মেয়েটির পরিবারের সাথে দেখা করে বিয়ের দিন/তারিখ ঠিকঠাক করে নিতে। যতো দ্রুত সম্ভব বিয়েটা পড়িয়ে দিতে। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন…”
থেমে গেলেন মা! শান্ত চোখ দুটো মুহূর্তের মধ্যেই মায়ের অশান্ত হয়ে উঠল! ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। কান্নাজড়িত গলায় বললেন,,
“হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় তরুনের কার এক্সিডেন্ট হয়! খুবই মারাত্নক জখম হয় তরুনের সমস্ত শরীর। বিশেষ করে মাথায় খুব বেশি এফেক্ট হয়! বিগত এক থেকে দেড় বছর আগের স্মৃতি তরুন ভুলতে শুরু করে! রিয়াশার নামটি ছাড়া রিয়াশার সাথে থাকা সমস্ত সম্পর্কের কথা ভুলে যায় তরুন! দেশে যতো উন্নত এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা আছে সব চিকিৎসা প্রয়োগ করেছিলাম আমরা। তবে লাভ কিছু হয় নি এতে। টানা তিন মাস তরুন হসপিটালে ভর্তি ছিল। রিয়াশা প্রতিদিন নিয়ম করে তরুনের সাথে দেখা করতে যেতো। তবে তরুন শুধুমাত্র রিয়াশাকে ফ্রেন্ড হিসেবেই ট্রিট করত! তাদের মধ্যে থাকা গভীর প্রেমের সম্পর্কের কথাও পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল তরুন! রিয়াশা চোখের সামনে এসব সহ্য করতে পারছিল না! মেয়েটিও ভেতর থেকে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল! যদিও ডক্টর বলেছিলেন তরুনকে কয়েকটি মাস সময় দিতে। হতে পারে সেটা ৫ মাস ৬ মাস কিংবা ১ বছর! ঔষধের প্রভাবে তার মানসিক শক্তি দিন দিন ফিরে আসতে পারে। হারিয়ে যাওয়া এক/দেড় বছরের স্মৃতি আবারও ফিরে আসতে পারে! সেই আশাতেই ছিলাম আমরা। তবে রিয়াশার পরিবার রিয়াশাকে সেই সময়টুকু দিতে চান নি! তারা জোরপূর্বক রিয়াশাকে ধরে বেঁধে ফ্রান্সে শিফট হয়ে যান! ঐ দেশে রিয়াশার বাবার গ্রিন কার্ড ছিল। তাই কম সময়ের মধ্যে ফ্রান্সে যাওয়া তাদের জন্য জটিল কিছু ছিল না। সেই থেকে প্রায় এক বছর হতে চলল তরুনের সাথে রিয়াশার বিচ্ছেদের!”
অশ্রুজল যেনো কিছুতেই বাঁধ মানছিল না আমার। চিৎকার করে আমি আর্তনাদ প্রকাশ করে আমি বললাম,,
“কেন সময় দেন নি আপনারা তরুনকে এক বছর হ্যাঁ? কেন সময় দেন নি? কেন এসবের মাঝে আপনারা আমাকে টেনে আনলেন? একটু একটু করে তরুনের স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতে শুরু করছে। এখন আপনারা তরুনকে যাই বুঝাচ্ছেন তরুন হয়তো তাই বুঝে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে কিছুদিন পর যখন তার স্মৃতি শক্তি পুরোপুরি ফিরতে শুরু করবে তখন কী হবে আমার? শুধু রিয়াশা নামটি মিললেই তো চলবে না, চেহারার মিলও তো থাকতে হবে! তখন কী জবাব দিবেন আপনারা তরুনকে হ্যাঁ? আমিই বা কী জবাব দিব তরুনকে?”
#চলবে….?