চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ১৬

0
765

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ১৬
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________

জঙ্গলটা আজকে এত পরিষ্কার মনে হচ্ছে কেন? কোথায় সেই চির ক্ষয়িষ্ণু কালো অন্ধকার? কোথায়? আগে যে অন্ধকার দেখা যেত জঙ্গলের ভিতর, দেখে যে মনে হতো ওখানে কোনো দিন কোনো আলোর প্রবেশ ঘটেনি, সেটা আজকে আর মনে হচ্ছে না কেন? তবে কি ভয়, কৌতূহলে অত বেশি অন্ধকার দেখতে পেত? সেটাই কি? উহ, কাল রাত থেকে এসব ভাবতে ভাবতে মাথায় যন্ত্রণা ধরে যাচ্ছে। মিতুল এসব ভাবনাকে অতলে তলিয়ে দিয়ে জঙ্গলে যাওয়ার পথ ধরলো। সরু রাস্তা ধরে হাঁটছে। আশেপাশে তাকালে দেখা যাচ্ছে বড়ো বড়ো গাছ। মিতুল জানে এখন আর এই জঙ্গলে ভয়ের কিছু নেই। তবুও কেন যেন গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে। কালকে রাতে ভালো করে কিছুই দেখা হয়নি। দূরে যে ওই আলো দেখতে পেয়েছিল, সেটা কী ছিল? এই জঙ্গলের ভিতর আলো এলো কোত্থেকে? আজকে জোহানকে এ ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করবে।
রাতে মিতুলের ভালো ঘুম হয়নি। বলতে গেলে ঘুমই হয়নি। কালকে রাতের কথা মনে পড়ছিল বার বার। জোহানকে কেন মেরেছিল ওই ছেলেগুলো? জোহানের সাথে তাদের সম্পর্ক কী? জোহানের মুখে যে আগেও মারের দাগ দেখেছিল, তাও কি ওই ছেলেগুলোর থেকে পাওয়া আঘাতের কারণে ছিল? না কি আবার অন্য কেউ মেরেছিল? মারলো কেন ওকে? এর সব উত্তর জোহানের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে। মিতুলের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে জঙ্গল নিয়ে ওর এত ভয়, দুশ্চিন্তা ছিল, সেই জঙ্গলে কি না ভয়ের কিছুই নেই। ভাবা যায়?

মিতুল দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছন ফিরে তাকালো। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। গার্ডেন দেখা যাচ্ছে এখনও। ওর মনে হলো জঙ্গলের প্রথম দিকে গাছ যেন বেশি ঘন। এখানে বেশি সূর্যের আলো নেই। গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে অল্প অল্প সূর্যের আলো এসে জমিন ছুঁয়ে দিচ্ছে। মিতুল হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে নিবিড় চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সব। গাছ পাতলা হয়ে এসেছে। এখানে অনেক রং বেরঙের বুনো ফুলের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলোর খেলা এখন জঙ্গল জুড়ে। সব যেন চকচকে আলোয় স্বচ্ছ পরিষ্কার। আর কয়েক পা হাঁটলে দেখা যাবে গাছই নেই প্রায়। যে জঙ্গলকে অন্ধকার রাজ্য মনে করতো, সেই জঙ্গলের এখানে এখন রাশি রাশি আলো। হঠাৎ মনে হলো জঙ্গলটা ওর ভালোই লাগছে। যারা কেবল বাইরে থেকে দেখেছে জঙ্গলটা, তারা এর ভিতরে না ঢুকলে বুঝতেই পারবে না এই জঙ্গলের ভিতর কত আলো! ও নিজেও তো বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল জঙ্গলটা বোধহয় একটা অন্ধকার রাজ্য।
মিতুল বামে বাঁক নিলো। ওই তো জোহানের ঘরটা দেখা যাচ্ছে। মিতুল কালকে আলো দেখা জায়গাটায় তাকালো। চোখ সরু হয়ে এলো। ওখানেও কি ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে না কি? হুম তাইতো। এই জঙ্গল থেকে বাইরের দৃশ্যও দেখা যায় তাহলে? কালকে কি তবে ওইসব বাড়িতে জ্বালানো লাইটের আলোই দেখেছিল? হ্যাঁ, তাই হয়ে থাকবে।
মিতুল দূরের বাড়িগুলো দেখতে দেখতে জোহানের ঘরের সামনে এসে গেছে।
আচ্ছা, জোহান থাকে কী করে এখানে? ভয় করে না ওর? হোক এটা তেমন গাছপালা ঘেরা ঘন জঙ্গল নয়, তারপরও…
মিতুলের জোহানের কথা মনে পড়লো। জোহান ঘুম থেকে উঠেছে? মিতুল তিন ধাপ ওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। দরজা দিয়ে উঁকিঝুকি মারার চেষ্টা করছে। কিন্তু উঁকিঝুকি মেরে কী দেখছে সেটা নিজেও জানে না। মিতুলের উঁকিঝুকি মারার এক পর্যায়ে বন্ধ দরজাটা চোখের পলকে হঠাৎ খুলে গেল। মিতুল দেখতে পেল এক জোড়া বাদামি চোখ ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। জোহানকে দেখে মিতুল অপ্রস্তুত হাসলো।

“গুড মর্নিং জোহান!”

“তুমি এখানে?”

“দেখতে এলাম তোমাকে। তোমার ব্যথা কি সেরে গেছে? দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে।”
মিতুল এখানে একটু মিথ্যা বললো। জোহানকে দেখতে আসা ওর প্রধান উদ্দেশ্য নয়। রাতে এই জঙ্গল এবং জোহানের এই টাইম হাউজ কিছুই ভালো করে দেখতে পারেনি। সেটাই এখন দেখতে এসেছে।

“দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেন? ভিতরে ঢুকতে দেবে না?”

জোহান দরজার কাছ থেকে সরে বললো,
“এসো।”

মিতুল প্রবেশ করলো। প্রথমেই চোখ চলে গেল ফ্রিসিয়াস ফুলগুলোর উপর। ঘরকে মিষ্টি সুবাসে ভরিয়ে রেখেছে এরা। ফুলের উপর রোদ এসে পড়েছে।
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললো,
“কালকে তো বলছিলে তুমি খুব দুর্বল! কাউচ ছেড়ে নামার শক্তিটুকুও নেই তোমার। তাহলে আজকে এত টনটনা ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছ কী করে?”

“আমাকে কি তোমাদের মতো নিষ্কর্মা মনে হয়? যে একটু মার খেয়েই এক মাস বিছানায় পড়ে থাকবো? আই অ্যাম অ্যা একটিভ বয়।”
বলতে বলতে কাউচের উপর বসলো জোহান।

মিতুলের এতক্ষণে জোহানের পোশাকের দিকে খেয়াল হলো। পোশাকও পাল্টে ফেলেছে দেখছে। শার্ট, জিন্স রেখে ধূসর রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং বেগুনি রঙের টি শার্ট পরেছে। অথচ কাল বললো ও কাউচ ছেড়েই নামতে পারবে না, এতটাই দুর্বল!

“এমন করে কী দেখছো?” মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো জোহান।

“তোমার দিকে একটু তাকালেই কি এরকম আর সেরকম করে দেখা হয়ে যায়? কী হবে তোমাকে একটু দেখলে? তোমার রূপ নগরী ধ্বংস হয়ে যাবে?”

“হতে কতক্ষণ? বলা তো যায় না, নজর তো লেগেও যেতে পারে। তোমাদের মেয়ে জাতির উপর কোনো বিশ্বাস নেই। তোমরা চাইলে সবই পারো।”

মিতুল মুখ বাঁকালো।

জোহান বললো,
“ঠিক আছে, এ নিয়ে আর কথা না বাড়াই। এক কাজ করো। কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে আনো আমার জন্য।”

“কী? কী করবো আমি?”

“কফি বানিয়ে আনতে বললাম তোমায়…
ওহ বুঝতে পেরেছি। আমার একার জন্য কফি বানাতে বললাম বলে রাগ করেছো? ঠিক আছে, আমার একার জন্য নয়, তোমার জন্যও এক মগ বানিয়ো।”

জোহান যে অপমান করে কথা বলছে সেটা বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না মিতুলের। মিতুল তেজি গলায় বললো,
“আমাকে কি নিজের দাসী মনে করো? তুমি যা বলবে তাই করতে হবে আমার? কালকে তোমার ট্রিটমেন্ট করে দিয়েছি সেটাই ছিল মাত্রাতিরিক্ত! বুঝেছো? জীবনেও যেই কাজ করিনি আমি তোমার জন্য সেটা করতে হয়েছে আমার। কালকে করে দিয়েছি বলে কি আজকেও হুকুম নিয়ে বসেছো? তোমার হুকুম তুমি নিজেই শোনো এবং পালন করো। তোমার হুকুম পালন করতে এই মিতুল দিলরাবা বসে নেই।”

“এখানে দাসী, ট্রিটমেন্ট এত এত কথা উঠলো কেন? কে বললো যে আমি তোমাকে হুকুম করছি? দেখতে পাচ্ছ না আমি আহত একজন রোগী? একজন আহত রোগীর পক্ষে কি কফি বানিয়ে খাওয়া সম্ভব?” মিতুলকে প্রশ্ন করে আবার নিজেই বললো,
“না, সম্ভব নয়। একজন আহত রোগী কিছুতেই কফি বানিয়ে খাওয়ার অবস্থায় থাকে না। এটা অবশ্যই অন্য কারো বানিয়ে খাওয়ানো উচিত। বুঝতে পে…”
জোহান কথার মাঝেই হঠাৎ পেট চেপে ধরে ব্যথা পাওয়ার মতো শব্দ করলো। পেট চেপে ধরেই আস্তে আস্তে একদিকে কাত হয়ে কাউচের সাথে মিশে গেল একেবারে।
মিতুলের চক্ষু দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ও পেল ভীষণ। উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হলো তোমার?”

জোহান সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মিতুলের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
“একজন রোগীকে কী করে তুমি উত্তেজিত করে তুলতে পারো? জানো না, রোগীর সাথে এমন আচরণ করা বেআইনি? কেউ শেখায়নি তোমায়?”

মিতুল কিছু বলতে পারলো না। শুধু অপরাধী চোখে নিরাশ তাকিয়ে রইল।
জোহান আরও কিছুক্ষণ ওভাবে কাউচের সাথে থেকে সোজা হয়ে বসলো। নিজের পেটের আহত জায়গায় হালকা ম্যাসাজ করতে করতে বললো,
“তুমি এখনও এভাবে স্থির দাঁড়িয়ে আছো কেন? একজন রোগীকে দুর অবস্থায় ফেলে দিয়েও কি অনুশোচনা হচ্ছে না তোমার? যাও কফি বানিয়ে আনো আমার জন্য।”

মিতুল বাধ্য মেয়ের মতো বললো,
“যাচ্ছি।”

মিতুল কিচেনে ঢুকতে যাবে এমন সময় জোহান পিছন থেকে বলে উঠলো,
“এই দাঁড়াও।”

মিতুল পিছন ফিরে বললো,
“কী?”

জোহান মিতুলকে এতক্ষণ একেবারেই খেয়াল করে দেখেনি। এখন ভালো করে দেখতে লাগলো। মিতুলের পরনে খয়েরি রঙের জর্জেটের থ্রি পিস। মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছে। গায়ে জড়িয়ে রেখেছে একটা খয়েরি রঙের শাল। জোহান মিতুলকে এমন সাজে কখনো দেখেনি। বললো,
“হঠাৎ করে তোমার লুক চেঞ্জ হয়ে গেল কেন?”

“মানে?”

“আমি তোমার ড্রেস আপের কথা বলছি।”

ড্রেস আপ? মিতুল নিজের ড্রেসের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটু। জোহানকে প্রশ্ন করলো,
“কী হয়েছে আমার ড্রেসের?”

“কিছুই হয়নি। তোমাকে জাস্ট ভালো লাগছে না দেখতে। কখনো এই ড্রেস পরবে না আর। আর হ্যাঁ, ওই…” জোহান মিতুলের গায়ের শালটার দিকে ইঙ্গিত করলো।
“ওটা দেখে মনে হচ্ছে একটা বস্তা জড়িয়ে আছো গায়ে।”

মিতুলের মুখ অপমানে রক্তিম হয়ে উঠলো। ওকে দেখতে খারাপ লাগে? এটাই বললো জোহান? মিতুল প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“এখন আমি কি পরবো সেটাও তুমি ডিসাইড করে দেবে? একশ বার এই ড্রেস পরবো আমি। কী করবে তুমি? একটানা দশ দিন এই ড্রেস পরে তোমার সামনে সামনে ঘুরবো আমি। কী করবে তুমি?”
বলে ঝড়ের গতিতে কিচেনে ঢুকে গেল।

জোহান কিচেনের শূন্য দরজাটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। অস্ফুট স্বরে বললো,
“তোমাকে রাগলে খুব ভালোই লাগে নাক ফুলো তুলতুল। তুমি একটানা দশ দিন এই ড্রেস পরে আমার সামনে ঘুরলে আমি মনে করবো এটা আমার আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া একটি চোখ জুড়ানো উপহার। কারণ তুমি এই ড্রেসে দেখতে অত্যাধিক সুন্দর।”

ইচ্ছা করছে জোহানকে কফির বদলে বিষ বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু বিষ বানানোর প্রক্রিয়া তো ও জানে না। কী কী লাগে এই বিষ বানাতে? কিছু বিষাক্ত গাছের নির্যাস একসাথে মিক্সড করলে পারফেক্ট বিষ হবে? মিতুল এসব ভাবতে ভাবতেই কফি তৈরির সব উপকরণ খুঁজতে লাগলো। ও জীবনেও কফি তৈরি করে খাওয়াতো না জোহানকে। কিন্তু নানুর কথা মনে পড়ছে ওর। নানু বলতেন অসুস্থ মানুষের দেখভাল করতে হয়, সাহায্য করতে হয়। জোহান তো এখন অসুস্থ। মিতুল ভাববে ও জোহানের জন্য নয়, একজন অসুস্থ মানুষের জন্য কফি তৈরি করছে।

মিতুল কফি তৈরির মেশিন ব্যবহার করে কফি তৈরি করতে জানে না। কী ভাবে ইউজ করে এটা? চেয়েছিল একটু ট্রাই করে দেখবে। কিন্তু সাহস পেল না। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে? বাই চান্স যদি মেশিনটাই নষ্ট হয়ে যায়? না না দরকার নেই। পরের জিনিস নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। এসব ইচ্ছা থাকলে ওই জোহান বদমাইশটার থাকতে পারে। মিতুল চুলোতে কফি তৈরি করলো।
এক মগ কফি নিয়ে ফিরলো লিভিং রুমে। এই কফি জোহানকে খেতে দিতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে জোহানের মুখে ছুড়ে মেরে ওর মুখটা পুড়িয়ে দেয়।
একটা মগ দেখে জোহান বললো,
“একি, শুধু আমার জন্য কফি তৈরি করলে কেন? নিজের জন্যও করতে।”

মিতুল কঠিন মুখে জবাব দিলো,
“তোমার এখানে কফি খেতে আসিনি আমি। তোমার এখানে বসে কফি খাওয়ার থেকে তো বিষ পান করাও বেটার।”

জোহান মগে চুমুক দিয়ে বললো,
“কিন্তু বিষ পান করলে তো তুমি মারা যাবে।”

“মরলে আমি মরবো। তোমাকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। নিজের জীবন নিয়ে নিজে ভাবো।”
বলে মিতুল টাইম হাউজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরলো। কয়েক পা হেঁটে আবার থেমে গেল। জোহানের কাছে যা জানার ছিল তা তো জানা হয়নি ওর। মিতুল ভাবছে ওর এখন কী করা উচিত? রাগ দেখিয়ে এখনই এই ঘর ত্যাগ করা উচিত? না কি কথা গুলো জেনে তারপর যাওয়া উচিত?

মিতুল জোহানের দিকে তাকালো পিছন ফিরে। মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে। মিতুল শেষমেষ জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“আচ্ছা, ওই ছেলেগুলো কারা ছিল? কী সম্পর্ক তোমার ওদের সাথে? মারলো কেন তোমাকে?”

জোহান স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দিলো,
“ওরা আমার শত্রু।”

মিতুলের কপাল কুঁচকে গেল।
“শত্রু? আমি তো জানতাম ফেমাস লোকদের বেশি শত্রু থেকে থাকে।”

“তো আমাকে কি তোমার ফেমাস মনে হয় না? অবশ্যই আমি একজন ফেমাস ব্যক্তি। যার পিছনে হাজার হাজার মেয়ে ঘোরে, তাকে ফেমাস ছাড়া আর কী ভাববে তুমি?”

“ঠিক আছে ধরলাম তুমি ফেমাস…”

“ধরছো মানে? আমি যে ফেমাস, সে বিষয়ে তোমার সন্দেহ আছে?”

মিতুলের বলতে ইচ্ছা হলো,
“আরে ব্যাটা, তুই ফেমাস না কি ফেমাস না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ করার কোনো দরকার নেই। আমি একশ পার্সেন্ট শিওর তুই ফেমাস না।”

কিন্তু মুখে দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না, সন্দেহ নেই।”
এমন কথা বললো কারণ, ও ভালোয় ভালোয় সত্যিটা জানতে চায়। তা না হলে জোহানের এই মিথ্যা ফেমাসের গল্প এক কিক মেরে চুরমার করে দিতো।
“কিন্তু ওরা তোমার শত্রু হলো কীভাবে?”

“হিংসায়। ওদের অধিক হিংসার কারণেই ওরা আমার শত্রুতে পরিণত হয়েছে।”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“হিংসা? কী নিয়ে হিংসা করে ওরা?”

“এই যে আমি এত সুদর্শন! আমার সৌন্দর্য নিয়ে হিংসা করে ওরা। সব মেয়েরা আমার পিছন পিছন ঘোরে বলে ওদের সহ্য হয় না একেবারে। হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় ওরা। আর এই হিংসা থেকেই ওরা আমার উপর অ্যাট‍্যাক করে। যাতে ওদের মারের ফলে আমার চেহারার বারোটা বেজে যায়। আমার মুখ মন্ডল যেন কুৎসিত হয়ে যায়। কিন্তু ওরা তো জানে না, ওদের ওই ঠুনকো মারে আমার কিছুই হবে না। যে সুন্দর, সে সব সময়ই সুন্দর। আমি আমার ত্বকের প্রতি ভীষণ যত্নশীল। আমার এই যত্নশীলতার সাথে সাথে ওদের দেওয়া আঘাতের এসব দাগ সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। আর দাগ থেকে গেলেও সমস্যা নেই। আমার দিকে দেখো। কী? খারাপ লাগছে আমাকে? এখন এই মারের দাগ নিয়েও সুদর্শন নই আমি?”

মিতুল তাজ্জব বনে গেল। জোহানের মুখ থেকে এতক্ষণ কী শুনলো এসব? এসব লজিকও কি মানার মতো? মিতুল বললো,
“সত্যি সত্যিই তুমি সুদর্শন বলে ওরা হিংসা করে মেরেছে তোমাকে?”

জোহান বেশ দাপটের সাথে বললো,
“তা নয় তো কী? তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছি আমি?”

মিতুলের মেজাজটা আবার প্রচণ্ড রকমের খারাপ হয়ে গেল। কীভাবে কথা বলছে দেখো বদমাইশটা! একটা পাগলও কি এসব বিশ্বাস করবে? মিতুল কোনো কথা বাড়াতে চাইলো না। রাগটা সামলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল জোহানের ঘর থেকে। কিন্তু পা বাড়াতেই জোহান ডাকলো আবার,
“শোনো…”

মিতুল দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়াতে চায়নি। কিন্তু পা দুটো কেন যেন থেমে গেল। মিতুল গাম্ভীর্য মুখ নিয়ে পিছন ফিরে তাকালো।
জোহান হাতের মগটা উপরে উঠিয়ে ওকে দেখিয়ে বললো,
“কফি বানিয়ে খাওয়াতে বলাটা কিন্তু আমার অর্ডার ছিল না। কিন্তু এখন একটা অর্ডার দিচ্ছি তোমায়। যদি অর্ডার হিসেবে না মানো, তবে অনুরোধ হিসেবেই মেনে নিয়ো। এই মগটা ধুয়ে রেখে যাও। আর হ্যাঁ, জীবনেও আর কাউকে কোনো দিন কফি বানিয়ে খাওয়াতে যেয়ো না। ইট’স ভেরি ব্যাড!”

জোহানের অপমানিত বাক্যতে মিতুলের মস্তিষ্কের কিছু একটা ব্লাস্ট হলো যেন। মিতুল এগিয়ে এলো জোহানের কাছে। জোহানের হাত থেকে মগটা নিয়ে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলো। শান্ত অথচ ধারালো কণ্ঠে বাংলাতে বললো,
“তোমাকে মাঝে মধ্যে কী ইচ্ছা হয় আমার জানো তো? ইচ্ছা হয় আমার দাদা বাড়ির পিছনের বিশাল পুকুরের ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে মারি তোমায়!”

মিতুলের বাংলা জোহানের মাথাতে সব ধরলো না।
“দাদা বারি…পু-কুর…চু-চু…হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে?”

জোহানের কথায় মিতুল কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। হাতের মগটা তীব্র রাগের সাথে মেঝেতে ফেলে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল জোহানের টাইম হাউজ থেকে।

জোহানের মাথায় কিছুতেই ধরছে না মিতুল কীসব বলে গেল!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here